একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ২৮

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ২৮
সাদিয়া জাহান উম্মি

সকালের নাস্তা করছে ইয়ং’রা। আজ তাদের ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছে সবার।তাই তাদের দেরি হয়েছে ব্রেকফাস্ট করতে।বড়দের সবার ব্রেকফাস্ট শেষ।এদিকে প্রাহি বারবার ইশি আর হেমন্ত’র দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি দিচ্ছে।হেমন্ত’র তাতে কিছু যায় আসে না অবশ্য।কিন্তু ইশি ঠিকভাবে খাবারটাও খেতে পারছে না।প্রাহিকে খাবার খেয়ে এইভাবে দুষ্টুমি করতে দেখে চোখ অর্থ ওর দিকে না তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,

‘ কেউ যদি এখানে খাবার না খেয়ে এইভাবে অন্যদের ডিস্টার্ব করতে চায় তাহলে সে যেন উঠে চলে যায়।অযথা খাবার কেন নষ্ট করছে বসে বসে?’
অর্থ’র এমন খোঁচা মারা কথায় মুহূর্তেই মুখটা কালো হয়ে গেলো প্রাহির। লোকটা সকাল থেকে এমন তেতো মুখে কথা বলছে।কি হয়েছে?কি করেছে প্রাহি? প্রাহি আর কোনকিছু বললো না চুপচাপ খাবার খেতে লাগলো।খাবার খাওয়া শেষে অর্থ ধুপ করে ওর প্লেটের কিনারে ওষুধগুলো দিয়ে উঠে চলে গেলো।প্রাহি অর্থ’র যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।চোখ ভরে আসতে চাইলেও নিজেকে সামলে নিলো প্রাহি।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

চুপ-চাপ ওষুধ খেয়ে নিলো।উঠে গিয়ে টিভি ছেড়ে সোফায় বসে পরলো প্রাহি।এদিকে আরাফ,হিয়া,হেমন্ত,ইশি সবাই তৈরি হয়েই নেমেছে।ওদের খাওয়া শেষে হিয়া চলে গেলো নিজের স্কুটি নিয়ে।অবশ্য আরাফ ফিসফিসিয়ে বলেছিলো ওকে আরাফের সাথে যেতে।কিন্তু হিয়া জেদ দেখিয়ে একাই চলে গিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।হিয়া আর হেমন্ত প্রাহির সাথে টুকাটাকি কথা বলে তারাও রওনা দিলো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।প্রাহি সুস্থ্য হতে আরো একসপ্তাহের মতো লাগবে।তাই সে আপাততো যাচ্ছে না ভার্সিটি।হিয়া আর হেমন্ত ওকে সব পড়া নোট করে এনে দেয়।আর অর্থ ওকে পড়ায় বাসায়।এদিকে আরাফ অপেক্ষা করছে অর্থ’র জন্যে।

আরাফ আর অর্থ দুজন মিলে একসাথে একটা ফ্যাশন হাইজ দিয়েছে।দুজনে এখন একসাথে এখন এই ব্যবসাটা সামলাবে।অবশ্য বিদেশেও ওদের ভিন্ন ভিন্ন বিজন্যাস আছে।আরাফের বাবা এতে ছেলের প্রতি অনেক ক্ষিপ্ত হয়ে আছে।তাতে অবশ্য আরাফের কিছু যায় আসে না। ব্যবসাটাও ভালোই চলছে।আরাফ সিদ্ধান্ত নিয়েছে দু-চারদিনের মাঝে একটা ফ্লাট কিনে সেখানে গিয়ে উঠবে।বন্ধুর বাড়িতে আর কয়দিন পরে থাকবে।নিজের কাছেই কেমন যেন দৃষ্টিকটু লাগে বিষয়টা আরাফের।তাছাড়া কয়দিন পর তো এমনিতেও এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে জামাই হবে আরাফ।তখন নাহয় ইচ্ছেমতো বেড়ানো যাবে।আপাততো সেকয়দিনের জন্যে একা একটু কষ্ট করে থাকতে হবে।এদিকে প্রাহি বারবার সিড়ির দিকে তাকাচ্ছে।

অর্থ আসলে অর্থকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবে। ইলফাকে অর্থ কি করেছে?কোথায় রেখেছে?তা প্রাহি জানেনা। তাই সেই বিষয়েই জিজ্ঞেস করবে ভেবেছে।এই ক’দিনের ঝামেলায় জিজ্ঞেস করতে মনে নেই কিছু।কিয়ৎক্ষন বাদেই অর্থ নিচে নেমে আসে।আসতেই আরাফকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ চল দেরি হয়ে যাচ্ছে।একটা ইম্পোর্টেন্ট মিটিং আছে দেরি করা যাবে না।’
আরাফ মাথা ঝাকিয়ে চলে গেলো বাহিরে।প্রাহি সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো।অর্থকে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই অর্থ চিল্লিয়ে রায়হানা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে,
‘ মা আমি চলে যাচ্ছি।তুমি একটু খেয়াল রেখো একজনের প্রতি।সে যেন দুপুরে খাবার খেয়ে ওষুধটাও সময় মতো খেয়ে নেয়।আমি দুপুরে আসতে পারবো না।মিটিং আছে একটা।আসছি!’

