নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ২৭

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ২৭
ইফা আমহৃদ

মোতাহার হোসেন ফোন করে কাজি সমেত বাড়িতে যেতে বলেছে অপূর্বকে। অপূর্ব বাবার আদেশ মেনে কাজি বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ফেরেনি বাড়িতে। আরও একটা গুরু দায়িত্ব পড়েছে। সুমির বিয়ের জন্য আপাতত লাল বেনারসি ও হালকা জুয়েলারি নিয়ে যেতে বলেছে।

তুর ও শেফালীর রিকশাটা মার্কেটের বাইরে রেখে আরুকে নিয়ে ভেতরে গেল অপূর্ব।
একেক পর এক শাড়ি দেখাচ্ছে। শাড়ি সম্পর্কে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই আরু ও অপূর্বর। তাই দোকানদারের দেওয়া শাড়িটাই পছন্দ করে নিল অপূর্ব। বিল মিটিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল করল আরু একটা লাল বিয়ের বেনারসির দিকে তাকিয়ে আছে অপলক। আরুর কাঁধে হাত রেখে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে অপূর্ব, “দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছ? পছন্দ হয়েছে?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“শাড়িটা সুন্দর না? একদম সিম্পল, কিন্তু মনকাড়া।” আরু শাড়ির মিহিন দেহে স্পর্শ করতে করতে অপূর্বকে প্রশ্ন করে। অপূর্বও ভালো লাগল। অপূর্ব ও‌ আরুর বিয়ে হতে বহু প্রহর অপেক্ষা করতে হবে, ততদিনে কোনো নারী এই বেনারসি অঙ্গে জড়িয়ে কোনো পুরুষের অর্ধাঙিনীর স্বীকৃতি নিবে। অপূর্ব শাড়িটাকে দেখিয়ে জড়ানো গলায় বলে, “এটাও প্যাকেট করে দিন।”

আরও কিছু শাড়ি কেনার পাট চুকিয়ে নিয়ে গেল জুয়েলারি দোকানে। আরুকে দায়িত্ব দিল গহনা পছন্দ করার। আরু পছন্দ করার ফাঁকে প্রশ্ন করে, “আপাতত আজকে পরার জন্য এই বক্সটা নিন। সাথে নরমাল জুয়েলারিগুলো। বক্সটার গহনাগুলো আজকের জন্য, আর এগুলো রোজকারের জন্য। তারপরে নাহয় সুমি ভাবী আর তিয়াস ভাইয়া পছন্দমতো কিনে নিবে।”

অপূর্ব আরুর কথা মেনে শাড়ি ও অলংকার
কিনে নিল। আরুকে সবকিছু বুঝিয়ে অপূর্ব মিষ্টি কিনতে গেল। শেফালীর হাতে একটা ছোটো কাঁচের কৌটা দেখতে পেল আরু। উচ্চ স্বরে বলে, “তুর ওর হাতে কী? যাওয়ার সময় তো দেখলাম না।”
“মাত্র কিনে নিয়ে এসেছে। ওর সাদা গোলাপ ফুলের গাছে না-কি পোকামাকড় বাসা বেঁধেছে। এজন্য এনেছে।” তুর বলে। ততক্ষণে মিষ্টি কিনে ফিরে এসেছে অপূর্ব। শেফালীও লুকিয়ে নিয়েছে সেই ওষুধটা। আরুর বুক কেঁপে উঠছে। শেফালী উলটাপালটা কিছু বলে বসবে না-তো?

সন্ধ্যা হতে না হতেই চাঁদের মৃদু প্রতিবিম্ব দেখা গেল জলে আর আয়নাতে দেখা গেল সুমির লজ্জায় মাখা বধূবেশের প্রতিবিম্ব। আরু লাল ওড়নাটা সুমির মাথায় তুলে দিয়ে বলে, “ভাবী, তোমরা কতদিন ধরে প্রেম করছিলে? প্রেম হলো কীভাবে?”

“একদম ছোট থাকতে। আমি তো তোমাদের ভাইকে পাত্তা দিতাম না। সে নিজেই আমার স্কুলের সামনে গিয়ে ঘুরঘুর করতো। সবার দেখাদেখি ভাবলাম আমিও নাহয় প্রেম করি। তবে এতটা কাবু হয়ে যাবো ভাবিনি।” বলেই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে উঠল সুমি। শেফালী তখন এলো দুধের গ্লাস নিয়ে। সুমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “খেয়ে নাও ভাবী।”
আরুর সন্দেহ লাগল ব্যাপারটা। যে মেয়েটা সহ্য করতে পারেনা সুমিকে, তার থেকে এমন মিষ্টি ব্যবহার প্রত্যাশার বাইরে। সুমি খাওয়ার জন্য হেসে গ্লাস তুলতেই আরু বাধা দেয়। গ্লাসটা ফিরিয়ে দিয়ে বলে, “এখন খেলে বাসর ঘরে স্বাদ পাবে না। পরে খেও। চল ভাবী। কাজি ডাকছে।”

তুর ধরে ধরে সুমিকে নিয়ে গেল ড্রয়িং রুমে। তবে আরুকে যেতে দিল না। বাহু ধরে টেনে ঘরের দ্বার বন্ধ করে দিল। হুংকার দিয়ে বলে, “তুই কেন সুমিকে দুধ খেতে দিলি না আরু? তুই কি আমার ভালো চাস না?”
“তারমানে আমার ধারণা সত্যি। তুই ওটা দুধে মিশিয়ে ছিলিস?”
“হ্যাঁ, মিশিয়েছি। ওকে মে/রে ফেলতাম আমি। আমার সামনে ও নেচে নেচে বিয়ে করে নিবে আর সেটা আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব। এতটা মহান আমি নই।”

“দেখ শেফু, সুমি ভাবী ও তিয়াস ভাই দুজন দুজনকে ভালোবাসে। ওদের সুখী হতে দে।” আরুর কথার প্রেক্ষিতে শেফালী বাক্য তোলে না। শেফালী গ্লাসটা নিয়ে পান করার প্রয়াস করল। চকিতে গ্লাসটা নিজের আয়ত্বে নিয়ে সরে গেল আরু। শেফালী ক্রমশ আরুর দিকে‌ এগিয়ে আসার পাশাপাশি গ্লাস ফেরত চাইছে। চট করে দরজার ছিটকিনি খুলে আরু বেরিয়ে গেল দুধের গ্লাস সমেত। ভীত শেফালী সেদিক যাওয়ার স্পর্ধা দেখায় না।

পারুল বাড়ির কাজ শেষ করে অয়নকে নিয়ে এসেছেন। পারুল উঠানে জাহানারা অনিতার সাথে কথা বলছেন। ছেলেদের বিয়ে মায়ের দেখতে হয় না বিধায় চাচিরা উঠানে বসে আছে। অয়ন ছুটে ভেতরে এসে লক্ষ্য করে আরুর হাতে দুধের গ্লাস। অয়ন আরুর থেকে গ্লাসটা নিতে নিতে বলে, “বুবু, তুই একা এই গ্লাস ভর্তি দুধ খাবি? আমাকেও একটু দে।

“না! একদম না।” হতভম্ব হয়ে আরু দ্রুত হাতটা উপরে তোলে। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উচ্চতা বৃদ্ধি করে আরুর হাত থেকে নেওয়ার প্রয়াস করে। অনবরত বারণ করে চলেছে আরু। তবুও নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে অয়ন। আরু অধৈর্য হয়ে দেয় ধমক, “এক চড়ে সবগুলো দাঁত ফেলে দিবে অয়নের বাচ্চা। বলেছি না, এটা দেওয়া যাবেনা। সামনে থেকে সর।”

অয়ন ছুটে গেল পারুলের কাছে। ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে, “মা, বুবু আমাকে দুধ খেতে দিচ্ছে না। এক গ্লাস দুধ। আমি বলেছি একটু দিতে। দিবে না, আরও আমাকে মারতে চায় বাবু।”

“আরু ওকে দুধের গ্লাস দে। আমার বাপের বাড়িতে দুধ কম পড়েনি যে, তোর ভাগ্যে জুটবে না। ওকে গ্লাসটা দিয়ে তুই আরও এক গ্লাস নিয়ে আয়।” বলতে বলতে গ্লাস নিতে অনেকটা এগিয়ে এলো পারুল। আরুর হাত থরথরিয়ে কাঁপছে। শেফালীর ব্যাপারটা বলা শোভা পায় না, অন্যদিকে গ্লাস দিলে অয়ন খেয়ে ফেলবে। পারুল গ্লাস ধরার পূর্ব মুহুর্তে আরু হাত ছেড়ে দিল।

অবিলম্বে তা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়। কাঁচের টুকরোগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। ক্ষোভের গোঙানি তুলে আরুর দিকে তাকায় পারুল। তিন সেকেন্ড পর তার হাতটা আপনাআপনি গিয়ে ঠেকে আরুর গালে। আরু বুঝতে পারিনি এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। আরও একটা চড় মারার জন্য হাত নাড়াতেই এগিয়ে এলেন অনিতা। আরুকে যথাসম্ভব আড়াল করে বলে, “মেয়েটাকে মারছ কেন পারুল? তোমার জোরাজুরিতে গ্লাসটা হাত ফসকে পড়ে গেছে। ভালোভাবে বললে আরু নিশ্চয়ই দিয়ে দিতো।”

“আমি গ্লাসটা ধরার আগেই ও ইচ্ছে করে ফেলে দিয়েছে। অয়নকে দুচোখে সহ্য করতে পারেনা মেয়েটা। ভাই হয় ওর, একটুখানি দিলে কী হতো?” তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আরুর পানে নিক্ষেপ করে প্রত্যুত্তর করে পারুল। পারুলের প্রশ্নের ফিরতি জবাব দেয় জাহানারা, “অয়ন যখন দেখছে, আরু ঐ গ্লাসে দুধ খাচ্ছে। তাহলে ওর কেন ওটাতেই খেতে হবে।

ডেক্সিতে আরও দুধ ছিল। আমাকে বললে আমিই দিতাম। তোমার মেয়ে নয়, তোমার ছেলে আরুকে সহ্য করতে পারে না। (অয়নকে উদ্দেশ্য করে) আয়, তোকে দুধের ভেতরে চুবিয়ে জীবনের মতো দুধ খাওয়া শেখাচ্ছি।”
সবাই ঘরের দিকে চলে গেল। আরু একা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দিঘির দিকে গেল। নারিকেল গাছের নিচে বসে নিঃশব্দে অশ্রু ফেলতে লাগল।

সুমি ও তিয়াসের বিয়ের কাজ শেষ। মাগরিবের নামাজ আদায় করতে দিঘির পাড়ে এসেছে অজু করতে। অজু করে উঠে উপরের দিকে দুই পা ফেলতেই নারিকেল গাছের দিকে তার চোখ পড়ল। আবছা অন্ধকারে মানুষের মতো ঠাওর করতে পারে অপূর্ব। তাই গলা ছেড়ে ডাকে, “কে ওখানে?”

আরু একটু নড়েচড়ে উঠে অপূর্বর ডাকে। ভাঙা গলায় সাড়া দিতে চেয়ে অনুভব করে তার গলায় কোনো স্বর নেই। অপূর্ব ততক্ষণে টর্চ নিয়ে এগিয়ে গেছে। আরুর মুখের দিকে তাকাতেই খণ্ডিত হলো নিজের বুক। উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ২৬

“এখানে বসে কাঁদছিস কেন মেয়ে? কেউ কিছু বলেছে?”
আরুর প্রত্যুত্তর হীন মুখ আভাস দেয় সম্মতির।

নীলপদ্ম গেঁথে রেখেছি তোর নামে পর্ব ২৮