অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩২

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩২
অরনিশা সাথী

নুহাশ চোখ মেলে দেখে ও এখনো রুজবার কোলেই শুয়ে আছে। রুজবার হাত ওর মাথায় রাখা। মুচকি হেসে উঠে বসে সে। দেখে রুজবা বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। রুজবার দিকে বেশ ক্ষানিকটা ঝুঁকে যায় ও। ঘুমন্ত অবস্থায় রুজবাকে পুরো বাচ্চা বাচ্চা লাগে। নাক আর ঠোঁটের মধ্যবর্তী অংশে যে গর্ত আছে সেখানে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে।

ফ্যান চলছে তবুও মেয়েটাকে ঘামাচ্ছে। নুহাশ বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে রুজবার ঠোঁটের উপরের ঘাম মুছে দেয়। শব্দ করে চুমু খায় ওর কপালে। সরে আসার সময় রুজবার ঠোঁট জোড়া যেন আফিমের মতো টানে নুহাশকে। নুহাশ আলতো করে রুজবার ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ায়। সে মূহুর্তে চোখ মেলে তাকায় রুজবা৷ নুহাশ একগাল হেসে আচমকাই অধরে অধর মিলিয়ে দেয়। শুষে নিতে থাকে প্রেয়সীর ঠোঁটের স্বাদ। রুজবা বড় বড় চোখে তাকায়। লোকটা আসলেই পাগল। মিনিট দুয়েক বাদেই সরে আসে নুহাশ। রুজবা বড় করে শ্বাস ফেলে উফস বাবা, আর একটু হলেই যেন জানটা বেরিয়ে যেতো ওর।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে ঘরে এসেছে নুহাশ। রুজবা ওর মায়ের সাথে কিচেনে হাতে হাতে সবকিছু গুছিয়ে রেখে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। নুহাশ বিছানায় বসে আয়েশ করে ফোন দেখছে। রুজবাকে দেখে ফোনটা রেখে বলে,
–“আমার এখন ফিরতে হবে রুজবা। তুমি একটু আংকেল আন্টিকে বুঝিয়ে বলো। অনেক কাজ পেন্ডিং আছে।”
রুজবা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মাথা থেকে উড়না ফেলে দিয়ে চুল আঁচড়ানো শুরু করলো। চুল একপাশে নিয়ে বিনুনি করতে করতেই বললো,

–“সবাই যখন এত করে বলছে থেকে যান আজ।”
নুহাশ রুজবার পেছনে দাঁড়িয়ে বললো,
–“কই আমার বউ তো একবারো বললো না থেকে যেতে।”
–“বললে থেকে যাবেন?”
–“উঁহু, আজ সম্ভব না। সামনে সপ্তাহে আসবো প্রমিস। আংকেল আন্টিকে একটু বলো তুমি।”
–“আচ্ছা বলবো।”

নুহাশ পেছন থেকে রুজবার দুই বাহু ধরে ঝুঁকে গিয়ে ওর গালে চুমু খায়। তারপর গলা থেকে উড়না সরিয়ে গলায় আর কাঁধে চুমু খায়। কেঁপে উঠে রুজবা। চোখ বন্ধ করে নেয় তৎক্ষনাৎ। নুহাশ মৃদু হেসে সরে আসে। রুজবা দ্রুত চুল বিনুনি করে উঠে চলে যায় ওর বাবার ঘরে। মিনিট পাঁচেক বাদে আবার ফিরে এসে বলে,

–“মেনে গিয়েছেন আব্বু।”
নুহাশ মুচকি হেসে রুজবাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
–“থ্যাংকিউ।”
–“হুম এবার যান, রাত বেশি হচ্ছে তো।”

