আসক্তি পর্ব ৪

আসক্তি পর্ব ৪
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

শান বরাবরই তার প্রফেশনে এক্টিভ।এক্টিভ বলতে যথেষ্ঠই এক্টিভ।কাজের ক্ষেত্রে কোন কম্প্রোমাইজ সে বরদাস্ত করে না।আজ কেইস ছিলো তিন টা।অপারেশন কম্পিলিট করে এপ্রোন টা খুলে কেবিনে চলে আসে।মাথা এলিয়ে বসে পরে চেয়ারে।বিয়ের তৃতীয় দিন চলছে তার। কোথায় আর পাঁচটা নতুন দম্পতির মতো বাড়ি বসে বসে নতুন বউয়ের সাথে সময় কাটাবে তা না তাকে তার নিত্যদিনের রুটিন মাফিক কাজ চালাতে হচ্ছে।না আছে বাড়িতে সে স্বাচ্ছন্দ্য না আছে কর্মক্ষেত্রে বিরতি।চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে শান।হঠাৎই পাখির মুখটা ভেসে ওঠে মানোষ পটে।

“কতোই না মায়াভরা তার মুখটা!কতো সুন্দরই না তার গঠন।আর কি চাই!আমার মা কখনোই ভুল ছিলেন না। সেদিনও না আজও না।কিন্তু ওর সমস্যা কি? ও কেন আমার কাছে আসা তো দূরের কথা একটু ভালো করে কথাও বলে না?আমায় কি ওর পছন্দ হয় নি? আমারই উচিত দূরত্বটা ধীরেধীরে কমানো”-ভাবতে ভাবতেই কল করে পাখির নম্বরটায়।দুলাভাই দিয়েছিলো বিয়ের আগের দিন।কল দিয়েছিলো শান ;রিসিভ হয় নি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এদিকে পাখির সারাদিন কেটে গেলো সবার সাথেই অনেক আনন্দে হাসি তামাশায়।মোটামোটি জয়েন ফ্যামিলিই বলা চলে।সবাই খুব মিশুক। এদের ফ্যামিলির মাঝে পাখির নিজেকে বড্ডো বেমানান লাগে তবুও কোথাও কারো কোন বিন্দুমাত্র সমস্যা পাখির চোখে পড়ে নি।সবাই তাকে নিজেদের মতোই আপন করে নিয়েছি।

“এখানে সবাই কতো ভালো। এতো ভালোবাসা কি আমি ডিজার্ভ করি! জানি না মা আমার কি দেখে এতো পছন্দ করলেন!”
“নতুন বউ, ও নতুন বউ!কই রে, বাইর হোস না কেন ঘরের থাকি! “আচমকা দাদিমার ডাকে সম্বিত ফিরে পাখি সাড়া দেয়।
বিছানা ছেড়ে দাড়িয়ে মুচকি হেসে দাদিকে ঘরে এনে বসায়।
-“এতো ঘরকুনো কেন তুই?বাহিরে সবাই কতো গল্প করছে আর তুই কিনা একা একা এখানে!
দাদিমার দুইহাত নিজের দুইহাতে মুঠোভরে নিয়ে মেঝেতে বসতে বসতে পাখি জবাব”এতোক্ষন তো ছিলাম গো দাদিজান”

-“কি মিষ্টি করে ডাকিস রে বুবু,কইলজা জুড়ি যায়”পাখির থুঁতনিতে হালকা স্পর্শ করে বলে দাদিমা।
-“শুনলাম আমার নাতিডারে খুব কষ্টে রাখছিস?ক্যান এমন করিস?আমারে ক তো?
দাদিমার মুখের দিক ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে পাখি কিন্তু কোন কথার জবাব দিতে পারে না।
“এই একটা কথার কেন কোন জবাব আমার কাছে নেই?সত্যিই তো কেন মানুষটাকে দূরে রেখেছি?এতো হ্যান্ডসাম একজন মানুষ তার উপর ওয়েল স্টাবলিস্ট।ব্যবহারও অনেক ভালো তাও কেন মানতে পারছি না সবটা।তার সংস্পর্শ কেন এতো খারাপ লাগে!একটা কথা জানি আমার ভালো লাগে না ওসব কিছু”

