অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩৩

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩৩
অরনিশা সাথী

কিয়ানদের পুরো বাড়ি সকাল সাড়ে নয়টার মধ্যেই সুন্দর করে সাজানো হয়ে গেছে। হলরুমেই ছোট করে স্টেজ বানানো হয়েছে ফারিন আর কিয়ানের হলুদের জন্য। দশটা/সাড়ে দশটা নাগাদ ওদের দুজনকে হলুদ দিয়ে একেবারে গোসল করিয়ে ফেলবে।

তারপর বিকেলে বিয়ে পড়ানো হবে৷ কিয়ানের চাচা ফুপু এবং নানার বাড়ির সকলকে কাল রাতেই বলে রেখেছিলেন রোমান সাহেব। ঘরোয়া ভাবেই বিয়েটা হবে আজ। ফারিনের বাসায় রাজি থাকলে অনেক বড় করে ধুমধামে বিয়ের আয়োজন করা যেতো। কিন্তু এখন তা সম্ভব না। ফারিন এই বাড়িতে আছে। বিয়ে ছাড়া কিয়ানদের বাড়ি বেশি দিন থাকলে সমাজ সেটাকে অন্যচোখে দেখবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তাছাড়া কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে ভোর থেকেই, কিয়ান মেয়ে ভাগিয়ে এনেছে। তাই আর রোমান সাহেব দেরী করতে চাইছে না। উনি চাইলেই সপ্তাহ খানেক দেরি করে সময় নিয়ে ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করতে পারতো। কিন্তু আশেপাশের মানুষের যে কথা তাই আর দেরি করবেন না উনি। ইতিমধ্যেই পুরো বাড়ি কাছের মানুষজনে ভরে গেছে।

আদিরা আর জান্নাত নুহাশকে নিয়ে শপিংয়ে বেরিয়ে পড়েছে আটটা নাগাদ৷ পরিচিত দোকান থেকে হলুদের শাড়ি পাঞ্জাবি আর বিয়ের লেহেঙ্গা এবং শেরওয়ানী নিবে ওরা। সাথে ফারিনের জন্য টুকটাক কসমেটিকস, অরনামেন্টস, জুতো, রেডিমেড ব্লাউজ আর পেটিকোট। সবকিছু কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দশটা বেজে যায় ওদের৷ এসেই দুজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ফারিনকে সাজাতে। রান্নার দিকটা রিয়ান আর নিবির সামলাচ্ছে।

শপিং থেকে ফিরেই চিৎপটাং হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে নুহাশ। ভীষণ ক্লান্ত ও। ঘুমে তাকাতে পারছে না। কাল অনেক রাত অব্দি রুজবার সাথে ফোনে কথা বলেছে। ঘুমিয়েছিলো তিনটার দিক৷ এদিকে সাতটা নাগাদই আদিরা আর জান্নাত ঘুম থেকে টেনে তুলে শপিংয়ে যাওয়ার জন্য। এর মধ্যে রুজবার সাথে আর কথা হয়নি ওর। রুজবার কথা মনে হতেই অধরে হাসির রেখা দেখা গেলো। ক্লান্তি ভাব যেন উবে গেলো নিমিষেই। পকেট থেকে ফোন বের করে রুজবার নাম্বারে ডায়াল করলো। রিং হওয়ার কিছুক্ষণ বাদেই ফোন রিসিভ করে রুজবা। সালাম দিয়ে বলে,

–“হ্যাঁ বলুন।”
–“কি করছো?”
–“তেমন কিছু না, আপনি?”
–“তোমাকে মিস করছি ভীষণ।”
পরবর্তীতে কি জবাব দিবে রুজবা ভেবে পেলো না। নুহাশ প্রশ্ন করলো,

–“দুপুরে সবাই আসছো তো?”
–“হুম।”
–“এখনই চলে আসলে বেশি খুশি হতাম। একটুখানি হলুদ ছোঁয়াতাম তোমার গালে খুব যত্ন করে।”
রুজবা লাজুক হাসলো। নুহাশ বলে,

–“দুপুরে শাড়ি পড়ে আসবে কিন্তু।”
–“বোরখার নিচে শাড়ি? অসম্ভব।”
–“বোরখা পড়তে হবে না। শুধু শাড়ি পড়ে আসলেই হবে।”
–“বিয়ের পর প্রথম শ্বশুর বাড়ি যাবো, তাও আবার বোরখা ছাড়া? মানুষ কি বলবে?”
–“বিয়ের দিন কি বউরা শাড়ি পড়ে আসে?”

–“তা যায় না___”
–“তাহলে?”
–“আচ্ছা পড়বো শাড়ি।”
–“গুড।”
–“আপনাকে পরে ফোন দেই আমি? এখন একটু রাখি?”
–“আচ্ছা, আচ্ছা।”

রুজবা লাইন কেটে দিয়ে মৃদু হাসে। এক পলক আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখে। পরণে লাল ব্লাউজের সাথে সাদা জামদানী। কুচি দিয়ে শাড়ি পড়েছে৷ লম্বা চুলগুলো এলোমেলো ভাবে খোপা করে তাতে চুলের কাঠি লাগায়। কানে বড় ঝুমকো, দুহাত ভর্তি চুড়ি, ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক এবং চোখে কাজল। ব্যাস এতেই রেডি রুজবা। নির্ঝর দৌড়ে এসে রুজবার আঁচল টেনে বলে,

–“ছোটমাকে বউ লাগছে।”
রুজবা হেসে নির্ঝরকে কোলে তুলে নেয়। গালে চুমু দিয়ে বলে,
–“তাই? কার বউ লাগছে?”
–“চাচ্চুর বউ।”

রুজবা এইটুকুন বাচ্চা ছেলের কথায় লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। নুহাশের বউ ও? নুহাশের বউ হয়ে আজ প্রথমবার ও নুহাশদের বাড়িতে পা রাখবে। কেমন যেন অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে। অচেনা, অজানা, কিছুটা ভয় আর সাথে একরাশ ভালো লাগা৷ সবকিছুর মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। আচ্ছা নুহাশ যদি ফারিন আর কিয়ানের হলুদে ওকে উপস্থিত দেখে তাহলে কি লোকটা চমকাবে না?

অবশ্যই চমকাবে৷ ভীষণ চমকাবে। লোকটার চমকানো মুখটাই তো দেখতে চায় রুজবা। তাই তো নুহাশকে জানালো না ও আর রুপশা এখনই যাচ্ছে ও বাড়িতে৷ দুপুরে রাফাত আর বাবা-মা যাবে৷ নয়টার দিকে নোমান সাহেব নির্ঝরকে নিয়ে রুজবাদের বাসায় এসেছে রুজবাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এটা নুহাশ জানে না। ও তো তখন শপিংয়ে গেছিলো।
শাহানা বেগম নোমান সাহেবকে পাঠিয়েছে রুজবাকে নিতে।

রুজবা আর ফারিন বেস্ট ফ্রেন্ড এখন ওর হলুদে রুজবা না থাকলে দুজনেরই তো ভীষণ মন খারাপ হতো। তাছাড়া রুজবা এখন উনার ছোট ছেলের বউ, দেবরের বিয়েতে সে সবার সাথে উপস্থিত থেকে হই হুল্লোড় করবে না তা কি হয়? সেজন্যই উনি নোমান সাহেবকে কথাটা বলেছেন। উনার কাছেও ভালো লেগেছে শাহানা বেগমের প্রস্তাব, তাই তো কালবিলম্ব না করে নির্ঝরকে নিয়ে চলে আসেন রুজবাদের বাড়ি।

নুহাশকে পাঠাতো, কিন্তু রুজবা আজই প্রথম যাবে তাই উনি নিজেই এসে নিয়ে যাচ্ছেন। যাতে বিষয়টা দেখতেও ভালো লাগে৷ শাহানা বেগম রুজবাকে ফোন করে জানিয়ে দেয় রুজবা আর রুপশা যেন হলুদের জন্য একেবারে শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে আসে। আদিরা জান্নাত সবাই শাড়ি পড়বে। রুজবা ওরা বিয়ে বাড়ি গিয়ে রেডি হতে গেলে সময় বেশি লাগবে। তাই বাড়িতে থেকেই ধীরে সুস্থে রেডি হয়ে যেতে বলেন উনি।

নুহাশদের বাড়ি পা রাখতেই অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে রুজবার। নোমান সাহেব রুজবাকে নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকতেই শাহানা বেগম দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে ওকে। রুজবা নিচু কন্ঠে সালাম জানায়৷ শাহানা বেগম সালামের জবাব নিয়ে রুজবা রুপাশা দুজনকেই সোফায় বসিয়ে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে। আদিরা কিয়ানদের বাড়ি। হলুদের সবকিছু দেখভাল করছে৷ রুজবার জন্যই অপেক্ষা করছিলো ওরা, এবার হলুদের অনুষ্ঠান শুরু করবে। রুজবা আসার কথা শুনে আদিরা দ্রুত চলে আসে নিজেদের বাড়ি। রুজবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

–“কেমন আছো তুমি? কতদিন পর দেখলাম তোমায়।”
–“আলহামদুলিল্লাহ ভাবী, আপনি কেমন আছেন?”
–“ভালো।”

এই বলে আদিরা রুপশাকেও এটা ওটা জিজ্ঞেস করে৷ হঠাৎ করে রুজবার লিয়ার দিকে চোখ গেলো। লিয়া রুজবাকে দেখে রাগে দাঁত কিড়মিড়িয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। রুজবা দৃষ্টি সরিয়ে ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে। ইতিমধ্যেই শাহানা বেগম কয়েক ধরনের নাস্তা এনে হাজির করেন। খেতে না চাইলে জোর করে হালকা নাস্তা করান উনি। তারপর আদিরা রুজবা আর রুপশাকে নিয়ে কিয়ানদের বাড়ি যায়৷

ফারিন এসে জাপ্টে ধরে রুজবাকে। এভাবে পরিবার ছাড়া বিয়ে করতে হচ্ছে বলে বেশ কাঁদে ফারিন। কিন্তু এছাড়াও যে আর উপায় নেই। রুজবা শান্ত করে ওকে৷ চোখের পানি মুছে দেয় যত্নসহকারে। ফারিন আর কিয়ানকে পাশাপাশি বসানো হয় স্টেজে।

এখানে এসেও রুজবা নুহাশকে দেখতে পেলো না। ভেবেছিলো ওদের বাড়িতে যেহেতু নেই তাহলে কিয়ানের সাথে হবে নিশ্চয়ই, কিন্তু এখানে কিয়ানও একা। তাহলে লোকটা কোথায়? কিয়ান বুঝতে পেরে রুজবার পাশে এসে দাঁড়ায়। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,

–“তুমি যাকে খুঁজছো, সে বোধহয় তার রুমে শুয়ে ঘুমাচ্ছে।”
রুজবা চমকে তাকায় কিয়ানের দিকে। মৃদু লজ্জা পায়। কিয়ান হেসে বলে,
–“কাল নিশ্চয়ই দুজনে সারারাত জেগে কথা বলছো? বেচারাকে সকালে দুই ভাবী মিলে ঘুম থেকে টেনে উঠাতে পারে না। বহু কষ্টে ওকে উঠিয়ে নিয়ে সকালে শপিংয়ে গিয়েছে ভাবীরা। ডাকবো নুহাশকে? ও তো মেবি জানে না তুমি আসবে, জানলে ঘুমাতো না। কাউকে দিয়ে ডেকে দিই?”

–“না থাক, উনি ঘুমাক। ঘুম ভাঙানোর প্রয়োজন নেই।”
কিয়ান মৃদু হাসলো৷ তখনই নির্ঝর এসে রুজবার হাত ধরে টানতে টানতে নুহাশদের বাড়ি নিয়ে যায় ওকে। রুজবাকে আসতে দেখে লিয়া বাঁকা হেসে চলে যায়। বাড়ি এখন সম্পূর্ণ ফাঁকা। সবাই কিয়ানদের বাড়ি। নির্ঝর রুজবাকে নুহাশের ঘরের সামনে নিয়ে আসলো। ঘরে ঢুকতে গেলেই পেছন থেকে জান্নাতের মেয়ে রিজা নির্ঝরকে ডাকে। নির্ঝর রুজবার দিকে তাকিয়ে বলে,

–“চাচ্চুর ঘর, তুমি যাও আমি আসি।”
কথাটা বলতে বলতেই দৌড়ে চলে যায় নির্ঝর। রুজবা পড়ে মহা বিপাকে। কি করবে এখন? ভেবে পায় না কিছু৷ ভাবলো ঘরের ভিতর যাবে না। একবার উঁকি দিয়ে দেখবে বাইরে থেকে। যেই ভাবা সেই কাজ। রুজবা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিতেই ওর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। চমকে দুই পা পিছিয়ে যায় রুজবা। চোখে পানি টলমল করছে। খালি গায়ে নুহাশ শুয়ে আছে।

নুহাশের দিকে ঝুঁকে বসে আছে লিয়া। আলতো করে হাত দিয়ে স্পর্শ করে নুহাশের সারামুখ তারপর স্পর্শ করে নুহাশের বুকে। কপালে চুমু দিতে গেলেই চিৎকার করে উঠে রুজবা। ও জানে নুহাশ কোনো ভাবে ঠকাতে পারে না রুজবাকে। কখনো ঠকাবেও না।

নুহাশ ওকে কতটা ভালোবাসে সেটা রুজবা খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু এই মূহুর্তে ওর নিউরন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে যেন। মনে হচ্ছে লিয়া কেন ওর মানুষটাকে স্পর্শ করবে? কিভাবে করে? নুহাশ টের পাচ্ছে না কেন? বুঝতে পারছে না কেন? রুজবার সহ্য হচ্ছে না আর। নিজের স্বামীর পাশে পর-নারীকে কোনো স্ত্রীই সহ্য করতে পারে না।

রাগে ফোঁসফোঁস করে ঘরে যায় রুজবা। আচমকা এমন চিৎকারে ধরফরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে নুহাশ। সামনে রুজবাকে রাগী চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। লিয়া ততক্ষণে সরে অন্য সাইডে গিয়ে দাঁড়ায় যার ফলে নুহাশের চোখে পড়ে না আর। নুহাশ ফোনে সময় দেখে সাড়ে দশটা৷ ও উঠে দাঁড়ায় রুজবার মুখোমুখি। ওর হাত ধরে জিজ্ঞেস করে,

–“হোয়াট অ্যা সারপ্রাইজ বউ? দুপুরে আসার কথা ছিলো না? আগে আগেই___”
রুজবা হাত সরিয়ে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–“আপনার থেকে বেশি সারপ্রাইজ তো আমি। লিয়া আপনাকে স্পর্শ করছে অপ্রীতিকর ভাবে, বাজে ভাবে স্পর্শ করছে আর, আর___”
কথাটা বলার সময় রুজবার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে অনবরত। নুহাশ বিস্মিত চোখে তাকায় রুজবার দিকে। শক্ত কন্ঠে বলে,

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩২

–“কি আজেবাজে বলছো? লিয়া__”
বলতে বলতেই নুহাশের চোখ যায় লিয়ার দিকে। মূহুর্তেই চোয়াল শক্ত হয়। নুহাশের বুঝতে অসুবিধা হয় না কি ঘটতে পারে বা কি ঘটেছে।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩৪