অনেক সাধনার পরে পর্ব ২৭

অনেক সাধনার পরে পর্ব ২৭
অরনিশা সাথী

ফোন হাতে নিয়ে ম্যাসেজ চেক করে নুহাশ। কল লিস্টেও লিয়ার নাম্বার। তবে রিসিভ হয়নি। এবার রুজবার ওরকম ত্যাড়া কথার মানে খুঁজে পেলো ও। মেয়েটা কি লিয়াকে নিয়ে জেলাস? হয়তো, আবার হয়তো না। তবে নুহাশের সিক্স সেন্স বলছে রুজবা জেলাস।

একটু না খুব বেশিই জেলাস। হাসি ফুঁটে উঠে ওর অধরে৷ বিয়ের পরদিনই স্বামীর পাশে অন্য মেয়েকে সহ্য হচ্ছে না, গুড। ভালো লক্ষণ এটা৷ মেয়েটার ভালোবাসা পেতেও খুব একটা সময় লাগবে না তাহলে আর৷ ফোনটা আবার আগের জায়গায় রেখে বিছানার এক কোনে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকা রুজবার পানে তাকায়। মেয়েটা কি একটু বেশিই রেগে আছে?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

–“কাছে গিয়ে দেখা যাক।”
বিড়বিড় করে কথাটা বলে রুজবার দিকে এগোয় নুহাশ। নুহাশ’কে সামনে দাঁড়াতে দেখে ফট করে উল্টোদিকে ঘুরে যায়। এতে যেন নুহাশের সুবিধাই হলো। নুহাশ গায়ের টি-শার্ট খুলে বালিশের পাশে রেখে চটজলদি রুজবার পাশে শুয়ে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। রুজবা চুপ করে আছে। না নড়ছে আর না নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। নুহাশ রুজবার কাঁধে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করে,

–“কি হয়েছে?”
–“কিছু না।”
সোজা উত্তর রুজবার। নুহাশ ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসলো।
–“লিয়াকে নিয়ে জেলাস ফিল করছো?”

রুজবা চমকায়, কিন্তু নুহাশকে বুঝতে দেয় না। স্বাভাবিক রাখে নিজেকে৷ আচ্ছা লোকটা কি ওকে পড়তে জানে? না বলতেই সব এভাবে বুঝে যায় কিভাবে? লোকটার কি সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার আছে? সবাইকে এভাবে বুঝতে পারে? নাকি শুধুমাত্র ওকেই বুঝে? এমন হাজারো প্রশ্নের উত্তর রুজবা ভেবেও পায় না। নুহাশ রুজবাকে নিজের দিকে ঘুরায়।

কপালের লেপ্টানো চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে গভীর চুমু খায় কপালে। কেঁপে উঠে রুজবা। ভেতরে ভেতরে অস্থিরতা শুরু হয়। মানুষটার স্পর্শ পেলে রুজবার ভেতরটা এত ছটফট করে উঠে কেন? কি আছে মানুষটার স্পর্শে?
নুহাশেরও একই অনূভুতি। রুজবার সংস্পর্শে এলে নিজেকে সামলানো বেশ কঠিন হয়ে যায় ওর পক্ষে।

তবুও নিজেকে সামলে নেয়। মেয়েটা যেন আফিমের চেয়েও বড্ড নেশালো। এই মেয়েটা ওকে যতটা টানে, অন্য কোনো কিছুই নুহাশকে এতটা টানে না৷ মেয়েটা আশেপাশে থাকলেই ওর নিজেকে মাতাল মাতাল মনে হয়। মেয়েটার নেশায় মজে থাকতে ইচ্ছে হয়। বড় করে দুটো শ্বাস নেয় নুহাশ। সামলে নেয় নিজের অনূভুতি গুলোকে। নুহাশ নিজে বসে, রুজবাকেও নিজের মুখোমুখি বসায়। রুজবার গালে আদুরে স্পর্শ করে বলে,

–“আমার ভালোবাসা নিয়ে কোনো ডাউট আছে তোমার?”
রুজবা দু দিকে মাথা নাড়ায়। যার অর্থ না। নুহাশ বলে,
–“তাহলে লিয়াকে নিয়ে জেলাস কেন হচ্ছো? লিয়া আমাকে চাইলেই কি আমি লিয়ার হয়ে যাবো?”
রুজবা মাথা নিচু করে বলে,

–“জারাফ তো নিদ্রা’র হয়ে গিয়েছিলো।”
–“আমি কি জারাফ?”
রুজবার এবারেও দু দিকে মাথা নাড়ায়। নুহাশ প্রশ্ন ছুঁড়ে,
–“তাহলে?”

রুজবা মাথা তুলে একবার তাকায় নুহাশের দিকে। রুজবার চোখ থেকে টুপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে৷ নুহাশ হতভম্ব হয়ে যায়। দ্রুত রুজবার চোখের পানি মুছে দেয়। অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
–“একি কাঁদছো কেন?”

রুজবা কিছু না বলে আচমকাই ঝাপিয়ে পড়ে নুহাশের বুকে। নুহাশ ক্ষানিকটা পেছন দিকে হেলে যায়। তবুও সামলে নেয় নিজেকে। রুজবাকে বুকে জড়িয়ে নেয় দুহাতে৷ রুজবা এবার শব্দ করে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,

–“আমার ভয় হয়৷ জারাফকে ভালোবেসেছিলাম অনেকটা। কিন্তু নিদ্রা আসায় ও চেঞ্জ হয়ে গেলো, ক্যারিয়ারের জন্য নিদ্রার সাথে জড়ালো। ঠকালো আমায়, আমার সাথে থাকলে নাকি শুধু ভালোবাসা পাবে। আর নিদ্রাকে চুজ করলে ভালোবাসা, টাকা, সুন্দর ক্যারিয়ার সবই পাবে। শুধু ভালোবাসায় নাকি সুখি হওয়া যায় না। শান্তি পাওয়া যায় না। এজন্য ঠকালো আমায় দিনের পর দিন, শেষে ছেড়েও দিলো।”

কান্নার ফলে ভালো করে কথা বলতে পারছে না ও। বারবার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে৷ এলোমেলো হচ্ছে। কিছু সময় চুপ থেকে আবারো বলে,
–“এখন আপনি আছেন আমার জীবনে। আপনি আমার স্বামী। হ্যাঁ একটু সময় লাগবে আপনাকে ভালোবাসতে। কিন্তু আমি আমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি আপনাকে ভালোবাসতে। আমাদের এনগেজমেন্ট এর পর থেকেই চেষ্টা চালাচ্ছি। ক্ষানিকটা হয়তো সফল হয়েছি, নয়তো জেলাসি’টা আসতো না আমার। আপনিই এখন আমার সব। লিয়া’ও যদি কোনো ভাবে আপনাকে আমার থেকে দূরে সরায় তাহলে, তাহলে আমি___”

পুরো কথা শেষ করতে পারে না রুজবা৷ বারবার কথা জড়াচ্ছে৷ হেঁচকি তুলে কাঁদছে ও। নুহাশ রুজবাকে বুক থেকে সরিয়ে ওর চোখের পানি মুছে দেয়৷ দু গাল ধরে বলে,
–“হুঁশ, কাঁদে না একদম। একমাত্র মৃত্যু দিয়েই তোমার থেকে দূরে সরবো। নয়তো তোমার থেকে দূরে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। অনেক গুলো বছর এক তরফা ভালোবেসেছি, তোমার একটু ভালোবাসা পাওয়ার অপেক্ষা করেছি। আর এখন সুযোগ পেয়েছি তোমার ভালোবাসা পাওয়ার, আর তুমি বলছো আমি দূরে সরে যাবো? অনেক সাধনার পর পেয়েছি, এত সহজে ছাড়ছি না। আমৃত্যু আছি আমি তোমার হয়ে। শুধমাত্র তোমার হয়েই থাকবো।”
রুজবা তখনো হেঁচকি তুলে কাঁদছে। নুহাশ চোখের পানি মুছে দিয়ে রুজবাকে বুকে টেনে নিলো। রুজবার মাথায় আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে বললো,

–“আমেরিকায় যখন ছিলাম, তখন জানতাম জারাফ আর তুমি দুজন দুজনকে ভালোবাসো। তোমাকে পাওয়ার কোনো চান্স নেই আমার। তখনই লিয়ার হইনি, আর এখন তুমি আমার বউ। এখন লিয়ার ডাকে কিভাবে সাড়া দেই বলো? তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো, মৃত্যু ছাড়া আমি ❝নুহাশ ফারদিন❞ তোমাকে ছাড়ছি না।”

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে নিজেকে নুহাশের দু হাতের মাঝে বন্দি দেখে মৃদু হাসলো রুজবা। লোকটার বুকের সাথে লেপ্টে থাকতে ভালোই লাগছে। নুহাশের লোমশ বুক থেকে একটা অদ্ভুত স্মেল আসছে। নুহাশ নুহাশ স্মেল। যা রুজবার কাছে বেশ লাগছে।

শ্যামলা বুকে কুচকুচে কালো লোমগুলো আরো বেশি নেশালো। রুজবা বেশ কিছুক্ষণ লোমশ বুকে নাক ঘঁষে নুহাশের স্মেল নেয়। হঠাৎ ভাবে নুহাশ যদি জেগে যায়? জেগে যদি ওকে এভাবে দেখে? ইশ্ কি বিশ্রী একটা ব্যাপার হবে। তাই দ্রুত নুহাশের বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে যায় ও।

বাড়িতে এখন মেহেমান নেই বললেই চলে। রুজবার খালামণিরা’ও চলে গেছে। শুধু নৌশিন আর মিনহা আছে। আর কিয়ান নুহাশ। কিয়ান আজ চলে যাবে। নুহাশ’ও বোধহয় যাবে, রুজবা সঠিক জানে না। রুজবা কিচেনে এসে দেখে শারমিন বেগম নাস্তা বানাচ্ছে। রুজবা উনার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,

–“সাহায্য করি?”
শারমিন বেগম মুচকি হেসে বলে,
–“নুহাশ উঠেছে?”
–“উঁহু, কি করবো বলো।”
শারমিন বেগম গ্যাসের সামনে থেকে সরে বললো,
–“পরোটা ভাজ, আমি বেলে দিচ্ছি।”

রুজবা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। মা মেয়ে মিলে হাতে হাতে সকল নাস্তা বানিয়ে ফেলে। একে একে সব টেবিলে সাজায় দুজনে। রুজবা নিজের ঘরে চলে আসে। নুহাশকে ডেকে তুলবে।
উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে নুহাশ। রুজবা পাশে বসে চুলে অলতো করে হাত বুলায়। নুহাশের দিকে বেশ ক্ষানিকটা ঝুঁকে যায় ও৷ কাছ থেকে দেখে লোকটাকে৷ শ্যামরঙা চেহারায় যেন এক অদ্ভুত রকম মায়া বিরাজ করে৷ খুব মনোযোগ সহকারে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে নুহাশকে। রুজবার নিশ্বাস নুহাশের চোখমুখে পড়তেই নুহাশ ফট করে চোখ মেলে তাকায়। অপ্রস্তুত হয় রুজবা৷ হকচকিয়ে যায়, হতভম্ব হয়৷ ইশ্! কি বিশ্রী ব্যাপার৷ লোকটা কি ভাবলো? দ্রুত সোজা হয়ে দাঁড়ায় রুজবা। আমতা আমতা করে বলে,

–“আ্ আসলে আমি আপনাকে ডাক্ ডাকতে এসেছিলাম।”
নুহাশ ভ্রু কুঁচকে তাকায়৷ রুজবা এদিক সেদিক এলোমেলো ভাবে চোখের পলক ফেলে৷ আচমকা নুহাশ রুজবার হাত ধরে টান মারে। হুমড়ি খেয়ে রুজবা নুহাশের বুকের উপর পড়ে। নুহাশ রুজবার মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে গভীর ভাবে চুমু খায় রুজবার কপালে। তারপর চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,

–“মর্নিং কিস এটা।”
রুজবা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মানুষটা এত অদ্ভুত কেন? রুজবা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বলে,
–“ফ্রেশ হয়ে আসুন, নাস্তা করবেন না?”

নুহাশ কিছু না বলে উঠে যায়। রুজবা ব্যস্ত হয় বিছানা গোছাতে। রাতে বিছানা করা এবং সকালে বিছানা গোছানোর কাজটা রুজবার ভারী অসহ্য লাগে৷ আগে শারমিন বেগমই করে দিতেন। এখন নুহাশ থাকায় বাধ্য হয়ে রুজবাই করে। বিছানায় বসে দু পা দুলাচ্ছে রুজবা৷ বালিশের পাশ থেকে নিজের ফোন হাতে নেয়৷ দুদিন ধরে এফবিতে যাওয়া হয় না।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ২৬

তাই এখন একটু ঢোঁ মারতে গেলো। এফবিতে ঢুকেই এত এত ম্যাসেজ আর নোটিফিকেশন দেখে ক্ষানিকটা বিরক্ত হয়। কিছু কিছু আজাইরা পাবলিক শুধু শুধুই অনেক পোস্টে মেনশন এবং ট্যাগ করে যা রুজবার কাছে ভীষণ বিরক্তিকর লাগে৷ নোটিফিকেশন চেক না করে ইনবক্সে গেলো ম্যাসেজ চেক করতে। প্রথমেই জারাফের আইডি ভাসছে। চারটা ম্যাসেজ এসেছে ওর আইডি থেকে৷ রুজবা চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিলো। ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে চোখ মেলে তাকায় ও৷ তারপর জারাফের ম্যাসেজ চেক না করেই আবার লগআউট করে আইডি।

অনেক সাধনার পরে পর্ব ২৮