উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৭

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৭
জিন্নাত চৌধুরী হাবিবা

কালরাতে বৃষ্টিতে ভেজায় দলবেঁধে শরীরে জ্বর হানা দিয়েছে। এখনো মাথাটা ভীষণ ভার লাগছে, শরীর ব্যথায় ম্যাজ ম্যাজ করছে। কোনোভাবে নাস্তা করে অসুস্থ শরীর নিয়েই বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো রাহাত। আনোয়ার হোসেন চুপচাপ বাড়ি আসছেন, আবার চুপচাপ বেরিয়ে যাচ্ছেন। শামীম নাস্তার টেবিলে বাবার উদ্দেশ্য বলল,

-“বাবা, উষা ওদের বাড়িতে দুদিন থেকে আসবে।”
-“দিয়ে এসো।”
গম্ভীর স্বরে জবাব দিলেন আনোয়ার হোসেন। আর কথা বাড়তে দিলেন না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

উষাকে নামিয়ে দিয়ে আর অফিস গেলোনা শামীম। সোজা মায়ের সাথে দেখা করতে গেলো। প্রথমদিন থেকেই মায়ের সাথে যোগাযোগ আছে তার। তিনি নিজের ভু*ল বুঝতে পেরেছেন, এটাই বা ক’জন বোঝে! সে শুধু পরিস্থিতি ঠান্ডা হওয়ার অপেক্ষায় আছে। বাবার ওপর এখন কিছু বলা যাচ্ছেনা। সবটা ঠিকঠাক হলেই মাকে তার পূর্বের জায়গায় ফিরিয়ে আনবে। বাবা রা*গে*র মাথায় কাজটা করলেও তাকে চেনা আছে শামীমের। মাথা ঠান্ডা হলেই সহজ সমাধানে আসবেন তিনি।
নাসিমা বেগম ছেলের সাথে যোগাযোগ রাখলেও নিজের সেদিনের অসুস্থতার কথা চেপে গেলেন। সবাইকে আর দুশ্চিন্তায় ফে*ল*তে চান না।

নানার বাড়িতে গিয়ে খানিকটা অবাক হলো শামীম। মায়ের সাথে শান্তি আপা কথা বলছেন। নিশ্চয়ই মাকে দেখতে এসেছেন। শামীম মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-“কেমন আছো আপা?”
শান্তির শান্ত জবাব,
-“ভালো, তুই কেমন আছিস?”
বসতে বসতে শামীম জবাব দিলো,
-“হুম, ভালোই। কখন এসেছো?”
-“ঘন্টাখানেক হবে।”

মা বোনের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে ওয়াশরুমের দিকে গেলো শামীম। সেখান থেকে ফিরে দেখলো মামাতো ভাইয়ের বউ নাস্তা নিয়ে এসেছে। তাকে দেখেই সালাম দিলো।
সালামের উত্তর দিয়ে মাকে উদ্দেশ্য করে শামীম বলল,
-”একা থাকতে পারবে, মা? তোমার জন্য একটা বাসা দেখবো, আমি মাঝেমধ্যে যাবো। রিয়াকেও কিছুদিনের জন্য তোমার কাছে পাঠিয়ে দেবো।”
নাসিমা বেগম অবাক হয়ে জানতে চাইলেন,

-“বাসা দেখবি মানে?”
মামাতো ভাইয়ের বউ বলল,
-”আমাদের এতবড় বাড়ি থাকতে ফুফি অন্য বাসায় থাকবে কেন, ভাইয়া? এটা তো ফুফির নিজেরই বাড়ি।”
তাচ্ছিল্য হাসলো শামীম। কারো দৃষ্টিগোচর হলোনা। কন্ঠে স্বাভাবিকতা বজায় রেখেই বলল,
-“মা এখানে থাকলে অনেকেই ঝা*মে*লা*য় পড়তে পারে। বাড়ির প্রাইভেসি নষ্ট হতে পারে। এই যে, যখন-তখন আমি, আপা, রিয়া, যেকেউ মায়ের সাথে দেখা করতে চলে আসছি। এটা কিন্তু কিন্তু মোটেই ভালো দেখায় না।”

শামীমের মামাতো ভাইয়ের বউ খানিকটা থতমত খেয়ে বলল,
-“নাস্তা করুন ভাইয়া। আমি চুলায় রান্না ফে*লে এসেছি।”
শান্তি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
-“কী হয়েছে বলতো? এমনভাবে কথা বলছিস কেন?”
-“ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় শুনতে পেলাম মা এই বাড়িতে থাকায় ভাবিদের খুবই প্রবলেম হচ্ছে। বাড়তি একজন লোকের কাজ বেড়েছে। যখন-তখন আমরা আসায় প্রাইভেসি নষ্ট হচ্ছে।”

