অনেক সাধনার পরে পর্ব ২৮

অনেক সাধনার পরে পর্ব ২৮
অরনিশা সাথী

ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে চোখ মেলে তাকায় রুজবা। দেখে নুহাশ খালি গায়ে টাওয়াল পড়া অবস্থায় বাইরে বেরিয়ে এসেছে। লজ্জায় পিছন ঘুরে যায়। নুহাশ তা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাঁসে। রুজবা চোখ ফিরিয়ে নিলেও ঘুরে-ফিরে চোখ বার বার নুহাশ এর দিকে পড়ছে। মনে মনে ভাবছে, ইশ ছেলেটার কি লজ্জা নেয় নাকি? এভাবে কেউ সামনে আসে। নুহাশ চট করে বুঝে ফেললো যেনো রুজবার মনের কথা। সে ঠোঁট কামড়ে বললো,

–“কি বলো তো রুজবা আমার লজ্জাটা না বরাবরই খুব কম। আর এভাবে লুকিয়ে দেখার কি আছে বউ? আমি তো তোমারই।
রুজবা চমকায় সাথে লজ্জাও পেয়ে যায়। ইশ লোকটা কি বুঝে গেলো রুজবা ওর দিকে তাকিয়ে ছিলো? কি লজ্জার ব্যাপার। এই লোক কিভাবে ওর মনের কথা বুঝে ফেললো? কোনো ম্যাজিক জানে নাকি নুহাশ? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই নিজের ঘাড়ে কারো নিশ্বাসের শব্দ অনুভব করে। না ঘুরেই বুঝে ফেললো কে সে। এই ২ দিনে যে এই স্পর্শ তার খুব চেনা হয়ে গেছে। নুহাশ বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“কি এতো ভাবো বউ? একটু তো এই অধমের দিকে নজর দাও। দেখো বউ এর আদর না পেয়ে বেচারা কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।”
রুজবা কিছু বলবে তার আগেই পিছন থেকে কেউ বলে উঠে,
–“তুই কাঠ হলে ভাই আমি তো মাছি।”
নুহাশ রুজবা ২ জনই চমকায়। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কিয়ান দাঁত কেলিয়ে হাসছে। তড়িৎ বেগে দূরে সরে দাঁড়ায়। নুহাশ রেগে বলে,

–“তোর আর কাজ নেই? জানিস না কারো রুমে ঢুকতে হলে পারমিশন নিতে হয়? নাকি সব ম্যানার্স ভুলে গেছিস?”
–“বা..রেএএ নিজে দরজা খুলে খুল্লাম-খুল্লাম রোমান্স করবে, আর আমি কিছু বললেই দোষ?”
–“শা*লা রোমান্স করতে দিলি কই? তার আগেই তো কাবাব মে হাড্ডি চলে আসলো।
–“দিস ইজ নট ফেয়ার ব্রো। সকাল সকাল এভাবে আমার শালীকে জ্বালানো শুরু করে দিলি? শা*লা তোরে তো ভদ্র ভাবছিলাম।”

নুহাশ কিছু বলবে তার আগেই রুজবা বলে,
–“আচ্ছা আপনারা নাস্তা করতে আসুন। আমি যাই।”
এই বলে রুজবা দৌড়ে বেরিয়ে যায়। আর একটু হলে মরেই যাচ্ছিলো। ছি ছি কি বলে এরা এসব। নির্লজ্জ লোকজন।

নুহাশ রেডী হয়ে বের হয় কিয়ানের সঙ্গে। টেবিলে বসে সকলে। শারমিন বেগম আর রুজবা মিলে নাস্তা সার্ভ করে দিলো। নাস্তা করতে করতেই রুজবার দিকে একবার তাকিয়ে নুহাশ বললো,
–“আঙ্কেল আজ আমায় ফিরতে হবে।”

