উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৫

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৫
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

প্রজ্জ্বলিত সুখের বাতি ধপ করেই নিভে গেলো। জীবন নামের আকাশে ঘন হয়ে এলো অন্ধকার। নিরোধ ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে অস্ফুট কাঁপা স্বর,
-“কী বলছো তুমি? এই বয়সে এসে এসব কি শোভা পায়?”

প্রত্যুত্তরে কোনরূপ কুণ্ঠাবোধ না করেই চোখেমুখে দৃঢ় অবজ্ঞার ছাপ ফেলে আনোয়ার হোসেন নিরেট গলায় বললেন,
-“প্রাপ্যটুকু গ্রহণ করা উচিত তোমার। পা*প যখন বয়স মানেনি, তবে শা*স্তি কেন বয়স মানবে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ঘন বর্ষার জল নামলো চোখে। অবিচল ধারায় কপোল গড়িয়ে চিবুক স্পর্শ করলো নাসিমা বেগমের। বয়সের ভারে তলিয়ে যাওয়া রুগ্ন শরীর নিয়ে কম্পিত কন্ঠে অনুরোধ জহুরা খাতুনের। তীব্র ক্রো*ধে*র সীমা পেরিয়েও সন্তানের ম*ন্দ চাইতে পারলেন না। মা হয়ে সন্তানের সংসার ভাঙা দৃশ্য মেনে নিতে চাইলেন না।
অনুনয় করে বললেন,

-“বাবা, সংসার ভাঙা কোন সমাধান নয়। তুমি অন্যভাবে শা*স্তি দাও নাসিমাকে।”
শাশুড়ির কথা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করলেন আনোয়ার হোসেন। নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দিলেন,
-“দয়া করে আমাকে অনুরোধ করবেন না আম্মা। আমি আপনার এই অনুরোধ রাখতে পারবোনা।”

রাহাত স্তব্ধ বনে গেলো। বাবা এমন একটা সিদ্ধান্ত কিভাবে নিতে পারলো? এতটা অবি*চার সহ্য করার পরও মায়ের এতবড় সর্ব*নাশ মেনে নিতে পারছেনা সে। এমনটা সে কখনোই চায়নি।
মাঝে শামীম বাবাকে বোঝাতে চাইলো,
-“বাবা, মায়ের সাথে এমনটা করা কি জরুরি? আদোও কি কোন সমাধান মিলবে? বরং আরও একটা মানুষ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।”

-“তুমি চুপ থাক শামীম। মায়ের হয়ে সাফাই গাইতে এসোনা। তোমাদের কারো টালবাহানা আমাকে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে হটাতে পারবেনা।”
ক্ষণকালের নিরবতার অবসান ঘটিয়ে মুখ খুললো রাহাত,
-“মায়ের সাথে এমনটা করোনা, বাবা।”
বিদ্রু*পের হাসি হাসলেন আনোয়ার হোসেন।

-“যে মায়ের জন্য আজ আমার কাছে অনুরোধ করছো, সেই মায়ের প্ররোচনায় পড়েই নিজের শা*ন্তি নষ্ট করেছো। সাথে নির্দো*ষ একটা মেয়েকে ক্ষ*ত*বি*ক্ষ*ত করেছো। তোমার মতো ছেলের লজ্জা হওয়া উচিত।”
মাথানিচু করে নিলো রাহাত। নাসিমা বেগমের টলমলে জলে পূর্ণ আঁখিদ্বয় তাকিয়ে রইলো ছেলের দিকে। এতটা অ*ন্যা*য়ে*র পরও মায়ের সংসার বাঁচাতে চাইছে। সুডৌল দেহের ছেলেটির মুখমণ্ডল বিবর্ণ, ম্লান হয়ে আছে। অল্পদিনেই সুঠাম দেহ নেতিয়ে পড়লো। এতটা বি*ষা*দ বুঝি দিয়ে ফেলেছেন! আজ ছেলের কাছে হাত জোড় করে ক্ষ*মা চাইলেন।

-“আমার করা অ*ন্যা*য় ক্ষ*মা*র অযোগ্য। কখনো যদি পারিস, মন থেকেই ক্ষ*মা করিস।”
জবাব দিতে পারলোনা রাহাত।
শামীম মায়ের মাথায় হাত রাখলো।
-“বাবার মাথা ঠান্ডা হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে মা। চিন্তা করো না।”
রোষানল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আনোয়ার হোসেন। বজ্র কন্ঠে হুংকার ছাড়লেন,

-“কিছু ঠিক হবেনা। এই মহিলা আজ বাড়ি না ছাড়লে, আমি বাড়ি ছাড়বো। এতটুকু নিশ্চিত থাক।”
রিয়া অনবরত কেঁদে চলেছে। বারবার বাবার কাছে হাত জোড় করেও লাভ হচ্ছেনা।
আনোয়ার হোসেনের শেষোক্ত উক্তিতে কেউই আর কিছু বলার সাহস পেলোনা।

বুকের বাঁ পাশটা অস্থির ভীষণ, ক্রমাগত হৃৎস্পন্দনের ব্যগ্র আচরণ। একফালি দুঃখ, একবুক হাহাকার নিয়ে বিদায়ের ঘন্টা বাজলো। টকটকে লাল চোখজোড়া কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। সময়ের সাথে নি*ষ্ঠু*র মানুষটির সাথেও নি*ষ্ঠু*র কান্ড ঘটলো। চূর্ণবিচূর্ণ হলো সমস্ত অহংকার। শেষ হলো সৌন্দর্যের দর্প। দাম্ভিকতা এক নিমেষেই উড়াল দিলো হাওয়ায় ভেসে। একটু একটু উপলব্ধি হলো সংসার ভাঙনের কষ্ট।

এ তো সংসার ভাঙা নয়! সারাজীবনের মায়া, ভালোবাসা, বিশ্বাস, ভরসা, সবকিছুই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া। ঊর্মির গোপন ব্যথা আজ ঝেঁকে ধরলো তাকে। অসহায় চোখজোড়া একবার নজর বুলিয়ে নিলো ভালোবাসায় গড়া মানুষগুলোর মুখপানে। নজর বুলিয়ে নিলো যতনে গড়া বাড়ির প্রতিটি কোণায় কোণায়। ভেতর থেকে কেবল দীর্ঘশ্বাস ভেসে এলো নাসিমা বেগমের।

দিশেহারা রিয়া শেষমেশ বড় আপাকে ফোন করে জানালো। বাবাকে আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে দেখতে চাইলো। মমতাময়ী মায়ের করুণ পরিণতিতে আৎকে উঠলো শান্তি। দ্রুত বাবার ফোনে ডায়াল করলো। বড় মেয়ের ফোন দেখেও তুললেন না আনোয়ার হোসেন। সবার উদ্দেশ্য তিনি এক নিমিষেই ধরে ফেললেন। কিছুতেই টলবেন না তিনি, পিছু হটবেন না। নিজ সিদ্ধান্তে অটল রইলেন।

গোপন চিৎকার বুকে চেপে বাড়ির চৌকাঠের বাহিরে পা রাখলেন। বুক কেঁপে উঠলো নাসিমা বেগমের। পেছনে ফেলে এসেছেন এক জীবনের সমস্ত আয়োজন, ভালোবাসা, গভীর মায়া। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণায় আত্মাহুতি দিতে চাইলেন। সন্তানদের অসহায় মুখ, ছোট মেয়েটার হৃদয়বিদারক কান্না সহ্য করতে পারলেন না তিনি। গাড়ির সিটেই গভীর নিদ্রায় শায়িত হলেন। জ্ঞানহীন শরীরটা নেতিয়ে পড়লো সিটের বাহিরে। আৎকে উঠলেন জহুরা খাতুন। সামনে থাকা ড্রাইভারের উদ্দেশ্য বললেন,

-“গাড়ি থামাও। তাড়াতাড়ি পানির ব্যবস্থা কর।”
নিষুপ্তিহীন এক একটি রজনি বিশাল সমুদ্রের ন্যায় বিস্তৃত। সময় যেন গড়িয়েও গড়াতে চায় না। নরম হৃদয়ে কাঠিন্যের বিস্তার যেন দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। রাহাতের মুখের দিকে তাকালেই ইচ্ছে করে তার কাছে ফিরে যেতে। উন্মুক্ত বক্ষে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে।

কিন্তু পরক্ষণেই মনটা কঠিন পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। মনে পড়ে যায় প্রতিটি মুহূর্ত তার কিভাবে কে*টে*ছে। তারচেয়ে বড় বি*ষা*দ অন্যকাউকে কত সহজেই জীবনে ঠাঁই দিয়ে দিলো। একের পর এক যখন অ*ন্যা*য় করে গেল, তখন তার কথা বিন্দু পরিমাণ মনে পড়েনি৷ যখন এগুলো মনে পড়ে তখনই রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে নি*ষ্ঠু*র*তা*র কঠিন বি*ষ।

তবে আজ কেন মানুষটির এত আ*ক্ষে*প, অনুনয়। নিজেকে আত্মসম্মান হীন করতেও দ্বিধাবোধ করছেনা। মনে হচ্ছে তাকে ফিরে পেতে সবচেয়ে নিচুস্তরে নামতে পারবে মানুষটি। কবে কাটবে অন্ধকার? আঁধার ডিঙিয়ে আলো ফুটবে, নতুন প্রহরে মিলবে প্রশান্তি!

দু’চোখ জুড়ে ঘুমের নে*শা। তবুও যেন আজ ঘুমেরা ধরা দিতে চাইছেনা। একটি ঘটনা বাড়ির প্রতিটি মানুষের মনে, মস্তিষ্কে কঠিন প্রভাব ফেলেছে। কপালে ডানহাত ঠেকিয়ে ভাবনায় মশগুল শামীম। পরম শান্তিতে তারই বুকে স্থান দখল করে আছে উষা। মনের আনাচে-কানাচে ফূর্তি। তবে ভাবখানা এমন যে, এরূপ ঘটনায় তার মনের আনন্দটুকুও গায়েব। প্রতি*শোধ এমন একটি জিনিস, যা ভালো মানুষের ভেতরেও হিং*স্রতাকে জাগিয়ে তোলে। শামীমকে অনেকক্ষণ যাবত ছটফট করতে দেখে উষা জিজ্ঞেস করলো,

-“ঘুমাচ্ছেন না কেন?”
শামীমের নিস্তেজ কন্ঠ,
-“ঘুম আসছেনা।”
-“আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ঘুমানোর চেষ্টা করুণ। যা হওয়ার, তাতো হবেই। আমরা কিছুই দমিয়ে রাখতে পারবোনা। সেই ক্ষমতা আমাদের নেই।”

উষার নরম হাতের চিকন আঙ্গুল গুলো বিচরণ করলো শামীমের চুলের ভাঁজে ভাঁজে।
মুদে রাখা নেত্রপল্লব দুশ্চিন্তায় অল্প অল্প নড়ে উঠছে। তপ্ত শ্বাস ঠে*লে বেরিয়ে এলো জীবনের প্রতি অভিযোগ।
-“আমাদের পরিবারটাই কেন এলোমেলো হতে হলো?”
হাত থেমে গেল উষার। মলিন হেসে বলল,

-“শুধু কি আপনার পরিবারটাই এলোমেলো হলো? আর কারো পরিবার চোখে পড়লো না? প্রতিনিয়ত আমার পরিবার কতটা কষ্ট, লা*ঞ্ছ*না সহ্য করেছে সেটা দেখলেন না। প্রতিবেশীরা বারবার সমবেদনা দিতে এসে খুঁচিয়ে র*ক্তা*ক্ত করতো আমার বোনকে। সমাজে একটি ডি*ভো*র্সি মেয়ের স্থান কোথায়, তাদের কেমন চোখে দেখা হয় সেটা হয়তো আপনি উপলব্ধি করতে পারেন নি। আপনার পরিবার কেন এলোমেলো হলো বলে অভিযোগ জানাতে পারলেন, অথচ কার জন্য এলোমেলো হলো সেটা জেনেও কেমন জানতে চাইলেন না।”

অদৃশ্য অভিমানের দেয়াল তুলে শামীমের বাহুবন্ধনী ছেড়ে বালিশে মাথা ঠেকালো উষা। পাশ ফিরে চোখ বন্ধ রেখেই বলল,
-“ঘুমানোর চেষ্টা করুণ। কাল অফিস আছে আপনার।”
নিজেদের মধ্যকার দূরত্ব বাড়তে দিতে চাইলোনা শামীম। দুহাত বাড়িয়ে পূর্বের স্থানে নিয়ে এলো উষাকে। গভীর স্বরে বলল,

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৪

-“এভাবেই ঘুমাবে।”
সরতে চাইলো উষা। বাঁধা দিলো শামীম। শক্ত হাতের থাবায় বেশিদূর যাওয়া হলোনা। অধর কোণে পড়লো গাড় চুম্বন। উষ্ণতা বাড়লো ভালোবাসার।

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৬