অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩০

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩০
অরনিশা সাথী

নুহাশ শহরে নিজেদের শো-রুমে যাবে আজ। নোমান সাহেব কিছুদিন ধরেই বলছিলো একবার গিয়ে ঘুরে আসতে। নুহাশ সময় করে উঠতে পারেনি, তাই আজ সময় বের করেছে যাওয়ার জন্য। এরই মাঝে নুহাশের ছোট মামা বেশ কয়েকবার ওকে ফোন করে ডেকে পাঠিয়েছে। কোম্পানির কাজে নুহাশকে দরকার।

নুহাশ সরাসরি বলে দিয়েছে ও ইউএসএ’তে ব্যাক করবে না আর। এখানেই স্যাটেল্ড হবে। নুহাশের মামা হাল ছাড়ছে না। নুহাশ উনার কোম্পানিতে জয়েন করার পর বিজনেস সবসময় লাভের মুখ দেখেছে। নুহাশ কোম্পানি ছেড়ে দিলে আবার আগের জায়গায় নেমে যাবে উনি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তাই নুহাশকে যে কোনো ভাবে ইউএসএ যাওয়ার জন্য রাজি করাতে উঠে পড়ে লেগেছে উনি। কোনো ভাবেই নুহাশকে রাজি করাতে না পেরে উনি জানান বিডিতে থেকেই নুহাশকে উনার কোম্পানির জন্য কাজ করতে হবে। নুহাশ রাজি হয়ে যায়। সব ডাটা ইনফরমেশন নুহাশকে ই-মেইল করে দিবে ও এখান থেকেই কাজ করবে কোম্পানির জন্য৷ খুব ইমারজেন্সি পড়ে গেলে তখন যাবে ওখানে। এমনটাই কথা হয়েছে নুহাশ আর ওর ছোট মামার।

ফর্মাল লুকে রেডি নুহাশ। পরণে কালো গ্যাবাডিং প্যান্ট আর সাদা শার্ট। শার্টের উপরের দুইটা বোতাম খোলা। যার কারণে লোমশ বুক উম্মুক্ত। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো সেট করে নেয় নুহাশ। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ব্ল্যাক ওয়াচ নিয়ে হাতে পড়ে। গায়ে পারফিউম লাগিয়ে পেছনে ঘোরার আগেই পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরে ওকে। নুহাশের বুঝতে অসুবিধা হয় না কে হতে পারে। একটা মেয়ে এতটা ছ্যাচড়া কিভাবে হয় ভেবে পায় না ও। লিয়াকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে সজোরে চ/ড় বসায় ওর গালে৷ লিয়া গালে হাত দিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে বলে,

–“তুমি আমায় মারলে নুহাশ?”
নুহাশ লিয়াকে পাত্তা না দিয়ে চিৎকার করে ওর মা’কে ডাকে। মিনিট দুয়েক গড়াতেই শাহানা বেগম হন্তদন্ত হয়ে ছুঁটে আসে নুহাশের ঘরে। লিয়াকে দেখে ক্ষানিকটা ভয় পায় উনি। মেয়েটা নির্ঘাত আবার উল্টাপাল্টা কিছু করেছে। নয়তো নুহাশ এত রেগে যেতো না। শাহানা বেগম ভয়ে ভয়ে বলে,

–“কি হয়েছে বাবা? এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন?”
–“তোমার ভাইজি’কে বেরিয়ে যেতে বলো বাসা থেকে৷ ওকে বলেছি না ও যাতে এ বাসায় না থাকে? ওর সাহস কি করে হয় আমার ঘরে পারমিশন ছাড়া ঢুকে আমাকে জড়িয়ে ধরার? মিনিমাম ম্যানার্স নেই ওর? একজন বিবাহিত পর পুরুষের ঘরে ঢুকে এসব নোংরামি করে কোন সাহসে ও? আমার বাড়ি থেকে এক্ষুনি বেরিয়ে যেতে বলো, মাথা গরম আছে আমার নয়তো খুন করে ফেলবো।”