দীর্ঘশ্বাস ফে*ল*লে*ন নাসিমা বেগম। উনি এই বাড়িতে আসার প্রথমদিন সব ঠিকঠাক চললেও বিপত্তি ঘটলো পরদিন। সবাই যখন জানলো তিনি একেবারেই এবাড়িতে চলে এসেছেন তখন থেকেই সবটা বদলে গেলো। আগের মতো যত্নআত্তি চললোনা। ভাইপো বউয়েরা উনাকে শুনিয়ে শুনিয়েই নিজেদের মধ্যে আলাপ করছে “বুড়ো বয়সে এদের পেছনে কে খাটবে? আল্লাহ না করুক যদি অবস হয়ে ঘরে ঢুকে যায়, তখন সব পরিষ্কার করবে কে? সব আ*প*দ ঘাড়ে এসে উঠছে। বাবা যে কী করেন না? ছেলে বউয়ের পেছনে প্যাঁচ লাগিয়ে এসেছে। আমাদের শান্তি দেবে না-কি?”

সেদিনই বুঝে গেলেন নাসিমা বেগম এ জগতে কেউ কারো আপন নয়। আগে ফুফি বলে জান দিতো, আর বি*প*দে পড়তেই মু*খো*শ পাল্টে গেল। খুব একটা আফসোস করতে পারলেন না তিনি। মনে পড়ে গেলো, নিজেও তো বি*প*দে*র সময় ঊর্মিকে আসল রূপ দেখিয়েছেন। এখন শামীমের কথা অনুযায়ী নতুন বাসায় উঠলে নানান কথা হতে পারে বাড়িতে। তাই শামীমকে থামিয়ে বললেন,

-“ঝোঁ*কের মাথায় বলে ফেলেছে হয়তো। এমনি আমার সাথে খা*রা*প ব্যবহার করেনা।”
শান্তি মুখ অন্ধকার করে বলল,
-“যত যাই বলো, মা। শামীম যা বলছে, তাই করো। এখন আড়ালে বলছে, দুদিন পর সামনাসামনি বলবে তোমায়।”
কথা ঘুরিয়ে দিলেন নাসিমা বেগম।
-“তোদের নানু একা মানুষ। মায়ের কাছে থাকতে ভালোই লাগছে। অন্য বাসায় উঠলে একা একা দিন কা*ট*বে না আমার।”

শামীমের নির্লিপ্ত জবাব,
-“এখানে থাকতে চাইছো, থাকো। আমি তোমার খাবার খরচের টাকা দিয়ে দেবো। তাছাড়া বেশিদিন থাকতে হবেনা তোমায়।”

অনেকদিন যাবত বিভিন্ন হুজুর দের কাছে হাঁটাহাঁটি করেছে রাহাত। তাদের মসজিদের ইমাম একজন আলেমের সন্ধ্যান দিলেন। যিনি বিস্তারিত বর্ণনা করে সঠিক তথ্য দিতে পারেন তা*লা*কে*র ব্যাপারে। বহু কষ্টে সেই আলেমের কাছ থেকে একঘন্টা সময় চেয়ে নিয়েছে। রাহাত নিজে জানলে তো চলবেনা, সবাইকে জানতে হবে ভেবে বাবাকে ফোন করে ঊর্মিদের বাসায় যেতে বলল। সে এখান থেকে হুজুরকে সঙ্গে নিয়ে যাবে।
ঊর্মিদের বাসায় যাওয়ার কারণ জানতে চাইলেন আনোয়ার হোসেন। রাহাত বলল,

-“গেলেই জানতে পারবে। এক ঘন্টার মাঝে উপস্থিত হবে।”
ছেলে আবার কী কান্ড করতে চলেছে এই ভেবে বেয়াইয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন আনোয়ার হোসেন।
বাড়িতে আনোয়ার হোসেনকে দেখে মোটামুটি সবাই অবাক হয়েছে। কেননা, সকালেই উষা এসেছে। তার শশুর আসবে এই কথা তো সে বলেনি!
উষা বলল,

-“বাবা, সকালে বললেন না কেন আপনি আসবেন?”
-“মেয়েদের দেখতে বাবার আবার বলে আসতে হয়?”
উষা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল,
-“আমি সেটা বলিনি, বাবা।”
উষা মায়ের সাথে রান্নাঘরে ঢুকলো। তানজিনার শরীর কিছুদিন যাবত অসুস্থ। উষা ভেবে রেখেছে আনোয়ার হোসেনকে বলে আর কিছুদিনের সময় নেবে। ঊর্মি, তানজিনা দুজনই অসুস্থ। মা একা হাতে সব সামলে উঠতে পারবেনা। সে থাকলে মায়ের কিছুটা উপকার হবে।

