আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৩৪

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৩৪
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

ড্রয়িংরুমে পিনপতন নীরবতা।কিছুক্ষন পূর্বেও কতো মুখোরিত ছিলো চারিপাশ।তারপর কান্নার শব্দ আর খানিক পর সবটা শান্ত।কেউ কোন কথা বলছে না, কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞেসাও করছে না।শুধু কানে ভাসছে বাহিরের জনজীবনের শাব্দিক রূপ।শর্মিলা সোফার হাতলে ডান কনুই ঠিকেয়ে কপালে হাত দিয়ে মেঝের দিকে চেয়ে আছে।যেন কতো বছরের দায়িত্ব তার মাথা থেকে নেমে গেলো

শান একটু ঝুঁকে দুহাতে ঘাড়টা চেপে মাথাটা জড়িয়ে দুই হাঁটুর দিকে নিয়ে বসে আছে।
পাখি সবদিকটা দেখে রাহেলাকে ইশারা করলেন।রাহেলা উঠে একগ্লাস পানি এনে শর্মিলার সামনে ধরলেন।শান্তস্বরে ডাকলেন,”ম্যাডাম”
শর্মিলা চকিতে কপাল থেকে হাত সরিয়ে রাহেলার দিকে তাকালেন।হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিয়ে সবটুকু পানিই নিমিশেই শেষ করলেন।দেখে যে কেউই বুঝতে পারবে এই পানির জন্যেই তিনি অপেক্ষা করছিলেন এতোক্ষন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পাখি শানের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে এতো বড় ধাক্কাটা তিনি কিভাবে নেবেন।আজ তার শানকে বড্ডো চূর্ণ মনে হচ্ছে। কেমন যেন কলিজা ফেটে যাচ্ছে শানকে দেখে।শানের দিকে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ শান নড়ে ওঠে।আস্তে করে মাথাটা তুলে সামনে তাকায়।সেদিকে তাকিয়ে বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে পাখির।চোখদুটো রক্তবর্ণ ধারন করেছে,চোখের পাপড়ি গুলো ভারী লাগছে যেন কতো শত বছরের ক্লান্ত পথিক সে।চোখের নিচে ফুলে উঠেছে।সেদিকে করূন চোখে তাকায় পাখি। কান্না সংবরন করা দায় যে তার!

শান পুরোপুরিভাবে মাথাটা তুলে কয়েকবার মাথাটা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে স্বাভাবিক করে নেয়।এরপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পাখির দিকে তাকায়।টুপ করে দুফোটা জল গড়িয়ে পরে পাখির গাল বেয়ে।শান পরপর কয়েকবার নাকে ছিচকে শব্দ করে উঠে দাঁড়ায়।পাখিও পরপর কতোগুলো শুকনো ঢোক গিলে উঠে দাঁড়ায়।রাহেলা বসে আছে শর্মিলার পাশে।শান খুব ধীরে এমন ভাবে পা ফেলে পাখির দিকে আসছে যেন সারা রাস্তায় কাঁটা বিছানো,এদিক সেদিক হলেই কাঁটা ফুটবে পায়ে।পাখি হাত কচলাতে কচলাতে শানের দিকে পা বারায়।পাখির সামনে এসে দাঁড়ায় শান।দুহাতে চোখের পানি মুছিয়ে দেয় পাখির।আবার চোখ থেকে খসে পরে কয়েকফোটা অশ্রু।এরপর নিজের দুহাত রাখে পাখির দুই গালে।অপলক কিছুক্ষন চেয়ে থাকে।পাখি শুধু শানের চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছে।শান কি করতে চলেছে সেটাই বুঝতে চাইছে সে।