কথাটা বলেই বিছানা থেকে ফোন নিয়ে হনহনিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় নুহাশ। শাহানা বেগম বেশ কয়েকবার পেছনে ডাকলেও সে দাঁড়ায়নি। বাইক বের করে চলে যায়। শাহানা বেগম হতাশার শ্বাস ফেলেন। কি করবেন এ ছেলেকে নিয়ে ভেবে পায় না। লিয়ার উপরও বেশ রাগ হচ্ছে। অনেকদিন পর বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছেন বলে কিছু বলতেও পারেন না আদরের ভাইজিকে। কিন্তু আজ যেন আর সহ্য হলো না উনার। তেঁতে গিয়ে বললো,

–“কি সমস্যা তোর? নুহাশ বিবাহিত এটা জানিস না? ওর বিয়ের দিন এসে এ বাড়িতে ঝামেলা পাকিয়েছিস মানলাম। প্রথমবার ভেবে ছাড় দিয়েছি। কিন্তু রাতে তুই কি করেছিস? নুহাশের শ্বশুর বাড়ি গিয়ে হাজির হয়েছিস, সেখানেও উল্টাপাল্টা করেছিস আজ আবার। আর কত লিয়া? আত্মসম্মান বোধ টুকুও নেই তোর? বিবাহিত ছেলের পেছনে পড়ে আছিস কেন? তুই অনেক সুন্দর মা, নুহাশের থেকে ভালো কাউকে পাবি। ভুলে যা ওকে। নুহাশ বিবাহিত ওর বউ আছে।”

–“আমি যখন নুহাশকে ভালোবেসেছি তখন ও বিবাহিত ছিলো না। আমার ওর থেকে ভালো কাউকে চাই না ফুপ্পি আমি ওকেই চাই। তুমি বুঝাও না নুহাশকে।”
শাহানা বেগম হতাশ শ্বাস ফেললেন। ব্যর্থ চোখে তাকান লিয়ার দিকে৷ আর কোনো উপায় না পেয়ে ঠিক করলো এক্ষুনি লিয়ার বাবাকে ফোন দিয়ে সবটা জানাবে উনি। মনে মনে এসব ঠিক করেই নিজের ঘরে দিকে পা বাড়ান শাহানা বেগম।

রুজবা ফারিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। গত চারদিন ধরে মেয়েটা শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। কিয়ান ওর পরিবার’কে পাঠিয়েছিলো বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু আসাদ সাহেব সরাসরি নাকোচ করে দেন। রোমান সাহেব ও রিয়ান অনেক অনুরোধ করেছিলেন আসাদ সাহেবকে কিন্তু উনি এই সম্পর্ক মানতে নারাজ। জানান খুব শীঘ্রই উনি দিপ্ত’র সাথেই ফারিনের বিয়ের কাজ সম্পন্ন করবেন।

এতে রোমান সাহেব আর রিয়ানের কিছুই করার ছিলো না। উনারা উনাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। কিয়ানের সাথেও কোনো যোগাযোগ করতে পারছে না ফারিন। আসাদ সাহেব ফোন কেড়ে নিয়েছেন। আসাদ সাহেব আজ বাড়ি নেই। হাঁটে গিয়েছেন। সেই সুযোগেই রুজবা এসেছে। কিয়ানের সাথে কথা বলিয়ে দিবে। রুজবা কিয়ানের নাম্বারে ডায়াল করে ফারিনের দিকে ফোন এগিয়ে দেয়। সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হয়। যেন এই ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলো কিয়ান। ফারিন হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠে। কিয়ান বহু কষ্টে নিজেকে সামলায়। প্রেয়সীর কান্না সহ্য হয় না যে ওর। ফারিনকে শান্ত করতে বলে,

–“কেঁদো না তো। আমি কি মরে গেছি? তোমার বিয়ে অন্য কারো সাথে আমি বেঁচে থাকতে হতে দিবো না ফারিন। এইটুকু ভরসা তুমি আমাকে করতেই পারো।”
–“শুক্রবার বিয়ে কিয়ান। হাতে আর দুদিন। বাবা বড্ড তাড়াহুড়ো করে ফেলছে। কি করবো কিচ্ছু ভেবে পাচ্ছি না। প্লিজ কিছু একটা করো। নয়তো, বিয়ের বেনারসি গায়ে জড়ানোর আগে কাফনের কাপড় গায়ে জড়াবো আমি বলে রাখলাম।”