নুহাশ রুজবাকে নিয়েই বেরিয়ে আসে। ড্রয়িংরুমে রায়হান সাহেব, শারমিন বেগম, রাফাত, রুপশা সকলেই আছে। নুহাশ সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায়৷ পেছন পেছন রুজবা রুপশা দুজনে বের হয়৷ নুহাশ বাইকে উঠে বসতেই ফারিন দৌড়ে আসে। রুজবা ভ্রু কুঁচকে বলে,
–“এভাবে দৌড়াচ্ছিস কেন? কি হয়েছে?”
ফারিন হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,

–“আমি অনেক ভেবেছি রুজবা। কিয়ানকে ছেড়ে দিপ্ত ভাইকে বিয়ে করা আমার সম্ভব না। বিকেলে তোর বলা কথাগুলো ভেবেছি আমি। বাবা একদিন মেনে নিবে। কিন্তু আজ বাবার কথায় কিয়ান কে ছেড়ে দিপ্ত ভাইকে বিয়ে করলে আমি আমার কিয়ানকে সারাজীবনের জন্য হারাবো। কিয়া্ কিয়ানকে ফোন দে, আমায় নিয়ে যেতে বল।”
নুহাশ বাইক থেকে নেমে ফারিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

–“আর ইউ সিরিয়াস? তুমি আংকেলের সাথে ভালোভাবে কথা বলো ফারিন। উনাকে বোঝানোর চেষ্টা করো। উনি মানবে নিশ্চয়ই।”
–“মানবে না নুহাশ ভাই। আমি আজ সন্ধ্যায়’ও বাবাকে বলেছি। বাবা আমাকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিবে তবুও উনার কথার নড়চড় করবে না। আপনি কিয়ানকে ফোন করুন নুহাশ ভাই৷ এসে আমায় নিয়ে যেতে বলুন। একটু পরেই সবাই আবার খোঁজাখুঁজি শুরু করবে।”
নুহাশ কিয়ানকে ফোন করে। দু বার ফোন বেজে কেটে যায়। তিন বারের সময় কিয়ান ফোন রিসিভ করে। ভাঙা গলায় বলে,

–“হ্যাঁ নুহাশ বল।”
–“ফারিন কথা বলতে চাচ্ছে।”
মরুর বুকে যেন এক পশলা বৃষ্টির দেখা মিললো। এই এক সপ্তাহেই কিয়ানের চোখমুখের বেহাল দশা। ফারিন কথা বলতে চায় শুনে হাসি ফুঁটে উঠে কিয়ানের মুখে। উচ্ছাসিত কন্ঠে বলে,
–“দে।”

নুহাশ এগিয়ে দেয় ফারিনের দিকে ফোন৷ ফারিন হাতে নিয়েই কেঁদে দেয়। কিয়ান আজ কিছু বলছে না। কেঁদে নিজেকে একটু হালকা করুক। ফারিন কাঁদতে কাঁদতে বলে,
–“আমি তোমাকে হারাতে পারবো না কিয়ান। আমকে নিয়ে যাও তুমি। এক্ষুনি এসে নিয়ে যাও প্লিজ। বাবা একবার টের পেয়ে গেলে আমাকে আর পাবা না।”

–“তুমি চিন্তা করো না। নুহাশের কাছে ফোনটা দাও।”
ফারিন এগিয়ে দেয় নুহাশের দিকে। নুহাশ ফোন কানে নিয়ে হ্যালো বলতেই কিয়ান বলে,
–“ভাই তুই ফারিনকে একটু নিয়ে আয় প্লিজ। আমি যেতে যেতে লেট হয়ে যাবে। যদি আবার ওর বাসা থেকে খোঁজাখুঁজি করে? তুই একটু নিয়ে আয়।”
–“এত হাইপার হচ্ছিস কেন? আমি নিয়ে আসছি। তুই নিশ্চিন্ত থাক।”

কিয়ানকে জাপ্টে ধরে কাঁদছে ফারিন। কিয়ানের চোখেও আজ পানি যেন বাঁধ মানছে না। কিয়ানদের বাড়ির উঠোনেই দাঁড়িয়ে আছে সকলে। নুহাশ অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। কান্নার শব্দ পেয়ে ভেতর থেকে রোমান সাহেব এবং নোমান সাহেবের পুরো পরিবার বেরিয়ে আসে। রিয়ান গলা খাঁকারি দিতেই ফারিন কিয়ানকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ায়। রোমান সাহেব ওদের দুজনের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

