এই অবেলায় তুমি পর্ব ৩৬

এই অবেলায় তুমি পর্ব ৩৬
Sabihatul Sabha

সময় আর স্রোত কারো জন্য থেমে থাকে না।
আজ একমাস হলো আদি না কারো কাছে ফোন দিয়েছে আর না বাড়িতে এসেছে।
রুহিকে দেখলে এখন কেউ ভালো করে চিনবে না। কেমন যেনো নিশ্চুপ হয়ে গেছে। দরকার না পরলে বাড়তি একটা কথাও বলে না চোখের নিচে কালো কালি পরে গেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাসার কাজে হাত লাগায় যতটুকু পারে করার চেষ্টা করে। আবার কলেজ যাওয়া শুরু করেছে। পড়াশোনা ছাড়া সামনে ওর ভবিষ্যত অন্ধকার সে দেখতে পাচ্ছে। শুধু নূরের সাথে সম্পর্ক এখনো ঠিক হয়নি। সে এখনো নূরকে একটু ও সয্য করতে পারে না। তবে সেটা বুঝতে দেয় না কাউকে নিজের মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখে নিজের রাগ,আর নূরের প্রতি এক আকাশ সমান ঘৃণা। আজ ওর জীবনের এই পরিনতির জন্য সে নূর কে দায়ী করছে।

নীল বাসায় এসেই ওর মেঝো মামীর সাথে দেখা করে। উপরে নূরের রুমের দিকে গেলো বাইকের চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে নূরের রুমের সামনে গিয়ে দরজায় টুকা দিলো।
নূর দরজার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো,’ বা বাহ্ অনেক ভদ্র হয়ে গেছিস দেখছি। বড় ভাইয়ের বউ মানে ভাবির দরজায় যে নক করে ঢুকতে হয় এত দিনে এসে শিখলি। যাক তোর পড়াশোনা এত দিনে সার্থক হলো।
নীল রুমে ঢুকেই মুখ ভেংচি কেটে বললো,’দেখ তোকে আমি জীবনও ভাবি বলতে পারবো না৷ আর রইলো ভাবি বলে নক করা একদমি না। আমি তো নক করেছি ছোটো বোনের রোমাঞ্চ তো আর বড় ভাই হয়ে সব সময় দেখতে পারি না। তোরা যেই ভাবে যেখানে সেখানে রোমাঞ্চ শুরু করছোস তোদের না হয় লজ্জা নেই কিন্তু আমার তো লজ্জা প্রচুর তাই নক করে ঢুকলাম।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নূরঃ নীলের বাচ্চা আমার সামনে থেকে সর। আর আমাকে সম্মান দিয়ে কথা বলবি। আপনি করে বলবি, ভাবি বলে ডাকবি…লজ্জাবতী গাছ হতে আসছে ইসস দরলেই যেনো লজ্জায় মিয়িয়ে যাচ্ছে।
নীলঃ ইসস্ রে তোরে দেখলে পুরাই শাঁকচুন্নিদের মতো লাগে। আর যাই বলিস ভাবি এত সুন্দর ডাকটা তোর সাথে যায় না। আর আমি এখনো বিয়ে করি নাই বাচ্চা পাইলি কই??
নূরঃ তোর থেকে সুন্দর আছি…
নীলঃ হিহিহি তাই তো। আয়নার মধ্যে দেখ।

নূর সত্যি সত্যি আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা শুরু করলো।
নূরের অবস্থা দেখে নীল হাসতে হাসতে পেটে হাত দিয়ে গিয়ে খাটের মধ্যে বসলো।
নূরঃ ব*দ*মা*শ ছেলে।
নীলঃ আচ্ছা সব বাদ এখানে আয় তোর জন্য গিফট নিয়ে এসেছি।
নূর ভ্রু কুঁচকে তাকালো। যে ছেলের কাছ থেকে এক কানাকড়ি ও নেওয়া যায় না। সে না-কি ওর জন্য গিফট এনেছে ভাবা যায়।