অর্থ প্রাহিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গটগট পায়ে বাহিরে চলে গেলো।এদিকে প্রাহি বিমুঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অর্থ’র যাওয়ার পানে।অর্থ কি রাগ করেছে প্রাহির উপর?এরকম ইগনোর করছে কেন প্রাহিকে?তবে কি কাল উনার কথা না শোনার কারনেই উনি এমন করছে?এটাই হবে।নাহলে তো অর্থ কখনই এমন করে না প্রাহির সাথে।প্রাহির কান্না পাচ্ছে ভীষনভাবে।তাই চুপচাপ নিজের শরীর ভালো লাগছে না বাহানা দিয়ে রুমে চলে গেলো। রুমে এসেও কি করবে ভেবে পাচ্ছে না প্রাহি।ওর কিছুই ভালো লাগছে।হঠাৎ টেবিলের উপর চোখ গেলো অর্থ’র ল্যাপটপ রাখা।

লোকটার মিটিং আছে বললো তাহলে এইভাবে ল্যাপটপ রেখে যাওয়ার মানে কি?প্রাহির চিন্তা হলো লোকটা যদি ভুলে ল্যাপটপটা রেখে যায় তাহলে মিটিংটা করবে কিভাবে?প্রাহি চিন্তিত হয়ে অর্থকে তৎক্ষনাৎ ফোন করলো।কিন্তু ফোনটা রিসিভ হলো না।প্রাহি আবারো ট্রায় করলো একবার দুবার।কিন্তু কলটা ধরলো না অর্থ।৩য় বার কল করার পর বুঝতে পারলো অর্থ ফোনটা বন্ধ করে রেখেছে।প্রাহির বুক ভার হয়ে আসলো কষ্টে।দুচোখ বেয়ে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো। প্রাহি নিজেকে সামলে নিয়ে টেবিল থেকে ল্যাপটপটা হাতে নিলো।সাথে সাথে ল্যাপটপের নিচে একটা চিরকুট পেলো।প্রাহি কৌতুহল নিয়ে চিরকুট খুলেই দেখতে পেলো গুটিগুটি অক্ষরের কিছু লিখা,

‘ খামোখা টেন্সন করে লাভ নেই।আমি ইচ্ছে করে ল্যাপটপ রেখে গিয়েছে।যাতে কেউ একজন বোর ফিল না করে।’
প্রাহি জানে এটা অর্থ’র লিখা।প্রাহি মুখ ভেংচি মারলো।ও শুধু শুধুই টেন্সন করছিলো বজ্জাত লোকটার জন্যে।প্রাহি ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় আরাম করে বসলো।নেটফ্লিক্স এপে ঢুকে কিছু হরর মুভি দেখতে লাগলো।মুভিটা পুরোপুরি শুরু হওয়ার আগে আবারও উঠে গিয়ে কয়েকপ্যাকেট চিপ্স আর চকলেট নিয়ে এসে বসলো।এগুলো অর্থই এনে দেয় ওকে।প্রাহি প্রায় দু দুটো ডিব্বা পুরো ভরে রাখে এইগুলা দিয়ে।শেষ হওয়ার আগেই আবারও অর্থ এনে দেয়।এইভাবে মুভি দেখতে দেখতে কখন যে দুপুর হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারেনি প্রাহি।আজানের ধ্বনি শুনে দ্রুত উঠে বসে।এখন আরেকটা মুভি চলছে।সে পওস করে উঠে গোসল করে নামাজ পরে নিলো।নিচ থেকে রায়হানা বেগম ডাকছন দুপুরের খাবারের জন্যে।প্রাহি দ্রুত নিচে আসলো।নিচে এসে দেখে ইশি আর হেমন্ত ভার্সিটি থেকে এসে পরেছে।প্রাহি চেয়ারে বসতে বসতে বলে,

‘ কখন আসলি?’
হেমন্ত পানি খাচ্ছিলো। ইশিই জবাব দিলো,
‘ এইতো একটু আগেই।ফ্রেস হয়েই এখানে আসলাম খেতে মা আর বড় মা ডাকছিলেন।’
হেমন্ত পানি খাওয়া শেষ বলে,
‘ আমি তোকে একটু পর নোট্সগুলো দিয়ে যাবোনে।এখন ভালোভাবে খেয়ে নেয়।’
খাওয়া দাওয়া হলো।প্রাহি বেশি না কোনরকম দুতিন লোকমা খেলো।হেমন্ত চোখ রাঙ্গিয়ে বলে,
‘ এইটাকে খাওয়া বলে?তোর থেকে পাশের বাড়ির আন্টির ছয়বছরের ছেলেটাও বেশি খায়।’
প্রাহি রাগি চোখে তাকালো হেমন্ত দিকে।তেজি কন্ঠে বলে,

