অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩১

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩১
অরনিশা সাথী

রুজবা’দের বাসার গেটের ডান পাশেই রাস্তার ধারে বড় একটা কড়ই গাছ। তার পাশেই বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নুহাশ। রুজবা মাথায় ঘোমটা টেনে গেটের বাইরে বেরিয়ে এদিক সেদিক তাকায়৷ কড়ই গাছের পাশে নুহাশকে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়াতে দেখে এগিয়ে যায় সেদিকে।

রুজবাকে দেখে নুহাশের ঠোঁটে হাসি ফুঁটে উঠে। প্রসস্থ হেসে রুজবার হাত ধরে টেনে রুজবাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। নুহাশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে রেখেছে রুজবা৷ নুহাশ অপলক দেখছে ওকে। গত চারদিন না দেখার তৃষ্ণা যেন আজ, এক্ষুনি, একসাথে মেটাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর রুজবা সরাসরি দৃষ্টি ফেলে নুহাশের চোখে। নুহাশের দৃষ্টি তখনো স্থির। রুজবা দ্রুত দৃষ্টি সরায়। ওরকম চাহনির দিকে তাকিয়ে থাকার সাধ্য ওর নেই। নিচু কন্ঠে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“ভেতরে চলুন।”
–“অন্যদিন যাবো, আজ এখানেই থাকি।”
রুজবা তাকায় নুহাশের দিকে। নুহাশের দৃষ্টি এখন স্বাভাবিক। নুহাশ বাইকে ঝুলানো দুটো শপিং ব্যাগ থেকে একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে বলে,
–“এটা তোমার আর রুপশার।”
রুজবা প্রশ্ন চোখে তাকায়৷ নুহাশ বলে,

–“চকলেট আছে তোমার আর রুপশার জন্য। দুজনেই তো আবার চকলেট খোর রাইট?”
রুজবা মৃদু হেসে ব্যাগটা হাতে নেয়৷ নুহাশ দ্বিতীয় ব্যাগটাও রুজবার হাতে দিয়ে বলে,
–“এটা রাফাতের। ওর ফুটবল আর ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁক না অনেক? এখানে ওর জন্য ওর প্রিয় দলের জার্সি, জুতো, ব্যাট এসব আছে।”

–“ওর এসব আছে তো, আপনি আবার শুধু শুধু___”
–“একটা মাত্র শালা আমার, ওকে কিছু দিতে পারি না আমি?”
–“পারেন কিন্তু___”
–“কোনো কিন্তু না।”
রুজবা চুপ হয়ে যায়। নুহাশ ব্যাগ দুটো নিয়ে বাইকের উপর রেখে দেয়। রুজবাকে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে দুই বাহু ধরে বলে,

–“রুজবা?”
–“জ্বি।”
–“তোমার আলিঙ্গন পাওয়ার লোভ হচ্ছে ভীষণ।”
রুজবা ক্ষানিক চমকালো। লোকটা যে এরকম আবদার করে বসবে কল্পনাতেও ভাবেনি। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না রুজবা। এমন সময় রায়হান সাহেব বাসা থেকে বের হতেই নজরে আসে নুহাশ আর রুজবাকে। নুহাশ শ্বশুর মশাইকে দেকে সালাম জানান। রায়হান সাহেব সালাম নিয়ে বলে,

–“এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন বাবা? ভিতরে যাও। রুজবা, নুহাশকে ভেতরে নিয়ে যাও।”
শেষ কথাটা রুজবাকে উদ্দেশ্য করে শেষ করেন উনি। নুহাশ নাকোচ করে বলে,
–“আজ যাবো না আংকেল, অন্যদিন আসবো।”
রায়হান সাহেব এগিয়ে গিয়ে নুহাশের পিঠে হাত রেখে বলে,

–“বাড়ির জামাই, বাড়ির দোরগোড়ায় এসে ফিরে যাবে তা কখনো হয় নাকি? ভেতরে যাও তুমি। আমি বাজার থেকে ঘুরে আসছি, এসে যেন তোমাকে বাসায় পাই।”
নুহাশ রুজবাকে ইশারা করছে কিছু বলার জন্য। কিন্তু রুজবা কিছু না বলে চুপ করে আছে। রায়হান সাহেব রুজবাকে বললো,

–“দাঁড়িয়ে আছো কেন? নুহাশকে নিয়ে বাড়িতে যাও।”
রুজবা মাথা নাড়িয়ে বাড়ির ভেতরে পা রাখে। রায়হান সাহেব নুহাশকে ইশারা করে নুহাশ আর কোনো উপায় না পেয়ে রুজবার পিছু নেয়। রায়হান সাহেব ওদের দুজনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসেন৷ ছেলেটা রুজবাকে সত্যিই ভীষণ ভালোবাসে, ওর মতো করে ভালোবাসতে, ভালো রাখতে আর কেউ পারবে না কখনো। আল্লাহ যেন দুজনকে সবসময় এভাবেই হাসিখুশি ভাবে একসাথে আজীবন বেঁধে রাখে। এই ভেবে তিনি বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।

ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে নুহাশ। সামনে এত এত নাস্তার আইটেম। নুহাশের নিজেকে অসহায় লাগছে এবার। এর আগে কিয়ান সাথে ছিলো তাই অতটা একা একা ফিল হয়নি। বাট আজ ও একা, রাফাত’ও কোচিং-এ গেছে মেবি। রুপশা নুহাশের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,

–“কিছু খাচ্ছেন না কেন ভাইয়া? কি ভাবছেন?”
–“তোমার আপু কোথায়?”
–“কিচেনে, আম্মুকে হেল্প করছে। ডাকবো?”
–“না থাক।”
নুহাশ কথাটা বলতে বলতেই রুজবা উড়নায় হাত মুছতে মুছতে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো। নুহাশের অপর পাশে বসে প্রশ্ন করলো,

–“একি আপনি তো কিছুই খাননি, বসে আছেন কেন?”
নুহাশ একবার নাস্তার দিকে তাকিয়ে বললো,
–“এত কিছু একটা মানুষ একা কিভাবে খেতে পারে?”
–“সবটা থেকে একটু একটু টেস্ট করুন।”
নুহাশ কিছু বলার আগেই রুপশা বলে,

–“ভাইয়া, পুডিং আর ভূনা সেমাই’টা টেস্ট করুন। এই দুইটা আপু বানিয়েছে। ওর হাতের এই দুইটা আমাদের বাসার সবার ভীষণ ফেভারিট।”
–“বউ বানিয়েছে বলে কথা, টেস্ট তো করতেই হয়।”
নুহাশ কাটা চামুচে করে একটু খানি পুডিং কেটে নিয়ে মুখে পুড়ে৷ খেতে খেতেই বলে,

–“ইয়াম্মি।”
রুপশা সেমাই এগিয়ে দিয়ে বলে,
–“এবার এটা টেস্ট করুন।”
নুহাশ এক চামুচ সেমাই খায়। এটাও দুর্দান্ত বানিয়েছে রুজবা। ওর রান্নার হাত নিশ্চয়ই ভীষণ ভালো। নয়তো ভালো পুডিং আর ভূনা সেমাই নিশ্চয়ই বানাতে পারতো না।

–“সেমাইটা’ও দারুন হয়েছে।”
রুপশা বলে,
–“বলেছিলাম না আপুর বানানো এই দুইটা ডিশ সবার ভীষণ পছন্দের।”
–“এখন থেকে আমারও।”

নুহাশের কথা শুনে রুজবা আর রুপশা দুজনেই ফিক করে হেসে দেয়। শারমিন বেগম আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে আসে নুহাশ ওদের দিকে। নুহাশ এসেছে বিধায় উনি আবার রাতের জন্য নতুন করে সব রান্নার আয়োজন করেছেন। কয়েক পদ রান্না এর মধ্যে শেষও। বাকি দুই/তিন পদ আছে এখনো। রুজবা হাতে হাতে সব এগিয়ে গুছিয়ে দিয়েছে বলেই এত তাড়াতাড়ি রান্না শেষ করতে পারবেন উনি। শারমিন বেগম নুহাশকে ওর বাড়ির সকলের কথা জিজ্ঞেস করে বলে,

–“ঘরে গিয়ে রেস্ট নাও বাবা।”
–“না আন্টি চলে যাবো আমি।”
–“আজ আর যাওয়া হচ্ছে না। তোমার শ্বশুর মশাই কড়া করে জানিয়ে দিয়েছেন আজ যাতে তোমাকে যেতে না দেওয়া হয়।”

–“আজ থাকা হবে না আন্টি, আংকেল আসলে আমি দেখা করেই চলে যাবো। অফিসের কাজ পড়ে আছে অনেক, সেগুলো কমপ্লিট করা লাগবে।”
–“একদিন কাজ না করলে কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। আজকে তুমি থাকছো।”

