সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২৮

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২৮
রাউফুন

‘এটা আপনি কি করলেন? আমার এতো সুন্দর নখ গুলো এভাবে কে’টে দিলেন। নেইল কা’টারও রাখেন আপনি নিজের কাছে?’
‘আমার কাছে, আমার গাড়িতে নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল জিনিস আছে। দেখবি?’

সুপ্রিয় প্রতিটি জিনিস খু’টিয়ে খু’টিয়ে দেখালো! বিউটির কাঁদো কাঁদো ফেস দেখে সুপ্রিয় দম ফাটা হাসি হাসলো।
‘আপনি জানেন আপনি কতটা খারাপ?’
‘হুম জানি! তারপর!’

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘একটা রাক্ষস!’
‘আর?’
‘আর জম্বুক, র’ক্ত খেকো!’
‘নখ কার বড় আমার না তোর? দাঁত তোর বড় না আমার? এই দেখ, আমার দাঁত একদম সুন্দর পারফেক্ট সাইজের। তোর দাঁত কোদালের মতো লম্বা লম্বা, ডা’কি’নিদের হয় এমন দাঁত, শা’কচুন্নীদের হয় নখ বড় হয়!’
‘আপনি আমাকে শাক’চুন্নী বললেন?’ রাগী কন্ঠে বললো বিউটি!

সুপ্রিয় মুচকি মুচকি হেসে বললো,
‘শুধু তাই বলিনি, ডাকিনিও বলেছি। ডাকিনিদের দাঁত বড় বড় হয়!’
‘আপনি আমার নখ কে’টেছেন তো কি? আমি আপনাকে খা’ম’চি না দিতে পারলেও কা’ম’ড়ে তো দিতেই পারি? কি পারি না? যেহেতু দাঁত বড়। দাঁত খানা ভালো ভাবেই বসানো যাবে। ঘাড়ে, বুকে, মুখে, গালে, ঠোঁটে…..!’

সুপ্রিয় শিউরে উঠে বিউটির কথা শুনে। এই মেয়েটা মাঝে মধ্যে এমন বেফাঁস বাক্য বলে ফেলে নিজেই বুঝে না। বিউটি তাকিয়ে দেখলো সুপ্রিয়র মুখাবয়ব গম্ভীর, শীতল। সে বোঝার চেষ্টা করলো, সুপ্রিয়র মনে কি চলছে৷ সে যা বুঝলো, তা সঠিক কি না বুঝতে আরও একটু বাজিয়ে দেখতে চাইলো। বললো,

‘নাকি ঠোঁটে কা’ম’ড়ে দেওয়ার জন্য দাঁত ভেঙে দেবেন? ভাবছি আমি লাভ বাইটই বেশি দিবো বিবাহের পর!’
সুপ্রিয় গাড়ির ব্রেক কষলো জোরেশোরে। বিউটি হকচকিয়ে উঠলো! সুপ্রিয় হুট করেই বিউটির দুই কাঁধ চেপে ধরলো। বিউটি আচমকা এমন আক্রমণে কাঠ কাঠ হয়ে বসে রইলো। মুখ দিয়ে টু শব্দ টি বের করলো না। বুঝলো সুপ্রিয় ভাই নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গেছে! সুপ্রিয় সাপের মতো হিসহিসিয়ে বললো,

‘তোকে কতবার বলেছি, আমাকে উষ্কাবি না! আমি তোর কাছাকাছি আসলে বেসামাল, বেপরোয়া হয়ে পড়ি! তারপর আবার এমন লু’চু মার্কা কথা! এখন তোকে আমার থেকে কে বাঁচাই আমিও দেখি!’
বিউটি চোখ বন্ধ করেই বললো, ‘স্যরি আর বলবো না। মাফ করে দিন!’
সুপ্রিয় রহস্য করে হাসে। ফিচেল গলায় বললো, ‘ঠিক তো? তবে আজকে তোকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না, মাফ করবো না আমি আজকে!’

সুপ্রিয় বিউটির দুই চিবুক চেপে ধরলো। বিউটি কেঁপে উঠে একটু পেছানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু গাড়িতে অবশিষ্ট জায়গায় নেই যে পিছিয়ে যাবে।একদম চেপে গেলো বিউটি। আচমকা সে গাড়িত দরজা খুলে নিচে পড়ে গেলো। হো হো করে হেসে উঠলো সুপ্রিয়। বিউটি চোখ খুলে কোমড়ে হাত বুলাতে বুলাতে উঠার চেষ্টা করলো।

‘আশ্চর্য, এটা কি হলো?’
‘আহ! অনেক দিন পর আশ্চর্য কথা শুনলাম তোর মুখ থেকে। এইটা তোর শাস্তি! আমাকে উষ্কানোর ছোট্ট একটা শাস্তি।’
‘গাড়ি থেকে আমি পড়লাম কিভাবে?’
‘গাড়ির দরজার লক খুলে দিয়েছি!’

বিউটি ভ্যা ভ্যা করে কাঁন্না করে দিলো। বললো, ‘এয়্যাহে আমার কোমড়টা বুঝি গেলো।’
‘হয়েছে তোর নাটক? দেড় ইঞ্চি উঁচু থেকে পড়লে কারোর কোমড় ভাঙে না! উঠ!’
‘আশ্চর্য, আমি ব্যথা পেলাম যে!’
‘ব্যথা দিতেই তো ফেললাম!’

বিউটি উঠতে চেয়েও পারলো না। সুপ্রিয় বিউটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। বিউটি গোমড়া মুখে তার হাত ধরে গাড়িতে উঠে বসলো। তম্বন্ধেই সুপ্রিয়র ফোন বেজে উঠলো! পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো মঞ্জু কল করেছে! বিউটির সামনে ফোন ধরবে কি ধরবে না এই নিয়ে মনে একটা শঙ্কা কাজ করছে! এসব ভাবতে ভাবতেই কল কে’টে গেলো।
বিউটি বললো, ‘কার ফোন ছিলো?’

‘মঞ্জুর!’
‘কে’টে গেলো তো। ধরলেন না?’
‘ধরবো। পরে আগে তোকে নামিয়ে দিই!’
‘আচ্ছা।’ বিউটি আর কোনো প্রশ্ন করলো না।
সুপ্রিয় বিউটিকে ওর বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে মঞ্জুকে কল দিলো। মঞ্জু রিসিভ করেই বললো

‘হ্যালো ভাই?’
‘হ্যাঁ বলো!’
‘এই চেয়ারম্যানকে নিয়ে কিছু ভাবলেন? ব্যাটা এতো ত্যাদড়, মুখ থেকে একটা কথাও বের করছে না। শুয়োরের বাচ্চাটাকে ইচ্ছে করছে জা’ণে শেষ করে দিই!’
‘ওর পেট থেকে সব কথা বের করতে হবে যেভাবেই হোক, তবে ওর প্রাণ নেওয়া যাবে না। এক কাজ করো, ওঁকে দিয়ে একটা চিঠি লিখাও। অতঃপর সেই চিঠি মুসা চেয়ারম্যান এর বাড়িতে যথাযথ সময় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করো। নিশ্চয়ই বুঝেছো কি লিখতে হবে?’

‘হ্যাঁ ভাই! ওর বাসায় যেনো চিন্তা না করে তার উপর বেস্ করে চিঠিটা লিখিয়ে নিতে হবে। যেনো চেয়ারম্যান এর কিছু হলেও পরবর্তী তার দায় কোনো ভাবেই আমাদের উপর না বর্তায়!’
চেয়ারম্যান এর উপর অনেক অত্যাচার করার পরেও কোনো ভাবেই মুখ খুলছে না চেয়ারম্যান। কেন চেয়ারম্যান তাদের উপর আক্রমণের চেষ্টা করেছে সেটা এখনো পরিষ্কার না। সিজানের বিষয় টা এবারে ক্লিয়ার করার পালা। ওঁকে রাখা যাবে না আর ডেরায়।

‘ভাই কিছু বলছেন না কেন? হ্যালো ভাই আপনি লাইনে আছেন?’
‘হ্যাঁ বলো!
‘ঐ ব্যাটা সিজানের কি করবো? আগের দুইটারে তো ছেড়েই দিয়েছি!’
‘ওকে একটা হসপিটালে রাতের অন্ধকারে রেখে আসো। এমন ভাবে রেখে আসো যেনো কেউ-ই বুঝতে না পারে।’
‘ওর হাত আর মুখ তো ঝলসানো। ওর অবস্থা খুবই খারাপ!’

‘তো? ওঁকে যে বাঁচিয়ে রেখেছি এটাই ওঁর ভাগ্য। খুনাখুনির ঝামেলায় খামোখা জড়াতে চাইছি না তাই ওকে ছাড়ছি! সামনে তোর ভাবির সঙ্গে আমার বিয়ে, এই মুহুর্তে কোনো গজামিল করতে চাই না!’
‘ওকে ভাই, ভাই একটা কথা বলবো?’

‘বলো?’
‘আপনার বিয়েতে কি আমরা যাইতে পারবো না?’
‘পারবে না কেন? অবশ্যই তোমরা সবাই আসবে। একজনও বাদ পড়বে না। সুপ্রিয়র বিয়ে বলে কথা!’

বিউটি বাসায় এসে কারোর সঙ্গে কোনো প্রকার কথা না বলে, ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়েছিলো। এক ঘুমে রাত দশটা। টী টেবিলের উপর বুমবুম করে ভাইব্রেট হচ্ছে ফোনটা। বিউটির ঘুম হালকা হলেও সে ফোন ধরলো না৷ সোজা ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো সুপ্রিয় কল করেছিলো। কল ব্যাক করবে তার মধ্যেই শাহানা বেগম এলেন! তার কথার ধাচ্ কিছু টা গম্ভীর শোনালো। শান্ত তবে ক্লেশ কন্ঠে বললেন,

‘সর্বক্ষন কি আপনি ঘুমাবেন আর ফোন ই গুতাবেন? খাওয়া দাওয়া সব বাদ?’
‘আশ্চর্য আম্মু, এভাবে কথা বলছো কেন?’
‘কিভাবে বললাম? নিজের মর্জি মতো চলাফেরা করেন, যা খুশি করে বেড়ান, কোথাও গেলে বলে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেন না, এসেও নিজের মতো রুমে ঢুকে ঘুমিয়ে যান। আমরা যে এই বাড়িতে আছি সেটা তো ভুলেই বসেছেন।

ভুলবেনই তো, আমরা এই বাড়ির ভাড়াটিয়া না? ভাড়াটিয়া কেন বলছি আপনার মাইনে দিয়ে পোষা কাজের লোক! দাসী বাদী করে রেখেছেন আমাদের। চারটে রেধে বেড়ে দেবো খাবেন, নাহ সেটাও মুখে তুলে দিতে হবে! আসেন রানী সাহেবা চারটে গিলে উদ্ধার করেন। তা না হলে তো আবার আপনার জমিদার বাবা আমাদের ই কথা শুনাবেন!’
বিউটি বুঝলো, তার মা বেশ রেগে গেছে। সে মাকে বুঝাতে চাইলো সে কোনো ভুল কাজ করছে না। কিন্তু শাহানা বেগম চেচামেচি শুরু করলেন। স্ত্রীর চিৎকার শুনে বাইরে এলেন হাশেম আলী। তার পরপরই সন্দিপ্তা আর লিমন এলো।

‘কি হয়েছে মা? চেচাচ্ছো কেন?’
‘আমি তো শুধুই চেচামেচি করি! সারাটা জীবন এই সংসারের ঘানি টানতে টানতে বুড়ো হয়ে গেলাম। তার বিনিময়ে এই সংসার থেকে আমি কি পেয়েছি? দুঃখ ছাড়া আর কিছু দিয়েছিস তোরা আমায়?’
‘আম্মু, আব্বু তোমাকে আমাদের দিয়েছেন!’

বিউটি কথাটা বলেই ফিক করে হেসে দিলো। হাশেম আলীও ঠোঁট চেপে হাসলেন। শাহানা বেগমের সহ্য হলো না বিউটির মশকরা! দিলেজ ঠাটিয়ে চ’ড় বসিয়ে! মুহুর্তের মধ্যে পরিবেশ থমথমে হয়ে গেলো। বিউটি সপাটে সবার মুখের উপর দরজা আটকে দিলো। মুখ চেপে কা’ন্না নিবারণের চেষ্টা করলো সে।
‘এটা তুমি কি করলে শাহানা? একটা এতো বড় মেয়েকে এভাবে মা’র’লে? লজ্জা করলো না হাত উঠাতে?’
‘আম্মু, তোমার থেকে এটা আশা করিনি। ওকে মে’রে তুমি ভুল করলে। আমার বোনকে এভাবে মা’র’তে পারো না তুমি!’

কথা শেষ করেই লিমন চলে গেলো রুমে। সন্দিপ্তা বলার ভাষা হারিয়ে আটসাট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পরিবেশ টা যে এতোটা গুমোট হবে তা ধারণাও ছিলো না কারোরই! শাহানা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

‘আপনার মেয়েকে তারাতাড়ি বিয়ে দিন ওকে আর আমার চোখে সহ্য হচ্ছে না। বিয়ে দিয়ে বিদেয় করলে আমার শান্তি। আপনার মেয়ের সংসার দেখার সাধ না জাগলেও আমাত কি জাগে না? বয়স তো কম হলো না, কদিন পর ম’রে যাবো। নাতী নাতনীর মুখ কি দেখতে ইচ্ছে করে না আমার? আমি ওর মা, ওর একটা সুন্দর সংসার কি মা হয়ে দেখতে চাইতে পারি না? বিয়ে দিন ওকে!’

‘চুপ করো শাহানা! বেশি কথা বলো না। ওর তো বিয়ে হবেই!’
‘আরও কবে?’
‘শান্ত হও, ঘরে আসো। আসো তো!’

সন্দিপ্তা এখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো। তার ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠে। তাদের বিয়ের এতো বছরেও তো একটা নাতী নাতনীর মুখ দেখাতে পারেনি৷ আজ যদি তার একটা সন্তান হতো তবে হয়তো এসব কথা বিউটিকে বলতো না তার শাশুড়ী মা। হ্যাঁ তাকে কখনোই এই বাড়ির কেউ বাচ্চা নিয়ে কিছু বলেনি তবে প্রত্যেকটা মানুষের মনে তো এই নিয়ে আক্ষেপ রয়েইছে। হাশেম আলী লক্ষ্য করলেন সবার অলক্ষ্যে সন্দিপ্তা চোখের জল মুছছে। তিনি নিজের স্ত্রীকে সেটা ইশারায় বোঝালেন। শাহানা বেগম বুঝলেন, কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলেন।

‘বুঝলে মা, আজ বোধহয় তোমার শাশুড়ী আমাকে ঘরে জায়গা দেবেন না। যা রেগে গেছে। এই বুড়ো বয়সে আমাকে বাইরে না রাত কাটাতে হয়!’
সন্দিপ্তা হেসে উঠলো। হাশেম আলী তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘মা জননী, তোমার চোখে অশ্রু যে শোভা পায় না। আমার ঘরের লক্ষী, আমার মেয়েরা কাঁদলে কি এই বুড়ো বাবাটার ভালো লাগে? যাও ঘরে যাও! দেখি তোমার শাশুড়ীর মান ভাঙাতে পারি কি না।’

সন্দিপ্তা আবারও হাসলো। এই মানুষ গুলো প্রতিটি মুহুর্তে তার শক্তি হয়ে এসেছে এভাবেই। সন্দিপ্তা চলে গেলো বিউটির জন্য খাবার আনতে। মেয়েটাকে না খাইয়ে তো রাখা যায় না?
বিউটি রুমে ঢুকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো। তারপর সুপ্রিয়কে কলে করে রিসিভ হতেই বললো,’সুপ্রিয় ভাই, আমি এক্ষুনি, আজ এই মুহুর্তে বিয়ে করতে চাই আপনাকে? পারবেন আসতে? বিয়ের এক বছরের মধ্যে বাচ্চা কাচ্চা হলে আমার আব্বু আম্মুর হাতে ওঁকে তুলে দিবো। বলুন এক্ষুনি বিয়ে করবেন?’

অপরপাশে সুপ্রিয় তাজ্জব বনে হা হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। এটা কি সত্যিই বিউটি নাকি অন্য কেউ? ভুতে টুতে পেলো না তো এই রাত বিরেতে? ভুলভাল বাক্য বলছে! নাকি সে ভুল শুনছে?
‘কি হলো বলুন? বিয়ে করবেন? না করলে বলুন আমি এক্ষুনি বাসা থেকে বের হবো, গিয়ে মিনহাজ স্যারকে বিয়ে করে নিবো!’

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২৭

‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর? শান্ত হো। আরেকবার এমন ভুল ভাল বকবি খু’ন করে ফেলবো!’

সে আমার সুকেশিনী পর্ব ২৯