নীলঃ কি হলো আয়।
নূর সামনে গিয়ে খুশিতে আগের ঝগড়াঝাটি ভুলে হাত বাড়িয়ে দিলো।
নীল ওর হাতে মধ্যে টিকটিকি ছেড়ে দিলো।
নূরের চিৎকারে বাসার সবাই ওর দরজার সামনে।
নূর হাত জারছে আর এখান থেকে লাফ দিয়ে ওখানে যাচ্ছে আর চিৎকার করে বলছে এটা সরানোর জন্য।
নূরের অবস্থা দেখে নীল হাসতে হাসতে খাটে ঘরাঘরি খাচ্ছে।

টিকটিকি দেখে ভয়ে আদিবা সামনে এগুচ্ছে না। তবে নীলকে বলছে এটা ওর কাছ থেকে সরানোর জন্য। বাসার বাকি সবাই রাবেয়া আন্টির বাসায় গেছে। রুহি নিজেও টিকটিকি আরশোলা দেখলে ভয় পায়।
নীল উঠে এসে ওর সামনে থেকে টিকটিকি হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো।
নীলঃ আরে থাম এটা রবার্টের টিকটিকি।

তবুও নূর ভয়ে বললো,’ নীল ভাই আমার, দেবর আমার এটা বাহিরে ফেলেদে প্লিজ।
নীল নূরের দিকে তাকিয়ে বাহিরে ছুড়ে ফেললো টিকটিকি। আর দরজায় যেহেতু আদিবা আর রুহি ছিলো৷
টিকটিকি গিয়ে পরলো রুহির চুলের উপর। বেচারি ভয়ে একদফা নাগিন ডান্স দেওয়া শেষ।
নিজের বোনের এমন ডান্স দেখে নীল তো হাসতে হাসতে আজ ওর অবস্থা খারাপ।
রুহির কাহিনি দেখে নূর আর আদিবা ও হেসে দিলো।
রুহি সবার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিচে চলে গেলো৷ সবাই একটু অবাক হলো রুহির আচরণে। রুহি তো এতক্ষনে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলার কথা সে-ই মেয়ে কি না। কিছু না বলে এভাবে চলে গেলো।
আদিবা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
নূর রাগী লুকে ওর দিকে তাকালো।

নীলঃ ওফ্ফ এভাবে তাকাইস না নূর একদম ডাইনী পিশাচিনীদের মতো লাগে। আমার মতো একটা ভদ্র ছেলেকে ভয় দেখাতে তোর খারাপ লাগছে না।
নূরঃ তোকে এখন ঘার মটকাতে পারলে আমি শান্তি পেতাম। কেনো আসছোস সেটা বল??
নীলঃ ওহ এখন তো এখানে আসতে হলে আপনার অনুমতি নিয়ে আসতে হবে মেডাম। বাড়ির ছোট বউয়ের কথায় তো চলতে হবে।

নূরঃ ডং বন্ধ করে সত্যি করে বল উদ্দেশ্য কি??
নীলঃ ছি! নূর ভাই বোনের কাছে আসবে আবার উদ্দেশ্য কি! বুকে হাত দিয়ে বললো কষ্ট পেলাম..
নূর বিরবির করে বললো, ‘ নাটক বাজ একটা। জীবনেও কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া আমার কাছে আসবে না। আজ আসছে ভাই গিরি দেখাতে।

নীলঃ বিরবির না করে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেই তো হয়।
নূরঃ দেখা শেষ। বোনকে দেখতে আসছিস দেখা শেষ। এবার বের হ..
নীলঃ তুই আমাকে অফমান্স করলি??
নূরঃ এটা অপমান হবে। আচ্ছা ভালো করছিস আসছোস। তোর বাইক আনছিস??
নীলঃ হুম কেনো??
নূরঃ চাবিটা দেখি তো কেমন??
নীলঃ চাবি দেখার কি আছে?
নূরঃ আরে আমার চাবিটার মতো কিনা দেখি..

নীল চাবি সামনে ধরতেই নূর চাবিটা হাতে নিয়ে বললো,’ তুই আমার রুম পাহাড়া দে। আমি আসছি..
নীলঃ আগে আমার চাবি দে..
নূরঃ দেখ আমার এখন তোর বাইকটা লাগবে।
নীলঃ দেখ নূর একদম পাগলামো করবি না৷ তোর ভয়ে আমি বাইক আনি না এই বাসায়। চাবি দে?
নূরঃ আমার এখন দরকার তো..
নীলঃ কি করবি??
নূরঃ ইরিনের বাসায় যাবো।

ইরিনের কথা শুনে নীল চুপ হয়ে গেলো৷ ওতো ইরিনের খবর নেওয়ার জন্যই এখানে এসেছে কিন্তু আসল কথাটাই ভুলে গেলো। এই বেয়াদব মেয়ের কাছে আসলে ভালো মানুষ ও পাগল হয়ে পাবনায় যেতে হবে। আজ একমাস ইরিনের দেখা নেই। মাঝ রাতে কল দিলেও মোবাইল বন্ধ দেখাচ্ছে।
নীলঃ এখন হরিণের বাসায় কেনো??
নূরঃ সেটা যেনে তোর কাজ কি??
নীলঃ তুই কি সোজাসুজি জবাব দিতে পারোস না।
নূরঃ দেখ আমার এখন যাওয়াটা জরুরি।

নীলঃ আমাকে বলা জায় না? আর ওই হরিণ কে এই কয়দিন দেখলাম না যে? কই থাকে? ফোন দিলেও ধরছে না!
নূর গোলগোল আঁখিদুটি নীলের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ তাহলে তুই সেই বেয়াদব ব*দ*মাস আগুন্তকঃ??….
নীল আমতাআমতা করে বললো,’ কিসের আগুন্তকঃ? আর কেনো যাইবি সেটা বল? হরিণের কি কিছু হয়েছে??
নূরঃ আচ্ছা এখন না হয় বাদ দিলাম ওদের বাসা থেকে এসে সব বের করতেছি! আর হয়েছে তো অনেক কিছুই..
নীলঃ দেখ নূর বোন আমার কি হইছে বল??

নূরঃ তাহলে তুই আমার সাথে চল। যেতে যেতে বলছি রাত হয়ে গেছে একা যাওয়া ঠিক হবে না তাই।
নীলঃ ঠিক আছে কিন্তু যদি ওর আম্মু কিছু মনে করে এত রাতে একটা ছেলে আরেকটা মেয়েকে দেখে।
নূরঃ আন্টি আমাকে চিনে। আর ভয় নেই তোকে তো বাসায় নিবো না।
নীল অবাক হয়ে বললো,’ তাহলে আমি কোথায় থাকবো??..
নূরঃ রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাইক পাহাড়া দিবি।
নীলঃ বাইক পাহাড়া দেওয়ার কি আছে? আর আমিও তোর সাথে বাসায় যাবো। তুই না নিলে আমি নিজেই এখন এখান থেকে একদম হরিণের বাসায় যেতাম।

নূরঃ কী!!!?
নীলঃ হা করে না থেকে চল।
নূর নীলের সাথে বের হওয়াই কেউ কিছু বললো না।
নীলঃ নূর আস্তে চালা না। এত জোরে এক্সিডেন্ট করবি তো।
নূরঃ চুপ করে আমাকে ধরে বসে থাক। আজ বিয়ের মিষ্টি খেতে যাচ্ছি।
নীল কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না থমকে গেলো বিয়ের মিষ্টি মানে? কার বিয়ে হরিণের?? নীলের মনে হলো শ্বাস আটকে আসছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে। এই কয়দিন পাগল পাগল লেগেছে নিজেকে নিজের। নীল আর কিছু বললো না শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো।

