উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৪

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৪
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

পুরু প্রাচীর ঘেরা ইট-সিমেন্টে বাঁধাই করা বাড়িটির বাহির যতটা প্রশান্তি দেয়, ভেতর ততটাই স্তব্ধ, থমথমে ঝড়ের আভাসে পরিপূর্ণ। অবলীলায় চলতে থাকা তেজী ঘোড়া রুখে দাঁড়াবার মতো সবকিছুই থেমে গেলো। রিনরিনে শীতল বাতাস ছুঁয়ে দিলো একটি একটি করে প্রতিটি শরীরের লোমকূপ। সকলের চোখেমুখে স্তব্ধতা দেখা গেলেও লিলির মাঝে দেখা দিল বৈপরীত্য। সকল মনোভাব ঠে*লে*ঠু*লে তার মাঝে জায়গা করে নিলো কেবল একরাশ বিষন্নতা। গতদিন থেকেই সে চুপচাপ হয়ে আছে। রাত্রিযাপন হচ্ছে এমন একটি ঘরে, যেখানে সকলের যাতায়াত কদাচিৎ লক্ষ করা যায়। যাকে গেস্ট রুম হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ভেতরে কিসের একটা পরিতাপ তাড়া করে বেড়ালো। তার জীবনটা কি এমনই হওয়ার কথা ছিলো?
জীবনের শুরুটা ছিল ভু*ল, ফের ভু*ল। শেষটায় কি আছে সেই ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত সে। প্রতিটি ঘটনার পেছনেই একটা নির্দিষ্ট কারণ থাকে। মানুষ কৌতূহলপ্রিয়। অজ্ঞাত বিষয় জানার প্রতি তাদের থাকে প্রবল আগ্রহ। কাউকে ভালো রাখার আশায় নিজেকে আড়াল রাখলো লিলি। বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত লিলি এই বাড়ির প্রতিটি মানুষের কাছেই অজানা। বিয়ের পর এক নতুনত্ব অধ্যায়। যাকে পুরোপুরিভাবে জানতে হলে তার পুরোনো অধ্যায়কে ঘেঁটে দেখা আবশ্যক। অথচ সে বিষয়ে কারো বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নাসিমা বেগম ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণা অনুভব করলেন। আজ ভীষণভাবে উপলব্ধি করতে ইচ্ছে হলো তার নিজের দো*ষে*ই সুন্দর জীবনগুলো এলোমেলো হয়ে গেলো। সংসারে শান্তি বিনষ্ট হলো। স্বামী, সন্তানের মন থেকে পুরোপুরি উঠে গেলেন তিনি। লিলির সাথে রাহাতের বিয়ে হওয়ার কথা ছিলোনা। মেয়েটা প্রথমদিকে অমত পোষণ করলো। রাহাত হয়তো সবটা বলে দিয়েছে ভেবে লিলির পরিবারকে মি*থ্যে বোঝালেন।

“রাহাতের কথা পুরোপুরি সত্য নয়। তার স্ত্রী ও স্ত্রীর পরিবার টাকার লো*ভে ডি*ভো*র্স নিয়েছেন। মোটা অঙ্ক দেনমোহর ধরে বিয়ে দিয়ে ডি*ভো*র্স নেয়া, এটা তাদের একপ্রকার ব্যবসা। ছেলে জানতে পারলে কষ্ট পাবে বলেই তিনি রাহাতের কাছে বিষয়টি চে*পে গেলেন। তাই রাহাত যতটুকু দেখেছে, ততটুকুই লিলিকে বর্ণনা দিয়েছে। লিলির সাথে বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তাছাড়া ডি*ভো*র্স তো হয়েই গেল।”

এতটুকু শুনেই লিলির পরিবার বিয়েতে হ্যাঁ করে দিলেন। মেয়েকে রাজি করানোর দায়িত্ব তাদের। আজ নাসিমা বেগমের মনে হচ্ছে লিলি কিংবা তার পরিবারের ও কোন না কোন খুঁ*ত আছে। নয়তো এতটা জটিল ব্যাপার কত সহজেই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিলো? তাও আবার কুমারী মেয়ের জন্য।

নাসিমা বেগম নিশ্চুপ দায়িত্ব পালন করেই ঘরে ফিরলেন। দরজায় খিল চাপিয়ে একবার আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিজের কুঁচকে যাওয়া হালকা থলথলে চামড়া দেখে ভাবলেন সৌন্দর্যই কি সব? দুদিন আগেও তো তার নিজের কাছে সৌন্দর্যের গুরুত্ব ছিলো অত্যাধিক। সৌন্দর্যই সব কিছু, এই মনোভাবেই বিরাট বড় অ*ন্যা*য় করে ফেললেন। ভেবেছেন অসুন্দর চেহারার মেয়ে নিয়ে ছেলে সুখী হবেনা। ছেলের কথা ভাবতে গিয়ে তার বিরাট আকারের ক্ষ*তি করে বসলেন।

যদি রূপ- লাবণ্যই ভালোবাসার মূল হেতু হতো, তবে এই কুঁচকে যাওয়া চামড়া নিয়ে এখন পর্যন্ত আনোয়ার হোসেনের ঘর করতে পারতেন? চামড়া কুঁচকে যাওয়ার সাথে সাথে আনেয়ার হোসেনও নিশ্চয়ই ভরা যৌবনের কাউকে খুঁজে নিতেন। নিত্যনতুন সঙ্গী খুঁজতেন। একই চেহারায় তৃপ্তি মিটে গেলে তাকে ছুঁড়ে অন্যকারো রূপে ডুবে যেতেন। একহাতে তিনটি জীবন ন*র*কে পরিণত করলেন। ঊর্মিকে দূর করেছেন নিজ প্রচেষ্টায়, লিলিকেও এনেছেন নিজ প্রচেষ্টায়। এখন যখন অনুতাপ হলো, তখন সবকিছুই জটিল, এলোমেলো হয়ে উঠলো। কোনটা দেখবেন তিনি? ছেলের সুখ? চাইলেও বা সেটা কিভাবে সম্ভব? নিজ হাতেই তো সবটা শেষ করলেন।

ঊর্মি আর লিলিরই বা কী হবে? অসহনীয় যন্ত্রণায় মাথা চেপে ধরলেন নাসিমা বেগম। সেদিন ছেলেকে মৃ*ত্যু ভ*য় দেখালেও আজ সত্যিই মৃ*ত্যু*কে বরণ করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার মৃ*ত্যু*তে আদোও কি কোন সমাধান হবে? নিজ হাতে যা ছিন্নভিন্ন করেছেন, তা কি আর ঠিক করার পথ রেখেছেন? একজন নারী যেমন গড়ার কারণ হতে পারে, তেমনি ধ্বং*সের কারণও হতে পারে।

আনোয়ার হোসেন হন্তদন্ত হয়ে ছেলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। বেশিদূর যেতে হলোনা, মাঝরাস্তায় রাহাতের দেখা পেলেন। নাকের নিচে র*ক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে আছে। চোখমুখে নিভু নিভু ভাব। সকালের মসৃণ শার্ট সহ চুলের এলোমেলো অবস্থা।

বাবাকে দেখতে পেয়েই অগোছালো হাসলো রাহাত। আনোয়ার হোসেন যেমনটা প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলেন, তার একটুও ছেলের উপর প্রয়োগ করতে পারলেন না। মায়া হলো। কিছুমাস আগের চমৎকার দেখতে ছেলেটিকে কোথাও খুঁজে পেলেন না। চোখের সামনে দেখলেন কেবল বিধস্ত, ভগ্নহৃদয়ের, বিদীর্ণ এক ছন্দহীন মানুষ।
বাবা হয়ে নয়, একজন মানুষ হয়ে এই মানুষটির প্রতি মায়া বাড়লো, করুণা জন্মালো মনে।
রাহাতের খুব ইচ্ছে হলো বাবাকে জড়িয়ে ধরতে। তার ভেতরের দুঃখগুলোক ভাসিয়ে দিতে।
বাবার সাথে খুব খোলামেলা সম্পর্ক না হওয়ায় ইচ্ছেটাকে চাপা দিতে হলো। ভাসলো কেবল দীর্ঘশ্বাস।
নরম কন্ঠে আনোয়ার হোসেন বললেন,

-“পরিস্থিতি সব সময় আমাদের অনুকূলে থাকে না। যা হচ্ছে তা মেনে নাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ যা করেন, আমাদের ভালোর জন্যই করেন।”
রুদ্ধ হয়ে আসা গলায় রাহাত বলল,
-“ভালোটা যে আমি দেখতে পাচ্ছি না, বাবা। আমার কি ম*রে যাওয়া উচিত? ম*রে গেলে যদি সঠিক শা*স্তি হয় আমার, যন্ত্রণাগুলো যদি ঘুচে যায়!”
আৎকে উঠলেন আনোয়ার হোসেন। ছেলেকে জড়িয়ে নিলেন বুকে। এতক্ষণ রাহাত যা পারেনি, দূরত্বটুকু ঘুচিয়ে সেটাই করলেন তিনি। বললেন,

-“চলো, কোথাও বসি।”
সর্বপ্রথম এক বোতল পানি কিনে রাহাতের দিকে বাড়িয়ে দিলো। বোতলের মুখ খুলে পানি পান করে নিতেই রাহাতকে নিয়ে জনমানবহীন একটি জায়গায় বসলেন। কাঁধে হাত রেখে বোঝালেন,

-“এত সহজে হে*রে গেলে চলবেনা। কত মানুষ একটু বেঁচে থাকার আশায় লড়াই করে যাচ্ছে। হাসপাতালে গেলেই দেখবে সেসকল মানুষের আহাজারি। যারা পৃথিবীকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে, অথচ হাতে কিঞ্চিৎ সময় পাচ্ছেনা। আর তুমি পরিপূর্ণ এক জীবন পেয়েও মৃ*ত্যু*র কথা ভাবছো? জীবনে প্রতিকূলতা আসবেই, মনে হিম্মত রেখে সেসকল প্রতিকূলতা, বাঁধা অতিক্রম করতে হবে। জীবন মানেই সংগ্রাম। সেই সংগ্রাম এক একজনের কাছে এক এক ভাবে ধরা দিচ্ছে। আশেপাশে দৃষ্টি দিলেই দেখতে পাবে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা তোমার চেয়েও কঠিন পরিস্থিতি পার করছে। তাহলে তুমি কেন ধৈর্য হারা হচ্ছো?”

বাবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো রাহাত। অভিযোগ করা কন্ঠে বলল,
-“হাসপাতালে ঊর্মিকে নিয়ে যখন দিশেহারা আমি, সে সময়টাতে যদি এমনভাবে পাশে এসে দাঁড়াতে, আমি হয়তো সাহস পেতাম। এমন পরিস্থিতি আমার জীবনে আসতো না। কোন সন্তান মায়ের মৃ*ত্যু*র কারণ হতে চায়? কে চায় সারাজীবন মায়ের মৃ*ত্যু*র দায়ভার বয়ে বেড়াতে?”

আনোয়ার হোসেনের রা*গ ক্রমশ দীর্ঘ হলো। কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। যেভাবে সবার জীবন ন*ষ্ট করেছে, ঠিক সেভাবেই নাসিমা বেগমকে দূরে সরাবেন। নিজের থেকে, সন্তানদের কাছ থেকে, এমনকি এই সংসার থেকেও। আজই শাশুড়ির সাথে কথা বলে জানিয়ে দেবেন তার মেয়েকে এসে নিয়ে যায় যেন। উনার সংসারে আর নাসিমা বেগমের প্রয়োজন নেই।

শামীম বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে। বাড়ির পরিবেশ এতটা শান্ত দেখে কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো। উষার পুড়ে যাওয়া পায়ের অবস্থা পরখ করতে করতেই বাড়িতে কিছু হয়েছিল কি-না জানতে চাইলো শামীম। ভনিতা ছাড়াই উষা সবকিছু স্পষ্ট বলে দিলো। চিন্তিত দেখালো শামীমকে। বুঝে উঠতে পারলোনা কোনটা সঠিক আর কোনটা ভু*ল।
রাহাতের দিক দিয়ে ভাবতে গেলে তার প্রতি ক*রু*ণা হয়, সে পরিস্থিতির স্বীকার।
সব কিছুর মূলে প্রবেশ করলে একমাত্র দো*ষী মাকেই মনে হয়। একজনের কারণেই এতটা ধ্বং*সের সৃষ্টি। মাঝ দরিয়ায় রাহাত। না পারছে ঊর্মির কাছে ফিরতে, আর না পারছে লিলিকে মেনে নিতে।

আকস্মিক বৃদ্ধ মায়ের আগমনে আশ্চর্য হলেন নাসিমা বেগম। লাঠিতে ভর দিয়ে এখনো দিব্যি চলাফেরা করতে পারেন। বড়ভাই মাকে নামিয়ে দিয়েই চলে গেলেন। মাকে ধরে এগিয়ে নিতে গেলেই তিনি নাসিমা বেগমের হাত ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে দিলেন। আনোয়ার হোসেন কাঠকাঠ গলায় বলে দিলেন,

-“যাওয়ার সময় আপনার মেয়েকে নিয়ে যাবেন আম্মা। আমার সংসারে আর এই মহিলার কারণে অ*শা*ন্তি চাই না।”
বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো যেন। বিস্ফোরিত নয়ন জোড়ায় মিনিটেই ভীতি নামলো। এই বয়সে এসে সংসার ছাড়া হবেন? এরচেয়ে লজ্জা আর অপ*মান কিসে হতে পারে? আজ আকাশ ও যেন নাসিমা বেগমকে উপহাস করলেন। বিদ্রু*পের হাসি হেসে যেন বলছে “ভাঙনের কষ্ট তুমিও এবার উপলব্ধি করো”।

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৩

শুধু যে নাসিমা বেগমই আশ্চর্য হয়েছেন, তা নয়। বরং উপস্থিত সকলেই আনোয়ার হোসেনের কথায় স্তম্ভিত হলেন। উষার খা*রা*প লাগতে গিয়েও লাগছেনা। মনে হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা সঠিক শা*স্তি*টা*ই দিচ্ছেন। ওর মতো দয়ামায়াহীন, পাথর হৃদয়ের হতে ঊর্মি নিশ্চয়ই কোনদিন পারবেনা।

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৫