এই মন তোমারি পর্ব ৩৩

এই মন তোমারি পর্ব ৩৩
নুজাইফা নূন

-“দেখো মা তুমি কে বা তোমার পরিচয় কি সেটা আমরা জানতে চাই না। পুরোনো সব দুঃখের কথা তুমি ভুলে যাও। তোমাকে আর কোনো দুঃখ কষ্ট স্পর্শ করতে পারবে না।আজ থেকে তুমি শানজানা।শানজানা চৌধুরী।ডটার অফ শিল্পপতি শাহিন চৌধুরী বলে।

জানো মা আমার খুব ইচ্ছে ছিলো আমার একটা পরীর মতো মেয়ে হবে। মেয়েটা আধো আধো বুলিতে আমাকে পাপা বলে ডাকবে।তার ছোট ছোট পা দিয়ে সারা বাড়ি হেঁটে বেড়াবে। সারাক্ষণ আমার নিস্তব্ধ বাড়িটা মাতিয়ে রাখবে।মেয়েকে নিয়ে অনেক বড়ো স্বপ্ন ছিলো আমার। আমার ইচ্ছে ছিলো আমার মেয়েকে আমি অনেক বড়ো ডক্টর করবো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

শুধু এই দিনাজপুর শহরের মানুষ নয় পুরো বাংলাদেশের মানুষ আমাকে মেয়েকে এক নামে চিনবে।সবাই যখন আমার মেয়ের সাফল্যের গুনগান করবে ,তখন গর্বে আমার বুক ভরে যাবে। তুই আমার সেই চাওয়া টা পূরণ করবি মা?শাহিন চৌধুরীর এহেন আবদারে সূরা হতবাক হতভম্ব হয়ে গিয়েছে।একটা মানুষ কতোটা ভালো হলে রাস্তা থেকে একটা মেয়েকে তুলে এনে এমন নতুন একটা জীবন দিতে পারে?তাকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখাতে পারে?

নিজের মেয়ের আসনে বসাতে পারে ?শাহিন চৌধুরীর মুখে স্বপ্নের কথা শুনে নাজমা দেওয়ান এর কথা মনে পড়ে গেল সূরার। এমন স্বপ্ন তাকে নাজমা দেওয়ান ও দেখিয়েছিলো।তাকে নতুন একটা জীবন উপহার দিয়েছিলো।তাকে নিজের মেয়ে করে নিয়েছিলো। মানুষ টা বড্ড ভালোবাসাতো তাকে। শুধু মাত্র তার জন্য সে নিজের স্বামী নামক অমানুষের সাথে লড়েছে।

এ পর্যায়ে যখন মানুষ টা শয়তানের সাথে লড়াই করে হেরে যায় তখন মানুষ টা এই বয়সে এসে নিজের সংসার , সন্তান ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।সূরা আর ভাবতে পারলো না কিছু।পানিতে চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো।চোখের সামনে ভাসতে লাগলো তার নিজের সংসার ছাড়ার দৃশ্য।

সূরা সেদিন রাতে শাফায়াতের জন্য একটা চিরকুট লিখে টেবিলের উপর রেখে নাজমা মঞ্জিল থেকে বেরিয়ে ‌সোজা শহরের রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে।সূরা এই দ্বিতীয় বার নাজমা মঞ্জিল থেকে বেরিয়েছে। প্রথম বার নাজমা মঞ্জিল থেকে রাগ করে বেরিয়ে আসলে ও শাফায়াত কে দেখে তার রাগ পানি হয়ে গিয়েছিলো।যার জন্য সে আবারো নাজমা মঞ্জিলে ফিরে গিয়েছিলো। কিন্তু এবার সে আর নাজমা মঞ্জিলে ফিরবে না।

কিছুতেই না।চোখের সামনে প্রিয় মানুষ টাকে অন্য কারো সাথে দেখে প্রতিদিন একটু একটু করে ম’রা’র থেকে তার চোখের সামনে থেকে দূরে চলে যাওয়া ভালো । সূরা চোখের পানি মুছে পায়ের গতি বাড়িয়ে হাঁটতে লাগলো। রাস্তায় পিনপতন নীরবতা কাজ করছে। মাঝে মাঝে দূর থেকে শেয়ালের আওয়াজ ‌ভেসে আসছে। হঠাৎ হঠাৎ আওয়াজে কেঁপে উঠে সূরা। তবুও সে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে না।

সূরা পায়ের গতি বাড়িয়ে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে সূরা কোন রাস্তা থেকে কোন রাস্তায় চলে এসেছে কিছু বুঝতে পারে না।সূরা রাস্তার মোড়ে এসে দেখলো সেখানে চার দিকে চার টা রাস্তা চলে গিয়েছে। সূরা কোন দিকে যাবে বুঝতে না পেরে ডান দিকে পা বাড়ালো। কয়েক কদম পা বাড়াতে’ই সূরা ল্যাম্পপোস্টের আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেলো চার পাঁচ টা ছেলে মদ্য পান করছে। এলোমেলো চুল, চোখ লাল হয়ে আছে। দেখতে কেমন বখাটে মনে হচ্ছে।

সূরা তাদের কাছাকাছি আসলে ছেলেগুলো কেমন যেন লুলুপ দৃষ্টি তে তাকায় তার দিকে। ছেলেগুলোর এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভেতরে ‌ভেতরে ভয় আঁকড়ে ধরে সূরা কে। সে ভয়ে ঘামতে শুরু করে।আগের থেকে দ্রুত গতিতে সূরা পা চালিয়ে হাঁটতে শুরু করে সূরা।কিন্তু সুরা কে ফলো করে সূরার পেছন পেছন ছেলেগুলোও আসতে থাকে। ভয়ে কলিজা কেঁপে উঠে সূরা। এক পর্যায়ে সূরা দৌড়াতে শুরু করে।

দৌড়াতে দৌড়াতে সূরা মেইন শহরের বাস স্ট্যান্ডে চলে আসে।বাস স্ট্যান্ডে তখনো অনেক লোকের সমাগম রয়েছে।সূরা নিজেকে বাঁচাতে কোনো কিছু না ভেবে বাসে উঠে যায়।বাসে উঠে হাঁফাতে থাকে সে।সূরা কে হাঁপাতে দেখে একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ সূরার হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে দেয়।সূরা প্রথমে আন‌ইজি ফিল করলেও পরে ভাবে লোকটা তো আমার বাবার বয়সী।হয়তো আমার বয়সী মেয়ে ও আছে তার।এসব ভেবে সূরা নিজেকে শান্তনা দেয়।বাস আপন গতিতে চলতে শুরু করে ।

সূরা অনেকক্ষণ যাবত দৌড়ানোর ফলে ক্লান্তিতে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। কিছু সময়ের জন্য ঘুমিয়ে পড়ে সূরা। হঠাৎ পিঠে কারো স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে যায় সূরার।সূরার ঘুম ভাঙ্গতে’ই দেখতে পায় তার পাশে বসা তার বাবার বয়সী লোকটা সূরার পিঠে হাত দিয়ে স্লাইড করছে।তার দৃষ্টিতে রয়েছে কামনা বাসনা। লোকটার এমন রুপ দেখে ঘৃণার গাঁ ঘিনঘিন করে উঠে সূরার।

সূরা মনে মনে বললো, কাকে বিশ্বাস করবো? পুরুষ মানুষের এতো গুলো রুপ হয় জানতাম না। পুরুষ মানুষ একটা মেয়ের মানসিক শান্তির কারণ ।আবার সেই পুরুষ মানুষ ‘ই মেয়েদের যন্ত্রণার ‌কারণ। সূরা কোনো কিছু না ভেবে লোকটার নাক বরাবর ঘুষি মেরে দিয়ে বাস থেকে নেমে পড়ে। কিন্তু বাস থেকে নেমে আরেক দফা চমকে উঠে সূরা।তার পেছন পেছন সেই পাঁচ টা বখাটে ছেলে ও রয়েছে।যা দেখে ভয় পেয়ে যায় সূরা।সূরা কে ভয় পেতে একটা ছেলে বললো,

-” কি সুন্দরী ভেবেছিলে আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যেতে পারবে তাই না? আমাদের নজরে একবার যখন পড়েছো তখন আর তোমার নিস্তার নেই সুন্দরী।তোমার পেছনে অনেক দৌড় দৌড়াতে হয়েছে আমাদের। এখন তুমি কোথায় পালাবে সুন্দরী? শুধু শুধু নিজের এর্নাজি নষ্ট করলে।তার চেয়ে বরং আমাদের কাছে ধরা দিলে নিজেও আনন্দ পেতে আর আমরাও বলে পৌশাচিক হাসিতে মেতে উঠলো ছেলে গুলো।

সূরা মনে মনে বললো , হে আল্লাহ! এ কোন পরীক্ষায় ফেললে আমাকে? এখন কি করবো? আমার কি বাঁচার আর কোনো পথ নেই? আমাকে কি এই নরপশুদের খাদ্য পরিনত হতে হবে? আগামীকাল সকালের নিউজের হেড লাইন হতে হবে? সূরা অসহায় হয়ে চোখের পানি ফেলতে থাকে। হঠাৎ তার চোখ যায় রাস্তার পাশে রাখা বালির স্তুপ এর দিকে।

সূরা আর এক মুহূর্ত দেরি না করে এক মুঠো বালি ছুঁড়ে দেয় ছেলেগুলোর দিকে। তাদের চোখে মুখে বালি ছুঁড়ে দেওয়ার কারণে তারা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে সূরা কে।সূরা আবারো দৌড়াতে শুরু করে। দৌড়াতে দৌড়াতে এক পর্যায়ে সূরা রাস্তায় পড়ে গিয়ে পা ছুঁলে রক্ত বের হয়ে যায়।সূরা ব্যাথায় ককিয়ে উঠে রাস্তায় বসে পড়ে।

কিন্তু পেছন থেকে ছেলেগুলোর গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে আবারো দৌড়াতে থাকে সূরা। হঠাৎ করে সূরার মাথা ঘুরতে শুরু করে , চোখ ঝাপসা হয়ে আসে তার।সে দেখতে পায় একটা গাড়ি তার দিকে ধেয়ে আসছে। এরপর আর কিছু মনে নেই সূরার।জ্ঞান ফেরার পর সে নিজেকে হসপিটালে আবিষ্কার করে।সে জানতে পারে তার সুন্দর ব্যাডা মানুষ থেকে সে এখন অনেক দূরে দিনাজপুরে রয়েছে। পুরোনো কথা মনে পড়তে’ই বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে সূরা।সূরার থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে শাহিন চৌধুরী বললেন,

এই মন তোমারি পর্ব ৩২

-” কিরে মা কোথায় হারিয়ে গেলি তুই? আমি তোকে কিছু জিজ্ঞেস করছি। তুই পারবি শানজানা চৌধুরী হয়ে আমার স্বপ্ন পূরণ করতে?”
-” পারবো বাবা।আমাকে যে পারতেই হবে।”

এই মন তোমারি পর্ব ৩৪