–“ফারিন তুমি এখানে?”
ফারিন কিয়ানের হাত আঁকড়ে ধরে বলে,
–“আমাকে তাড়িয়ে দিবেন না আংকেল প্লিজ। আমি কিয়ানকে ছাড়া থাকতে পারবো না।”
রোমান সাহেব কঠিন স্বরে বলে,

–“তোমার বাবা তো এ সম্পর্কে রাজি না৷ তাহলে___”
কিয়ান ফারিনের হাত ধরে ওর বাবার চোখে চোখ রেখে বলে,
–“বাবা প্লিজ তুমিও ফারিনের বাবার মতো কঠোর হইয়ো না৷ আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি।”
রোমান সাহেব বলে,
–“আমার কোনো আপত্তি নেই তোমাদের সম্পর্ক মানতে। কিন্তু এভাবে চলে আসাটা কি ঠিক হয়েছে?”
রিয়ান বলে,

–“ফারিনের বাবা তো মানছে না৷ তাহলে আর কি করবে ওরা? নিজেদের ভালোবাসা ভুলে যাবে?”
–“আমি সেটা বলিনি রিয়ান। কিন্তু এভাবে___”
–“বাবা আমি বলি কি, কিয়ান আর ফারিনের বিয়েটা দিয়ে দিন। একদিন ঠিক মেনে নিবে সবাই।”

জান্নাতের কথায় ফারিন টলমলে চোখে তাকায় ওর দিকে৷ এই জান্নাত আজ ওর পাশে দাঁড়াচ্ছে, ওদের বিয়ের কথা বলছে। অথচ জান্নাতের সাথে ওদের সম্পর্কটা শুরু থেকে তেমন একটা ভালো ছিলো না। মাঝে ভালো হয়েছে কথা হয় তবে তেমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নেই। রোমান সাহেব জান্নাতকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“তোমাদের সবার কথা আমি বুঝতে পারছি কিন্তু এভাবে ওর অভিভাবক ছাড়া আমরা বিয়ে দিতে পারি নাকি?”
নুহাশ এতক্ষণ চুপচাপ সবার কথা শুনছিলো একপাশে দাঁড়িয়ে। এবার সামনে এগিয়ে এসে বললো,

–“কাকা আমি কিছু বলি?”
রোমান সাহেব বললো,
–“তুই এটা কি করে করলি নুহাশ? ফারিনকে এভাবে নিয়ে আসলি কেন?”
নুহাশ সমস্ত ঘটনা রোমান সাহেবকে খুলে বলে। সমস্ত কিছু শুনে তিনি বলে,
–“তবুও___”

–“আপনি বরং ফারিনের বাবাকে ফোন দিয়ে সব বলুন, দেখুন উনি কি বলে। সেই ভেবে না হয় সিদ্ধান্ত নিবেন।”
রোমান সাহেবের নুহাশের কথা পছন্দ হলো। সবাই মিলে কিয়ানদের বাসার ভিতরে গেলো। ফারিন বারবার না করছিলো ওর বাবাকে ফোন দিতে। কিন্তু রোমান সাহেব ওকে আশ্বাস দিয়েছেন যা হবে ভালোই হবে। ফারিন ওর বাবার নাম্বার বলতেই রোমান সাহেব ফোন দেন আসাদ সাহেবকে। রোমান সাহেব নিজের পরিচয় দিয়ে ফারিনের এখানে চলে আসার কথা জানান তিনি৷ এটাও বলেন,

–“ওরা দুজন দুজনকে অনেক ভালোবাসে, ওদের কথা ভেবে না হয় এই সম্পর্কটা মেনে নিন আপনি। ছোট মানুষ ভুল করে ফেলেছে, আমি ফারিনকে বাসায় পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। কাল আমরা বড়রা বসে না হয় ওদের বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করবো।”
আসাদ সাহেব তেঁতে গিয়ে বলেন,
–“আমার বড় মেয়ে নেই। ও এ বাড়ি থেকে পালানোর সাথে সাথেই আমার কাছে মৃত হয়ে গেছে। যে মেয়ে একবারো আমার মান সম্মানের কথা না ভেবে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে সে মেয়ের দরকার নেই আমার। ইতিমধ্যেই সারা এলাকা ঢইঢই হয়ে গেছে ও পালিয়ে গেছে। ওর মুখ আর দেখতে চাই না আমি। যে মেয়ে বাবার কথা ভাবে না সে মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকা শতগুণে ভালো।”
কথাগুলো বলে রোমান সাহেবকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আসাদ সাহেব লাইন কেটে দেন। রোমান সাহেব ব্যর্থ চোখে তাকান সকলের দিকে৷ নরম স্বরে বলেন,
–“আজ তো অনেক রাত হয়েছে, এখন কাজি পাওয়া যাবে না। আজ রাতটা যাক, কালই কাজী আর হজুর এনে ওদের বিয়ে পড়াবো।”
রোমান সাহেবের কথায় সকলে সহমত প্রকাশ করেন। উনি আর কিছু না বলে ঘরে চলে যান। নোমান সাহেবরাও নিজেদের বাড়ি ফিরে যান। জান্নাত রিয়ানকে বলে,
–“তুমি আজ কিয়ানের ঘরে থেকো, ফারিন আমার সঙ্গে থাকবে।”

বাসায় ঢুকে এখনো লিয়াকে দেখে মেজাজ চটে যায় নুহাশের। রুজবার সাথে থেকে মুডটা পুরো ঝাকানাকা হয়ে গেছিলো, এখন এই মেয়েকে দেখে আবার মেজাজ বিগড়ে যায়৷ শাহানা বেগম লিয়াকে নিজের ঘরে যেতে বললে ও না গিয়ে সেখানেই বসে থাকে। শাহানা বেগম বিরক্ত হলেও প্রকাশ করে না। নুহাশের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

–“খেতে দিই চল।”
–“রুজবাদের বাড়ি গিয়েছিলাম ওখান থেকেই খেয়ে এসেছি মা।”
–“কেমন আছে রুজবা? দুদিন ধরে মেয়েটার সাথে কথা হয় না, ও বাড়ির সবাই ভালো আছে তো?”
নুহাশ ঘরে যেতে যেতে জবাব দেয়,
–“হ্যাঁ, সবাই ভালো।”

ঘরে গিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করতেই দেখলো রুজবার অনেক গুলো মিসডকল৷ নুহাশ তৎক্ষনাৎ কলব্যাক করে। নুহাশের ফোনের অপেক্ষাতেই যেন ছিলো রুজবা। একবার রিং হতেই ফোন রিসিভ করে ও। নুহাশ প্রশ্ন ছুঁড়ে,
–“ঘুমাওনি এখনো? রাত হয়েছে তো অনেক।”
–“ওদিকে কি হয়েছে না জানা অব্দি ঘুম আসবে না। তাছাড়া সন্ধ্যায় আবার ঘুমিয়েছি না? এত সহজে ঘুম আসবে না।”

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩১

–“তাহলে তো আজ সারারাত জেগে কথা বলা’ই যায়। কি বলো?”
–“হ্যাঁ তা যায়, আমার কোনো আপত্তি নেই। আগে বলুন ওদিকে সব ঠিকঠাক?”
নুহাশ সমস্ত কিছু বলে রুজবাকে। সব শুনে আসাদ সাহেবের কথায় ক্ষানিকটা মন খারাপ হয় ফারিনের জন্য। পরে আবার এটা ভেবে খুশি হয় যে কাল ওদের বিয়েটা হচ্ছে।”

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩৩