আসক্তি পর্ব ৭

আসক্তি পর্ব ৭
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

বিয়ের আট দিন পর শান তার শ্বশুর বাড়ি এসেছে।পাখির মা তাকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকিত আজ।বিয়ের দিন তেমন ভাবে খেয়াল করে দেখে নি নিজের মেয়ের জামাইকে।গেইট খুলে হতভম্ব তিনি।শানের ইতস্তত লাগছিলো ব্যপার টা।কিছুক্ষন পর শান সৌজন্যমূলক হাসি ঠোঁটে এলিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে।

“ববাবা ততুমি!আজ!হঠাৎ এভাবে! সব ঠিকাছে তো! পাখি কই? “-অনেকদিন ধরে নিজের ছোট মেয়েকে না দেখে অস্থির হয়ে কথাগুলো জিজ্ঞেসা করলেন পাখির মা
“মা ..আসলে ওকে আনি নি।আমার এদিকে একটু কাজ ছিলো তাই ভাবলাম আপনাদের সাথে দেখা করেই যায়”
“ওহহহ, সমস্যা নেই বাবা।তোমার যখন ইচ্ছে তখন আসবে। তুমি ভিতরে যাও রেস্ট করো।আমি খাবারের ব্যবস্থা করছি।”
“আমার কিছু জানার আছে আন্টি পাখির ব্যপারে”-
“কি বলোতো বাবা! ”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এরপর পাখির জীবনের কিছু কথা তার মা শানকে জানিয়ে দেয়।
“ও ছোট বেলায় খুব চঞ্চল ছিলো।তাই শখ করে নাম রেখেছিলাম পাখি।আমার মেয়ের চাঞ্চলতা হারিয়ে যায়, পরে নামটার সাথে মেয়েটার মিল আর খুঁজে পাই নি”
কথার মাঝেই পাখির ভাবিও তাদের সাথে বসে

“একদিন ঈদে ও খুব সেজেছিলো।ওর চাচা চাচি রংপুর থেকে ঈদে বেড়াতে এসেছিলো।ওর চাচি ওকে দেখে বলেছিলো পাখিকে তো ভুতের মতো লাগছে।এতো সাজছো কেন?এমনিই কালো মানুষ আরো ভুত দেখা যাচ্ছে।তার একটু পরপরই ও সবকিছু ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে।সেদিনের পর থেকে কখনো সাজতে দেখিনি।এরপর নানা ভাবে মেয়েটা আমার গায়ের রং নিয়ে মানুষের কথা শুনে নিজেকে একা করে নিয়েছিলো।”

“আন্টি ও কি কখনো বড় ধরনের ভয় পেয়েছিলো?”
“একদিন আমি ওকে সাথে নিয়ে আমার ভাতিজির বিয়েতে যাই।বিয়ের পরদিন সকালেই আমার ভাতিজিটা মাত্রাতিরিক্ত ব্লিডিং হয়ে মারা যায়। ওর মৃত্যুর সময় ঘরে কেউ ছিলো না।পাখি ছিলো শুধু।তখন পাখি ক্লাস সিক্সে পড়ত।এই ঘটনায় সে টানা সাত দিন কোন কথা বলতে পারে নি।এরপর কোন ছেলে মানুষকেই সে আশেপাশে সহ্য করতে পারত না।ওর ধারনা বিয়ে হলেই মেয়েরা মরে যায়।এই ঘটনার পর ও আগের থেকে আরো ঘরকুনো হয়ে যায়।আশপাশ কারোর সাথে মিশতো না।”

শানকে কিছু একটা ভাবতে দেখে পাখির মা জানতে চায়,”কিন্তু বাবা এসব এতোদিন পর কেন জানতে চাইছো?সব ঠিকাছে আছে তো বাবা?আমার মেয়ের কিছু হয়নি তো?”
শান কিছু একটা ভেবে সবটা চেপে গিয়ে পাখির ঘরে আসে।ঘুরে ঘুরে ঘরের প্রতিটা কোণা খেয়াল করছে।
“মেয়েটা সত্যিই খুব আত্মকেন্দ্রিক। তা না হলে প্রতিটা ড্রয়ারে তালা ঝুলবে কেন!”-ভাবতে ভাবতেই শান চাবির তালাশ করে।কিছুক্ষন খুঁজে পেয়েও যায়।ড্রয়ার খুলে একটা মোটা কালো রঙ্গের ডায়রি খুঁজে পায়।বাড়ির প্রতিটা দেয়ালে খুব সুন্দর মেয়েলি হাতের পেইন্ট শানের নজর এড়ায় না।খোঁজ নিয়ে জানতে পারে পাখি ই এসব আঁকতো।

বাড়িতে আজ নতুন বউয়ের রান্না করা খাবার মুখে তুলতে চেয়েছেন শানের দাদিমা।সে অনুযায়ী খাবারের মেন্যুও তিনি দিয়েছেন।আলাদা আলাদা করে বিশ টা আইটেম তিনি দিয়েছেন।যার সবগুলোই করতে হবে পাখিকে।রান্নায় পাখির বেশ পারদর্শিতা আছে। তাই কোমড়ে আঁচল গুজে নেমে পরে রান্নায়।
শান ও বাড়ি থেকে ফিরেছে ঘন্টা খানেক হলো।এসেই রুমে ঢুকেছে আর বের হয় নি।কিছুক্ষন পর কালো কুচকুচে রঙ্গের একটা হাফহাতা টিশার্ট পরে বাইরে বের হয়।ড্রয়িং রুমে বসে সবার সাথে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে আর বার বার আড়চোখে রান্না ঘরে পাখির দিকে দেখছে।

মেয়েটা আজ ছাই কালারের একটা শাড়ি পরেছে।কোমড়ে আঁচল গোজার ফলে কোমড়ের বেশ খানিকটা অংশ বের হয়ে আছে।ঘারের উপর লম্বা চুলের ঢিলে হাতখোপা টা উসখুস করছে।কপালের উপর ঘামে লেপ্টে আছে বেবি হেয়ার গুলো।
দাদি শানকে ফলো করছে অনেক্ষন।তারপর কনুই দিয়ে গুতা দিয়ে রান্না ঘরে যেতে ইশারা করে।শান মুচকি হেসে কিছু না বলেই পাখির পিছনে গিয়ে দাড়ায়।আচমকা ঘুরতে গিয়েই শানের বুকের সাথে ধাক্কা লাগে পাখির।চোখ খুলে শানকে দেখতে পেয়েই থ হয়ে চেয়ে থাকে সেদিকে।

শাওয়ার নেয়া ভেজা চুল গুলো থেকে ছোট ছোট ফোটায় পানি পরছে।গায়ে কালো টিশার্ট। টিশার্টের বুকের কাছের দুটো খোলা বোতাম ভেদ করে লোম গুলো জানান দিচ্ছে।ফর্সা দেহে কালো রংটা যেন শানকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে।পাখির নজর সরছে না কিছুতেই।
শান পাখির সামনে তুড়ি বাজাতেই চমকে ফেরে সে।
পিছনে ফিরে রান্নায় মনোযোগ দিতে দিতে বলে”আপনি কখন এসেছেন,কোথায় গিয়েছিলেন?”

“কেন, মিস করছিলে বুঝি?”-পাখির কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে শান
শানের কথায় সারা শরীরে যেন শিহরন বয়ে গেলো পাখির।বাম কাঁধটা একটু নাড়িয়ে শানকে সরিয়ে দেয় সে।শান সরে না গিয়ে নিজের বাম হাত টা পাখির কোমড়ের কাছে আনতেই খপ করে হাতটা ধরে ফেলে পাখি।
“কি করছেন এসব ছাড়ুন!বাহিরে সবাই দেখছে।আমার ভালো লাগছে না কিন্তু”
শান ওর কথায় কান না দিয়ে কোমড়ে গোজা শাড়ির আঁচলটা টেনে খুলে দিয়ে কাঁধের উপর থেকে শাড়িটা নামিয়ে দেয়।

পাখি শুধু শানের কার্যকলাপ দেখছে।
“আমার অসুবিধা হচ্ছে আর আপনি খুলে দেলেন কেন”-বলতে বলতেই শানের দিকে ফেরে পাখি
শান কোন কথা না বলে এক হাতে পাখির কোমড় জড়িয়ে আরেক হাতে কপালের উপর লেপ্টে থাকা চুল গুলো সরিয়ে দিতে ব্যস্ত।এদিকে পাখি শুধু ছটফট করেই যাচ্ছে।
“শুধুমাত্র আমার সামনেই কোমড়,পেট,পিঠ উন্মুক্ত রাখবে।এখানে কেউ নেই তবুও ঢেকে কাজ করবে।তোমার সব দেখার অধিকার শুধুই আমার”-শেষ কথাটা বেশ মাখালো কন্ঠে অধিকার খাটিয়ে বলে শান।

পাখি নির্বাক শ্রোতা হয়ে শানের কথা শুনে যাচ্ছে।
“এ কথাগুলোয় কি যেন একটা আছে।এভাবে তো কখনো কথা বলে নি এর আগে নাকি আমিই শুনতে চাই নি”
পাখির ভাবনার মাঝেই শান ওকে ছেড়ে একটা আপেলে বাইট দিয়ে পাখির দিক এগিয়ে দেয়
“খাবে?”
“উুহুম” পাখির না সূচক শব্দে শান গুনগুন করে গান গেয়ে বাহিরে বেরিয়ে আসে।
ড্রয়িং রুমে সবাই বেশ অবাক শানকে গান গাইতে দেখে।কারণ এর আগে কখনোই সে এভাবে গান গাইত না।

একে একে সবকিছু রান্না করে পাখি ঘরে আসে।ঘরটায় ড্রিম লাইট জ্বালানো।বেশ অবাক হয় সে। তারপর কোনকিছুকে পাত্তা না দিয়ে একটা শাড়ি খাটের উপর রেখে ব্লাউজ পিটিকোর্ট নিয়ে ওয়াশরুমে দ্রুত ঢুকে পরে। ঘামের শরীর তার একদম ভালো লাগে না।গোসল সেরে নিতে পারলেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে ও।
কিছুক্ষন পর মাথায় টাওয়াল পেচাতে পেচাতে ঘরে ঢোকে পাখি।সাথে সাথেই ঘরের লাইট জ্বলে উঠলো।আচমকায় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে লাইটের দিকে।এরপর চেয়ে শানকে দেখতে পায়।অবাকের চরম সীমা পার হয় পাখির।

এদিকে পাখিকে এ অবস্থায় দেখে বুকের ঢিপঢিপ শব্দ বেড়েই চলেছে শানের।শুকনো ঢোক গিলে অপলকে চেয়ে থাকে সেদিকে।শরীর ভালো করে না মোছার ফলে কোমড়ের কাছের পানি গুলো টপটপ করে পেটিকোট ভিজিয়ে দিচ্ছে। শান এক দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে দেখছে।
শানকে ওভাবে দেখতে পেয়ে অস্বস্তিতে পরে পাখি মুখ ফিরিয়ে অপরপাশে ঘুরে দাড়ায়।
“খুব স্লো মোশনে আগাতে হবে শান।ধৈর্য হারা হলে চলবে না”নিরার কথাটা হঠাৎ মগজে গিজগিজ করতেই শান চোখ ফিরিয়ে খাটের উপর থাকা শাড়ি টা হাতে নিয়ে পাখির দিকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে।এদিকে শানের পদধ্বনির দিক আন্দাজ করতে পেরে পাখি ভয়ে চুপসে যায়।গত রাতে শানের খারাপ ব্যবহারের কথা মাথায় আসে।

শান ধীর পায়ে পাখির পিছনে দাড়িয়ে শাড়িটা এগিয়ে দেয়,”নাও,শাড়িটা পরে নাও”
পাখি অবাক হয়ে মাথা তুলে নেয়।দ্রুত হাত বাড়িয়ে শাড়িটা এক প্রকার টেনে নেয়।
“আপনি বাহিরে যান আমি শাড়ি সেট করব”
শান মুচকি হেসে বেরিয়ে আসে।

“লোকটা এতো চেঞ্জ হলো কি করে?আজ জোড় করলো না আমায়!”-ভাবতে ভাবতেই শাড়িটা সেট করে ঘরের চারিদিকে চেয়ে পাখি থামকে যায়।খাটের পাশে ভ্যাস টায় বেশ অনেক গুলো কালো গোলাপ,ড্রেসিং টেবিলের উপরের ভ্যাসে কালো গোলাপ রাখা।যেদিকেই চোখ রাখছে কালো গোলাপের সৌন্দর্যে ঘরটা ছেয়ে আছে।ঠোঁটের কোণে বিশাল হাসি এলিয়ে গোলাপ গুলো একে একে ছুঁয়ে দেখছে পাখি।অজানা ভালো লাগায় ভরে উঠলো তার তনু মন।

“কে রাখলো এসব? শান!তাছাড়া কে?মানষটা জানলো কি করে আমার কাঙ্খিত ফুল কালো গোলাপ?মানুষটার এতো চেঞ্জ!যাই হোক এ ফুলের বড্ডো শখ ছিলো আমার পূরণ হলো আজ”-ভাবতে ভাবতেই হেসে ফেলে পাখি।
দরজার আড়াল থেকে পাখির হাসি যেন শানের অন্তরকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে তুলছে।অবাক চোখে চেয়ে আছে সেদিকে।এই প্রথম পাখিকে হাসতে দেখলো শান।হাসলে পাখির চোখ গুলো ছোট ছোট হয়ে যায়।অপরূপ, অমায়িক পবিত্র একটা হাসি।

“উহু উহু”-হালকা গলা ঝেড়ে শান রুমে ঢোকে
পাখি চোখ মেলে সেদিকে চায়।একরাশ প্রশান্তি নিয়ে চেয়ে থাকে শানের দিকে।
“পছন্দ হয়েছে?”
“হুমমম,অনননেক”-মাথা নাড়িয়ে বলে পাখি।
পাখির হাতটা ধরতে গিয়েও না ধরে শান বিছানায় বসে পরে।
ইশারায় পাখিকেও বসতে বলে।দু হাত দূরে পাখি গুটিসুটি মেরে বসে
“আমায় ভয় পাও পাখি?”
…..(পাখি নিশ্চুপ)
“আচ্ছা পাখি আমরা কি বন্ধু হতে পারি?”
পাখি মাথা তুলে তাকিয়ে মুচকি হেসে মাথা নিচু করে নেয়।

রাতে ডিনার টেবিলে পাখির প্রশংসায় সকলেই পঞ্চমুখ।শ্বশুর খুশি হয়ে পাঁচ হাজার টাকা গুঁজে দিয়েছেন পাখির হাতে।সবাই রান্নার প্রশংসা করছে। শর্মিলা বেগম নিজের সিদ্ধান্তে যথেষ্ঠ গর্ববোধ তার চোখে মুখে উপচে পড়ছে।সামিহা ভিতর ভিতর জ্বলছে বাহিরে তার কিছুটা প্রকাশ পাচ্ছে।
“পাখি তোমার রান্নার হাত তো….”কথাটা বলতে গিয়েও সামিহার দিকে চেয়ে আটকে গেলো শানের ভাইয়া ফয়েজ।

আসক্তি পর্ব ৬

“বহুদিন এমন পর পেট ভর শান্তির ঢেকুর তুললাম নাতবউ।অনেক সুখী হ”
“ভাবি অনেক অনেক মজা হয়েছে। জাস্ট ফাটিয়ে দিয়েছো”-টিনা আর রনি একসাথেই চিল্লিয়ে ওঠে।
শুধু কথা বলছে না শান।মাথা নিচু করে খেয়েই চলেছে আর মুচকি হাসছে।
রুমে এসে পাখি আরেকবার নিজের রুমটায় চোখ বুলিয়ে খাটের একপাশে গিয়ে শুয়ে পরে।শান কিছু মেডিকেল ফাইল চেইক করে খাটের অপরপাশে মাথার নিচে একহাত রেখে শোয়।

“কেন আমি পাখির জন্যে এতো করছি?কেন ট্রিটমেন্টে আগাচ্ছি?অন্য কাউকে বিয়ে করলে তো আমার লাইফটা এমন হতো না। কেন তবে এই লাইফটাকে বেছে নিলাম?কেন ছেড়ে দিচ্ছি না?শুধু কি মায়ের সিদ্ধন্তকে সম্মান নাকি অন্যকিছু”-শানের ভাবনার মাঝেই পাখি এপাশ ফিরে বেঘোরে ঘুমায়।
শান এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে পাখির দিকে।

“কি আছে ওর মাঝে?কেন অপেক্ষা করছি ওর জন্যে?”
“এতো মায়ময় মুখটা!”তাহলে কি ওর মায়ায় আটকে গেলাম!রান্নায় তো সবার মন জয় করে নিলে আমায় কবে জয় করবে বলোতো?”
ভাবতে ভাবতেই সাবধানতার সাথে এগিয়ে এসে আলতো করে চুমু দেয় পাখির কপালে।পাশ ফেরায় আঁচল সরে যায় পাখির।শান এক পলক সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আঁচল উঠিয়ে নিজের জায়গায় আসে।পাখি আরেকটু নড়েচড়ে গালের নিচে এক হাত দিয়ে আবারও ঘুমিয়ে পরে।

আসক্তি পর্ব ৮