রুজবা তাকায় নুহাশের দিকে। নুহাশ চলে যাবে আজ? কেমন যেনো বুক চিন চিন করে উঠলো রুজবার। শারমিন বেগম এর কথায় রুজবার ঘোর কাটলো,
–“কি বলছো নুহাশ? আজকেই চলে যাবে কেনো? কয়েকটা দিন থাকলে হয় না?”
নুহাশ কিছু বলার পূর্বেই রুজবার বাবা বলে,
–“হ্যাঁ, আর কয়েকটা দিন না হয় থাকো। তারপর যেও, এতো তাড়া কিসের?”
নুহাশ রুজবার দিকে তাকিয়ে বললো,

–“না আঙ্কেল। কিছু ইমারজেন্সি আছে। পরে অন্যময় আসবো আবার।”
এইটুকু বলে থামে নুহাশ। তারপর আবার রুজবার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
–“এখন তো আসা যাওয়া লেগেই থাকবে। বউটাই তো এখানে রেখে যাচ্ছি।”
নুহাশের কথায় রুজবা বিষম খায়। নুহাশ দ্রুত পানি এগিয়ে দেয়। রুজবা ঢকঢক করে পুরো পানি শেষ করে। এর মধ্যেই কিয়ান দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,

–“হ ভাই তাড়াতাড়ি চল। নাইলে আবার মানুষ ঘর জামাই বলবে। তখন আমার আবার সহ্য হবে না। জানিসই তো তুই আমার পেয়ারে দোস্ত।”
কিয়ান এর কথায় সবাই হেসে উঠে। সবাই হাঁসলেও রুজবা নুহাশ এর দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে আছে। সে তো নুহাশ’কে দেখতে ব্যস্ত।
ভাবনার মাঝেই কিয়ান বলে উঠে,

–” পড়ে না চোখের পলক, কি তোমার রুপের ঝলক। দোহায় লাগে মুখটি এবার একটু বন্ধ করো..নাইলে মাছি ঢুকবে, তখন পেট খারাপ থেকে বাঁচাতে পারবে না কেউ।”
কিয়ান এর কথা শুনে সবাই আরেক দফা হেঁসে উঠে। এর মাঝেই রুজবা না খেয়ে উঠে যায়। রুজবার পিছন পিছন নুহাশ’ও উঠে পড়ে।

রুমে এসে রুজবা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে সুন্দর স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। ভালো লাগছে তার এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে। হটাৎ পিছন থেকে নুহাশ এসে জড়িয়ে ধরে। রুজবা চমকায় না। যেনো, আগে থেকেই জানতো এমন কিছু হবে। ছাড়িয়ে নিতে চায় নিজেকে। কিন্তু নুহাশ ছাড়ে না। নুহাশ চিন্তিত স্বরে বলে,
–“কি হলো, এভাবে না খেয়ে চলে এলে? শরীর ঠিক আছে তোমার?”

রুজবাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে কপাল, গলায় হাত দিয়ে চেক করে। রুজবা হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,
–“ঠিক আছি আমি। এতো চিন্তিত হওয়ার মতো কিছু হয়নি।”
–“তুমি কি এখনো লিয়ার ব্যাপারটা নিয়ে রেগে আছো?”
–“নাহ।”

–“তাহলে কি হয়েছে তোমার? দেখো আজ চলে যাবো তাও তোমার এই গোমরা মুখটা দেখে যেতে হবে আমার? কি হয়েছে বলবে তো, আমি কি কিছু করেছি?
–“যেতে হবে না, থেকে যান না আর কয়েকটা দিন। আমি চিনতে চাই আপনাকে, আপনার আগাগোড়া সবটা জানতে চাই। ভালোবাসতে চাই আপনাকে আমি। ও বাড়িতে যে লিয়া আছে, আমার যে ভয় লাগছে নুহাশ। যদি দূরে সরে যান? লিয়া যদি কেড়ে নেয় আপনাকে? তখন? তখন কি হবে আমার? আমি যে সব হারিয়ে শূণ্য হয়ে যাবো।”
মনে মনে খুব করে চাইলো উপরোক্ত এই কথাগুলো বলতে৷ কিন্তু বলতে পারলো না। মুখে বললো,

