উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৩

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৩
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

সূর্যের ক্ষীণ আলো খোলা জানালা দিয়ে প্রবেশ করেই রঙিন কার্পেটে লুটোপুটি খাচ্ছে। শুভ্র রঙা পর্দা গুলো মৃদু-মন্দ বাতাসে একটুখানি দুলছে। দিন পঞ্জিকার পাতা গুনলো ঊর্মি। আজ ২৫ ডিসেম্বর। বি*চ্ছে*দে*র ত্রিশ তম দিন। তার এক্সি*ডেন্ট এর তিনমাস সময় কাঁটায় কাঁটায় পূর্ণ হলো। ভাঙা হাড়ে ব্যান্ডেজ ব্যবহার করলেও একটা পায়ে অপা*রেশন এর প্রয়োজন পড়েছে।

সেই পা ঠিক হতে অনেকটা সময়ের প্রয়োজন। বাকি হাড়ের ব্যান্ডেজ গতকাল খোলা হয়েছে। সাবধানে চলাফেরা করার নির্দেশ ডাক্তারের। দ্বিতীয় ব্যান্ডেজে হাড় জোড়া নিয়েছে। অপারেশন যুক্ত বাম পায়ের ক্ষ*ত এখনো শুকায়নি। অন্তরের ক্ষত যেখানে তাজা, পায়ের ক্ষ*ত আর এমন কী? একবার বি*ভৎ*স স্মৃতির পাতা ওল্টাতে গিয়েও দীর্ঘশ্বাস ফে*ল*লো ঊর্মি। বসার ঘর থেকে টুকটাক আওয়াজ ভেসে আসছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ড্রয়িংরুমের সোফায় নতমস্তকে বসে আছে রাহাত। সদর দরজা খোলা পেয়েই ঢুকলো। বেল দেওয়ার প্রয়োজন পড়লোনা। দোকানের উদ্দেশ্যে বের হবেন মোস্তফা সাহেব। তৈরি হয়ে ঘর ছেড়ে বের হলেন। ড্রয়িংরুম পর্যন্ত এসেই থেমে গেলেন।
রাহাত বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো। মোস্তফা সাহেবের উদ্দেশ্যে সালাম দিতেই তিনি উত্তর দিলেন।
গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন,

-“হঠাৎ এই বাসায় কেন এসেছো?”
রাহাত সহসাই জবাব দিতে পারলোনা। একটু জিরিয়ে গলার স্বর যথাসম্ভব নিচু রেখে বলল,
-“আমাকে ক্ষ*মা করুণ বাবা। একবার যে ভুল করেছি, তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।”
কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়লো মোস্তফা সাহেবের। বিষয়টি খোলাসা করে জানার উদ্দেশ্যে বললেন,
-“তোমার কথা ঠিক বোধগম্য হলোনা আমার।”

হাঁটু গেড়ে মোস্তফা সাহেবের দুহাত মুঠোয় নিয়ে নিলো রাহাত। আকুল দাবী নিয়ে বলল,
-“বাবা আমি ঊর্মিকে নিতে চাই।”
মুহূর্তেই ঝটকা খেলেন মোস্তফা সাহেব। রাহাতের কথায় থমকালেন তিনি৷ বিমূঢ় হয়ে হাত জোড়া ছাড়িয়ে নিলেন। এক জোড়া রক্তিম চোখ নিয়েই চেঁচিয়ে উঠলেন,
-“ঊর্মিকে নিতে চাও মানে কী? তুমি বলবে, আর আমিও মেয়ে দিয়ে দেব ভেবেছ?”

আশিক ঘরেই ছিল। বাবার উচ্চ আওয়াজে সবার সাথে সেও বেরিয়ে এলো। ঊর্মি ঘর থেকেই বাবার রাগান্বিত হওয়ার যথাযথ কারণ বোঝার চেষ্টা করলো। বরাবরই ব্যর্থ হলো সে। তাই ডান পা ও ক্রাচে ভর দিয়ে দরজা পর্যন্ত এসে দাঁড়ালো। এখান থেকে ড্রয়িংরুম স্পষ্ট দেখা না গেলেও আংশিক দেখা যায়। কোনাকুনি উত্তরের সোফার সামনেই হাঁটু গেড়ে বসে থাকা রাহাতকে দেখে তড়াক করে উঠলো ঊর্মি। ক্রমশ ব্যাকুল হয়ে উঠলো মন। অস্থির, তটস্থ চাহনিতে এদিক-ওদিক তাকালো। কিছুতেই মনকে স্থির করতে পারলোনা।

রাহাতকে দেখে আশিক প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালো।
ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো,
-“কি হয়েছে বাবা?”
অতিরিক্ত ক্ষো*ভে জর্জরিত মোস্তফা সাহেবের শরীর থরথর করে কেঁপে উঠলো। চোখমুখ উল্টানোর ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে, সম্ভব হলে এখানেই রাহাতকে গেঁড়ে ফে*ল*তে*ন। দৃষ্টি ফিরিয়ে আশিকের উদ্দেশ্য বললেন,
-“সে কী বলছে, জানো? আমার মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে চায়? মেয়ে মানেই কি খেলনা? অন্যদের কাছে খেলনা হলেও আমার কাছে আমার মেয়েরা সবচেয়ে মূল্যবান হীরা।”

চোখ দুটো জ্বলে উঠলো আশিকের। চোয়াল শক্ত করে মুহূর্তেই হাতের মুঠো শক্ত করে নিলো। একসময় তার ভেতরে খা*রা*প সত্তার রাজত্য থাকলেও, নিজ প্রচেষ্টায় সেগুলো দূর করতে সক্ষম হয়েছে। এখন পরিবারের প্রতিটি মানুষকে নিয়ে মস্তিষ্ক তাকে ভাবতে বাধ্য করে। সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে মা-বাবা, স্ত্রী, বোনদের নিয়ে জীবনযাপন করতে চায়।
মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুটিয়ে দৈবাৎ রাহাতের শার্টের কলার আঁকড়ে ধরলো। র*ক্ত*চ*ক্ষু নিক্ষেপ করে বলল,

-“তুমি যখন যেভাবে চাইবে, সবটা সেভাবেই হবে?
মানলাম আমার বোনের সাথে সংসার করতে চাওনা, আরেকটা বিয়ে করলে তাতেও আমাদের কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু এবার আর মানতে পারলাম না। বিচ্ছেদ চেয়েছো তুমি, আবার সব মিটমাটও করতে চাইছো তুমি। মাঝখানে আমার বোনের কোন গুরুত্বই নেই? সে কি বানের জলে ভেসে এসেছে?”

রাহাত কলার ছাড়ানোর চেষ্টা করলোনা। বরং আরেকটু আকুতি নিয়ে বলল,
-“আমি অ*ন্যা*য় করেছি। নিজের ইচ্ছেতে কিছুই করিনি। মায়ের চাপে পড়েই আমি বাধ্য হয়েছি। কিছুদিনের জন্য আমার বিবেক আর দৃষ্টি শক্তি লোপ পেলেও, এখন বুঝতে পারছি কত বড় অ*ন্যা*য় আমি করেছি। আপনারা দয়া করে আমার প্রতি সদয় হন। দ্বিতীয়বার এমন ভু*ল আমাকে দিয়ে হবেনা।”

মোস্তফা সাহেব আশিকের মুঠো হতে রাহাতের কলার ছাড়িয়ে নিলেন। শান্ত হয়ে বসলেন সোফায়। বিচক্ষণতার সাথেই শান্ত মস্তিষ্কে কথা বললেন। প্রথমেই রাহাতকে বোঝালেন,
-“তুমি কী করেছো, কেন করেছ তা আমাদের জানার প্রয়োজন নেই। প্রথমত তুমি তালাকনামায় স্বাক্ষর করেছো। দ্বিতীয়ত তোমার এখন স্ত্রী আছে।

আমি একজন বাবা হয়ে না পারবো নিজের মেয়ের জীবন অনিশ্চয়তায় ফেলতে, আর না পারবো আরেকজন মেয়ের সংসার ভা*ঙ*নে*র মুখে ঠে*লে দিতে। আমি ঠান্ডা মাথায় বলছি তুমি বাড়ি ফিরে যাও। নিজের সংসারে মন দাও।”
_“বাবা সাইন হলেও ৯০ দিন পর্যন্ত ডি*ভো*র্স কার্যকর হয়না। এর ভেতর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সব মিটমাট করার সুযোগ থাকে। মাত্র ৩০ দিন হলো। আমি যখন ডি*ভো*র্স পেপারে সাইন করেছি, তখন সুস্থ মস্তিষ্কে ছিলাম না। এখন সুস্থ মস্তিষ্কে আমি ডি*ভো*র্স তুলে নিলাম। আমি গতকাল উকিলের সাথে কথা বলেছি বাবা। সবটা নিশ্চিত হয়েই এসেছি আমি।

দয়া করে আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না।”
মোস্তফা সাহেব বললেন,
-“আইনি ব্যাপারে সমাধান করলেইতো হলোনা। ৯০ দিন পর্যন্ত মিটমাট করার সুযোগ থাকে সেটা আমাদের অজানা নয়। বড় কথা হলো আমার মেয়ে বা আমরা কেউই চাইছিনা মিটমাট হোক। তুমি আইন দিয়ে সমাধান করলেও আমরা শরিয়তকে গুরুত্ব দিচ্ছি। শরিয়তের দৃষ্টিতে তোমার কাছে কতটুকু সমাধান আছে? তাছাড়া তুমি বারবার বলছো তোমার দ্বারা দ্বিতীয়বার একই ভুল হবেনা। কিভাবে এতটা গ্যারান্টি দিচ্ছো তুমি? তুমি যাকে বিয়ে করেছো, তাকে কী করবে? তার সাথেও কি তুমি একই কাজ করবেনা? যা আমার মেয়ের সাথে করেছিলে?”

মস্তিস্ক শূন্য হয়ে পড়লো। যতটা প্রস্তুতি আর সাহস নিয়ে এসেছিলো, তার সবটাই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। বারংবার হে*রে যাচ্ছে রাহাত। ঘুরেফিরে তার একই আকুতি,
-“বাবা একবার আমাদের ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করুন। লিলিকে ও মায়ের কারণে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি।”
তাচ্ছিল্য হাসলেন মোস্তফা সাহেব। বললেন,

-“বিয়ে তো মা করেনি, তুমিই করেছো। তুমি বিয়ে না করলে মেয়েটা নিশ্চয়ই তোমার বাড়ি আসতে পারতোনা। বারবার মায়ের দো*ষ দেখাচ্ছো কেন? তুমিও তো সমান দো*ষী। মা বলবে, আর তার প্ররোচনায় পড়ে তুমিও যা ইচ্ছে তাই করে ফেলবে? বিবেক নেই তোমার? নিশ্চয়ই তোমাকে সম্পূর্ণ বিবেকবুদ্ধি দিয়ে পরিপূর্ণ করেই সৃষ্টিকর্তা দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন।”

-“আমি নিজের দো*ষ*টা অস্বীকার করছিনা। আমিও মায়ের সাথে সমান দো*ষী। নিজের করা অ*ন্যা*য়ে আমি অনুতপ্ত। একটা বার প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দিন।”
-“মানলাম তুমি অনুতপ্ত। নিজের ভুল বুঝতে পেরেছো। তবে আমার মেয়ে তোমার সাথে যাবেনা।”
এতক্ষণ ধৈর্য ধরে থাকলেও মোস্তফা সাহেবের কাঠকাঠ স্বরে রাহাত এবার দৃঢ় কন্ঠে জানালো,
-“আমি আমার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো।”

মোস্তফা সাহেব নিজের সিদ্ধান্তে অটুট রইলেন। আশিক পূনরায় রাহাতের কলার চে*পে ধরলো। এবার আর মোস্তফা সাহেব ছেলেকে থামালেন না। শান্তভাবে বোঝালেন রাহাতকে, না বুঝলে উনার আর করার কিছুই নেই।
রাহাত আর আশিকের মাঝে হাতা*হাতি লেগে গেলো।
ঊর্মি ভীতিগ্রস্ত হৃদয় নিয়ে ফোন হাতে তুললো। বুক ধড়ফড় করে উঠছে তার। শামীমের নম্বরে ডায়াল করলেও ওপাশ থেকে ফোন তুললোনা কেউ। বাধ্য হয়ে উষাকে ফোন দিলো। উষা ফোন তুলে কিছু বলার সুযোগ পেলোনা। ঊর্মি গড়গড় করে বলে উঠলো,

-“উষা বাড়িতে বড়সড় ঝা*মে*লা বেঁধেছে। তুই শামীম ভাইয়াকে পাঠা জলদি করে। উনি ফোন তুলছেন না।”
উষা অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
-“বাড়িতে কী হলো? উনাকেই বা কেন পাঠাতে বলছো। এখন তো উনি অফিসে। বাবা-মা, তোমরা সবাই ঠিক আছো তো? ভাইয়া কি আগের মতো কিছু করছে?”
-“আমরা ঠিক আছি। বাবা বাড়িতে থাকলে তাকে পাঠিয়ে দে। রাহাত সকালেই আমাদের বাড়িতে এসেছে। সে আমাকে ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছে। তুই ভাবতে পারছিস, কী হতে চলেছে? ইতিমধ্যে ভাইয়া আর ওর মাঝে হা*তা*হা*তি লেগে গিয়েছে।”
উষা তীক্ষ্ণ স্বরে জানতে চাইলো,

-“তুমি এমন অস্থির হচ্ছো কেন? যা করেছে, তাতে দু’চারটা উত্তম মধ্যম পড়া উচিত। সে এমন কাজ করেছে যেখানে না চাইতেও তার দ্বিতীয় স্ত্রীর চোখের শ*ত্রু হচ্ছো তুমি। তোমাকে দিয়ে ক্ষো*ভ মেটাতে না পেরে আমাকেই ব্যবহার করছে। অবশ্য মেয়েটার সাথে যা হচ্ছে, তার এমন আচরণ অস্বাভাবিক নয়। লিলির জায়গায় আমি থাকলে, আমি কি নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করতাম না?”
-“শামীম হলে তুই এমন কথা বলতে পারতি?”
উষা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“শামীম এমন করলে আমি তোমার মতো ফোন করে আলগা দরদ দেখাতাম না। বরং নিজ থেকেই দুটো চ*ড় মে*রে দিতাম।”

অতঃপর সন্দেহের সুর তুলেই বলল,
-“তুমি কী চাইছো বলোতো? তুমি কি আবারও ফিরতে চাও এই বাড়িতে?”
কঠিন হয়ে এলো ঊর্মির কন্ঠস্বর,-“কখনোই না। আমি আর পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চাইনা।”
খট করেই লাইন কে*টে দিলো ঊর্মি।

রাহাত আর আশিকের হা*তা*হা*তি যখন বা*জে পর্যায়ে যাচ্ছিলো, তখন মোস্তফা সাহেবই তাদের থামিয়ে দিলেন। একবার ঊর্মির ঘরের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো রাহাত।
এদিকে আনোয়ার হোসেন বাড়ি ফিরতেই সবটা জানিয়ে দিলো উষা। আনোয়ার হোসেনের সাথে সাথে উপস্থিত সবাই জেনে গেলেন রাহাতের ব্যাপারটা।

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১২

(সবার মনেই লিলিকে নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রশ্নের উত্তর আশা করি ধীরে ধীরে পেয়ে যাবেন। অনেকে আবার বলছেন আমি কেন লিলিকে সাপোর্ট করছি, অনেকে বলছেন রাহাতকে কেন সাপোর্ট করছি?
আমি কোন চরিত্রকেই সাপোর্ট করছিনা। শুধু এতটুকুই উল্লেখ করছি, কার চোখে কোন চরিত্র কতটুকু দো*ষী বা নি*র্দো*ষ। গল্পের চরিত্রের কথা বললে রাহাতের চোখে লিলি দো*ষী, সে কেন সবটা জেনেও বিয়ে করলো। আবার অন্যদের চোখে রাহাত দো*ষী। কারণ সে বিয়ে করেছে বলেই লিলি তার ঘর পর্যন্ত আসতে পেরেছে। সবাই যে সম্পুর্ন দো*ষী এমনটা নয়, আবার একেবারেই যে নি*র্দো*ষ তেমনটা ও নয়। কম বেশি সবারই দো*ষ আছে। প্রতিটি মানুষই আগে নিজের স্বা*র্থ খোঁজে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে লিলি, রাহাত দুজনেই নিজেদের স্বা*র্থ খুঁজতে ব্যস্ত। হ্যাপি রিডিং।)

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৪