শারমিন বেগমের কথার পিঠে আর কিছু বলতে পারে না নুহাশ। এখন মনে হচ্ছে না আসাটাই ভালো হতো। উফস! সত্যিই অনেক অনেক কাজ জমা পড়ে আছে ই-মেইলে। কিচ্ছু কমপ্লিট করা হয়নি এখনো। নুহাশেরও যে রুজবার কাছে থাকতে ইচ্ছে করছে না সেরকম না। কিন্তু আজকের রাত যাওয়া মানে কাল আরো নতুন কিছু ই-মেইল এসে জমা পড়বে তখন সব একসাথে আরো বেশি চাপ পড়ে যাবে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। এরই মধ্যে শারমিন বেগম বললেন,

–“রুজবা? নুহাশকে ঘরে নিয়ে যাও। আর রুপশা পড়তে বসো গিয়ে। নুহাশ এসেছে পর তো সারা সন্ধ্যা প্রায় আড্ডা দিয়েই কাটালি, এখন ঘরে গিয়ে পড়তে বস। দশটার আগে পড়ার টেবিল থেকে উঠতে না দেখি যাতে।”
রুজবা সম্মতি জানায়। আর রুপশা গোমড়া মুখে পড়তে চলে যায়। ঘরে এসেই নুহাশ বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে পড়ে। সারাদিন শো-রুমে বিজি ছিলো। ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেও বিশ্রাম নিতে পারেনি একদম। এখন যেন আর শরীর সায় দিচ্ছে না। তাই কোনো কিছু না ভেবেই শুয়ে পড়ে। মাথা উঁচু করে রুজবাকে বলে,

–“দরজাটা লাগিয়ে এসো, লক করার দরকার নেই।”
রুজবা চমকায়, এই আটটা বাজে ঘরের দরজা লাগাবে ও? বাকী সবাই কি ভাববে? ইশ্! কি লজ্জা! দরজা খুলে পরে সবার সামনে মুখ দেখাবে কি করে ও? কেউ তো আর জানবে না যে ওদের মাঝে কিছু হয়নি, বা দরজা লকড না। কিন্তু দরজা বন্ধ মানেই তো সবাই ভাববে____ইশ! মনে মনে রুজবা বেশ লজ্জা পেলেও মুখে সেটা প্রকাশ করলো না। নুহাশের কথামতো দরজা আটকে বিছানার কাছে যেতেই নুহাশ চট করে দাঁড়িয়ে যায়। রুজবার হাত ধরে কাছে টেনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রুজবাকে। ছেড়ে দিলেই যেন পালাবে রুজবা। রুজবার ঘাড়ে মুখ গুজে রেখেই নুহাশ বলে,

–“চার দিন পর বউয়ের আলিঙ্গন পেয়ে আমার অশান্ত মন যেন এবার শান্ত হলো।”
রুজবা মৃদু কাঁপে, নুহাশের স্পর্শে, আর কথায়। বেশ কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রেখে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে নুহাশ। রুজবাকে কাছে ডাকে। বিনাবাক্যে রুজবা বিছানায় গিয়ে বসে। নুহাশ রুজবার কোলে মাথা দিয়ে দুহাতে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে বলে,

–“আমি ভীষণ টায়ার্ড রুজবা। দু ঘন্টা ঘুমাবো। ততক্ষণে তুমি আমায় মন ভরে দেখো কেমন? আড়চোখে আর দেখা লাগবে না যখন ইচ্ছে হবে আমাকে তোমার সামনে বসিয়ে দু চোখ ভরে দেখবে। আমি ❝নুহাশ ফারদিন❞ তো তোমারই, এত লুকোচুরির কি আছে?”
রুজবা শুকনো ঢোক গিলে৷ লোকটা কি সব বুঝে যায়? ইশ্! কি লজ্জা, কি লজ্জা! নুহাশ রুজবার কোমরে মুখ গুজেই বলে,

–“চুলে হাত বুলিয়ে দাও, ঘুম তাড়াতাড়ি আসবে।”
নুহাশের কথামতো রুজবা চুলে হাত বোলাতে লাগলো। কিছু মূহুর্ত যেতেই নুহাশ ঘুমিয়ে পড়ে। রুজবা নুহাশের মাথার চুল টেনে দিচ্ছে আলতো ভাবে। আর ওর বা গালটা দেখছে। রুজবা ইচ্ছে হচ্ছে কুচকুচে কালো চাপদাড়িতে চুমু খেতে।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩০

নুহাশের গালের চাপদাড়ি আর লোমশ বুক রুজবাকে খুব করে টানে। রুজবা নিজের ইচ্ছেকে দমাতে না পেরে টুপ করেই নুহাশের দাড়িতে চুমু খেয়ে বসে। তারপর দ্রুত সরে যায়। নিজের কাছেই কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে। লজ্জায় দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে নেয় তৎক্ষনাৎ।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩২