আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৩১

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৩১
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

সকাল থেকে মুখ গোমড়া করে সোফায় বসে আছে ইনায়াহ্।কারোর সাথে কোন কথা বলে নি।তার অভিযোগ কাল কেন মুন সাইন তার পাশে ঘুমায় নি?কেন তাকে মিথ্যে বলা হলো?
ইনায়াহ্’কে ঘিরে রাখে পাখি,রাহেলা আর শান।সবাই এটা সেটা দিয়ে বুঝাচ্ছে কিন্তু কোন কাজই হচ্ছে না।
“সরি বেবি,আর কখনো হবে না এমন। প্লিজ রাগ করো না”,কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে কথাটা বলে পাখি।শান শান্ত চাহনীতে একবার পাখির দিকে তাকায়।কটমটে ও চোখের অভিযোগে চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হয় শান।

“আজ আমরা ঘুরতে যাবো মাম।তোমার ফেভারিট জায়গায়।যাবে আমার সাথে?”,চোখে মুখে একরাশ ইতিবাচক উত্তরের অপেক্ষায় প্রস্তাব রাখে শান।তবুও ইনায়াহ্ কথা বলে না।চোখের কোণে জল থৈথৈ। যেন পলক পড়লেই টুপ করে গন্ড ভেজাবে।পাখি বেশ বুঝতে পেরেছে ইনায়াহ্ ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে ভিতর ভিতর।রাগ দেখিয়ে শানকে সামন থেকে সরিয়ে দেয়।ইনায়াহ্’র পায়ের কাছে বসে মাথাটা কোলে এলিয়ে দেয়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,”তুমি যদি কথা না বলো আমি কেঁদে দেবো।বাড়ি চলে যাবো”
ইনায়াহ্ আর রাগকে সচল রাখতে পারে না।পাখির মাথায় একটা চুমু দিয়ে বলে,”কথা দাও আর কখনো আমায় ছাড়া থাকবে না?”
পাখি শানের দিকে একবার তাকিয়ে ইনায়াহ্’কে আশ্বস্ত করে, “আর কখনো তোমায় ছেড়ে থাকব না।প্রমিজ ”
ইনায়াহ্ খুশিতে গলা জড়িয়ে ধরে।

এতোক্ষন পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেন রাহেলা।ব্যপার টা মোটেও তার কাছে সুবিধের মনে হচ্ছে না।এমন চললে তো শান পাখির মাঝে দূরত্বের তৈরী হবে আর যেটা তাদের অাগত ভবিষ্যতের উপর প্রভাব ফেলবে।তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন যেভাবেই হোক ইনায়াহ্’কে তিনি বোঝাবেন।
পাখি রাহেলা মিলে সকলের জন্যে সকালের খাবারের ব্যবস্থা করে।সকালের ঐ ঘটনার পর থেকে আর চোখে পড়েনি শান।বাকি টুকটাক কাজ রাহেলাকে বুঝিয়ে ঘরে এসে শানকে খোঁজে পাখি;কোথাও নেই।হঠাৎই দরজা লাগানোর শব্দে চমকে পিছনে ফেরে পাখি।

“কি হলো দরজা কেন লাগালেন?”,অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
শান্ত ভঙ্গিতে পাখির দিকে চেয়ে শান জবাব দেয়,”সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি?”
“বলেছি?”
“তবুও ”
“পথ ছাড়ুন, নিচে চলুন। খাবেন।”
“খাবো তো”

শানের কথার মাঝে দুষ্টুমির রেশ।মাথা তুলে তাকিয়ে পাখি লাজুক স্বরে বলে,”আপনি খুব দুষ্টু। সরুন”
পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই ডান হাতটা টেনে একদম নিজের কাছে নিয়ে আসে শান।পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।ঘর্মাক্ত ঘাড়ে মুখ গুঁজে দেয় গভীরভাবে।প্রতিটা স্পর্শই অন্য অনুভূতির জানান দিচ্ছে।শানকে সরিয়ে দিতেই স্পর্শের গভীরত্ব আরো বেড়ে যায়।কাঁধের উপর লম্বা চুলের ঢিলে খোপাটা খুলে দেয় শান।ঘনঘন শ্বাসে ঘ্রান নেয় সে চুলের।অন্যরকম মাদকতার ছোঁয়ায় পাগল প্রায় শানের তনু মন।
হাতের বাঁধন হালকা হতেই পাখি সরে আসে।

“কি পাগল রে বাবা!”,অবাক হয়ে বলে পাখি।শান আবার হাতটা টেনে আনে নিজের কাছে।ঘোরলাগা সে দৃষ্টি উপেক্ষা করতে পারে না পাখি।গালের কাছে হাতের আলতো স্পর্শ দিয়ে শান বলে,”সত্যি কি মাম্মামের সাথে থাকবা?”
চকিতে মাথা তুলে পাখি শানের চোখের দিকে তাকায়। কেমন যেন অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে ও চোখ মুখে।
“কি করব?ও তো মানবে না!”,জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে পাখি।

“জানি না।”
গম্ভীরভাবে পাখি অস্ফুট স্বরে বলে,”রাত হোক, দেখা যাবে। এখন ছাড়ুন। অনেক কাজ পরে আছে আমার”
“খুব পালাই পালাই করছো না?”,অভিমানের সুর শানের কন্ঠে।
একগাল হেসে পাখি জবাব দেয়,”কাজ আছে বললাম না”
“ওকে”,বলেই পাখিকে ছেড়ে দেয় শান।

সেই সকাল বেলা শান বেরিয়ে গেছে। আর ফেরে নি।দুপুরে খেতেও আসে নি।ফোনও ধরছে না।ভীষণ দূঃচিন্তা হচ্ছে পাখির।নিজে থেকেই ফোন দেয়।রিং হচ্ছে অথচ ধরছে না।এভাবে কয়েকবার চলার পর ব্যর্থ হয়ে পাখি থম মেরে বসে থাকে।এদিকে ইনায়াহ্ও সকাল থেকে আর কাছ ছাড়া করছে না পাখিকে।পাখি যেখানে যেখানে যাচ্ছে সেও পিছু পিছু যাচ্ছে। যেটা দেখে বেশ হাসি পায় পাখির।
ইনায়াহ্’কে সোফায় বসিয়ে বলে,”বিকেল তো হয়ে এলো, নাস্তা করতে হবে না?”
“হুমমম।ক্ষিদে লেগেছে মুন সাইন”

“তাহলে এখানে বসো আমি কিছু করে নিয়ে আসি।”,বলেই দরজার দিকে একবার তাকায় পাখি।এই বুঝি শান চলে এলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রান্না ঘরের দিকে চলে যায়।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয় তবু শানের দেখা মেলে না।আনমনে ভাবতে থাকে,”এতো সামান্য ব্যপার নিয়ে এতো রাগ কে করে রে ভাই!তখন কাজ ছিলো বলেই তো…..”

পাখির ভাবনার মাঝেই শান চলে আসে। ইনায়াহ্’র ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত ইনায়াহ্’কে একবার ভালো করে দেখে কপালে চুমু এঁকে চলে যায়।পাখি হা করে শুধু চেয়ে থাকে।এমন একটা ভাব করে যেন পাশে আর কেউই ছিলো না।পাখি গজ গজ করে শানের পিছু পিছু ওর ঘরে চলে যায়।
“সারাদিন কোথায় ছিলেন?”,রাগি কন্ঠে প্রশ্ন করে পাখি।
শান কোন জবাব না দিয়ে শার্টের বোতাম খোলা শুরু করে।পাখি বুঝতে পারে রেগে বোম হয়ে আছে শান।দ্রুত এগিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।হাত সরিয়ে বোতাম খুলতে খুলতে বলে,”এতো রাগ কিসের, শুনি তো?”

শান অপলক চোখে পাখির দিকে চেয়ে ভাবে,”তোমার উপর কেন রাগ করে থাকা যায় না বলোতো!”
“কি হলো কিছু বলছেন না যে”
একহাতে পাখির কোমড় জড়িয়ে ধরে শান।গম্ভীর গলায় জবাব দেয়,”রাগ করলেই বা কি”
“বাব্বাহ,এতো অভিমান!তখন তো ব্যস্তই ছিলাম”

“আর এখন! “,বলতে বলতেই মুখটা এগিয়ে আনে পাখির কাছে।
“ইনায়াহ্”,বলতেই শান চট করে ছেড়ে দেয় পাখিকে।দরজার দিকে নজর ফেলে বুঝতে পারে কেউ নেই সেখানে।আর সেই সুযোগে পাখি হাসতে হাসতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
শান সেদিকে চেয়ে মুচকি হেসে ভাবে,”জীবনে অনেকটা পথ একসাথে হাঁটা বাকি।তাই কি বার বার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি?তোমায় আমি অনেক ভালো রাখবো পাখি”

গভীর রাত। চারদিক শুনশান। রাস্তার ধারের দুএকটা দোকান খোলা থাকলেও তাতে তেমন জাঁকজমকতা নেই।ঘুমন্ত শানের শরীর ঘামে ভিজে একাকার।মুখে শুধু অস্পষ্ট গোঙ্গানির শব্দ।ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে হফাতে থাকে।সাইডে রাখা পট খুলে পানি খেয়ে নেয়। যেন কতোকালের তৃষ্ণার্ত সে।বুকে হাত চেপে খানিক পূর্বে দেখা দূঃস্বপ্নের কথা ভাবতে থাকে।
“এটা কী করে সম্ভব?এরকম কিছু……”

ভাবতেই কেমন যেন ছটফট করে বুকের ভেতর।দরজা খুলে বাহিরে আসে শান।পাখিদের ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকে।কেমন নিষ্পাপ লাগছে পাখির মুখটা।ধীর পায়ে এগিয়ে যায় পাখির দিকে।সন্তর্পনে শুয়ে পরে পাশের ফাঁকা ছোট্ট জায়গায়।
দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পাখিকে।কাঁধে মুখ গুঁজে জড়িয়ে আসা কন্ঠে বলে,”আমি তোমায় ছেড়ে থাকতে পারব না।দেখা স্বপ্নটা যেন স্বপ্নই হয় পাখি”

ঘুম ভেঙ্গে যায় পাখির।পেটের দিকে তাকিয়ে দেখে দুটো হাত বেঁধে রেখেছে তাকে।কাঁধের উপর কারো অস্পষ্ট আকুতি।সাথে গরম নিঃশ্বাস।পাখির বুঝতে অসুবিধা হয় না মানুষটা কে হতে পারে!শানের হাতের উপর দুহাত চেপে চাপাস্বরে ভয়ার্ত গলায় বলে,”কি হয়েছে আপনার? ”
পাখির ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় উঠে বসে শান।পাখিও বসে সাথে সাথে।মুখোমুখি বসে শানের গালে হাত রেখে বলে,”কি হয়েছে?এতো ঘেমেছেন কেন? বলুন না প্লিজ”

শান স্থীর দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে পাখির দিকে।
হুট করে পাখিকে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমার কেন যেন মনে হয় আমি কোন ভুলে ডুবে আছি।এই স্বপ্নটা ইতোপূর্বে বহুবার দেখেছি। আজকের মতো ভয়ানক ছিলো না পাখি। আমায় একা করে যেও না।আমি আর

বলতে বলতে কেঁপে ওঠে শানের গলা।পাখি বেশ বুঝতে পেরেছে শান কোন দূঃস্বপ্ন দেখেছে।মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলে,”এরকম কখনো মনে করবেন না।আমি কখনোই আপনাকে ছেড়ে যাবো না”
শানের কপালে গাঢ় চুম্বন এঁকে বলে,”আমার কিছু বলার ছিলো ডাক্তার সাহেব”
শান নিজেকে ধাতস্ত করে বলে,”কি ?”
“আমার কেন যেন মনে হয় আপনার জানার মাঝে কিছু ভুল আছে।আপনার মা কে আমার কখনোই খারাপ মানুষ বলে মনে হয় না”

চট করে পাখিকে ছেড়ে দেয় শান।বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।ট্রাউজারের পকেটে হাত রেখে বিপরীত মুখী হয়ে জবাব দেয়,”উনি কখনোই ভালো মানুষ ছিলেন না আর না এখন আছেন।উনি মুখোশ পরিহীতা ভদ্র রমনী”
পাখি আর কিছু না বলে শানকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।পিঠে মুখ গুঁজে বলে, “আচ্ছা ঠিকাছে বাদ দিন এসব।এবার কি এখানে ঘুমাবেন নাকি ঘরে যাবেন?”
শান বুকে রাখা পাখির হাত দুটো টেনে হাতের পিঠে চুমু দিয়ে বলে,”নিজের ভালো থাকার পূর্বে ইনায়াহ্’র ভালো থাকাটা আমার কাছে বেশি ইম্পোর্ট্যান্ট পাখি।ও আমার পৃথিবী।”

শানের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে রাফি।গত কতোগুলো দিন সে গ্রামে কাটিয়েছে।ছুটি নিয়েছে মাত্র তিন দিনের। অথচ তিনদিন কবেই পেরিয়ে গেছে।শান আগা-গোড়া ভালো করে পরোখ করে বলে,”তা এতোদিন কি করলি গ্রামে?”
“ভাইয়া, মা অসুস্থ্য হয়ে গেছিলো।”,রিনরিনে কন্ঠে জবাব দেয় রাফি।
মায়ের কথা শুনতেই শানের চোখমুখে থমথমে ভাব চলে আসে। অন্যমনস্ক হয়ে প্রশ্ন করে, “মা কে খুব ভালোবাসিস?”

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৩০

“হ্যা ভাইয়া।খুব ভালোবাসি।মায়েরা খুব ভালো হয় বলেই তো ভালো না বেসে থাকা যায় না “,বলেই শানের মুখের দিকে তাকায় রাফি।
পাখি রান্না ঘরে কাজ করছে তবুও কোথাও যেন মনোযোগ টা শান আর রাফির কথার মাঝে রয়ে যায়।
রাফির কথায় শান ওর দিকে তাকায়।মনে পড়ে যায় নিজের মায়ের সাথে কাটানো সুখের মূহূর্তগুলো।
“যা, নাস্তা করে রেডি হয়ে আয়।হসপিটালে যাবো।”,স্বাভাবিক স্বরে বলে শান।
রাফি চলে যেতেই আবার বলে,”শোন, তোর ভাবিকে বল নাস্তা দিতে”
শানের কথায় রাফি বড় বড় চোখে তাকায়।বিড়বিড় করে বলে,”ভাবি!”

“হুমমম, তোকে কতোবার ফোন করেছিলাম।উঠাইছিস?”
“কোন ভাবি, ভাইয়া? ”
“পাখি”
খুশিতে ঝলমলিয়ে ওঠে রাফির চোখমুখ।সে যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না।
এতোক্ষন শানের কথা শুনে পাখি বুঝতে পারে মনের কোথাও না কোথাও এখনো মায়ের জন্যে শানের মনে অনুভূতি জীবন্ত।অনেক ভাবনার মাঝেই রাহেলা রান্না ঘরে ঢোকে।
“বউ মা, রান্না শেষ?”

“হ্যা চাচি,শেষ”,হাস্যোজ্বল মুখে বলে পাখি। নিজের কথা শেষ করে আবারও কাজে মনোযোগ দেয়।হঠাৎ কাজ থামিয়ে বলে,”চাচি আজ আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে।যেহেতু এখন আমি এ বাড়ির বউ। এটুকু অধিকার তো আমার আছে, তাই না?”
পাখির কথায় থমকে যায় রাহেলা।সে বেশ বুঝতে পারে পাখি এখন কি জানতে চাইবে।পাখির দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে,”আমি জানি মা, তুমি কি জানতে চাও”
“প্লিজ চাচি, না করবেন না।আমার জানাটা খুব জরুরী।আমি আর উনাকে কষ্ট পেতে দেখতে পারব না চাচি।উনি ভীষণ ভয়ে থাকেন এই একটা কারণে”

ইনায়াহ্’কে রেডি করিয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হয় পাখি।তার মন খুব চঞ্চল আজ।শুধু সময় গুনছে কতোক্ষনে স্কুলে যাবে, স্কুল ছুটি হবে আর কতোক্ষনে কাঙ্খিত মানুষটার সাথে দেখা হবে।সবটাই যেন সময়ের উপরই আজ নির্ভর করছে। আর সময় টাই যেন কাটতে চাইছে না।

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৩২