আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৪৬

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৪৬
লেখায়ঃআফিয়া আজাদ নিঝুম

বাড়ি ভর্তি মানুষ অথচ সবার মাঝেও নিজেকে কতোটা একা লাগছে পাখির।শান চলে যাবার পর থেকে বুক টা ধুকপুক করছে ভীষণ।একধ্যানে বেলকোনিতে বসে গেইটের দিকে উদাস মনে চেয়ে আছে পাখি।দৃষ্টি আজ স্থীর।কেন জানে না মনে আজ হাজারও কথা জেগে উঠছে।জেগে উঠছে বিষাদের নীল রেখা।চারপাশের কোলাহল কোনভাবেই সে বিষাদকে ছাপিয়ে যেতে পারছে না।

“ও মুন সাইন যাবে না তুমি?এখনো রেডিই হও নি?”,বলতে বলতে ঘরে ঢোকে ইনায়াহ্।
পাখি ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে মুচকি হেসে ইনায়াহ্’কে ডেকে নেয় কোলের কাছে।
“না যাবো না দিদা বলেছে বোনু কষ্ট পাবে, তোমার কোলে ওঠা যাবে না”,থমথমে মুখে জবাব দেয় ইনায়াহ্।
পাখি স্মিত হেসে বলে,”কে রেডি করালো তোমায়?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“দিদা করিয়েছে”
“মা শা আল্লাহ্, আমার মেয়েকে কতো সুন্দর লাগছে”,বলেই ইনায়াহ্’কে শক্ত করে জড়িয়ে কপালে গালে চুমু এঁকে দেয় পাখি।
“হয়েছে তোমাদের?”,পাখি আর ইনায়াহ্’র আলিঙ্গন দেখে স্বাভাবিকভাবেই কথাটা বলে শর্মিলা।
ইনায়াহ্’র সাথে পাখি এতোটাই ব্যস্ত ছিলো যে বেলকোনির দরজায় কেউ এসে দাঁড়িয়েছে তা বুঝতে পারে নি সে।

শর্মিলার দিকে চেয়ে শব্দহীন হেসে দেয় পাখি।
“চলো চলো চলো,আর কখন যাবে বলো তো”,বলে দ্বিতীয় দফা তাড়া দেয় শর্মিলা।
“একটু পরে যাই মা, শরীরটা ভালো ঠেকছে না”,দূর্বল কন্ঠে বলে পাখি।
শর্মিলা দ্রুত এসে পাখির কপাল গালে হাত রাখে,”কি হয়েছে বউ মা? খুব কি খারাপ লাগছে?বাবুকে কল করব?”
শর্মিলাকে মিছে আস্থা দিয়ে পাখি বলে,”না মা তেমন কিছু না।আপনার ছেলেকে ফোন দিতে হবে না। আপনি যান আমি রেডি হয়ে আসি”

এমনিতে কোথাও গেলে পাখির রেডি হতে মোটেও তেমন সময় লাগে না।আর আজ যেন হাতই চলছে না তার।কাবার্ড থেকে জাম রঙ্গের হালকা কাজের শাড়িটা বের করে।আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের খোলা পেটের দিকে একবার তাকায়।হাত চলে যায় পেটের উপর।মুচকি হেসে ওঠে পাখি।ফোনটা এনে পরপর কতোগুলো ছবি তোলে।পাঠিয়ে দেয় শানের বার্তাকক্ষে।এরপর শাড়িটাকে অগোছালো হাতে সেট করে নেয় নিজের শরীরে।আবার পর পর কতোগুলো ছবি উঠিয়ে, পাঠিয়ে দেয় শানের কাছে।

চুল আঁচড়ে ছেড়ে দিতেই শানের কথা মনে পড়ে।লম্বাচুল গুলো দুইদিকে ছড়িয়ে বিভিন্ন এঙ্গেলে কয়েকটা ছবি তোলে, সেগুলোকেও পাঠিয়ে দেয় ভালোবাসার মানুষটার কাছে।কিছুক্ষন পরে বেশ অগোছালো হয়েই ঘর ছাড়ে পাখি।