আনোয়ার হোসেন ঊর্মির ঘরের দরজায় নক করলেন।
-“ঊর্মি মা, আসবো?”
বসেই ছিলো ঊর্মি। আনোয়ার হোসেনের গলা শুনে তড়িঘড়ি করে মাথায় কাপড় টে*নে নিলো। বলল,
-“আসুন বাবা।”

টুকটাক কথাবার্তা বলে ঊর্মির মাথায় হাত রাখলেন আনোয়ার হোসেন। কোমল গলায় বললেন,
-“রাহাত আমাকে এখানে আসতে বলেছে। জানিনা আজ আবার সে কী করতে চলেছে। তুমি মন থেকে যা চাও, তাতে অটল থাকবে। না পরিবারের চা*প মানবে আর না রাহাতের পা*গ*লা*মি*তে সায় দেবে। তুমি যেটা চাও, সেটাই করবে। তোমার নিজের জন্য, নিজের প্রশান্তির জন্য। ছোট্ট এই জীবনে মাঝেমাঝে নিজের জন্য স্বার্থ*পর হতে হয়। তুমি ছাড়া তোমার ইচ্ছের মূল্য কেউ দিতে চাইবেনা। সবাই তাদের নিজ নিজ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাইবে।”

রাহাত আবার কী করতে চাইছে? খানিকটা ভ*য় ঢুকে গেল ঊর্মির মনে। আনোয়ার হোসেন ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলেন। মোস্তফা সাহেবের সাথে গল্পগুজবে মন দিলেন। আধঘন্টা সময় এভাবেই কে*টে গেলো।
ঊর্মি আর আনোয়ার হোসেনের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রাহতের দেখা মিললো। সাথে একজন হুজুর দেখা যাচ্ছে। ড্রয়িংরুমে মেয়েদের যাতায়াত কম থাকায় সুবিধা হলো বেশ। হুজুরকে সাথে নিয়ে সেখানেই বসলো রাহাত। মোস্তফা সাহেব প্রথমে রাহাতের আগমনে ভ্রু কুঁচকালেও পরক্ষণে নড়েচড়ে বসলেন। পাশে হুজুর দেখেই জানা হয়ে গিয়েছে রাহাত কী প্রমাণ করতে এসেছে। তিনি রাশভারি গলায় বললেন,

-“এখন আবার কী করতে চাইছো তুমি?”
-“আপনি তো সেদিন শরিয়তের দিক থেকে সমাধান চেয়েছেন। আমি সেই ব্যবস্থাটুকু করলাম। যদি শরিয়ত বলে আমাদের মাঝে সম্পর্ক সম্ভব নয়, আমি চিরদিনের মতো সরে যাবো। আর যদি শরিয়ত বলে আমরা পূর্বের মতো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে থাকতে পারবো, তবে আমি কোনভাবেই আমার স্ত্রীকে ছা*ড়*বো*না।
ঊর্মি সহ সবাইকে আড়ালে বসতে বলুন বাবা। ঊর্মির সবটা জানা উচিত।”
মোস্তফা সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন,

-“ঠিক আছে। তবে তোমার কথাই মানলাম। নিজের কথায় অটুট থেকো।”
তিনি মনে মনে শতগুণ নিশ্চিত রাহাত আর ঊর্মির সম্পর্ক পূণরায় সম্ভব নয়।
উষা, ঊর্মি, তার মা সহ তানজিনাকে আড়ালে বসতে বলা হলো। ঊর্মি, রাহাত দুজনের ভেতরেই তোলপাড় চলছে। হৃৎযন্ত্রের ধুকপুকানি ক্রমশ বেড়ে চলেছে। তাদের ভবিষ্যৎ কী?

রাহাত উপরে স্বাভাবিক থাকলেও ভেতরে ভ*য় ঢুকলো। বলে তো দিল যা সিদ্ধান্ত হয় মেনে নেবে, সিদ্ধান্ত তার অনুকূলে না থাকলে আদোও কী মেনে নিতে পারবে সে?

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৬

(আমি একটু অসুস্থ। তাছাড়া আগামী পর্ব গোছাতে একটা দিন সময় লাগবে। আগামী পর্ব পরশুদিন আসবে।)

উষাকালে ঊর্মিমালা পর্ব ১৮