আসক্তি পর্ব ৮

আসক্তি পর্ব ৮
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

রাত তিন টা বেজে পাঁচ ছুঁই ছুঁই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন চারপাশ।হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় পাখির।উঠতে উঠতেই খেয়াল করে শাড়ির আঁচলে টান পরছে তার। পাশে চোখ মেলে দেখে হার্ট সার্জন সাহেব ঠান্ডায় জড়সড় হয়ে ওর শাড়ির আঁচলে নিজেকে জড়িয়ে শুয়ে আছেন।
নিষ্পাপ একটা মুখোবয়ব মুচকি হেসে ঘুমিয়ে আছে।কপালের উপর নেমে আসা অবাধ্য চুল গুলো নাকে এসে ঠেকছে।

“এতো লম্বা চুল অথচ জেল টেল মরে ঠিক করে রাখে”-ভাবতে ভাবতেই মুচকি হেসে ওঠে পাখি।তারপর আস্তে আস্তে নিজের শাড়ির আঁচল বের করে এনে পায়ের কাছের পাতলা চাদর টা গায়ে এলিয়ে দিয়ে দেয়।সাথে সাথেই সার্জন সাহেব পাশ ফিরেই শক্ত করে চাদর জড়িয়ে আবার ঘুমিয়ে পরেন।যেন এই চাদরের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এরপর গুটি গুটি পায়ে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যায় পাখি।নামাজ হতেই খেয়াল হয় অনেকদিন ধরে কোরআন টা পড়া হচ্ছে না;পড়া উচিত। যেই ভাবা সেই কাজ।ভাগ্যিস সেদিন শ্বাশুরি মা’র রুম থেকে আনিয়েছে ।সুমধুর কন্ঠের চাপা তিলাওয়াত যেন ঘরময় ছড়িয়ে যাচ্ছে নিবিরভাবে।
তিলাওয়াতের মধুর ধ্বনিতে জেগে ওঠে শান।চোখ মেলে ডান পাশে তাকাতেই চোখে পড়ে মোহনীয় এক দৃশ্য।কোন প্রকার সাড়া শব্দ না করে মনোযোগ দিয়ে সে তিলাওয়াত শুনে যায়।

“জীবনে এই প্রথম, এভাবে ঘুম থেকে জেগে ওঠা।এর চেয়ে আদর্শ জীবন আর কি’ই বা হতে পারে।ধন্যবাদ হে মালিক আমার জীবনটাকে এতো সুন্দর করে তোলার জন্যে”-ভাবতে ভাবতেই মুচকি হাসির রেশ ফুটে উঠে শানের মুখে।

“ফজরের আজান হয়েছে।তাকে কি ডাকব নাকি ডাকব না?না জানি কতো রাতে ঘুমিয়েছে!নামাজ টাও তো ফরজ কি করি?”-পাখির ভাবনার মাঝেই চোখ মেলে উঠে বসে শান।ঠোঁট এলিয়ে হেসে ওয়াশরুমে চলে যায়।ওজু করে এসে মসজিদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।পাখির অন্তরে প্রশান্তির বিশাল বিশাল ঢেউ খেলে যায়।
শান নিয়মিত নামাজি না মাঝে মাঝে পড়ে।তবে পড়ার চেষ্টা করে।আজ তার বাবা আহমদ সাহেব তাকে দেখে ভীষণ খুশি।এই প্রথম বাবা ছেলে একইসাথে ফজর নামাজ পড়ছে।

সকাল হতে হতেই শানের ডাকে সবাই ড্রয়িং রুমে এসে পরে।তার ইচ্ছে ঘরের প্রতিটি দেয়ালে পেইন্টিং হবে।আর সেটা করবে বাড়ির নতুন বউ।পাখিকে অবাক করে দিয়ে নাম বলে দেয় শান।
“উনি কি করে জানলেন আমি পেইন্ট করি?যাই হোক কেউ তো একজন জীবনে এলো যে আমার অব্যক্ত ইচ্ছে গুলোর খেয়াল রাখছে”-ভেবেই শানের দিকে খেয়াল হয় পাখির।
সবার মাঝে কৌতূহলের শেষ থাকে না যে, নতুন বউ দেওয়াল পেইন্টিং ও করে।এ যেন আরেক গুনের নাম শুনে সবাই বিষ্মিত আজ।

পেইন্টিং এর সমস্ত ব্যবস্থা করে শান মেডিকেলে পৌঁছায়।এদিকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সারাদিন ঘরের কয়েকটা দেওয়াল পেইন্ট করে পাখি।শুধু অনুমতি পায় নি সামিহার ঘরের।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা।সবাইকে নাস্তার ব্যবস্থা করে দিয়ে পাখি নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়।কিছুক্ষন পর ক্লান্ত শ্রান্ত অবস্থায় টলমলে পায়ে ঘরে ঢুকেই শান ওয়াশরুমে চলে যায়।
“পাখি আমার জন্যে এককাপ ব্ল্যাক কফি আনবে প্লিজ “-ওয়াশরুম থেকে ডেকে বলে শান।
ফ্রেশ হয়ে ফিরে এসে দেখে পাখি কফির মগটা সাইড টেবিলের উপর রাখছে।
“মাথাটা একটু মাসাজ করে দেবে, খুব ব্যথা করছে সাথে ক্লান্তও লাগছে।আজ চেম্বারে অনেক ভীর ছিলো তাই হয়ত….”

“জজ্বি দদিচ্ছি”-শানের কথার মাঝেই পাখি আমতা আমতা করে সায় দেয়।
“তোমাকে দিয়ে কাজ করানোর কোন ইনটেইনশন আমার নেই পাখি।তবে আমি জানি আমার এমন ছোট ছোট কাজে তোমার মধ্যকার জড়তা কেটে যাবে”-মনে মনে কথাগুলো আওড়ায় শান।
“কই দাও”-বলেই পাখির হাত দুটো নিজের মাথায় রেখে বিছানায় শুয়ে পরে ।

পাখির মাঝে অনেক জড়তা কাজ করছে।সে না পারছে মাসাজ বন্ধ করতে না পারছে চালিয়ে যেতে।
“এই হাতে জোড় নাই, একটু জোড়ে দিতে পারো না”-বলেই শান পাখির হাত দুটো আস্তে করে চেপে ধরে।
ঘাড় ঘুরিয়ে উঠে বসে পাখির দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকে।চাহনীর গভীরে চলে যায় শান।চোখের দিকে চেয়েই আস্তে করে পাখির হাতের পিঠ পাশে আলতো ঠোঁটের স্পর্শ দিতেই কম্পিত হয় পাখির সারা শরীর।চোখ বুজে মুখ খিচে ফেলে।

কিছুই হয় নি ভাব নিয়ে শান উঠে কফির মগ হাতে নিয়ে বেলকোনিতে চলে যায়।চুমুক ফেলেই আবেগাপ্লুত হয় সে।”কফির টেষ্ট বেশ অন্যরকম তো”ভেবেই ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটিয়ে তোলে।
“লোকটা এমন হলো কেন হঠাৎ? জোড় করে না আর আবার আমার সবকিছুর এতো খেয়াল রাখছে।স্ট্রেইঞ্জ!তবে তাকে আগের ন্যায় এতোটাও অসহ্য লাগে না “পাখি স্তম্ভের ন্যায় বিছানায় বসে ভাবতে থাকে।

সকাল হয়েছে অনেক্ষন।শান মেডিকেলের জন্যে রেডি হচ্ছে।তার মাঝেই সামিহা আর ফয়েজের ঘর থেকে চাপা চাপা আওয়াজ ভেসে আসছে।পাশাপাশি ঘর হওয়ায় কথাগুলো স্পষ্টই শোনা যাচ্ছে।
“ভাইয়ার তো এতোক্ষনে অফিসে যাওয়ার কথা,তাহলে কারা এভাবে কথা বলছে।ধস্তাধস্তির মতো লাগছে”
“ভাবি প্লিজ আমি এসব দেখি না।আমি পারবো না এসব দেখতে।দয়া করে আমায় যেতে দিন”-এটা তো পাখির কন্ঠ

“আমার কি যাওয়া উচিত নাকি নয়?এদিকে সময়ও তেমন নেই”-ভাবতে ভাবতেই সামিহার ঘরের দরজায় এসে পরে শান।সামিহা পাখিকে ফোনে কিছু একটা দেখতে বেশ জোড় জবরদস্তি করছে।শান চোখ বন্ধ রেখে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে রাগ সংবরনের চেষ্টা চালাচ্ছে।সকল দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে দ্রুত রুমে ঢুকে ফোনটা এক প্রকার কেড়ে নিয়ে স্ক্রিনে চলমান জিনিস দেখে রক্তচক্ষু নিয়ে সামিহার দিকে তাকায়।
সামিহা ভাবতেও পারে নি শান এভাবে এ ঘরে ঢুকবে।সে ভেবেছিলো শান অলরেডি মেডিকেলে পৌঁছে গেছে।এদিকে অস্বস্তিতে আর ঘৃনায় পাখির চোখ বেয়ে পানি পরছে।শানকে দেখে পাখি দৌড়ে এসে শানের আড়ালে দাড়ায়।আর নীরবে কান্না করে যায়।

