নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ২৬

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ২৬
ইফা আমহৃদ

আরু ও তুর অপেক্ষা করছে শেফালী ও অপূর্বর জন্য। শেফালী দৃঢ় গলায় জানিয়েছে, সে তিস্তার সাথে সাক্ষাত করতে যাবে না। কিন্তু অপূর্ব কেন বিলম্ব করছে তা ঠাউর করতে পারে না ওরা। মিনিট তিন পর অপূর্ব এলো। তবে বেশ রাগান্বিত হয়ে, হাতে নতুন একটা জিন্স। আরুর সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলে, “এটা কী করেছিস তুই? সেলাই করেছিস কেন? আমাকে বলেছিলি আলমারিতে তুলে রাখবি, তোলার নাম করে কী করেছিস এটা? আমার আরও একটা স্টাইলিশ জিন্স দিয়ে তুই ঘর মুছেছিস।”

অবিলম্বে আরু অপূর্বর হাত থেকে কেড়ে নিল জিন্সটা। ভালোবাসে পর্যবেক্ষণ করে উপলব্ধি করে, সেই ছেঁড়া জিন্সটা। চড়া গলায় বলে, “এজন্য কারো ভালো করতে নেই। আপনাকে ব/ল/দ পেয়ে ছেঁড়া জিন্সটা গছিয়ে দিয়েছিল। ফেলে দেওয়ার চেয়ে সেলাই করে পরা ভালো। তাই নিজের হাতে সেলাই করেছি।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“এটা ছেঁড়া?”
“উঁহু। ছেঁড়া নয়। মনে হয় এই জিন্সটা কেনার জন্য দুজনে টানাটানি করেছিল। তখন ফেসে গেছে।”
“এটা স্টাইল!”
“এটা স্টাইল?”

“জি। থাকিস তো গ্ৰামে। জানবি কীভাবে? ড্রেস সম্পর্কে তোর কোনো আইডিয়া আছে? এমনিতেই খাঁটো, আবার একটা শাড়ি পরে ঘুরঘুর করিস। একদম ফুটবলের মতো লাগে তোকে। যা, শাড়ি পালটে একটা থ্রী পিস পরে আয়।” অপূর্ব থমথমে ভঙ্গিতে কথাটা বলে। আরু চাপা রাগ নিয়ে ঘরে চলে গেল। অতঃপর পথের দিকে চেয়ে লাজুক হাসি দিল। তুর অপূর্ব-র কাঁধে হাত রেখে বলে, “ভাই, আরুকে একদমই ফুটবলের মতো লাগে না। চোখ ঝলসানো পরীর মতো লাগে। আর তুমি তালগাছের মতো লম্বা, আরু মোটেও বেঁটে নয়।”

“তা তো জানিই। কোনো ছেলেই চাস না, তার প্রিয়তমার সৌন্দর্য অন্য কোনো পুরুষের চোখে পড়ুক।” অপূর্বর কথায় প্রয়াসের কথা স্মরণে এলো তুরের। তিয়াস তো পেয়ে গেল নিজের ভালোবাসার মানুষকে। কিন্তু তুর? সে কখনোই বাবা মায়ের মুখে চুনকালি লেপে প্রয়াসের হাত ধরে পালিয়ে যাবে না। ‘এতে যদি তাকে শেফালীর মতো আগুন বুকে চেপে স্বাভাবিক থাকার ভান করতে হয়’ – এতেও অসম্মতি নেই তুরের। তুর কল্পনা থেকে বেরিয়ে অপূর্বকে রঙ্গ করে বলে, “সামথিং! সামথিং!”

“নাথিং!” বলে হাতের দিকে ইঙ্গিত দিল অপূর্ব। অবিলম্বে হাত নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় তুর। আশেপাশে গভীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে শেফালীর সন্ধানে নামে অপূর্ব। ব্যস্ত থাকলে সবকিছু থেকে দূরে থাকবে শেফালী। অপূর্ব বলে, “শেফুকে দেখছি না যে, কোথায় ও?”

“কত করে বললাম আমাদের সাথে চল। ও যাবে না বলল।” তুর জানায়। তিয়াস তৈরি হয়ে এদিকেই এসেছে। রক্তের সম্পর্ক তিস্তার সাথে, তিয়াস না গেলে ভালো দেখায় না। তিয়াসের আপাদমস্তক নজরবন্দি করে অপূর্ব মুখ খুলে, “তোকে যেতে হবে না। কিছুক্ষণ পর সুমির বাবা ও চাচা আসবে। তুই তাদের জামাই। তোর এখানে থাকা জরুরি।”

“তিস্তা তো আমাদের অপেক্ষায় আছে!”
“আমিও তো ওর ভাই? তোর মতো আপন নয়। তবে ভাই তো। চিন্তা করিস না, আমি এই বিষয়ে কিছু বলব না। মেয়েটা তাহলে ওযথা চিন্তা করবে।”

“বাঁচালেন আমায়। আচ্ছা তাহলে আমি যাই, ওনারা ব্রীজ পর্যন্ত চলে এসেছে।” তিয়াস বিদায় নিয়ে চলে গেল ব্রীজের দিকে। আরুও শাড়ি পালটে উজ্জ্বল লাল রঙের থ্রিপিস পরে এসেছে। সাজগোজ টাও আগের তুলনায় বাড়িয়ে দিয়েছে। চোখের উপরে ও নিচে মোটা কাজল লাগিয়েছে, লাল টুকটুকে লিপস্টিক, দুহাত ভর্তি চুড়ির মাঝামাঝি একটা রুপার বালা।

পায়ে নূপুরের পাশাপাশি এখন আলতায় রাঙা, কপালের মাঝবরাবর একটা টিপ, হাঁটু সমান চুলগুলো খোলা। হাওয়াতে উড়ছে। ঠোঁটে ঝুলে আছে রহস্যময় হাসি। মেয়েটা কি কথাগুলো শুনে ফেলেছে? অপূর্বর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এই যে চৈত্র আসার আগেই চৈত্রের কাঠ ফাটা রোদ্দুরের তান্ডব শুরু করে দিয়েছে। কাছাকাছি আসতেই অপূর্ব দিল রাম ধমক, “চুলগুলো খোঁপা কর জলদি। মাথায় কাপড়ও দিবি। আমি শেফুকে নিয়ে আসছি।”
অপূর্ব দ্রুতগতিতে ঘরের ভেতরে চলে গেল। দুই গ্লাস পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিল। আরেকটু হলেই পানির পিয়াসে প্রাণ পাখিটা উড়ে যেত।

প্রথম রিকশা এসে থামল তালুকদার বাড়িতে। তুর ও আরু রিকশা থেকে নেমে অপেক্ষা করছে অপূর্বদের জন্য। অপূর্ব ও শেফালী আলাদা রিকশায় আসছে। আরুর মন বেজায় ভার‌। তার প্রবল স্পৃহা রিকশায় অপূর্ব হাত জড়িয়ে এত পথ পাড়ি দিয়ে তিস্তাদের বাড়িতে আসবে। পৃথিবীতে সকল প্রেমিক প্রেমিকারা চায়, প্রিয় মানুষের সাথে একান্ত সময় পার করতে। আরুও তার ব্যতিক্রম নয়!

আচ্ছা আমি কি অপূর্ব ভাইয়ের পাশে দাঁড়ানোর যোগ্য নই? আমাকে তার সাথে মানায় না বলেই কি তিনি অন্য রিকশায় এসেছেন? অপূর্বর জন্য সাজগোজটা বিষের মতো লাগল আরু কাছে। সময় নিয়ে সাজটা বৃথা। সৌজন্য হেসে ওড়না দিয়ে লেপটে দিল চোখের কাজল, লিপস্টিক, ফেলে দিল টিপ। চুলগুলো খোঁপা করে ওড়না টেনে দিল মাথায়। চুড়িগুলো চেপে কয়েকটা ভেঙে ফেলল।

তখন অপূর্ব এলো। দুই রিকশার ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। আড়চোখে একবার আরুকে দেখে মলিন লাগল মুখশ্রী। কিছুক্ষণ পূর্বেও প্রাণবন্ত ঠেকছিল সেই মুখ। হাতেও নেই সব চুড়ি। অপূর্ব সন্দিহান গলায় বলে, “কিরে সাজগোজ নষ্ট করেছিস কেন?”
“একটু আগেও না সব ঠিক ছিল?” তুর বলে।

“তিস্তা আপু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। চলো।” বিষয়টা সাবধানে ধামাচাপা দিয়ে আরু আগেই হেঁটে চলে গেল। অপূর্ব তাকালো মাটির দিকে। সেখানে চুড়ির টুকরো পড়ে আছে। টিপ ও সাথে কয়েক ফোঁটা রক্ত। ভাঙল প্রেমের বান। মনে মনে আওড়াল, “এত অভিমান কেন তোমার? কেন বুঝতে পারো না আমায়? আজকাল তোমার দিকে তাকালেও নিজেকে বেসামাল লাগে। আজ তো নিজেকে সেজেছ গোলাপ রানী। নিজেকে সামলাতে কতটা কষ্ট করতে হয়েছে, তা কি তুমি জানো?”

“তোরা ভেতরে যা। আমি আসছি‌।” মিষ্টির হাঁড়ি ও যাবতীয় বাজার দিয়ে দিল তুরের হাতে। ওরা দুজন চলে যেতেই অপূর্ব হাঁটু গেড়ে বসে। ভাঙা চুড়ির টুকরো জোড়া দিয়ে বুঝে চারটা চুড়ি ভেঙেছে। অপূর্ব দুর্বল হেসে বাড়ির ভেতরে যেতে যেতে বলে, “চারটা চুড়ি ভেঙেছ তুমি গোলাপ রানী। তোমাকে চার ডজন চুড়ি কিনে দেওয়া আমার দায়িত্ব।”

প্রিয় মানুষদের পেয়ে আরেকদফা কেঁদে ভাসিয়েছে তিস্তা। আরুও কম যায় না, সেও কাঁদল। অভিমানে একবারও তাকাল না অপূর্ব দিকে। তিস্তাদের টিনের বাড়ি। বাড়িতে অসংখ্য মানুষ গিজগিজ করলেও বাড়ির মূল সদস্য বর্তমানে তিনজন। সুজনের মা, ভাই, সুজন ও তিস্তা। বাকিরা বিয়ে উপলক্ষ্যে আসা অতিথি।
সুজন ও সেই ছেলেটা এলো সেখানে। গতকাল যে আরুর রুপের প্রশংসা করছিল। ওর নাম দর্পণ। ইতস্তত নিয়ে বলে,‌ “স্যরি‌। আসলে আমি বুঝতে পারিনি, বেয়াইদের সাথে‌ আপনারা তেমন মিশেন না। তাহলে আমরা কখনোই এমন করতাম না।”

“সমস্যা নেই। আসলে আমাদের বংশে তিস্তা আপুর বিয়েই ছিল প্রথম। বেয়াই বেয়ানদের সাথে কেমন সম্পর্ক হয় আমরা জানি না।” তুর বলে। ছেলেটা আবার আরুর রূপের মুগ্ধতা প্রকাশ করে, “আপনাকে দেখতে কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে। সাজগোজ নষ্ট হওয়ার পরেও অপূর্ব লাগছে। না জানি যখন সেজেছেন, তখন কেমন লাগছিল।”

তিস্তাদের এই বাড়ির এই ঘরটার একটা জানালা পূর্ব দিকে। তাই সূর্যের রশ্মিটা ঘরের ভেতরে পড়ছে। আরু তার বিপরীত পাশে বসেছে বলে সূর্যের রশ্মিতে তার মুখমণ্ডল সৌন্দর্যে দ্বিগুণ হয়েছে। অপূর্ব দর্পণের সব কথা সহ্য করে নেয়। আরু তা লক্ষ্য করে অপূর্বকে আরেকটু ঈর্ষান্বিত করে বলে, “আমাকে না-কি দেখতে ভালো লাগে না?”

“কে বলেছে? আমি বলব তার চোখ খারাপ। আপনার মতো সুন্দর মেয়ে আমি আর দেখিনি। তাহলে সেদিন বললাম, আমি হলে ভাবীকে রেখে আপনাকে বিয়ে করতাম?” বলেই দর্পণ ছেলেটা হাসল। আরুর ওর সাথে তাল মেলালো। অপূর্ব সবকিছু সহ্য করে উঠে দাঁড়ায়। ইতোমধ্যে বেতের টেবিলটাতে খাবারে ভর্তি করে ফেলেছে। একপাশে অপূর্বর নিয়ে আসা বাজার। অপূর্ব বাজারগুলো তিস্তার হাতে দিয়ে বলে, “এগুলো ভেতরে নিয়ে যা। বাড়িতে জরুরি কাজ আছে। আমাকে যেতে হবে। চিন্তা করিস না, আগামীকাল আমি গাড়ি নিয়ে এসে তোদের নিয়ে যাবো।”

তিস্তার মনে বর্ষণ শুরু হয়ে গেল। প্রিয় মানুষগুলো চলে যাবে ভাবতেই মলিন হয়ে এলো তার মুখমণ্ডল। বাজারগুলো নিয়ে ধীর পায়ে ভেতরে দিকে পা বাড়াল। অপূর্ব গেল তার পিছু পিছু। সবার অগোচরে একটা চিঠি তিস্তার হাতে গুজে দিয়ে বলে, “যখন একা থাকবি, তখন এটা পড়বি। বাকিটা বাড়িতে এসে জানবি। (কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে) মহারানী রেগে ঢোল হয়ে আছে। যখন তখন তোর ভাইয়ের গর্দানের আদেশ দিতে পারে। ভাইকে বাঁচাতে চাইলে, ওকে একটু সাজিয়ে দে।”

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ২৫

তিস্তা শুধু আরুকে নয়, তিনজনকেই সাজিয়ে দিল। তবে আশ্চর্যের বিষয়, এবার অপূর্ব নিজেই আগ বাড়িয়ে আরুর রিকশায় উঠে। শেফালী ও তুরকে আদেশ দেয়, “তোরা আগে আগে যা। বলা তো যায় না নতুন কোনো জ্বীন, পরীর রূপে মুগ্ধ হয়ে আবার ভর করে।”

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ২৭