কিয়ানের বুকটা ধক করে উঠলো। এসব কথা যে কি পরিমান যন্ত্রণা দিচ্ছে ওকে এটা শুধুমাত্র ও নিজেই জানে। কিয়ান বেশ কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
–“তোমার বাবা আমাদের সম্পর্ক মানছে না ফারিন। মনে হয় না উনি স্বেচ্ছায় আমাদের বিয়ে দিতে রাজি হবে।”
–“আমি অতশত জানি না, তুমি কিভাবে কি করবে শুধুমাত্র তুমি জানো। নয়তো আমি যা বলেছি তাই করবো, তবুও তুমি ব্যাতিত অন্যকারো সাথে নিজেকে জড়াবো না। কবুল বলবো না।”

–“পারবে পরিবার ছেড়ে আমার হাত ধরে চলে আসতে? এই মূহুর্তে এটা ছাড়া আর কিচ্ছু আমার মাথায় আসছে না। তোমার বাবাতে অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি আমি, আমার পরিবার। তবুও তো বুঝতে চাইছেন না উনি।”
–“আমি এভাবে তোমার হাত ধরে বাড়ি ছাড়লে আমার বাবা শেষ হয়ে যাবে কিয়ান। আমি পারবো না এটা। তুমি, তুমি চেষ্টা করো আমার বাবাকে মানানোর প্লিজ। আমি তোমাদের কাউকে ছাড়তে পারবো না। রাখছি এখন, বাবা চলে আসবে যে কোনো সময়।”

কথাটা বলেই ফারিন নিজেই ফোন কেটে দেয়। কিয়ান বিছানায় ফোন ছুঁড়ে মেরে দুহাতে নিজের মাথার চুল খামচে ধরে৷ চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে অনবরত। কিভাবে কি করবে ও? পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় মাথায় আসছে না তো ওর। কিন্তু ফারিন তো রাজি হচ্ছে না। তার উপর আবার কিসব বলে দিলো মেয়েটা৷ কানে শুধুমাত্র ফারিনের বলা, ❝বিয়ের বেনারসি গায়ে জড়ানোর আগে কাফনের কাপড় গায়ে জড়াবো আমি বলে রাখলাম❞ এই কথাটা’ই অনবরত বেজে চলছে।
রুজবা বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে ফারিনকে বললো,

–“পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমিও আর কোনো উপায় দেখছি না ফারু। চলে যা কিয়ান ভাইয়ার সাথে।”
–“আমি পারবো না, বাবাকে এত বড় কষ্ট দিতে আমি কিছুতেই পারবো না।”
–“তাহলে আর কি? বিয়ে করে নে দিপ্ত ভাইকে। এতে তোর বাবা কষ্ট পাবে না বরং খুশিই হবে।”
–“কিয়ানকে ছাড়া অন্যকাউকে বিয়ে করার কথা আমি চিন্তাতেও আনি না রুজবা।”

–“তাহলে করবি টা কি? যে কোনো একটা তো বেছে নিতে হবে তোকে। এখন যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতিতে তুই একইসাথে দুজনকে পাবি না। যে কোনো একজনকে চুজ করতে হবে তোর। কিয়ান ভাই তো কম চেষ্টা করেনি। তাহলে কাকা’কে কষ্ট দিতে না চাইলে কিয়ান ভাইকে ভুল যা তুই। কাকা’র পছন্দেই বিয়ে করে নে।”

–“তার থেকে বরং মরে যাবো আমি।”
–“তখন তোর বাবা কষ্ট পাবে না? কিয়ান ভাইয়ের সাথে চলে গেলে তুই তো বেঁচে থাকবি, কাকা কয়দিন কষ্ট পাবে? ছয় মাস? এক বছর? বড়জোর পাঁচ বছর? এরপর একদিন ঠিক মেনে নিবে ফারু। কিন্তু তুই যদি মরে যাস তাহলে তোর বাবা আজীবন তোকে হারানোর কষ্ট নিয়ে বাঁচবে এটা চাস তুই?”