“আমরা অনেক দূরে চলে যাবো।এই তিনকুলে তোমারও কেউ নাই।আমারও কেউ নাই।আমরা দুজনে মিলে অনেক সুখের সংসার শুরু করব। যাবে আমার সাথে?আমি যেখানেই নিয়ে যাই!”,খুব শান্তভাবে কথাগুলো বলছে শান।তবুও পাখির বড্ডো ভয় করছে।ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছে সে।গালে রাখা শানের হাতদুটো দু’হাতে ধরে নেয় পাখি।ছলছলে চোখে কিছু বলতে যাবে তার আগে শান বলে,”এই পৃথিবীটা খুব নিষ্ঠুর পাখি।মিথ্যের কাঁটায় পরিপূর্ণ।আমি চাইনা তুমি এখানে থেকে মিথ্যে শিখো।তুমি তো সত্য। তুমি তো আমার জীবনের চিরন্তন ধ্রুবতারা।”

শর্মিলা আর রাহেলা অবাক হয়ে দেখছে শান কি করতে চলছে।
“আমার জীবন টা কেন এমন হলো বলো তো?”,বলেই শান চোখ মুখ খিঁচে নেয়।কয়েকবার কান্না সংবরনের বৃথা চেষ্টা করে শান।তাতে খুব একটা লাভ হয় না।কান্নারা যেন আজ উগড়ে আসতে চাচ্ছে।বার বার জোড় করে ভিতরে পাঠাচ্ছে শান।কারণ সে চায় না পাখির সামনে কেঁদে ফেলুক।মেয়েটা বড্ডো কষ্ট পাবে।শানের ওরকম অবস্থা দেখে নিজেকে আটকাতে পারে না পাখি। ঠোঁট টিপে চোখের পানি ছেড়ে দেয় করূনভাবে।

শান আবার মুছে দিয়ে বলে,”পাগলি, কষ্ট তো আমার হচ্ছে তুমি কেন কাঁদছো?জান আমার কলিজাটা পুরে যাচ্ছে জান।কলিজাটা পুরে যাচ্ছে আমার।”
শেষের কথাটা বেশ চিৎকার করে বলে শান।আব্দুল্লাহ্ এতোক্ষন বাড়ির বাহিরে ইনায়াহ্’কে খেলার ছলে আগলে রেখেছিলো।শানের চিৎকারে দৌঁড়ে ভিতরে আসতে বাধ্য হয় সে।এসেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
শান দুচোখ বন্ধ করে কয়েক ফোটা জল ছেড়ে দেয়।কাঁপা কাঁপা হাতে পাখি সেটা মুছিয়ে দেয়।

“আআপনি শাশান্ত হহোন প্লিজ”,কান্না জড়িয়ে আসা কন্ঠে বলে পাখি।
হঠাৎ শান সবাইকে অবাক করে দিয়ে পাখিকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।
“আমার জীবন এতো মিথ্যেয় ঘেরা কেন পাখি?আমার জন্ম টা কেন হলো পাখি?আমার নিজের বাবা কেন আমায় মানলেন না?কেন বিগত ষোলটা বছর আমার অনুভূতি গুলো ডুকরে উঠলো?কেন বাবা নামোক পিশাচ লোকটা আমায় মিথ্যে বললো?কেন আমার মা আরো আগে সত্যিগুলো জানাল না?কেন এতো ভালোবাসার পরেও সে অভিনয় করলো?

জান আমার এতো কেন’র উত্তর আমি কোথায় পাবো?”
বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে শান।এভাবে কখনোই কেউ শানকে কাঁদতে দেখেনি।রাহেলা মুখে আঁচল চেপে কাঁদছে।আব্দুল্লাহ্ এগিয়ে আসতে শর্মিলা হাত উচিয়ে তাকে আটকে দেয়।শানের করা প্রতিটা কেন’র উত্তর তার কাছে জানা।তবুও ছেলের চোখের একেক ফোটা পানি যেন বিষাক্ত তীরের মতো বিঁধছে তাকে।
শানের কান্নায় পাখিও হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে।শানকে শান্তনা দেবার মতো কোন ভাষা তার জানা নেই।শুধু এটুকু বুঝেছে এই মানুষটাকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখা তার কর্তব্য। তার উপর অর্পিত ফরজ দায়িত্ব।শানের পিঠে আলতো করে হাত বুলাতে শর্মিলা বাজখাঁই কন্ঠে বলে ওঠেন,”বউ মা কাঁদতে দাও ওকে।এতোদিনের জমানো কষ্ট গুলো উগড়াতে দাও।থামিয়ে দিও না”

শানের কান্নার শব্দে মুখোরিত চারিপাশ।দেয়ালের প্রতিটা ইট যেন ডুকরে ডুকরে কাঁদছে আজ।এ কোন নতুন সত্যের মুখোমুখি সে?যে সত্যকে সামনে আসতে ষোলটা বছর খোয়াতে হলো?এমন সত্য মিথ্যের আড়ালে চাপা থাকাই বোধহয় ভালো ছিলো।

পাখির কাঁধ ভিজে গেছে শানের চোখের মুখের পানিতে।সেদিকে একটুও খেয়াল নেই কারোরই।পাখির বুকের ভিতরে হওয়া চিনচিনে ব্যথাটা এবার প্রবল আকাড় ধারন করলো।মনে হচ্ছে যেন শানের কান্নাগুলো বিশাল বড় হাতুড়ির মতো পেটাচ্ছে তার বুকে।নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে পাখির।নিজেকে ধাতস্থ করে শানের কানের কাছে মুখটা এনে বলে,”এভাবে কাঁদবেন না ডাক্তার সাহেব, আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে”
পাখির কথায় যেন কান্নার বেগ আরো বেড়ে যায় শানের।কিছুক্ষন পরে চট করে পাখিকে ছেড়ে দেয় শান।অবাক হয় পাখি।দৌঁড়ে চলে যায় শান উপরতলার দিকে। ভয়ার্ত চোখে পাখি পিছন পিছন গেলে শর্মিলা কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলেন,”ভয় পেও না বউ মা।আমার ছেলে তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে।আর যারা ভালোবাসতে জানে তারা কখনো আত্মহনন করতে পারে না”

শর্মিলার কথা শেষ হতে না হতেই শান একটা প্যাকেটে করে কিছু নিয়ে আসে।প্যাকেট টা হাতে নিয়ে খুব ধীরপায়ে শর্মিলার পায়ের কাছে এসে মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে পরে।সবাই অবাক হয়ে চেয়ে দেখছে শানের কর্মকান্ড। ইনায়াহ্ আব্দুল্লাহর কোলে ঠোঁট টিপে কেঁদে চলেছে নিঃশব্দে।
কাঁপা কাঁপা হাতে প্যাকেট থেকে একটা স্বর্ণের চিকোন চুড়ি বের করে সামনে ধরে শান।

“এএটার ককথা মনে আছে আপনার?”
শর্মিলা মরিয়া হয়ে চুড়িটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে।চকচক করে ওঠে চোখদুটো।চোখে এক সমুদ্র অশ্রু নিয়ে মাথা উপর নিচ করে বলে,”হ্যাএএ”
“বাবা আমার হাত খরচের যে টাকা দিতো সেটা থেকে বাঁচিয়ে আপনার জন্যে রতন কাকার দোকান থেকে গড়িয়ে দিয়েছিলাম।অবশ্য কিছুদিন পর জানতে পারি জোড়ার একটা নাকি হারিয়ে ফেলেছেন”

তৎক্ষনাৎ শর্মিলা নিজের হাত দুটো শাড়ির আঁচল থেকে উন্মুক্ত করে শানকে দেখায়।বাঁ হাতে একটা চুড়ি ঠিক সেরকমই যেরকম শানের হাতে।মুচকি হেসে শান বলে,”হারিয়ে যাওয়ার পর শত খুঁজেও পান নি।আর আপনার চলে যাওয়ার পর আমরা যখন ঢাকা আসব তখন ব্যাগ গুছানোর সময় এটা পাই। এতোগুলো দিন এটা আমার কাছে ছিলো”

শর্মিলা ঠোঁট টিপে কান্না সামলিয়ে বলে,”আর আমি এই একটা চুড়িতে ষোলটা বছর কাটিয়ে এলাম বাপ”
শান চোখের কোণা দুটো দুই আঙ্গুলে চেপে নাকে ছিচকে শব্দ করে আবার লাল প্যাকেটটার ভিতরে হাত রাখে।হাতে করে নিয়ে আসে একটা কাঁজলের কৌটা।হাতের তালুতে নিয়ে শান শর্মিলার সামনে ধরে।
“রোজ রোজ আপনার চোখে কাঁজল দেখতাম।জানি না কেন কাঁজল পরতেন মোটা করে।তাই আপনার চলে আসার দিন রহিম কাকার দোকান থেকে এই কৌটাটা কিনে নিয়েছিলাম।বাড়ি এসে জানকে পারি আপনি নেই”

সে সময় কৌটার কাঁজল মানে অনেক বেশি কিছু।
শর্মিলা গন্ডো বেয়ে নেমে আসা চোখের ধারাটা দুহাতের তালুতে মুছে বলেন,”রোজ রাতে কাঁদতাম।রাজ জেগে থাকতাম। তোমার বাবা নেশা করে এসে একটু চুন থেকে পান খসলেই সারারাত আমায় দিয়ে বডি ম্যাসাজ করে নিতো,অন্ধকার রাতে উঠানে দাঁড় করিয়ে রাখত রাতে ঘুমাতে পারতাম না, দিনেও সেটার উসুল হতো না;তোমাদের যত্ন নিতে,সংসারের ঘানি টানতে। চোখের নিচে মোটা কালি পরেছিলো। তাই কাঁজলের আবরনে ঢেকে চলতাম”

শান একধ্যানে চেয়ে কথাগুলো শুনছিলো।কথা শেষে প্যাকেটটায় আবার হাত দেয়। এবার একটা পুরোনো দিনের খসখসে সুতি শাড়ি বের করে আনে।
পাখি ভ্রুকুচকে চেয়ে থাকে শাড়িটার দিকে।চেনা চেনা মনে হচ্ছে তার।
শাড়িটা শর্মিলার সামনে ধরে বলে,”আপনার কাপড়ের মাঝে এটা আমার পছন্দের ছিলো।যেটা আপনি প্রতি শুক্রবার করে পড়তেন”

এতোক্ষনে চিনতে পেরেছে পাখি।এটা তো সেই শাড়ি যেটা এ বাড়িতে আসার প্রথম দিন শান ওকে পরতে দিয়েছিলো।
শর্মিলা শাড়িটাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। নিঃশব্দে কেঁদে চেলেছে অনবরত।তাকে দেখে বুঝাই যাচ্ছে ভদ্র মহিলা গত ষোল বছরে কতোটা শক্ত হয়ে গিয়েছে।

“আজ তো শুক্রবার, একটি বারের জন্যে কাপড় টা পড়বেন?”,অনুনয়মাখা কন্ঠে বলে শান।
রাহেলা বিনা বাক্য ব্যয়ে শর্মিলার হাত টেনে নিয়ে যায় নিজের ঘরে।থতমত খেয়ে শর্মিলা রাহেলার দিকে চলে যায়।পাখি সেদিকে চেয়ে শানের পাশে এসে বসে।কাঁধে হাত রাখতেই চমকে পাশ ফেরে শান।হাত টা টেনে এনে হাতের উল্টোপিঠে চুমু এঁকে দেয়।পাখির চোখ মুছিয়ে বলে,”এভাবে কাঁদবে না।আমি নিজের টা সামলে নিতে পারব। তোমার টা পারব না”

আব্দুল্লাহ্’র কোল থেকে ইনায়াহ্ নেমে আসে শান পাখির কাছে।শান ঘুরে কোলে বসায় ওকে।দুই গালে চুমু খেয়ে বলে,”কাঁদে না মা। আমার মেয়ে কতো স্ট্রং তাই না”
বলতেই শানের গলা জড়িয়ে ধরে ইনায়াহ্।কেঁদে কেঁদে বলে,”তুমি কাঁদবে না সান সাইন।আমার খুব কষ্ট হয়”

শান চোখ বন্ধ করে ইনায়াহ্’র মাথা বুলিয়ে দেয়।
কিছুক্ষণ পর ঘর থেকে বেরিয়ে আসে শর্মিলা।পাখি সেদিকে তাকাতেই তার নজর অনুসরন করে শানও সেদিকে তাকায়।থমকে যায় চোখ দুটো।
চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেদিনের সে দিনগুলো।মা শাড়িটা পড়ে বাড়ির এটা ওটা করছে।আর শান বার বার বলছে,”এই শাড়িতে তোমায় অনেক সুন্দর লাগছে আম্মা।একদম ঐশ্বরিয়া রায়”
মাথায় গাট্টা মেরে কান চেপে শর্মিলা বললো,”খুব পেকে গেছিস না”

“আউচচ আম্মা ব্যথা লাগে”
“বাবু”
হঠাৎ নিজের পুরোনো নাম টা কানে ভেসে আসে শানের।ভাবনার জগত তাকে যেন ধাক্কা মেরে বের করে দিলো কেউ।সম্বিৎ ফিরে পা থেকে মাথা অবধি দেখে নিলো তার জীবনের প্রথম নারী ;তার মাকে।
অজান্তেই ঠোঁটের ডগায় ফুটে উঠলো,”আম্মা”

শর্মিলার উৎসুক চোখ মুখে ভারী বর্ষন নেমে এলো।যেন পানিতে থৈথৈ করে উঠলো চারিপাশে।মূহুর্তেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন শর্মিলা।সাথে সাথে ভেঙ্গে গুঁড়ো হয়ে গেলো তার চারপাশের মিথ্যে শক্ত খোলসটা।বেরিয়ে এলো সিন্ধুকে তালাবদ্ধ সেই মাতৃসত্ত্বা।আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলো নিজের ছেলেকে।আকাশ বাতাস আরেক দফা ভারী হয়ে উঠলো যেন।
মায়ের গায়ের গন্ধটা প্রাণ ভরে শুষে নিলো শান।ছোট বাচ্চাদের কাঁধে মাথা শুয়ে বলে,”তোমায় একদম ঐশ্বরিয়া রায়ের মতো লাগছে আম্মা”

শর্মিলা ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে।কারণ তিনি বুঝেছেন ঝড়টা দরজায় এসে গেছে।ছেলেকে এবার সামলানোর পালা।
“আম্মা,ও আম্মা।আম্মা গো….এমন কেন হলো আম্মা।আমরা তো সুখে ছিলাম আম্মা”
“আব্বা, আমরা সুখের অভিনয় করেছিলাম”

“আম্মা আমি প্রত্যেকটা রাত কেঁদেছি আম্মা।তুমি জানবে না আম্মা আমি আঁধারের রাতগুলো কিভাবে কাটিয়েছে।বাবা বাসায় ফিরত না।চাচিও চলে যেত সন্ধ্যায়।আমি ডুকরে ডুকরে কেঁদেছি আম্মা।আম্মা ষোলটা বছর কেন এমন করে তোমায় ছাড়া কেটে গেলো?আম্মা আরো আগে কি সবটা জানানো যেত না।বলো না আম্মা।আম্মা আমার কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে।

তোমার শাড়ি চুড়ি কাজল হাতে নিয়ে রাতের পর রাত ঘুমিয়েছি আম্মা।ভাবতাম ভোর হলে সবটা আগের মতো হবে, হয় নি আম্মা।ধীরে ধীরে বিগড়ে গেছিলো সবটা।আম্মা আমার পড়া মাথায় ঢুকত না।বোর্ড এক্সাম দিতে খুব কষ্ট হইছে আম্মা।সবাই কেন আমায় এভাবে ঠকালে আম্মা।সত্যিটা না জানলে জীবন কি চলত না আম্মা।শেষমেশ এই বয়সে এসে কেন জানলাম সবটা।মানুষটা মরার আগে কেন জানলাম না?”
শানের ঐ অবস্থা দেখে ভয়ে আতঙ্কে মেঝেতে পা দাপিয়ে কাঁদছে ইনায়াহ্।পাখি দৌঁড়ে গিয়ে বুকে পিষে নেয়।

শর্মিলা বুঝতে পেরেছেন এই মূহূর্তে তিনি কিছুতেই ছেলেকে শান্ত করতে পারবে না ।তাই কাঁদতে দিলেন প্রাণ ভরে।
“আম্মা মানুষটা সে বার প্রথম যখন হ্যাটাক করলো, তখনো মূমূর্ষ অবস্থায় বলেছিলো যাতে তোমার সাথে সকল সম্পর্ক ত্যাগ করি।এতো নিখুঁত অভিনয় মানুষ কেমনে করে আম্মা?”
দীর্ঘসময় ধরে কাঁদছে শান।এবার শ্বাসের গতি ভারী হয়ে আসে শানে।নিমিশেই বন্ধ হয় শানের প্রলাপ। শর্মিলার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়।আতঙ্কিত চোখে মুখে পাখি, রাহেলা আর আব্দুল্লাহর দিকে তাকায়।
“মা কি হয়েছে,উনি চুপ কেন। মা?

“বাবু,এ বাবু।আব্দুল্লাহ্ ডাক্তারকে কল করো”
দিগ্বিদিক চিন্তা না করে আব্দুল্লাহ্ ডাক্তারের কাছে কল করে।সবাই মিলে ধরে পাশের সোফায় শুয়ে দেয় শানকে।পাখি বুঝতেছে না কি থেকে কি হয়ে গেলো।শানের হাত পা ঠান্ডায় জমে গিয়েছে যেন।দ্রুত উঠে রান্নাঘরের দিকে চলে যায় পাখি।একটা রসুন থেঁতলে বাটিতে সরিষার তেল ঢেলে চুলার আঁচে থেঁতলানো রসুন টা সমেত তেলটা গরম করে নেয়।এরপর দ্রুত ছুটে এসে শানের হাতে পায়ের তালুতে ম্যাসাজ করা শুরু করে।ওর দেখাদেখি রাহেলাও আরেক হাতে একই কাজ করে।শর্মিলা কি দেখে বিষম খাবে বুঝতে পারছে না।নিজের প্রতি ছেলের এতোদিনের জমানো কষ্টের প্রতিক্রিয়া দেখে নাকি ছেলের প্রতি পাখির অগাধ ভালোবাসা দেখে।

মূহূর্তেই ডাক্তার নাদিম চলে আসে বাড়িতে।শানকে দেখে খুব গম্ভীর মুখে তিনি বলেন, “কোন ব্যপারে খুব শক্ড তিনি।আর শক্ড থেকেই এই প্রতিক্রিয়া। দূঃচিন্তা করবেন না।তেমন মেজর কিছু না।…..এই ইঞ্জেকশন টা নিয়ে আসুন।সামনের দোকানেও পাবেন”
বলেই প্রেসক্রিপশন টা এগিয়ে দেয় আব্দুল্লাহ্’র দিকে।

আব্দুল্লাহ্ কোন সময় নষ্ট ছাড়া দ্রুত দৌঁড়ে চলে যায় গেইটের বাইরে।দুই কদম হাঁটলে সামনেই ফার্মাসি।প্রেসক্রিপশন এগিয়ে ইঞ্জেকশন টা নিয়ে আসে।হাফাতে হাফাতে ডাক্তারকে দেয়।
“আপনারা ঘাবড়াবেন না।আমি ঘুমের ইঞ্জেকশন টা দিলাম।এর মাঝে কেউ উনাকে ডাকবেন না।বা জাগানোর চেষ্টা করবেন না। উনার শরীরও অনেকটা দূর্বল।আর বাকিটা আমি শানের সাথে কথা বলে নেবো। “,শানের শরীরে ইঞ্জেকশন পুষ করতে করতে বলে ডাক্তার নাদিম।পাখি চোখ ঘুরিয়ে চোখমুখ খিঁচে ফেলে।

শর্মিলা সেদিকে দেখে আনমনে হেসে ওঠে।এই সময় কি হাসা উচিত?মনে তো হচ্ছে, না।তবে সে কেন হাসছে?ছেলের প্রতি কোন মেয়ের এমন ভালোবাসা দেখেই হয়ত অনুভূতিটা হাসি হয়ে বের হলো
আব্দুল্লাহ্’র সহযোগীতায় শানকে ঘরে নিয়ে আসে পাখি।

সেই যে বিকেলে ঘুমিয়েছে শান এখন রাত হয়ে এলো তবুও উঠতে পারে নি।ডাক্তারের কথামতো কেউ তাকে ডাকে নি।বার কয়েক শর্মিলা এসে দেখে গেছে, মাথায় হাত বুলিয়েছে,কপালে অজস্র চুমুর যেন শেষ নেই।রাহেলা সেসব দেখে চক্ষুশীতল করে নেয়।এ দৃশ্য আজ কতোটা বছর দেখছে সে।
রাতের রান্নায় ব্যস্ত রাহেলা আর শর্মিলা।শান ঘুমাচ্ছে পাখি একা একা ঘরে হাফিয়ে উঠেছে।নিচে এসে একবার সুধালো,”মা আমি একটু হেল্প করি?”

“উহু, আজ আমি নিজে হাতে আমার ছেলের জন্যে রাঁধব।আর সাহায্য করবে রাহেলা”,কাঠখোট্টা ভাবে জবাব দিলো শর্মিলা।থমথমে মুখে ফস করে পাখি বলেও ফেলল,”ওহহহ বুঝেছি,অতীতে ফিরতে চান তো।মানে তখন তো আমি ছিলাম না তাই এখনও আমায় রাখতে চাচ্ছেন না”
শর্মিলা কাজ থামিয়ে পাখির সামনে এসে দাঁড়ায়।টেনে এনে বসায় কিচেন ডেস্কের উপর। ঝুঁকে গিয়ে বলে,”আমার অতীত, আমার অনেক বড় শিক্ষা।সে অতীতে তুমি নেই আমি এতেই খুশি।তখন থাকলে হয়ত সময়ের স্রোতে তোমাকেও হারাতাম।”

নিজের কাজে আবার মনোযোগ দিয়ে শর্মিলা বলে,”শোন মেয়ে,তোমার ওয়ান এন্ড অনলি কাজই হলো আমার ছেলেকে অনেকটা ভালোবাসা।তাকে আগলে রাখা।এখন ঘরে যাও। রাত যেহেতু হয়েছে বাবুর কখন ঘুম ভাঙ্গে বলা যায় না।চোখ খুলে যেন তোমাকেই দেখতে পায়”
পাখি মুচকি হেসে রাহেলার দিকে তাকায়।রাহেলা হেসে জবাব দেয়,”কি বলেছিলাম বউ মা, আমার ম্যাডামের মতো মানুষ হাজারেও পাবে না”

“হ্যাহহ, হইছে দজ্জাল শ্বাশুরি”,বলেই পাখি এক দন্ড সেখানে দাঁড়ালো না।
এদিকে শর্মিলা থ হয়ে পাখির যাওয়ার দিকে চেয়ে আছে।
“রাহেলা এই মেয়ে মজা করতেও জানে?”
“কি বলেন ম্যাডাম,ও তো অলরাউন্ডার ”
বলেই শব্দ করে হেসে ওঠে দুজনেই।

“দিদা তোমার ফোন বাজছে”,ফোন হাতে হাফাতে হাফাতে বলে ইনায়াহ্।
“কে ফোন করেছে? ”
“দাদুভাই ও বাড়ির থেকে ফোন করেছে”
শর্মিলা জিহ্ব কেটে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ফোনটা হাতে নিলেন।
“হ্যালো”
“ও বাড়ি গিয়ে ভুলে গেলে বুঝি”
“মাফ করবেন, বাবু অসুস্থ্য হওয়ায়…….”
“কি হয়েছে শানের?”
“এতোদিনের জমানো বিশ্বাস টা ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেছে, বাবু আমার নিতে পারে নি”,দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে শর্মিলা।

“সব মিটে গেছে তাহলে!এখন কি তবে ছেলের কাছেই থাকবে?”
“আমার ছেলেকে আমার থেকেও বেশি আগলে রাখার, যত্নে রাখার মানুষ পেয়েছে আমার বাবু।কিন্তু আমার বুড়া রিটায়ার্ড খান সাহেবের জন্যে এরকম কাউকে পাই নি এখনো।পাইলে তখন না হয়……”
শর্মিলার কথায় শব্দ করে হেসে ওঠে আমজাদ খান।এতোক্ষন ধরে বুকের কোথাও চিনচিনে ব্যথাটা একটু কমে গেলো মনে হয় শর্মিলার রসিকতায়।

রাত হওয়ায় খান সাহেব ধরেই নিয়েছিলেন শর্মিলা বোধহয় আর ফিরবে না তার কাছে।অনেক অভিমান জমা হয় মনে।অভিমানগুলোকে দূরে রেখে তাই কল করে শর্মিলাকে।
“এতো জোড়ে হাসবেন না খান সাহেব”
“আসছো কবে?”
“আগামিকালই”

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৩৩

পাখি তখন থেকে ঘরে পায়চারী করছে আর মাথা উচিয়ে দেখছে শানের ঘুম ভাঙ্গে কিনা।একটু পর জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।দুপুরে গোসলের পর চুলগুলো বেঁধেছে; শুকানো হয়নি আর।তাই চুল ছেড়ে দাঁড়িয়ে দেখছে নিচের দিকে।

পিটপিট করে চোখ খোলে শানের।মাথাটা খুব ভার লাগছে।মাথার ভেতর কি যেন সব কিলবিল করছে।মাথা চেপে ধরে চারিদিকে তাকাতেই বুঝতে পারে রাত হয়েছে।জানলার দিকে চোখ পড়তেই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।পিছনের সমস্ত কষ্ট,যন্ত্রনা সব যেন স্মৃতি থেকে মুছে গেছে একটা ঘুমের বিনিময়ে।খুব সাবধানে পা ফেলে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে পাখিকে।কাঁধের কাছে নাকটা রেখে জোড়ে শ্বাস নেয়।হকচকিয়ে ওঠে পাখি।

“কখন উঠলেন?”
“এইত”
পাখি আর কিছু বলতে পারে না। কারন ডাক্তার বলে গেছে তাকে যেন বেশি মানসিক চাপ দেয়া না হয়।কিন্তু পাখির মনে ভাবনার অন্ত নেই।
“তিনি কি আবার কষ্ট পাবেন?
“মা কোথায়?”
শানের কথায় চমকে ওঠে পাখি।সাবলিল ভাবে বলে “আচ্ছা মা নাকি আম্মা! কোনটা?”
“দুটোই।কারণ আমি দুটোই ডাকতাম”
“ছেলের জন্যে রান্না করছেন।আমায় তো রান্নাঘরে ঢুকতেই দিলো না।একদিনেই আমার সংসার দখল করে নিলো।”

“তুমি কি কান ভাঙ্গাচ্ছো আমার?”,সরুচোখে প্রশ্ন করে শান।
সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে পাখি বলে,”বলে কিনা তোমার দায়িত্ব আমার ছেলেকে সামলানো।আরে বাবা তার ছেলে কি ছোট নাকি যে তাকে সামলাতে হবে!”
শান পাখির কথায় শব্দ করে হেসে আরো জোড়ে শক্ত করে চেপে ধরে।চোখ মুখ খিচে পাখি বলে,”আপনি একটা, আপনি একটা অসভ্য…..”
একটু পরে ওকে ছেড়ে দেয় শান।জানলার গ্রিল ধরে বলে,”আমি সন্তান হিসেবে অযোগ্য পাখি ”

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৩৫