-“কি ওতো ভাবিস বলতো?
শোন আমার হীরের টুকরো নাতিটাকে কষ্ট দিস না রে বুবু।ওদের তিন ভাইয়ের মাঝে ও খুবই ভালো ছেলে। খুব নম্র ভদ্র।জানিস কতো মেয়ে ওর জন্যে পাগল?অথচ ও কাউকে কখনোই পাত্তা দেয় নি।একজন অবশ্য ছিলো…..
“দাদদাদিমা নিচে চলো, মা তোমায় ডাকছে”-টিনা(শানের কাজিন বোন)যেন কথাটা শেষ হবার সাথে সাথেই দাদিমাকে টেনে নিয়ে গেলো
-“দাদিজান শেষের কথাটা কি বললো? কে ছিলো?”দাদির শেষ কথাটা ভাবাচ্ছে পাখিকে।
“শোন নাতবউ আজ রাইতেই সবটা মিটিয়ে ফেলিস, নয়ত পরে কান্দিস না।পুরুষ মাইনসের মন বুঝলি?”-দরজায় ফিরে এসে আবারও কথাটা বলে চলে গেলো দাদিমা

রাত ১০ টার দিকে শান রুমে ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে দেখে পাখি বেলকনিতে চেয়ে বাহিরের আকাশের দিক চেয়ে আছে।
দাদিজানের বলা তখনকার কথাগুলো নিয়েই ভেবে চলছে পাখি।
“মানুষের হার্ট সার্জারিতে ১ ঘন্টারও সময় লাগে না আমার অথচ আজ ৩ দিন ধরে এই মেয়েটার মনটাই বুঝতে পারছি না”-ভাবতে ভাবতেই মৃদু স্বরে ডেকে ওঠে পাখিকে
“পাখি,পাখি”

“জ্বি বলুন”ঘরে আসতে আসতে জবাব দেয় পাখি
ডার্ক কফি কালারের শাড়িটা মেয়েটাকে বড্ডো মানিয়েছে আজ।গড়নটাই এমন যেন সব রঙ্গই তার কাছে শোভা পায়।গভীর চাহনীতে চেয়ে থাকে শান।
শানের কোন সাড়া না পেয়ে মাথা তুলে তাকায় পাখি।
চোখে চোখ পড়তেই যেন থমকে যায় পাখির দৃষ্টি।
এতো গভীর সে চাহনী, চাহনীতে কিছু একটা আছে যা পাখিকে আকৃষ্ট করছে।
শানের যেন পাগল হবার উপক্রম।ধীর কদমে একবার এগিয়ে আসতেই পাখি দৃষ্টি সরিয়ে পিছিয়ে যায়।

“তোমার ফোন কোথায় পাখি?কতো বার ফোন দিলাম রিসিভই করলে না? “-খুব শান্ত আর ইতস্তত কন্ঠে প্রশ্ন করে শান
“কোথায় যেন রাখলাম।ঐঐঐ তো ড্রেসিং টেবিলের উপর”-ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে জবাব দেয় পাখি
শান আর কিছু বলতে পারে নি।খুব ক্লান্ত লাগছে আজ।মাথাটাও ধরেছে ভীষণ।বেশিক্ষন দাড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে শানের।কিন্তু সেটা মনের কষ্টের থেকে কম।শান কথা না বাড়িয়ে খাটের একপাশে ডানহাত মাথার নিচে আর বাম হাতের পিঠ কপালে ঠেকিয়ে শুয়ে পড়ে।

“ঘুমাবে না আজ?”-পাখিকে ঠাঁয় দাড়িয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করে শান।
পাখি কোন জবাব না দিয়েই খাটের অপরপাশে প্রতিদিনকার ন্যায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ার সাথে সাথে শান পাখির পিঠের দিক মুখ করে শোয়।শানের পাশ ফেরার শব্দে চোখ মুখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নেয় সে।
অনেকক্ষন এভাবে নিশ্চুপ থাকে দুজন।ঘর জুড়ে নীরবতা যেন জেঁকে বসেছে।
শান ঘুমিয়েছে কিনা সেটা দেখার জন্যে কৌতূহলী হয়ে হালকা পাশ ফিরে শানের চোখে চোখ পড়ে যায় তার।শান তার দিকে পলকহীন চেয়ে আছে।শুকনো ঢোক গিলে দ্রুত আগের মতো শুয়ে পড়ে পাখি।

“পাখি”-বড্ডো নেশালো কন্ঠে ডাক দেয় শান।
পাখির কোন সাড়া না পেয়ে বাহুতে হাত রাখে ওর।চোখ বন্ধ করে পাখি সামিহা, দাদি আর রাখির কথাগুলো ভাবতে থাকে-“সবাই কতো করে বুঝাচ্ছে।এটা স্বাভাবিক সম্পর্ক, আমি কেন এগোতে পারছি না এতে?কেন এতো ভালো মানুষটাকে এড়িয়ে চলছি?তারও তো ইচ্ছে হয় সারাদিনের সকল ক্লান্তি আমার মাঝে বিলিয়ে দিতে।আজ আমি এগোবো।হ্যা, সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব পেরিয়ে আমায় যে এগোতেই হবে।আর কতো দিন এভাবে দূর করিয়ে রাখবো মানুষটাকে?”

“Hey Pakhi, what happend?Open your eyes damn it.”
শানের কন্ঠের উদ্বিগ্নতা শুনে শানের দিকে পাশ ফেরে পাখি।
লম্বা নিঃশ্বাস মুখ দিয়ে বের করে নিজের জায়গায় শুতে শুতে শান বলে,”Are you ok? কথা কেন বলছিলে না?ভাবলাম সেন্সলেস হয়ে গেলে।ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে ভীষন।”
“শান”
আচমকা পাখির কন্ঠে নিজের নাম শুনে শান বেশ অবাক হয়ে যায়।ভ্রু কুচকে আবার একটু ঝুঁকে আসে পাখির দিকে।
“ডাকলে!তুমি!কককিছু বলবে?ববলো? আমি শুনছি”-বার কয়েক জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে শান হকচকিয়ে বলে ওঠে

পাখি শুকনো ঢোক গিলে শানের আরেকটু কাছে চলে আসে।শানকে অবাক করে দিয়ে তার বুকে মাথা রাখে। ফর্মালিটি মেইনটেইন করতে অনেক মেয়ে কলিগদের সাথে হাগ করতে হয়েছে শানের।কিন্তু এমন টা এর আগে কখনো লাগে। মনে হচ্ছে জীবনে প্রথম কোন মেয়ের স্পর্শ তাও এতোটাই কাছে! দম যেন আটকে আসছে শানের।বুকের লাবড্যাব শব্দ বাহির থেকে শুনতে পাচ্ছে ও।হার্ট যেন লাফিয়ে বাহিরে আসতে চাচ্ছে।

“থাম ভাই হার্ট।এমন করিস না।আমি তোর ভাই শান বলছি রে, এমনে লাফাস না।নয়ত কাল তোরই অপারেশন করব “-মনে মনে নিজের হার্টকে হাজার টা গালি দিচ্ছে শান
শান ভাবতেও পারে নি পাখি তাকে এতোটা অবাক করবে।বউয়ের স্পর্শে আর নিজেকে আটকাতে পারলো না সে।দুহাতে জড়িয়ে ধরলো পাখিকে শক্ত করে।নিশ্চুপ পাখি।শান দু হাতে পাখির মুখটা তুলে পলকহীন চেয়ে থাকে।পাখির মাঝে কোন দ্বিধা খুঁজে না পেয়ে ধীরেধিরে পাখির ঠোঁটের দিকে নজর রাখে।এগিয়ে যায় সেদিকে।দুজনের মাঝে ইঞ্চি পরিমান জায়গায়ও ফাঁকা থাকে না।অজানা আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে পাখি।

অধরে অধর ছোঁয়াতেই চমকিত চোখে চেয়ে রয় সে।ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই খুব দ্রুতই শানকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়।
“ছাড়ুন।প্লিইইজজজ।ছাড়ুন আমায়”
বিছানায় উঠে বসে আর হাঁফাতে থাকে পাখি।গা গুলিয়ে বমি আসতেই দুহাতে মুখ চেপে ধরে।কিন্তু বমি আসে না।পা দুটো বিছানার পাশে ঝুলিয়ে দুহাত বিছানায় ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে টপটপ করে চোখের জল ফেলে।

এদিকে শান অবস্থার গতি বুঝতে না পেরে এক লাফে বিছানা ছেড়ে পাখির সামনে এসে দাড়ায়।পাখির দু কাধ ঝাকিয়ে বলে”পাখি কি হয়েছে বলো,এমন করছো কেন?”
পাখি শানের দুইহাত ধরে নিজের কপালে ঠিকেয়ে শব্দ করে কান্না জুড়ে দেয়।শান কিছু বুঝতে পারছে না কি বলা উচিত তার এ মূহূর্তে।
“শান, আমায় প্লিজ আর ক’টা দিন সময় দিন।আমি কিছুতেই নিজেকে প্রস্তুত করতে পারছি না।আমি আপনার লাইফের উপযুক্ত বউ নই”

“আমায় আর কিছুদিন সময় দিন আমি ঠিক সবটা স্বাভাবিক করে দিবে”-দুহাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে কান্না জড়ানো কন্ঠে বলে ওঠে পাখি।চোখের পানি যেন বাঁধ মানছে না তার।
“পাখি,আমি বরাবরই মানুষের অনূভূতি বুঝার চেষ্টা করি।হয়ত কথা তেমন বলি না তবে, খুব করে চেষ্টা করি অপর মানুষটার কষ্টটা অনুভব করতে।কিন্তু তোমার বেলা আমি ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছি।না বলছো কিছু, না বুঝাচ্ছো কিছু?কিছু একটা তো অবশ্যই আছে যা তোমাকে আমার কাছে আসতে দিচ্ছে না!কি সে পিছুটান পাখি আমায় বলো,আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করব তোমাকে তা থেকে মুক্ত করার।তুমি আমার বউ হও।তোমার ভালো মন্দ সবটাই এখন আমার দায়িত্ব ড্যাম ইট!”

“আমি কিচ্ছু জানি না শান।আমার ওসব ভালো লাগে না।আমার কিছুদিন সময় চাই “-এদিক ওদিক তাকিয়ে ফট করে উত্তর দেয় পাখি।
তাদের কথার মাঝেই শানের ফোনে কল আসে।শান দ্রুত ফোনের দিকে যায়।ঘড়িতে তখন ১ টা বেজে ০৫ মিনিট “কে ফোন করবে এতো রাতে. কোন ইমারজেন্সি! ওহহ শিট!”ভাবতে ভাবতেই দ্রুত ফোন রিসিভ করে।
ফোনের ওপাশ থেকে চাপা আর্তনাদ ছাড়া কিছুই কানে আসছে না শানের।

আসক্তি পর্ব ৩

“এতো রাতে ব্যাগ গুছাচ্ছেন যে, কোথায় যাবেন?”
শান এগিয়ে এসে জবাব দেয়, “তোমার সময় প্রয়োজন। তাই স্পেইস দিলাম।তিনদিন পর ফিরছি।এসে আর কোন স্পেইস রাখবো না আমাদের মাঝে।তুমি চাইলেও না।Take care.আর প্রবলেম নেই আমাদের গাড়িতেই যাবো। Don’t worry.”
বলেই পাখির ডান গালটা হালকা টেনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় শান।
এদিকে পাখির যেন কিছুই ভালো লাগছে না।
“কোথায় গেলেন উনি কিছু বললেনও না।সকালে কেউ জিজ্ঞেসা করলে কি বলবো আমি”
ভাবনার মাঝেই ঘুমের রাজ্যে ডুবে যায় সে।

“স্যার আপনি একটু ঘুমান, আমি স্মুদ ড্রাইভ করব।নিশ্চিন্তে ঘুমান”-শানের সারাদিনের ক্লান্তি কেউ না জানলেও ড্রাইভার বেশ ভালো করেই জানে।শান যেখানেই যাক গাড়িতে উঠেই সিটে মাথা এলিয়ে দেয়।চোখে মুখে ক্লান্তির রেশ ফুটে উঠে।তা আর ড্রাইভার রাফির চোখ এড়ায় না।
“পারবি তো,শিওর! ভেবে বলছিস?”
“একদম স্যার, ঘুমান।”

ড্রাইভারের কথায় নিশ্চিন্ত হয়ে শান চোখ বুঝে নেয়।আর একটু আগে পাখির সাথে ঘটা সব ঘটনা গুলো চোখে ভাসতে থাকে।বার বার মনে হয় কেন এমন করে ও?
“মেয়েটার স্পর্শে মাতাল করা কিছু একটা আছে।কান্না করলেও যে কাউকে এতো মিষ্টি লাগে জানা ছিলো না।”মুচকি হেসে ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে যায় শান….

আসক্তি পর্ব ৫