একে একে সবাই গাড়িতে বসে পরে।পরপর চারটা গাড়ি দাঁড়ানো সদর দরজার বাহিরে।একটা বরের জন্যে বাকি তিনটা অন্যান্যদের জন্যে।শানের নিজস্ব গাড়িতে বাড়ির সদস্যরা উঠেছে আর বাকি ভাড়া গাড়িগুলোতে অন্যান্য আত্মীয় স্বজনরা।পাখি অন্য গাড়ির দিকে এগোতেই রাফি বলে,”ভাবি ভাইয়া আপনাকে এ গাড়িতে যেতে বলেছে”
চমকে পিছু ফেরে পাখি।ক্ষীনস্বরে “আচ্ছা”বলে গাড়িতে বসে।জানালার পাশে গিয়ে বসে পাখি।
“নিজে নেই অথচ আমার খেয়াল ঠিকই রেখেছে”,শানের কথা ভাবতেই ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে পাখির।ফোনের পাওয়ার বাটনে চেপে স্ক্রীনে শানের ছবিটায় হাত বুলিয়ে নেয়।

কমিউনিটি সেন্টার বাড়ি থেকে ততোটাও দূরে নয়।কিছুক্ষনের মাঝেই সবাই এসে পৌঁছায় সেখানে।শান যে বেশ খরচা করেছে এই বিয়েতে তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।চারদিকে টা ভালো করে দেখে পাখিরা ভিতরে ঢোকে।একে একে আমন্ত্রিত সকলেই চলে আসছে।রাখিরা চলে এসেছে একটু আগে।পার্লার থেকে মেয়েরা সাজাচ্ছে তাকে।পাখি আর সেদিকে পা বাড়ায় না।পিছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে তাকায় পাখি।
“রাফি তুমি!”,অবাক হয়ে প্রশ্ন করে পাখি।

সহাস্যে রাফি জবাব দেয়,”স্যার আপনাকে দেখে রাখতে বলেছে ভাবি।কখন আপনার কি প্রযোজন হয়!”
পাখি হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না।নিজেকে কোনমতে ধাতস্থ করে বলে,”তুমি যাও আমার কোন প্রয়োজন হলে আমি ডেকে নিবো তোমায়”
“ভাবি আপনাকে খুব দূর্বল লাগছে।চাইলে আপনি রেস্ট নিতে পারেন”
“কিভাবে রেস্ট নিবো রে ?”,সন্দিহান চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে পাখি।

“স্যার আপনার রেস্টের জন্যে এখানে একটা রুমও বুক করেছে।বলেছে আপনার খুব বেশি খারাপ লাগলে ঐ রুমে গিয়ে রেস্ট নিতে”,গড়গড় করে কথাগুলো বলে রাফি।
এতোটা ভাবে শান ওর জন্যে এটা ভাবতেই চোখের কোণে জল জমে যায় পাখির।ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির হাসি খেলে ওঠে।নিজের ভাগ্যের উপর নিজেরই বড্ডো হিংসে হচ্ছে আজ।
“তুমি যাও রাফি।লাগলে ডেকে নিবো”,বলে রাফিকে পাঠিয়ে দেয় পাখি।

বিয়ে বাড়িতে যতোই সবকিছু সময় ধরে করা হোক না কেন শেষ পর্যন্ত কোনটাই নির্দিষ্ট সময়ে করা হয় না।দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল পরে যায়।তবুও বিয়ের কাজ শুরু হয় না।বিয়ের আয়োজনে তাড়া দিতে থাকে আগত মেহমানরা।ঘন্টা খানিক পর শুরু হয় বিয়ের কার্যক্রম। সময় তখন বিকেলে ৫.৩০.
পাখি একবার ফোনের দিকে তাকাতেই দুজনের খুঁনসুটি মাখা মূহূর্তের ছবিটা ভেসে ওঠে।তখনি মনে পড়ে শান সকালে তাকে কি বলেছিলো!