“এসব কি ভাবি।হোয়াট দ্য হেল ইজ দিজ?”-দাঁত চেপে প্রশ্ন করে শান।শানের চোখে যেন আগুন ঝড়ছে।শানের রাগের মাত্রা এ বাড়ির কারোরই অজানা নয়।ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায় সামিহা।
“শশশান,ওওর মাঝে তো এসব বব্যপারে জড়তা কাজ করে তাই ভাবলাম যদি ব্যপার গুলোয় ও একটু ফ্রি হয়ে যেত তাহলে জজজড়তা টা কেটে যেত”-ভয় নিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় সামিহা বলে শানের রিঅ্যাকশনের অপেক্ষা করে।শানের মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে উত্তর তার পছন্দ হয় নি।

তাই আবার গড়গড় করে বলতে থাকে,”এসবে ওর তো একটা অসুস্থতা রয়েছে,না?তাই ভাবলাম এসবের মাধ্যমে যদি একটু নিজেকে রিকভার করতে পারে”
“এসব নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না।ইভেন কারোরই ভাবতে হবে না।আমি ওর হাজব্যান্ড আমি যদি অপেক্ষা করতে পারি তোমাদের কারোরই সমস্যা হবার কথা না।যা হবে আমি দেখে নিবো”-বলতে বলতেই শান পাখিকে একহাতে কাছে টেনে নেয়(এটাচ্ড পিকচার টার মতো) পাখিও ওর বুকের কাছে চলে যায়। এই মূহূর্তে কোন জড়তাই কাজ করছে না তার।

“শান ভুল ভাবছো আমায়।ও তো অনেক ব্যকডেটেড টাইপ মেয়ে,এসবে আনাড়ি।তাই ভাবলাম…আমি কিন্তু তোমাদের ভালোর জন্যে…”
“ব্যাস অনেক হয়েছে।আমার ভালো নিয়ে তোমাদের কারোরই ভাবার দরকার নাই, তোমারত নয়’ই।ও ব্যকডেটেডই থাকুক। তোমাদের ফ্যামিলির মেয়েদের মতো এডভান্স হবার দরকার নেই।নো নিড”-এক হাত উচিয়ে সামিহাকে থামিয়ে দেয়।
“শান!ইউ আর ক্রোসিং ইউর লিমিট।”

আসক্তি পর্ব ৭

“ইউ হ্যাভ অলরেডি ক্রোসড।ছিঃলজ্জা লাগছে আমার নিজেরই।
“নেভার ডেয়ার টু ডু দিজ উইথ হার লাইক দিজ ব্লাডি চিপ…দেন দেয়ার উইল বি নো ওয়ান ওয়ার্স দ্যান মি।মাইন্ড ইট!”-নিজের তর্জনী আঙ্গুল উচিয়ে সামিহাকে শক্ত চোখে বলে শান।
সামিহা ঢোক গিলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে
“বাই দ্য ওয়ে, তুমি কি করে জানলে ওর অসুস্থতার কথা?”
সামিহা কাচুমাচু করে কিন্তু বলার মতো কিছু পায় না।
“ওহহহ আই সি।কি করে ভুলে গেলাম আমি!হোয়াটেভার, আগেই মাথায় রাখা উচিত ছিলো আমার”-বলেই পাখিকে নিয়ে সামিহার ঘর থেকে বেরিয়ে যায় শান।

“তুমি ও ঘরে কেন? “-বিছানায় পাখিকে বসিয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে জানতে চায় শান।
গ্লাসের পানি শেষ করে ধীরেধীরে জবাব দেয়,”আমি কয়েকটা দেওয়াল পেইন্ট করেছি।ভাবি কাল করতে দেয় নি।ভাবলাম আজ আরেকবার জিজ্ঞেসা করি।তাই ঘরে গেছিলাম।আর ভাবি জোড় করেই ওসব…… ”
বলেই ঘৃনায় চোখ মুখ দুহাতে ঢেকে নেয় পাখি।

“রিল্যাক্স। আর কখনো আমার অনুমতি ছাড়া ও ঘরে যাবা না।ওকে?”
পাখিকে চুপ করে থাকতে দেখে গা ঝাকিয়ে আবার একটু জোড়ালো কন্ঠে জিজ্ঞেসা করে, “ওকে?”
পাখি চমকিত হয়ে মাথা একপাশে হেলিয়ে হ্যা সূচক জবাব দেয়।
“থাকো, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।কোন প্রবলেম হলে কল করবা নয়ত মাকে জানাবা।আসছি, টেইক কেয়ার”-বলতে বলতেই পাখির বাম গালে হালকা টেনে চলে যায় শান।

আসক্তি পর্ব ৯