অনেক সাধনার পরে পর্ব ২৯

অনেক সাধনার পরে পর্ব ২৯
অরনিশা সাথী

ড্রাইনিং রুমে বসে সবাই আড্ডা দিচ্ছিলো। একটু পরই নুহাশ, কিয়ান চলে যাবে। নুহাশ কথা বলছে কম, রুজবা’কেই দেখছে বেশী। ইশ্! একটু পর চলে যাবে মেয়েটাকে যে ভীষণ মিস করবে সে। আচ্ছা রাতে ঘুম হবে তো? এই ২ দিনে মেয়ে’টা যে বাজে একটা অভ্যাস তৈরি করে দিয়েছে। মেয়ে’টাকে বুকে না নিয়ে ঘুমালে কি ঘুম হবে তার? এখন থেকেই তো তার অস্বস্তি লাগছে। কিভাবে থাকবে? ভাবনার মাঝেই কিয়ান নুহাশ’কে চিমটি দিয়ে, নুহাশ এর কানে কানে বলে উঠে,

–“নজর লেগে যাবে তো ভাই আমার শালী’টার উপর। এভাবে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিস কেনো? বুঝছি নজর টিকা দিতে হবে রুজবা’কে।”
কিয়ানের দিকে রাগী চোখে একবার তাকিয়ে, ফের রুজবার দিকে তাকিয়েই আস্তে করে কিয়ান’কে বলে,
–“আমার চোখ জোড়া’ই আমার বউ এর জন্য নজর টিকা। আলাদা ভাবে নজর টিকার প্রয়োজন নেই।”
রুজবা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এই দুজন কি যে এত ফুসুরফুসুর করে আল্লাহ মালুম! কিয়ান রুজবার দিকে ঝুঁকে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“ভাবী জি, তোমার বান্ধবী জানে না আজ আমরা চলে যাচ্ছি?”
রুজবা মাথা নাড়িয়ে বলে,
–“জানে তো। বলেছিলো তো আসবে দেখা করতে।”
–“একটু ফোন দাও, বাসায় গিয়ে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে আর দেখা করতে পারবো না। দুদিনের কাজ পেন্ডিং পড়ে আছে, সেগুলো কমপ্লিট করা লাগবে।”

রুজবা উঠে নিজের ঘরে যায়। ফোন বিছানার উপর ফেলে রেখে এসেছে। ফোন হাতে নিয়ে দেখে ফারিনের নাম্বার থেকে অনেকগুলো মিসডকল। রুজবা ভ্রু কুঁচকায়৷ হঠাৎ এত ফোন করার কারণ খুঁজে পেলো না। ফারিনের নাম্বারে ডায়াল করতেই ফারিন এসে হাজির। আচমকা জাপ্টে ধরে রুজবাকে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে মেয়েটা। রুজবা ভ্রু গুটায়। কাঁদছে কেন ও? ফারিনকে নিজের থেকে সরিয়ে প্রশ্ন করলো,

–“কাঁদছিস কেন এভাবে? কি হয়েছে?”
–“বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে রুজবা। বড় ফুপ্পির ছেলের সাথে। আ্ আমি দিপ্ত ভাইকে বিয়ে করতে পারবো না। এ কথা জানিয়েছি বাবাকে কিন্তু বাবা কিছুতেই আমার কথা মানছে না রুজবা এবার কি করবো আমি?”
রুজবা ফারিনের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,

–“শান্ত হ, কাঁদছিস কেন এভাবে? কাঁদলেই প্রবলেম সলভ হয়ে যাবে? কাকা’কে কিয়ান ভাইয়ের কথা জানা।”
–“মেরে ফেলবে আমাকে। উনি এসব একদম পছন্দ করে না। আমি কি করবো বল না? আমি কিছু তেই দিপ্ত ভাইয়াকে বিয়ে করবো না রুজবা।”

–“আচ্ছা আচ্ছা, তোর কিছু বলা লাগবে না। কিয়ান ভাইকে জানিয়েছিস কথাটা?”
ফারিন মাথা নাড়ায়। রুজবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ফোন হাতেই ছিলো। নুহাশকে ম্যাসেজ করে বলে কিয়ান’কে নিয়ে ঘরে আসতে। মিনিট দুই গড়াতেই নুহাশ আর কিয়ান হাজির। ফারিনের চোখমুখের বেহাল দশা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে নুহাশ। কিয়ান অস্থির হয়ে ফারিনের সামনে দাঁড়িয়ে ওর দুই গাল ধরে বলে,

–“কি হয়েছে তোমার? কেঁদেছো? কিন্তু কেন? বলো না, চুপ করে আছো কেন?”
ফারিন আচমকা ঝাপিয়ে পড়ে কিয়ানের বুকে। দুহাতে শক্ত করে কিয়ানের পিঠের দিকের শার্ট খামচে ধরে শব্দ করে কাঁদতে থাকে। আচমকা টাল সামলাতে না পেরে ফারিনকে বুকে আগলে নিয়েই কয়েক পা পিছিয়ে যায় কিয়ান। রুজবা মাথা নিচু করে নেয়। নুহাশ’ও এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে অন্যদিকে। রুজবার দিকে এগিয়ে গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে,

–“ফারিনের কি হয়েছে?”
–“ওর বড় ফুপ্পির ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে ওর বাবা।”
নুহাশ ভ্রু কুঁচকে বলে,
–“এতে কাঁদার কি আছে? বাসায় বলুক ও কিয়ানকে ভালোবাসে।”
–“সবাই আপনার মতো না। নিজের বিয়ের কথা নিজের মুখেই দুই দুইবার বাবার কাছে বলেছেন, লজ্জা করেনি একবারো?”
নুহাশ ভাব নিয়ে বলে,

–“ইয়েস, সবাই আমার মতো না। দুনিয়াতে ❝নুহাশ ফারদিন❞ এক পিস-ই আছে।”
–“ভাব পরে নিয়েন, এখন ভাবেন কি করা যায়।”
নুহাশ এবার সিরিয়াস ভঙ্গিতে তাকায় ফারিন আর কিয়ানের দিকে। ফারিন তখনো কেঁদে কেঁদে কিয়ানের শার্ট ভেজাতে ব্যস্ত।

রুজবার ঘর থেকে এত জোরে কান্নার শব্দ পেয়ে রায়হান সাহেব এবং শারমিন বেগম হন্তদন্ত হয়ে ছুঁটে আসে রুজবার ঘরের সামনে। এসেই থ হয়ে যায় দুজনে। ফারিন কিয়ানের বুকে। নুহাশ রুজবা অপ্রস্তুত হয়ে যায় উনাদের দুজনকে দেখে। রায়হান সাহেব আর শারমিন বেগম দ্রুত কদমে সরে যায় সেখান থেকে।

ফারিনের বাবা আসাদ সাহেবের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ফারিন। পাশেই কিয়ান আর নুহাশ। আসাদ সাহেব কিয়ানের মুখ থেকে সবকিছু শুনে বললো,
–“আমি আমার বোনকে কথা দিয়ে ফেলেছি, সুতরাং ফারিনকে বিয়ে করার কথা চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।”
একটু থেমে আসাদ সাহেব আবার ফারিনকে ধমকের স্বরে বললো,

–“তুই এখানে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস? ঘরে যা বেয়াদব মেয়ে। স্কুল কলেজে পড়িয়েছি প্রেম করে বেড়ানোর জন্য তাই না? আজ থেকে ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ তোর। কিয়ানের সাথে একদম যোগাযোগ করার চেষ্টা করবি না। দিপ্তকে বিয়ে করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত কর।”
আসাদ সাহেবের এমন কড়া কড়া কথা শুনে ফারিন কাঁদতে কাঁদতে ঘরে চলে গেলো। নুহাশ আসাদ সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

–“আংকেল দিপ্তর সাথে বিয়ে হলে ফারিন ভালো থাকবে না। আপনি একবার আপনার মেয়ের সুখের কথা ভেবে দেখুন। দিপ্তর সাথে বিয়ে হলে ওরা কেউ ভালো থাকবে না।”
–“তুমি নতুন জামাই, নতুন জামাইয়ের মতোই থাকো। আমি চাই না এ বিষয়ে তুমি কোনো কথা কও, আমার মেয়ের বিয়ে আমি ওর সাথে দিবো না।”

–“আমি এখানে রুজবার বর হিসেবে আসিনি আংকেল। আমি কিয়ানের ভাই৷ সে হিসেবেই এসেছি। কিয়ানের সাথে ফারিনের বিয়ে দিতে সমস্যা কোথায় আংকেল? কোন দিক দিয়ে কমতি আছে ওর?”
–“আমি অতশত বুঝি না বাপু, আমার মেয়ের বিয়ে আমি দিপ্ত’র সাথেই দিবো। তোমরা এবার আসতে পারো।”
–“ফারিনের বিয়ে কিয়ানের সাথেই হবে। আমি আজ আপনার বাড়িতে দাঁড়িয়ে বলে যাচ্ছি এটা।”

কথাটা বলে নুহাশ নিজেই কিয়ানের হাত ধরে ফারিনদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। রুজবা উঠোনে পায়চারি করছিলো ফারিনদের বাসায় কি হচ্ছে জানার জন্য। ওদের দুজনকে আসতে দেখে দ্রুত কদমে এগোয় সেদিকে। কিয়ানের মলিন মুখ দেখে আর বুঝতে কিছু বাকী নেই। কিয়ান নুহাশ দুজনেরই মুড অফ হয়ে আছে। তাই আর কিছু জিজ্ঞেস করে না রুজবা।

কিয়ান, নুহাশ সকলের থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে নিজেদের গন্তব্যে। তবে যাওয়ার পূর্বে সবার অগোচরে রুজবার কপালে চুমু দিতে ভুলেনি ও। নুহাশ চলে যাওয়ার সময় রুজবার মন’টা অনেক খারাপ হয়ে যায়। বার বার একটা কথা মাথায় ঘুর-পাক খাচ্ছিলো, ওই লিয়া’টা আবার কিছু করে বসবে না তো? এই মেয়ে’কে একদম বিশ্বাস নেই। বাসর রাতে যেভাবে সিনক্রিয়েট করলো। রুজবা জানে নুহাশ ওকে কখনো ঠকাবে না। যে মানুষ’টা ওকে পাগলের মতো ভালোবাসে সে এমন কিছুতেই করবে না। তারপরও ভীষণ ভয় হয় রুজবার। হারানোর ভয়। দ্বিতীয় বারের মতো যদি ঠকে যায়, সে যে আর বাঁচতে পারবে না। মরেই যাবে এবার।

বিয়ের চক্করে অনেকদিন ভার্সিটির ক্লাসে এটেন্ড করে উঠতে পারেনি রুজবা৷ তাই আজ ভার্সিটি যাচ্ছে। একাই যাচ্ছে আজ৷ আসাদ সাহেব ফারিনকে আসতে দেয়নি। অগ্যতা রুজবা একা’ই যাচ্ছে। জারাফদের এলাকায় ঢুকতেই রুজবার বুক কাঁপে। মনে মনে প্রার্থনা করে জারাফের সাথে যাতে ওর দেখা না হয়। কিন্তু আল্লাহ ওর প্রার্থনা কবুল করেনি। রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে। আজ একটাও খালি রিকশা চোখে পড়ছে না। হঠাৎই জারাফ এসে হাজির হয়। রুজবা দেখেও না দেখার ভাণ করে হাঁটা শুরু করলে জারাফ পথ আটকায়৷ রুজবা তেঁতে গিয়ে বলে,

–“রাস্তাঘাটে বখাটে ছেলে-পেলে দের মতো কি অসভ্যতা শুরু করেছেন? পথ আটকে দাঁড়িয়েছেন কেন? যেতে দিন আমাকে।”
–“তুমি থেকে এত দ্রুত আপনি হয়ে গেলাম?”
–“সময় খুব দ্রুত যায় মিস্টার জারাফ জুহায়ের, সেই সাথে মানুষ’ও দ্রুত বদলায়।”
জারাফ রুজবার কথায় পাত্তা না দিয়ে রুজবার হাত ধরতে গেলেই রুজবা মৃদু চিৎকারে বলে,

–“স্টপ, ডোন্ট ডেয়ার টু টাচ মি।”
থেমে যায় জারাফের হাত। মনে পড়ে যায় রুজবাকে স্পর্শ করার অধিকার ও হারিয়েছে। হাত নামিয়ে নিয়ে রুজবার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“কিছু কথা বলবো, কোনো ক্যাফেতে গিয়ে বসি প্লিজ?”
–“আমার আপনার সাথে কোনো কথা নেই।”

বলে যেতে নিলেই জারাফ এবার রুজবার হাতের কবজি ধরে। তৎক্ষনাৎ রুজবা চড় বসায় জারাফের গালে। রেগে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–“কোন সাহসে আমায় স্পর্শ করেন আপনি? আমাকে স্পর্শ করার অধিকার নেই আপনার। আমাকে এখন শুধুমাত্র আমার স্বামী ❝নুহাশ ফারদিন❞ স্পর্শ করতে পারে। উনি ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ আমাকে স্পর্শ করতে পারে না, পারবে না।”

জারাফ অসহায় চোখে তাকায় রুজবার পানে। এটা কি সে রুজবা? যে জারাফের জন্য পাগল ছিলো? যাকে একসময় ও ভালোবেসেছিলো? এত চেঞ্জ? হ্যাঁ চেঞ্জ তো হবেই। জারাফ নিজেই যে বাধ্য করেছিলো মেয়েটাকে চেঞ্জ হতে। অবহেলা এত বাড়িয়ে দিয়েছিলো আর এমন বাজে ভাবে ঠকিয়েছে যে মেয়েটার দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়৷ সে সময় ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না যে। জারাফ নিচু স্বরে বললো,

অনেক সাধনার পরে পর্ব ২৮

–“প্লিজ, একটু কথা বলার সুযোগ দাও আমায়।”
–“নিদ্রা কোথায়? ওর প্রয়োজন শেষ? এখন আবার আমার সাথে কথা বলতে চাইছেন যে? দেখুন আমি আপনার সাথে কথা বলতে ইন্ট্রেস্ট না।”
কথাটা বলেই রুজবা একটা রিকশা ডেকে দ্রুত উঠে পড়লো। জারাফ হতাশ নিশ্বাশ ফেলে রুজবার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ৩০