–“কিছু হয়নি সত্যি। আপনি সাবধানে যাবেন, আর গিয়ে ফোন করবেন।”
নুহাশ মনে মনে ভাবে, রুজবা কি তার চলে যাওয়া নিয়ে রেগে আছে? রুজবা কি চায় নুহাশ থাকুক? তা তো মুখ দিয়ে বলছে না।উল্টো ম্যাডাম মুখে বলছে, চলে যেতে। একটু বাজিয়ে দেখা যাক,
–“হ্যাঁ হ্যাঁ। যাবোই তো। আমার বউ যেখানে আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে শশুড় বাড়ি থেকে সেখানে থেকেই বা কি হবে এখনি চলে যাবো আমি।”

বলেই চলে যেতে নেয়। রুজবা পিছন থেকে হাত ধরে আটকায়, মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠে,
–“ড্রামাবাজ একটা। এতোদিন তো জানতাম শুধু কিয়ান ভাই’ই পারে ড্রামা করতে। আপনিও দেখি কম যান না।”
রুজবার কথায় নুহাশ মৃদুস্বরে হাসে। তারপর রুজবা’কে কাছে টেনে নেয়। দু-হাতে মুখ উঁচু করে প্রশ্ন করে,
–“কি হয়েছে তোমার? আমি কি কিছু ভুল করেছি?”

নুহাশ এর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে রুজবা। তারপর আচমকাই জড়িয়ে ধরে বলে,
–“লিয়া এখনো আছে আপনাদের বাড়ি? বিয়ের দিন না ও এসে আপনাকে জড়িয়ে ধরেছিলো? রাতে তো আমাদের এ বাড়িতেও চলে এসেছিলো আপনার জন্য। এখন, এখন আপনি যাওয়ার পর যদি আবার এরকম কিছু করে?”
–“তো এইজন্যই ম্যাডাম এর মন খারাপ?”
রুজবা উত্তর করে না। নুহাশ ফের বলে,

–“নিশ্চিন্তে থাকো তুমি, কার এত সাধ্য তোমার বরকে নিয়ে যাবে? তুমি কালা টিকা হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে যাও, ওই লিয়া সাহসই পাবে না তোমাকে টপকে আমি অব্দি পৌঁছাতে। নিজের জিনিস সামলে রাখতে হয় রুজবা। বেখেয়ালি ভাবে একবার হারিয়ে ফেললে কিন্তু পাওয়া যাবে না আর।”

এইটুকু বলে থামলো নুহাশ। রুজবার মুখ ভার হয়ে গেছে নুহাশের শেষ কথা শুনে। নুহাশ ফোনে সময় দেখে বললো,
–“লেট হয়ে যাচ্ছে, যেতে হবে এবার। নয়তো দেখা যাবে কিয়ানের কথা’ই সত্যি হয়ে গেছে। লোকে ব্রেকিং নিউজ করে দিবে দ্যা “নুহাশ ফারদিন” ঘর জামাই হয়ে গেছে। এখন তুমি কি সেটা চাও?”

রুজবা এরপরও কিছু বললো না। কারণ সে জানে নুহাশ তাকে নরমাল করার জন্য কথা’টি বলেছে। নাহলে নুহাশ যেমন মানুষ তাতে, কে কি করলো কিংবা কে কি বললো তা একদমই ধার ধারে না এটা রুজবা এ ক’দিনে বেশ ভালোই জেনেছে। রুজবার কেমন অশান্ত লাগছে নিজেকে। এমন কেনো হচ্ছে সে নিজেও জানে না। আচ্ছা এটাই কি “কবুল” এর জোর? নুহাশ এর প্রতি রুজবা অদ্ভুত এক টান অনুভব করছে। এটা কি শুধুই তবে বিয়ে নামক পবিত্র সম্পর্কের জোর? নাকি সে কি দ্বিতীয় বারের মতো তার “স্বামী” নামক মানুষ’টার প্রেমে পড়ছে ধীরে ধীরে? কি জানি?সব কেমন ধোঁয়াসা হয়ে আছে। নুহাশ এর কথায় তার ধ্যান ভাঙ্গে,

–“কি ব্যাপার কি ভাবছো এতো?”
রুজবা মাথা নাড়ায়, কিছু হয় নি। নুহাশ দুহাতে রুজবার কোমড় টেনে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। তারপর বাঁকা হেসে বলে,
–“যাওয়ার আগে বউকে একটু আদর করে যাই? কি বলো?”

রুজবা কিছু বলবে, তার আগেই নুহাশ রুজবার অধরে অধর মেলায়। বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর, হটাৎ রুজবার কানে রিংটোনের আওয়াজ আসে। সে নুহাশ’কে সরিয়ে দেয়। জোরে শ্বাস নিয়ে বলে,
–“কল এসেছে আপনার।”

নুহাশ বিরক্ত হয়ে ‘চ’ বর্গীয় শব্দে করে মুখে। মোবাইল হাতে নিতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠে লিয়ার নাম। লিয়ার কল দেখে নুহাশ এর ভ্রু-জোড়া গুছিয়ে আসে। এই মেয়ে বার বার তাকে বিরক্ত কেনো করছে? এতো অপমানিত হওয়ার পরও একটা মানুষ কিভাবে এতো’টা বেহায়া হয়, নুহাশ ভেবে পায় না। কল রিসিভ করে কিছু বলবে তার আগেই লিয়া বলে,

–“নুহাশ এখনো আসছো না কেনো তুমি? আই মিস ইউ সো মাচ।”
নুহাশ কিছু বলার আগে রুজবা ফোন টেনে নেয়। লাউড স্পিকার দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–“অন্যের স্বামীকে মিস করছেন সেটা আবার বলছেন’ও লজ্জা লাগছে না? এত নির্লজ্জ কেন আপনি? মানুষ ঠিকই বলে, বিদেশের মাটিতে বা বিদেশী কালচারে বড় হওয়া মানুষজন একটু বেশিই নির্লজ্জ হয়। যা আপনাকে দেখে বেশ বুঝতে পারছি আমি। একদম আমার স্বামীর দিকে চোখ তুলে তাকাবেন না। নয়তো আপনার ওই চোখ আমি গেলে দিবো। ফুপ্পির বাসায় বেড়াতে এসেছেন বেড়াবেন। আমার স্বামীর আশেপাশে ঘেঁষার চেষ্টা করলে খুব খারাপ হবে।”
লিয়া রেগে হুংকার ছেড়ে বলে,

–“হাউ ডেয়ার ইউ___তুমি আমাকে অপমান করছো? তোমার___”
–“আপনার অপমানবোধ আছে? জানতাম না তো।”
–“এই মেয়ে শুনো___”
নুহাশ রুজবার থেকে মোবাইল নিয়ে ফোন কেটে দেয়। রুজবাকে বিছানায় বসিয়ে বলে,

–“রিল্যাক্স, এত হাইপার হচ্ছো কেন?”
–“ও যাতে আপনার আশেপাশে না ঘেঁষে তাহলে কিন্তু খুন করে ফেলবো। আমি কিয়ান ভাইকে বলে দিবো আপনাকে নজরে নজরে রাখতে আপনি, আপনি___”

অনেক সাধনার পরে পর্ব ২৭

নুহাশ রুজবাকে কিছু বলতে না দিয়ে টুপ করে ঠোঁটে চুমু খেয়ে সরে আসে। রুজবা হতভম্ব হয়। এই ছেলে এরকম সিরিয়াস মূহুর্তেও মজা করছে? রুজবাকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে নুহাশ ওর কপালে চুমু দিয়ে বলে,
–“আবারো বলছি, নিশ্চিন্তে থাকো তুমি। আমি ❝নুহাশ ফারদিন❞ এত সহজেই তোমাকে ছাড়ছি না। এখন আসছি লেট হচ্ছে।”

অনেক সাধনার পরে পর্ব ২৯