“এটা কি করে ভুললাম আমি?উনি তো ড্রেস আনতে বলেছিলেন আর সবার শেষে তো আমিই বাড়ি থেকে বেড়িয়েছি।তালাও তো দেই নি দরজায়”
ভাবতেই গায়ের সবগুলো লোম যেন দাঁড়িয়ে যায় পাখির।এদিকে সন্ধ্যা নামার আগেই চারদিকে ঘনকালো আঁধারে ঢেকে গেছে। হয়ত অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির পূর্বাভাস।পাখি ভাবতে থাকে এখন তার কি করা উচিত!
শত ভেবেও কোন উপায় না ;স্বশরীরে বাড়ি যাওয়া ছাড়া।যেই ভাবা সেই কাজ। মাথা উঠিয়ে দেখে তার আশেপাশে বাড়ির কেউ নেই।সবাই হয়ত বিয়ে দেখছে।পাখি উঠে এসে রাফিকে খোঁজে চারদিকে। কোথাও পায় না।অগত্যা ফোনটা হাতে নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায় গাড়ির জন্যে।

কিছুক্ষনের মাঝে গাড়িও পেয়ে যায় একটা।এদিকে ইতোমধ্যেই আকাশে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শুরু হয়ে গেছে।পাখির মন বলছে তাকে বাড়িতে যেতেই হবে, শানের ড্রেস আনতেই হবে, তালা দিতেই হবে।কথায় বলে বিপদ থাকলে সেখানে যাওয়ার জন্যে মন ব্যকুল হয়ে ওঠে।
গাড়িতে চড়ে সোজা চলে আসে বাড়ির গেইটে।গেইট খোলা অথচ দারোয়ান নেই।গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে সবখানে চোখ বুলিয়ে নেয় পাখি।মনে অজানা ভয় গ্রাস করে।

“বাড়িতে চোর ডাকাত পরে নি তো”
শুকনো ঢোক গিলে দোকানের দিকেও তাকায় পাখি।কোথাও দারোয়ান নেই।ঝড়ের পূর্বাভাস দেখে দোকানপাট সব বন্ধ করার প্রস্তুতি চলছে।গাড়িওয়ালাকে ভাড়াটা মিটিয়ে পাখি গেইটের ভিতরে পা রাখে।কোন জনমানব নেই বাড়িতে আজ।দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে সদর দরজার সামনের লাইটটা জ্বলছে ;হয়ত দারোয়ানই জ্বালিয়েছে।পাখির মনে ভয় হচ্ছে বাড়িতে ঢুকেই যদি চোর ডাকাতের মুখে পড়তে হয়।

মনে সাহস সঞ্চার করে বাড়ির দরজায় পা রাখে পাখি।অন্যরকম একটা গন্ধ এসে নাকে ঠেকে।চারপাশে তখন মাগরিবের আজান পরে যায়।শাড়ির আঁচলটা মাথায় টেনে ড্রয়িংরুমের লাইট জ্বালিয়ে দেয় পাখি। চারিদিকের সবটাই ঠিক আছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।কিছুক্ষনের মাঝেই ঝুম বৃষ্টি সাথে বাজ পরার কর্কশ শব্দে না চাইতেও গা হিম হয়ে আসে পাখির।ড্রয়িং রুমের চারদিকে ভালো করে দেখে নিয়ে পাখি উপরে নিজের ঘরে চলে যায়।উদ্দেশ্য শানের ড্রেসটা নিয়ে তালা চাবি সমেত নিচে নেমে আসা।
পাখি দ্রুত পা চালিয়ে চলে যায় উপরে।ঘরের দরজায় পা রাখতেই বিকট শব্দ করে উঠে।অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে মূহূর্তেই।হঠাৎ ছাদের দরজার কথা মনে হতেই সেদিকে পা বাড়ায় পাখি।কিন্তু আজ তো দরজা বন্ধ শব্দ টা কিসের হলো তাহলে।

শব্দের উৎস না খুঁজে পাখি নিজের ঘরে চলে আসে।দক্ষিনের জানালাটা খোলা।বৃষ্টির পানি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে সোফাটা।পাখি ফোনটা দরজার কাছের ওয়ারড্রোবের উপর রেখে এগিয়ে জানালাটা বন্ধ করে দেয়।এরপর কাবার্ড খুলে শানের হালকা বেগুনি রঙ্গের পাঞ্জাবিটা বের করে নেয়।কারণ এই পাঞ্জাবিটা বেশ মানায় শানের শরীরে।মুচকি হেসে সেটা আলতো ছুঁয়ে দেয়।
ঠোঁট এগিয়ে চুমু দিতেই হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে যায়

দ্বিতীয় দফা ভয়ে কেঁপে ওঠে পুরো শরীর।জানালা ভেদ করে বজ্রপাতের আলো ঘরে ঠিকরে ঢুকছে।সে আলোতে পাখি সন্তোর্পনে এগিয়ে যায় ফোনের কাছে।
ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে আড়চোখে দেখে নেয় পুরো ঘরটা।এরপর পাঞ্জাবির সেটটা নিজের সাইড ব্যাগে ভরে নেয় পাখি।

তালা চাবি বের করে দরজা টা ভিড়িয়ে বাহিরে চলে যায়।ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না যেন।ফোনের আলোয় নির্দিষ্ট একটা স্থান আলোকিত হলেও চারপাশটা অন্ধকারই রয়ে যায়।গা ছমছমে একটা পরিবেশ তৈরী হয়।বাহিরে বৃষ্টির শব্দে অন্য কিছু শোনার জো নেই।পা টিপে টিপে পাখি সিঁড়িতে চলে আসে।চোখে পড়ে সদর দরজা দিয়ে ভিতরে ঢোকা মানুষটার উপর।অবয়ব স্পষ্ট না হলেও তার গাতিবিধিই বোঝাচ্ছে সে মানুষ।

আগত মানুষটাকে দেখে ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয় পাখির।
“কে ওখানে?”,মনে ভয় কিন্তু কন্ঠে কাঠিন্য বজায় রেখে প্রশ্ন করে পাখি।আর তখনি থেমে যায় মানুষটার গতিবেগ। কোন জবাব ছাড়াই ফোনের লাইট অফ করে নেয় লোকটা।পরোক্ষণে মনে পড়ে রনির আসার দিন এমন একটা ঘটনা ঘটেছিলো।
মনে কিছুটা সাহস ফিরে পায় যেন
“আমি জানি আপনি রনি ভাইয়া।প্লিজ ভাইয়া এভাবে মজা করবেন না”,হেসে হেসে বলে পাখি নিচে নেমে আসে।

অথচ সে বেমালুম ভুলে যায় আজ তো রনিরই বিয়ে। তার এখানে থাকার কথা নয়।
যখন কথাটা মাথায় আসে ততোক্ষনে নিজেকে একদম সিঁড়ির দোরগোড়ায় আবিষ্কার করে পাখি।শিড়দাড়া বেয়ে শীতল কিছু একটা বয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।কাঁধে ব্যাগ,হাতে ফোন অন্যহাতে নিজের মুখ চেপে ধরে কান্না সংবরনের চেষ্টা করে।
“কেকে ওওখানে?”,জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে প্রশ্ন করে পাখি।

বৃষ্টির বেগ যেন সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।ঘরে ফিরে যাওয়াকে বুদ্ধিমতির কাজ ভেবে হাতে ফোনটা চেপে উপরে দ্রুত উঠতেই বিদ্যুৎ চলে আসে।থমকে যায় পাখির পা।আগত লোকটাকে দেখার অদম্য ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দিয়ে একটিবারের জন্যে পিছনে ফিরে তাকায় পাখি।আর তখনি পুরো শরীর যেন অসাড় হবার উপক্রম। হাত থেকে ফোনটা পরে যায়।এক সিঁড়ি থেকে আরেক সিঁড়িতে বারি খেয়ে গড়িয়ে পরে একদম নিচে।আগত লোকটা সেদিকে একবার তাকিয়ে পূনরায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে পাখির দিকে।
চোখের সামনে নিজের বিপদ ছাড়া কিছুই নজরে আসে না পাখির।

“ভুল হয়ে গেলো,বড্ডো ভুল হলো বুঝি!আল্লাহ্ সহায় হও…..এইই কই তুমি? কেন আসছো না? আজ বুঝি তোমার জানপাখির শেষ দিন হতে চললো”,আপনমনে ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড় করে পাখি।
আগন্তুক লোকটা দিগ্বিদিক না ভেবে পাখির উদ্দেশ্যে দৌঁড় দেয়।কাঁধের ব্যাগ ফেলে দৌঁড়াতে শাড়ির আঁচল গিয়ে আটকে যায় পায়ের সাথে।

সকালে অগোছালো হয়ে শাড়িটা পড়ায় আঁচলটা একটু বেশিই লম্বা হয়ে যায়।মুখ থুবড়ে পরে যায় পাখি।ব্যথায় নীল হয়ে যায় পুরো মুখ।উঠে দাঁড়াতেই বুঝতে পারে শাড়ির আঁচলে কারো টান।পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখে পুরো আঁচলটা লোকটার হাতের মুঠোয়।খানিক পরেই নিজের অবস্থার কথা ভেবে চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে আসে পাখির।করূনদৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকাতেই কটাক্ষের হাসি উপহার দেয় লোকটা।বুকের কাছের আঁচলটা চেপে টান দিয়েও কোন লাভ হয় না।

“আল্লাহ্”,অস্ফুট স্বরে বলে শাড়ির কুচি দ্রুত খুলে পুরো শাড়িটা খুলে লোকটার মুখে ছুড়ে মারে।এরপর প্রাণপনে ছুটে চলে আসে নিজের ঘরে।খুব দ্রুত দরজা লাগিয়ে হাফাতে থাকে পাখি।বুকের ছাতি যে হাঁফরের ন্যায় ওঠানামা করছে।হার্টবিট বেড়ে গেছে অনেকগুন।পেটের চারপাশে হাত চেপে চেপে বোঝার চেষ্টা করে কোথাও অজান্তেই ব্যথা পেয়েছে কিনা!

পরোক্ষণেই কান্নায় ভেঙ্গে পরে পাখি।মেঝেতে বসে দুহাতে হাঁটু জড়িয়ে কেঁদে ফেলে।
বার বার শানের কথা মনে আসছে,শানের মুখটা চোখে ভাসছে।
“কোথায় তুমি?আমাদের মনে হয় আর দেখা হবে না গো….আচ্ছা আমি কি আজ মরে যাবো?মরলেও কোন আফসোস নাই কিন্তু লোকটা যদি দরজা ভেঙ্গে আমার সাথে মন্দ কিছু করে! সহায় হও হে মালিক।”

ভাবতেই দরজায় পরপর কতোগুলো লাত্থির শব্দ স্পষ্ট হয়।ভয়ে আড়ষ্ট হয় পাখির পুরো তনুমন।
গা গুলিয়ে আসে পাখির।বুক ফেটে চিৎকার চলে আসছে যেন।কিন্তু চিৎকারে খুব একটা কাজ হবে বলে মনে হয় না।তবুও পরপর কতোগুলো চিৎকার দেয় পাখি।কিন্তু বৃষ্টির শব্দের কাছে সে চিৎকার ঘরের চারকোণাতেই সীমাবদ্ধ থাকে।একেতো শরীর অনেকটা দূর্বল তারউপর এতোটা ধকল শরীর নিতে পারে না।চিৎকার গুলো দেয়ার পর বুঝতে পারে তলপেটে চিনচিনে ব্যথা করছে।বৃষ্টির ধারার ন্যায় চোখের পানি ফেলে পেটে হাত বুলিয়ে বলে,”শান”

নিজের দিকে তাকাতেই চোখ মুখ মুছে দ্রুত কাবার্ড থেকে জামা বের করে গায়ে জড়িয়ে নেয়
“দরজা খোল”,দরজা ধাক্কার সাথে বলিষ্ঠ কন্ঠের কর্কশ আওয়াজে চমকে ওঠে পাখি।সেদিকে কান না দিয়ে দ্রুত ঘরের চারদিকে নিজের ফোন খোঁজা শুরু করে।মনে পড়ে যায়, “ফফোন তো সিঁড়িতে পরে গেছ,….আল্লাহ্ সহায় হও”

কাঁদতে কাঁদতে জানলার কাছে চলে যায় পাখি।নিচে তাকিয়ে আশপাশে কাউকে খোঁজার চেষ্টা করে।আবাসিক এলাকা হওয়ার দরূন মানুষের সমাগম বরাবরই কম এখানে।আর এমন প্রবল বেগে বৃষ্টিতে তো অণুবীক্ষণ যন্ত্রেও খুঁজে পাওয়া ভার।অন্যদিকে দরজায় সমান তালে লাত্থি, ধাক্কা দিয়েই চলেছে লোকটা।
ঘরের সব ড্রয়ার তন্য তন্য করে খুঁজেছে পাখি কোথাও কিছু নেই যার দ্বারা কারো কাছে সাহায্য পাওয়া সম্ভব।

“কি ওটা রাখলেন?”
“আগের সিম কার্ডটা”
“চেঞ্জ করলেন?”
“হুমম কয়েকটা মেয়ে খুব জ্বালাচ্ছিলো”

হঠাৎ সেদিনের কথা মাথায় আসে পাখির।চোখের পানি মুছে দ্রুত উঠে যায় সাইড টেবিলের প্রথম ড্রয়ারটার কাছে।টেনে খুলেই ড্রয়ারের সবকিছু বের করে পাখি।সিম টা হাতে উঠে আসে খানিক বাদেই।
চোখ দুটো চিকচিক করে ওঠে খুশিতে।মূহূর্তে সে খুশি গায়েব হয় ফোনের কথা ভেবে।
কিছু একটা ভেবে শানের টুলস বক্সটা হাতে নেয় পাখি।দৃঢ় বিশ্বাস এখানে কোন না কোন পুরোনো ফোন থাকবেই।যেই ভাবা সেই কাজ।অনেক খুঁজে একটা পুরোনো বাটন ফোন পেয়ে যায় পাখি।ঘাবড়ানো চোখ দুটো দরজার দিকে বার বার তাকাচ্ছে।একদিকে ভয় অপরদিকে বিপদ কাটানোর অদম্য ইচ্ছা।এ দুয়ের মাঝে পিষ্ট হচ্ছে পাখির তনু মন।

ফোনে সিম টা উঠানো হলেও খোলে না সে ফোন।দ্রুত চার্জিং এ লাগায়।কানেকশন পেয়ে যায়।শখের বশে মুখস্ত করা শানের নম্বরটায় ডায়াল করে পাখি।

“ড.শান প্লিজ প্রেজেন্ট ইওর প্রেজেন্টেশন। ইট’স ইওর টার্ণ ইয়াংম্যান ”
“ইয়াহ্ শিওর”
সন্ধ্যা ৭ টা বাজছে। সবার প্রেজেন্টেশন শেষে ক্রম আসে শানের।সৌজন্যমূলক হেসে মাউথস্পিকার টা ঠিক করে নিয়ে মনিটরে সকলের উদ্দেশ্যে প্রজেক্টের প্ল্যান গুলো দেখাতে শুরু করে শান।
সাউন্ডপ্রুভ ঘরটায় বৃষ্টির শব্দ ঢুকতে পারছে না। ফোন টা ভাইব্রেট করছে অনবরত।পিনপতন নীরবতায় ভাইব্রেশনের কম্পিত শব্দটাই বিরক্তির কারণ হচ্ছে সকলের।সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় শানের ফোনে। শান সকলের দিকে একবার তাকিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পরে যায়।ফোনের স্ক্রীনে ভেসে ওঠে অজানা একটা নম্বর।ভ্রু কুচকে কেটে দেয় সাথে সাথেই।

“এক্সট্রিমলি সরি “,অনুরোধের স্বরে বলে শান পূনরায় মনোযোগী হয় মিটিং এ।
এদিকে দরজায় বিকট শব্দ হতেই ভয়ে পাখির হাত থেকে পরে যায় ফোনটা।পাখি ধরেই নেয় দরজা ভেঙ্গে ফেলেছে লোকটা।কিন্তু না পাখিকে অবাক করে দরজা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে নিজের অবস্থানে।নিজেকে বড্ডো বেশি অসহায় লাগে মূহূর্তেই।ভিতর যে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।গলা শুকিয়ে আসছে বার বার।বার বার ঢোক গিলেও গলাটা ভিজছে না।কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা তুলে দেখে বন্ধ হয়ে গেছে।ফোন টা আবারও চার্জে লাগিয়র খোলার চেষ্টা করে পাখি।এবং দ্বিতীয় বার খুলেও যায় ফোনটা।হাজার বিপদের মাঝেও চোখ ঝলমলিয়ে ওঠে যেন।
সময়ের ব্যয় না করে আবারও শানের নম্বরে ডায়াল করে।

“ড.ফ্যায়সাল, প্লিজ পিক আপ দ্যা কল। উই উইল ওয়েট.রাইট?”,হাস্যোজ্বল মুখে সবার দিকে একবার তাকিয়ে কথাটা বলে ইন্ডিয়া থেকে আগত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ মনোজ শেঠি।
তার কথায় সবাই সম্মতি দিলেও ব্যপার টা যে মোটেও ভালো হলো না তা শানের বুঝতে অসুবিধা হয় না।বিরক্তি ভরা মুখে সকলের উদ্দেশ্যে বলে,”এক্সকিউজ মি প্লিজ!”
বাহিরে বেরিয়ে দ্রুত ফোনটা রিসিভ করে শান।

“হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো কে বলছেন?”,রেগে গিয়ে বলে শান।
শানের কথায় বুক ছিঁড়ে কান্না আসে পাখির।মুখ চেপে কান্না সংবরন করে বলে,”
“হহহ্যাহহহ হ্যালো হ্যালো, আআামি বলছি”
“আজ যাচ্ছি তারমানে এটা না আমি আর আসব না।আজকের ফল মোটেও ভালো হবে না পাখি “,পাখির কথার মাঝেই দরজার বাহিরে থেকে কর্কশ গলায় শাসায় লোকটা।কথা বলা রেখে পাখি কান পাতে বাহিরে থেকে আসা কন্ঠটার দিকে।মূহূর্তেই দরজায় সজোড়ে ধাক্কা মারার কারণে খানিকটা নড়ে ওঠে কাঠের মোটা দরজাটা।

পাখি দ্রুত বলে,”আমি পাখি, তুমি কই গো?প্লিজ বাড়ি আসো”
কিন্তু ওপাড় থেকে কোন আওয়াজ আসে না।দরজার ওপাড়েও সবটা নীরব।কেউ বলতেও পারবে না এতোক্ষণ দরজার উপর দিয়ে কি ঝড়টা বয়ে গেলো।
পাখি ফোনটা কান থেকে চোখের সামনে এনে দেখে ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছে।দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ফলে ব্যাটারি ডাউন হয় ফোনের।

ফোনের দিকে তাকিয়ে চোখে মুখে না বুঝার ছাপ চলে আসে শানের।বোধগম্য হয় না কে ছিলো, কারণ তখন বৃষ্টিটা ছিলো মুষলধারে।ফোনটা সাইলেন্ট মুডে টেবিলের উপরে,উপর করে রেখে শান দ্বিতীয় বারের মতো মিটিং এ মনোনিবেশ করে।

পাখি দরজায় কান দিয়ে পদধ্বনি বোঝার চেষ্টা করে।সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাওয়ার শব্দ বুঝতেই হাফ ছেড়ে বাঁচে পাখি।বাম হাত বুকে চেপে দরজায় ঠেস মেরে নিচে বসে পরে।একটু আগের কথা ভাবতেই চোখে ঝরনার ধারার মতো অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।ঘামে ভিজে একাকার পুরো শরীর।কেটে যায় পনের থেকে কুড়িটা মিনিট।তবুও বৃষ্টি থামার কোন নাম গন্ধ যেন নেই।নিজেকে বিপদ মুক্ত ভেবেই সন্তোর্পনে দরজাটা খোলে পাখি।আড়চোখে দরজার এপাশ ওপাশ তাকায় সে;কেউ নেই।শুকনো গলায় কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে এক পা বাড়ায় পাখি।উদ্দেশ্য যে করেই হোক বাড়ির কাউকে জানাতেই হবে।

চারদিকে ভালো করে দেখে পা টিপে টিপে আগে যে ঘরে ছিলো ইনায়াহ্ সহ সে ঘরে ঢোকে পাখি।দ্রুত দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে ইনায়াহ্’র ফোন খুঁজতে থাকে বিছানা আর টেবিলের ড্রয়ারে।অবশেষে ফোনটা খুঁজে পায় খাটের একদম পিছনের ফাঁকা জায়গায়।হাতে নিয়ে দ্রুত ডায়াল করে শানের নম্বরে।রিং হচ্ছে কিন্তু ফোন টা ধরছে না শান।
“ধরছে না?”,

নিজের পিছনে সেই চেনা কন্ঠটা কর্ণকুহরে ঢুকতেই বুকের ভিতর আবারও তোলপাড় উঠে যায়।খুব সাবধানে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায় পাখি । চোখ পিটপিট করে তার।
“আরে ধরবে না, মিটিং এ ব্যস্ত আছে”,খুব শান্ত অথচ ধারালো একটা কথা।দরজার দিকে চোখ পড়তেই পাখি বুঝতে পারে আবারও কতো বড় ভুল সে করলো দরজার ছিটকিনি টা নিজেই লাগিয়ে।কিন্তু সে তো লাগিয়েছিলো বিপদ থেকে বাঁচতে, সেই বিপদ কিনা ঘরের ভিতরেই!
হুহুস্বরে ডুকরে কেঁদে ওঠে পাখি।

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৪৫

“কংগ্রাচুলেশনস মিস্টার শান”
মিটিং শেষ করে ধপ করে পিছনের চেয়ারে বসে পরে শান।টাই টা টেনে ঢিলে করে চশমা টা খুলে টেবিলে রাখে।ফোনটা উল্টিয়ে দেখে ৮.৩০ বেজে গেছে।সাথে একটা মিস্ড কল ইনায়াহ্’র নম্বর থেকে।প্রথমে ভ্রুজোড়া কুচকালেও পরোক্ষনে মুচকি হেসে ব্যাগ প্যাক করে আমন্ত্রিত কলিগদের নিয়ে বের হয় কমিউনিটি সেন্টারের উদ্দেশ্যে।
পথে কয়েকবার পাখিকে ফোন করা হলেও ফোনটা সুইচ অফ পায় শান।মুচকি হেসে আনমনে বলে,”এতো অভিমান আমার বউটার।”
স্ক্রীনে পাখির হাস্যোজ্বল মুখটা আঙ্গুলে ছুঁয়ে বলে “পুতুল বউ আমার”

“ম্যাডাম বউ মা কোথায়?”,
“আছে হয়ত কোথাও।আমিও দেখছিনা অনেক্ষন ধরে।বউ মার শরীর টা খারাপ বুঝেছি।হয়ত রেস্ট নিচ্ছে”,বলেই শর্মিলা রাহেলাকে বলে ইনায়াহ্’কে নিয়ে বিয়ের অতিথীদের সাথে কুশল বিনিময় করে।
“বড় মা, ভাবি কোথায়?”,রাফি হন্তদন্ত হয় বলে।
পিছন ফিরে শর্মিলা অবাক হয়ে বলে,”কী রে, সবাই বউ মাকে খুঁজছিস মানে।আছে হয়ত কোথাও। দেখ না বাবা খুঁজে।”

“আমি পুরো সেন্টার তন্নতন্ন করে খুঁজলাম বড় মা।ভাবি কোথাও নেই।ভাইয়া বলেছে ভাবিকে চোখে চোখে রাখতে”,অপরাধীর ন্যায় কথাগুলো বলে রাফি।
শর্মিলার গায়ের লোম শিউড়ে ওঠে মূহূর্তেই।
“নেই মানে,কি বলিস এসব?”

আসক্তি সিজন ২ পর্ব ৪৭