মাহি শাশুড়ীর রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে আসলো। আজ সারা দিন অনেক জায়গায় ঘুরতে গেছে। আজ ফায়াজের কলেজ বন্ধ ছিলো তাই সারা বিকেল দুই জন রিক্সায় করে অনেক জায়গায় ঘুরে এসেছে। বিয়ের পর আজ প্রথম নয় ধরতে গেলে প্রতি রাতেই ওরা বের হয়। পাশাপাশি হাঁটা হয় শুধু হাতে হাত রাখা হয় না। মাহির রাতে নির্জন রাস্তায় হাঁটতে ভালোবাসে। ফায়াজ এটা শুনার পর থেকেই প্রতি রাতে মাহিকে নিয়ে নির্জন শহরটা ঘুরে বেড়ায়। চোখে চোখ রাখা হয় না, হাতে হাত রাখা হয় না। কিন্তু এক জন আরেক জনের নীরবে ভালোলাগা ভালোবাসা অনুভব করতে পারে।
রুমে এসে দেখে ফায়াজ কথা বলছে। মাহি কে দেখে বললো,’ আচ্ছা রুদ্র রাখি এখন পরে আবার কথা হবে ইনশাআল্লাহ।’
ফায়াজঃ পড়াশোনার কথা কি ভাবলে??

মাহিঃ আর কি ভাবার আছে??
ফায়াজঃ আর করবে না??
মাহিঃ না..
ফায়াজঃ কেনো??
মাহিঃ এমনি..
ফায়াজঃ পড়াশোনা ছাড়া যাবে না। কাল থেকে আবার ভার্সিটিতে যাওয়া শুরু করবে।
মাহি কিছু না বলে বালিশ ঠিক করে শুয়ে পরলো।
ফায়াজঃ এত তারাতারি ঘুমিয়ে যাবে??
মাহি রাগী লুকে ফায়াজের দিকে তাকালো।

ফায়াজঃ এভাবে এই লুকে আমার দিকে তাকিও না। তোমাকে এই রাগী লুক এ হ্যাব্বি কিউট লাগে। তুমি যখন মন খারাপ করে বা রাগ করে তাকাও তখন তোমাকে কতটা মায়াবী লাগে আমি বলে বুঝাতে পারবো না। কখন না জানি কনট্রোল হারিয়ে ফেলি। কখনো মনে হয় ভুল করে কিছু করে ফেলি পরে না হয় সরি বলে ক্ষমা চেয়ে নিবো। কিন্তু পরক্ষনে মনে হয় আমি তোমার মনে আগে আমার নামটা লিখে নিতে চাই৷ অন্য কারো জায়গাটা আমি চাই না নিজে আলাদা জায়গা করে নিতে চাই। যেখানে শুধু আমার রাজত্ব থাকতে অন্য কারো ছিটেফোঁটা ও না।
মাহি আবারও ফায়াজের প্রতিটি কথায় ভালোবাসা খুঁজে পেলো মুগ্ধ হলো। চোখের চাহনির মায়ার মধ্যে আটকে গেলো। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ফায়াজের দিকে।

মাহি শুয়া থেকে উঠে ফায়াজকে ফিসফিস করে বললো,’ আমি কি আপনাকে গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরতে পারি…?
ফায়াজের মনে হলো সে যেনো কানে ভুল শুনলো।
মুখে কিছু না বলে নিজেই মাহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
রুদ্র বাসায় আজ তারাতাড়ি চলে আসলো।
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হলো নূরকে খোজার উদ্দেশ্যে।কিন্তু ড্রয়িং রুম, রান্না ঘর, মায়ের রুমে কোথাও নূরকে না পেয়ে। মিম কে ডাকলো।

মিম বললো আপু নীল ভাইয়ার সাথে কোথায় যেনো গেছে।
রুদ্র রুমে বসে আছে আর টেনশন করছে নূর এত রাতে কোথায় গেলো??
রুদ্রের ভাবনার মাঝেই রুমে ফোন বেজে উঠলো।
নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো ওর ফোন ওর হাতে তাহলে রুমে আর কার ফোন৷
টেবিলে বইয়ের উপর নূরের ফোন দেখে বুঝলো ফোন ছাড়াই চলে গেছে।
ফোন ধরবে কি ধরবে না ভাবতে ভাবতে রিসিভ করে কানে ধরলো।

এই অবেলায় তুমি পর্ব ৩৫

নিজে কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে কেউ কিছু বলে উঠলো।
সাথে সাথে রুদ্র হাত মুষ্টি বদ্ধ করে চোখ বন্ধ করে নিলো।

এই অবেলায় তুমি পর্ব ৩৭