ফারিন ডুঁকরে কেঁদে উঠে। কি করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না৷ রুজবার কথাগুলো ফেলে দেওয়ার মতো না৷ রুজবা ঠিকই বলেছে। রুজবা ফারিনকে চুপ থাকতে দেখে বললো,

–“দেখ ফারু, কাকা একদিন ঠিক মেনে নিবে৷ কিন্তু তুই আজ কিয়ান ভাইকে হারালে আর কোনোদিনও ফিরে পাবি না। আজীবন কিয়ান ভাইকে হারানোর কষ্ট বুকে নিয়ে বাঁচতে হবে তোকে। হ্যাঁ একদিন বাস্তবতা মেনে নিয়ে দিপ্ত ভাইয়ের সাথে সংসার জীবনে এগিয়ে যাবি তুই, কিন্তু কোথাও না কোথাও কিয়ান ভাইর শূণ্যতা থেকে যাবে তোর৷ আর সেটা আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে। এবার তুই ভাব তুই কি করবি।”
ফারিন কিচ্ছু বললো না। চুপচাপ বসে চোখের পানি ফেলছে৷ রুজবা উঠে বললো,

–“আসি আমি, তুই ভালো করে ভাব ফারিন। তারপর তোর মন যেটা সায় দেয় সেটাই করিস। সম্পূর্ণ তোর চয়েজ, এখানে তোকে কেউ কিচ্ছু চাপিয়ে দিচ্ছে না।”
কথাগুলো বলেই রুজবা বেরিয়ে আসে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে।

শো-রুম থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়েছে নুহাশের। মেজাজ এখনো চটে আছে। বাসায় ফিরে লিয়াকে এখনো দেখে রাগটা যেন তড়তড় করে বেরে যায়। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নেয়৷ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয় আগে। শাহানা বেগম ঘরে এসে প্রশ্ন করে,

–“খেতে দিই? না খেয়ে আছিস না?”
–“শো-রুম থেকেই খেয়েছি দুপুরে। স্টাফ’রা খাবার আনিয়েছিলো।”
–“সে তো দুপুরে খেয়েছিস, এখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। হালকা কিছু দেই?”
–“নাহ, লিয়া যায়নি কেন এখনো?”

–“তোর মামাকে ফোন দিয়ে বলেছি সব। বলেছে দুদিনের মধ্যেই ওকে নেওয়ার ব্যবস্থা করবে।”
নুহাশ হাতে ঘড়ি পড়ে বেরোতে বেরোতে বললো,
–“দুদিন কিন্তু।”
–“এখনই তো বাসায় ফিরলি, আবার কোথায় যাচ্ছিস?”

–“মেজাজ এমনিতেই বিগড়ে আছে, বাড়িতে লিয়াকে আশেপাশে দেখলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো কিনা জানি না, তাই বাইরে থাকবো তাই ভালো৷”
–“বাড়ি ফিরবি না?”

–“হু, দশটা নাগাদ ফিরে আসবো। চিন্তা করো না।”
এক মূহুর্ত দাঁড়ালো না নুহাশ। বেরিয়ে যায় ও। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাহানা বেগম।

–“কি করছো?”
–“তেমন কিছু না, আপনি কি করছেন? বাসায় ফিরেছেন?”
–“হ্যাঁ, এখন তোমার বাসার সামনে আছি। বের হও দ্রুত।”

রুজবা ফট করে দাঁড়িয়ে যায়। নুহাশ ওর বাড়ির সামনে এসে ফোন দিয়েছে? রুজবা বলে,
–“বাইরে কেন? বাসার ভেতরে আসেন।”
–“উঁহু, দুদিন পরপরই শ্বশুর বাড়ি আসলে সবাই বলবে ❝নুহাশ ফারদিন❞ বউ পাগল, বউ ছাড়া কিচ্ছু বুঝে না। যদিওবা আমি সত্যিই বউ পাগল। আর কারো কথায় আমার কিছু যায় আসেও না। কিন্তু অন্য সবার মুখ থেকে কথাটা শুনতে তো আর মিসেস ফারদিনের ভালো লাগবে না তাই না? এজন্য আসছি না। তুমি বের হও দ্রুত।”
নুহাশের কথায় রুজবা ফিক করে হেসে দেয়। নুহাশ মুগ্ধ হয়ে শুনে সে হাসির শব্দ। রুজবা বলে,

অনেক সাধনার পরে পর্ব ২৯

–“আসছি।”
নুহাশ লাইন কেটে দেয়। রুজবা কাউকে না বলেই বের হয় বাসা থেকে।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩১