উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৬

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৬
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

শুরু হলো ঝড়বৃষ্টি। হু হু করে বাড়লো শীতের তীব্রতা। বাতাসের বেগে কনকনে ঠান্ডা। বিছানা ছেড়ে নামার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। কোমল পশমি কম্বলের ওমে মজে আছে উষা। পানি ছুঁয়ে দিলেই মনে হয়, বরফের তৈরি কা*টা*রি*র নিচে শরীর কা*টা পড়লো। তুমুল ঝড়বৃষ্টি, ঠান্ডার দিনেও বসে থাকার উপায় নেই। জীবিকার দায়ে বের হতে হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষদের।

বেশিক্ষণ শুয়ে থাকলোনা উষা। বাড়ির পরিস্থিতি ঠিক আগের মতো নেই। নাসিমা বেগম বাড়ি ছেড়েছেন দুদিন হলো। সবার খাবারদাবার, দেখাশোনার দায়িত্ব পড়লো তার আর লিলির উপর।
লিলি মেয়েটা নিরবে কাজ করে যায়। কারো সাথে কথা বলার আগ্রহ দেখায় না। কোন প্রশ্ন করলে হু হা উত্তর দেয়।
শামীমকে বিছানায় রেখেই উঠে পড়লো। ফজরের পর দুজনের হাঁটতে বের হওয়ার কথা থাকলেও অপ্রত্যাশিত ঝড়বৃষ্টিতে তা থেমে গেল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

একটুপর সবাই কাজের উদ্দেশ্যে বের হবে। রান্নাঘরে যাওয়াকেই শ্রেয় মনে করলো উষা। লিলিকে আগে থেকেই রান্নাঘরে দেখা গেলো। খুটখাট আওয়াজে কাজে হাত চালাচ্ছে। বাকি কাজে উষা হাত লাগালো।
-“সরি! তোমার পায়ে সেদিন ইচ্ছে করে পাতিল ফে*লি*নি আমি।”
আসবাবপত্রের টুকটাক শব্দ ছাড়া দুজনের মধ্যে কোন আলাপ হলোনা। আকস্মিক লিলির দিক থেকে সরি শুনে কিছুক্ষণ থম ধরে ছিলো উষা। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,

-“ঠিক আছে। সমস্যা নেই।”
আর কথা হলোনা। আবারও পুরোদমে কাজ চললো। ইচ্ছে না থাকা স্বত্বেও সবার সবটা নিয়মমাফিক চলছে। চলছেনা শুধু রিয়ার। আশেপাশে সবাই থাকলেও মায়ের মতো কাউকে মনে হয়না। শত আদর যত্নের পরও মা মা গন্ধ পাওয়া যায়না। মা যতই খা*রা*প হোক, সবচেয়ে কঠিন সত্য তিনি একজন মা। সবাইকে খাবার দিয়ে রিয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল উষা। তাকে এখানে সবার খাবারের দিকটা দেখাশোনা করতে দিয়ে রিয়ার জন্য খাবার ট্রে নিয়ে গেলো লিলি। বলা যায় একপ্রকার মুখ লুকানো। সে এখন চেষ্টা করে যেন রাহাতের মুখোমুখি না হতে হয়।

হিমশীতল ঠান্ডার মাঝেও বিছানার পাশের জানালা খুলে রেখেছে রিয়া। ঠান্ডার প্রকোপে শরীর কাঁটা দিয়ে উঠেছে। লিলি তড়িঘড়ি করে জানালা বন্ধ করে দিলো। ধ্যান ফিরলো রিয়ার। জানালা থেকে মুখ ঘুরিয়ে লিলির দিকে তাকালো। লিলি বলল,
-“এত ঠান্ডার মাঝে এভাবে জানালা খুলে বসে আছো কেন? অসুস্থ হয়ে পড়বে তো।”
তপ্ত শ্বাস ছাড়লো রিয়া। খাবারে ট্রে-তে নজর বুলিয়ে দুর্বল গলায় বলল,

-“এখন খেতে ইচ্ছে করছেনা। খাবার নিয়ে যাও।”
লিলি জোরগলায় বলল,
-“ইচ্ছে করছেনা মানে কী? এমনিতেই তোমাকে ভীষণ দুর্বল দেখাচ্ছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।”
-“ভালোলাগছেনা।”
লিলি দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল,
-“আমি খাইয়ে দিই?”

তাকিয়ে রইলো রিয়া। কত আদরযত্ন, ভালোবাসা। আহা! অথচ মায়ের মতো প্রশান্তিটা কোথাও নেই। মায়ের ঝাঁঝালো গলার স্বরও মধুর মনে হয়। হাজার বকা*বকির পরও বে*হা*য়া*র মতো হাসতে ইচ্ছে করে।
মা কিংবা বাবার অনুপস্থিতি ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা একটু বেশি উপলব্ধি করে। আল্লাহ হয়তো মেয়েদের ভেতর আবেগ জিনিসটা একটু বেশিই দিয়েছেন। তার উপর অবিবাহিত মেয়ে, যাদের সীমা থাকে বাবা-মা পর্যন্তই।

শান্তির মতো বিবাহিত হলে হয়তো সাংসারিক কাজের ভীড়ে বি*ষ*ন্ন*তা একটু হলেও কম অনুভব হতো। লিলি খাবার মুখের সামনে ধরলো। রিয়ার একদমই ইচ্ছে করলোনা খেতে। মুখ ফিরিয়ে নিলো সে। লিলি হঠাৎ খেয়াল করলো রিয়ার ডান গালে কানের বাঁ পাশে সাদা রঙের কোন একটা দাগ দেখা যাচ্ছে। ভালোভাবে নজর দিতেই বুঝতে পারলো এটা যেন-তেন দাগ নয়। শরীরের অন্যান্য অংশের তুলনায় জায়গাটি অনেক বেশিই সাদা। লিলি চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,

-“তোমার গালে এটা কিসের দাগ? গলায়ও দেখছি আছে। কতদিন থেকে?”
সেদিন ব্যাপারটা হে*লা*ফে*লা করলেও কয়েকদিন যাবত চেহারায় নজর দেওয়া হয়না। বিছানা ছেড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো রিয়া। পূর্বের তুলনায় অনেকটাই বড় দেখাচ্ছে দাগগুলো। কপাল কুঁচকে বলল,
-“অনেকদিন থেকেই দাগগুলো লক্ষ করেছি। ভেবেছি পড়াশোনার প্রেশার, পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ায় হয়তো কোন প্রবলেম দেখা দিয়েছে। এখন দেখছি দাগগুলো বড় হচ্ছে৷”

-“যেহেতু অনেকদিন থেকেই দাগ খেয়াল করেছো, একজন স্কিনের ডাক্তার দেখানো উচিত তোমার।”
আকস্মিক মুঠোফোনের শব্দে দুজনেই সেদিকে নজর দিলো। রিয়ার পারসোনাল ফোন ভেবে লিলি বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে বলে গেল খাবার যেন খেয়ে নেয়।
তানভীরের ফোন। টুকটাক কথা বলার পরই একটা সিরিয়াস ব্যাপারে কথা বলতে চাইলো সে। লিলি সম্মতি দিলো।
-“বলো।”

মুঠোফোনের ওপাশ থেকে তানভীর বলল,
-“বাসা থেকে বিয়ের জন্য প্রেশার দিচ্ছে। যথেষ্ট বয়স হয়েছে আমার। আমি তোমার কথা বলেছি বাসায়। বাবা-মা তোমাদের বাসায় আসতে চাচ্ছেন।”
-“এখন সম্ভব না, তানভীর। আমার পরিবারের অবস্থা এই মুহূর্তে খুব একটা সুখকর নয়। তুমি আরও কয়েকমাস সময় নাও।”
তানভীর পাল্টা প্রশ্ন করলো,

-“কী হয়েছে তোমার বাসায়? কয়েকদিন ধরেই মন ম*রা দেখাচ্ছে তোমায়।”
দীর্ঘশ্বাস ফে*ল*লো রিয়া। পরিবারের সব বিষয়ে সব সময় সবার সাথে খোলামেলা আলোচনা করা যায়না। হয়তো রিয়ার দিক থেকে আলোচনা করতে কোন সমস্যা নেই, সে তানভীরকে চেনে। কিন্তু তার পরিবারের জন্য তানভীর সম্পুর্ণ এক অচেনা লোক। বাইরের লোকের কাছে নিজেদের পরিবারের ঝা*মে*লা নিয়ে আলোচনা করা নিশ্চয়ই কেউ পছন্দ করবে না। তাই ব্যাপারটা চেপে গিয়ে বলল,

-“পারিবারিক সমস্যা,একেবারেই ব্যক্তিগত।”
তানভীরও আর চাপাচাপি করলোনা। বলল,
-“তুমি একটু চেষ্টা করো। অনেক কষ্টে বাসায় তোমার ব্যাপারটা মেনেজ করেছি। বাবা-মা এখন আসতে চাচ্ছেন। তাদের মত বদলাতে দেরি করবেন না। অলরেডি আমাকে না জানিয়ে মেয়েও পছন্দ করে বসে আছে।”

ধক করে উঠলো ভেতরটা। সব বি*ষা*দ কেন একসাথে ছুঁতে চায়? মা কাছে নেই। পরিবারের উপর প্রচুর ঝড়ঝাপটা যাচ্ছে। তার উপর তানভীরকে হা*রা*বে কিভাবে? হয়তো সব ক্ষ*ত একত্রে দগ্ধ হয়ে মা*রা পড়বে রিয়া। হুট করে শব্দ করেই কেঁদে ফেললো সে। হতবুদ্ধি হয়ে গেলো তানভীর। কিছুটা সময় নিয়ে বলল,
-“বিয়েটা হয়ে যাচ্ছেনা, রিয়া। বাসায় আমি তোমার কথা বলে দিয়েছি। বাকিটাও মেনেজ করে নেবো। কাঁদছো কেন বো*কা মেয়ে।”

কান্নামাখা গলায় রিয়া বলল,
-“আমার এখন একটুও কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা, তানভীর।”
মেনে নিলো তানভীর। “কান্নাকাটি করো না, আমি সবটা সামলে নেবো” বলে লাইন কে*টে দিলো।
ছেলেটাকে খুবই বো*কা মনে হলো রিয়ার। সে বলল আর কত সহজে মেনে গেলো। সব সময়ই তার কথাকে প্রাধান্য দেয়। অথচ বো*কা ছেলেটি তাকেই বো*কা বলে আখ্যা দিলো। কোথাও একটা পড়েছিল “বো*কা*রা প্রচুর ভালোবাসতে জানে”।

সময়ের কাঁটা রাত্রি আট এর ঘর পেরিয়েছে। সারাদিনের ঝুম বৃষ্টির পর আকাশ এখন অনেকটা শান্ত। তবে শীতের প্রকোপ কমলোনা। বরং ধীরে ধীরে বাড়লো। শরীরে একটা পাতলা শার্ট আর শীত নিবারণের চেষ্টায় একটা জ্যাকেট জড়িয়ে আছে রাহাত। ঊর্মির বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলো। চোখদুটো গ্রিলে আবদ্ধ বারান্দায় আটকে আছে। অথচ মেয়েটার দেখা মিলছেনা। প্রতিদিন এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে, অতঃপর নিরাশ হয়ে বাড়ি ফেরে।

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামলো, প্রতিটি বৃষ্টি কণা শরীর ভেদ করে হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। ঘন্টা দুয়েক দাঁড়িয়ে থেকে বাসায় ফিরতে যাচ্ছিলো রাহাত। হুট করেই বারান্দায় একটি অবয়ব দেখে থেমে গেলো। দৃষ্টি আটকে গেলো আবছায়া মানবীর ওপর। স্পষ্ট তাকে দেখা যাচ্ছেনা, তবে অবয়ব বলছে সে ঊর্মি। তৃষ্ণার্ত চোখজোড়ার নড়চড় হলোনা। ইতিমধ্যে ঠান্ডায় কয়েক দফা হাঁচি দেওয়া হয়ে গিয়েছে।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজেকে আড়াল করার বৃথা চেষ্টা আজ আর করলোনা ঊর্মি। এক দৃষ্টে বৃষ্টি দেখে গেলো। বৃষ্টি দেখলো বললে ভু*ল হবে, দেখে গেলো এক সময়ের নিজের পাওয়া মানুষটিকে। সরাসরি তাকালো রাহাতের দিকে। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রাহাতকে। টপটপ বৃষ্টির পানি চোয়াল গড়িয়ে বুক পযন্ত ভিজিয়ে দিচ্ছে, ভিজিয়ে দিচ্ছে পুরো শরীর। ফোন হাতেই ছিলো ঊর্মির। স্ক্রিনে আঙ্গুল চালিয়ে ফোন কানে তুললো।

বিকট শব্দে ফোন বেজে ওঠায় ঘোর কাটলো রা*হা*তে*র। পকেটে পড়ে ফোন ভিজে যাচ্ছে। সেই খেয়ালটুকু তার নেই। ঊর্মির ফোন পেয়ে আশার আলো দেখলো। কিন্তু পরক্ষণেই হ*তা*শ হতে হলো তাকে।
দৃষ্টি রাহাতের উপর আবদ্ধ রেখেই কানে ফোন তুলে ঊর্মি বলল,
-“এভাবে ঝড়বৃষ্টির মাঝে আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মানে কী? আপনি বুঝতে পারছেন না কেন? আমি ফিরতে চাইনা।”

অন্ধকারে অবয়ব দেখা গেলেও মুখমণ্ডল স্পষ্ট নয় ঊর্মির। তাই মুখভঙ্গি বোঝা গেলোনা। তবে রাহাত আন্দাজ করে নিয়েছে যথেষ্ট কঠিন করে রেখেছে মুখশ্রী। কন্ঠেই স্পষ্ট প্রমাণ পাচ্ছে সে। রাহাত মলিন কন্ঠে বলল,
-“এতটা কঠিন কিভাবে হয়ে গেলে? মনে আছে? একদিন বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফেরার পর তুমি কতটা ক্ষে*পে ছিলে আমার ওপর! আগ বাড়িয়ে চুল মুছে দিলে, শুকনো জামা বের করে দিলে, ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ এগিয়ে দিলে।
কিন্তু কথা বললে না, অভিমানে গাল ফুলিয়ে রেখেছিলে। ভালো নাই বা বাসো, এখনো কি আমার প্রতি সেই মায়া অনুভব করো?”

চোখ বুঁজে ফেললো ঊর্মি। নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা চালিয়ে কঠিন গলায় বলল,
-“সেগুলো অতীত ছিলো। বর্তমানে এমন কিছুই প্রত্যাশা করিনা আমি।”
পরপর কয়েকটা হাঁচি দিলো রাহাত। ঊর্মি বলল,
-”বাসায় যাচ্ছেন না কেন? আমি কিন্তু বাবাকে ডাকতে বাধ্য হবো। রাতভর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আমায় বিরক্ত করছেন আপনি?”

-“তুমি থেকে আপনি হয়ে গেলাম? এতটা ঘৃ*ণা?”
-“সম্পর্কহীন মানুষগুলো সব সময় অপরিচিতই থাকে। আপনিও আমার কাছে অপরিচিত।”
-“শীঘ্রই আমরা পরিচিত হবো।”
এই বলে বাড়ির পথে পা বাড়ালো রাহাত। এভাবে চলতে দেওয়া যায়না। গলায় কাঁটা বিঁধলে যেমন হয়, তেমন পরিস্থিতিতে আছে সে। না পারছে গিলে ফেলতে, না পারছে উগলে দিতে।

-”আমি একবার বাড়ি যেতে চাই।”
শুকনো কাপড় ভাঁজ করতে করতেই বলল উষা।
গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলো শামীম। উষার কথায় চমক কা*ট*লো। বলল,
-“আচ্ছা, কবে যেতে চাও। আমি নিয়ে যাবো।”
-“কালই যেতে চাই। দুদিন থাকবো আমি।”
বিরোধিতা করে বলে উঠলো শামীম,

-“সম্ভব নয়।”
উষা ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো,
-“কেন সম্ভব নয়?”
-“একা বিছানায় আমার ঘুম হয়না।”
কুঁচকানো ভ্রু জোড়া শীতল হলো। মৃদু রা*গ নিয়ে বলল,
-“বিয়ের আগে কিভাবে ঘুমিয়েছেন?”
-“তখন ভিন্ন ব্যাপার ছিলো। বউ না থাকলে তো তখন বউ ভাড়া করে আনা যেত না। এখন বউ থেকেও কেন ব্যাচেলর জীবন পার করবো?”

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৫

অনুরোধ করলো উষা।
-“প্লিজ! সবার কথা খুব মনে পড়ছে।”
উষার কোমল মুখে তাকিয়ে রাজি হলো শামীম।
-“ঠিক আছে। তবে একদিনের বেশি নয়।”
প্রফুল্লচিত্তে শামীমের কপালে অধর ছুঁইয়ে দিলো উষা।

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৭