‘ একদম বাজে কথা বলবি নাহ।আমার পেট এমনিতেই অনেক ভড়া ছিলো।তাই খেতে পারিনি!’
‘ কেন কি খেয়েছিস?যে ভাত খেতে পারলি নাহ?’
‘ আসলে মুভি দেখতে দেখতে অনেকগুলো চিপ্স আর চকলেট খেয়েছি তাই আর ক্ষিদে নেই।’
হেমন্ত দাঁতেদাঁত চিপে বলে,
‘ খুব ভালো করেছিস।এখন ওষুধ খেয়ে নেহ।তোকে তো থাপড়ানো উচিত দিনরাত।ভাইয়া যে কি করে?তোকে প্রতিদিন তিনবেলা ভাতের বদলে থাপ্পড় খেতে দিতে পারে নাহ?’
প্রাহির মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।ও তেড়ে গিয়ে ওর ভালো হাত দিয়ে হেমন্ত’র চুল টেনে ধরলো,
‘ আমার সাথে না লাগলে তোর ভালো লাগে না তাই নাহ?তুই শুধু শুধু কেন লাগতে আসিস আমার সাথে?আমার একহাতে ব্যাথা তো কি হয়েছে?আমার আরেক হাত তো ভালো আছে তোর মাথার সব চুল ছিড়ে ফেলবো শয়তান ছেলে।’
এদিকে ব্যাথায় হেমন্ত চেঁচিয়ে উঠলো,

‘ মা, বড়মা তোমাদের রাক্ষসী বউমা আমার সব চুল ছিড়ে ফেললো বাচাও গো।’
রায়হানা বেগম আর হেনা বেগম এসে ছেলেমেয়েদের এমন বাচ্চামো কান্ড দেখে হেসে দিলেন।ইশি এককোনায় দাঁড়িয়ে হাসছিলো।তারা ইশিকে কারন জিজ্ঞেস করতেই ইশি সব বলায় তারাও ইশির সাথে তাল মিলিয়ে হেসে দেয়।ইশিকে এমনভাবে হাসতে দেখে হেমন্ত রাগি গলায় বলে,
‘ তোর মতো শাকচুন্নি বউ থাকলে শত্রুর কোন প্রয়োজন নেই পেত্নি একটা। স্বামির এমন কষ্ট দেখেও কিছু করছে না।নিষ্ঠুর মেয়ে!’
ইশি রাগি চোখে তাকালো হেমন্ত’র দিকে। বললো,

‘ ইশি আরো জোড়ে মার।আমার পক্ষ থেকেও দুটো বোনাস দে।আমাকে বলে আমি নাকি শাকচুন্নি আর পেত্নি।কতো বড় সাহস।নেহাতি আমি ভালো মেয়ে তাই প্রাহিকে দিয়ে তোকে মার খাওয়াচ্ছি।নাহলে নিজে এসেই মারতাম।’
হেমন্ত অসহায়ভাবে একবার ভাবিরূপে নিজের একবন্ধুকে দেখছে আরেকজন বন্ধুকে বউরূপে দেখছে।এ কাদের পাল্লায় পরলো হেমন্ত।অবশেষে উপায় না পেয়ে অনেক আকুতি মিনুতি করে প্রাহির থেকে ছাড়া পায় হেমন্ত।ছাড়া পেতেই একদৌড়ে ও পগাঢ়পাড়। ওর এমন অবস্থা দেখে ইশি আর প্রাহি হাসতে হাসতে শেষ।ইশিও চলে গেলো ওর রুমে।প্রাহিও নিজের রুমে চলে গেলো।

তার এখনো মুভিটা দেখা বাকি।এখনো মুভির পুরো টুইস্ট বাকি আছে।প্রাহি গিয়ে আবারও মুভি দেখায় মনোযোগ দিলো।সারাদিন ও সুয়ে বসে মুভি দেখেই পার করেছে।বিকেলে শুধু উঠে হালকা নাস্তা খেয়েছে।আর ইশি আত হেমন্ত এবং হিয়ার সাথে ছাদে একঘন্টার মতো আড্ডা দিয়েছে।তারপর হেমন্তর থেকে নোট্সগুলো নিয়ে দুঘন্টা পড়েছেও।পড়া শেষে আবারও মুভি দেখতে বসেছে।নয়টা বাজলে রায়হানা বেগম খেতে ডাকলে বলে দিয়েছে, আপনার ছেলে আসলে খাবো মা প্লিজ। রায়হানা বেগম আর জোড় করেননি।

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ২৭

প্রাহি অর্থ’র জন্যে অপেক্ষা করতে করতে দেখে সারে এগারোটা বাজে।লোকটার তো কোনদিন এতো দেরি হয়নি।তবে আজ কেন এতো দেরি হচ্ছে।লোকটা ইচ্ছে করে এসব করছে যাতে ওকে ফেস করতে নাহয়?প্রাহি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো।বিছানায় উপর হয়ে সুয়ে কাঁদতে লাগলো।হাতে ব্যাথাও পেলো একটু কিন্তু তাতে ভ্রুক্ষেপ করলো। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে প্রাহি তা নিজেও জানলো না।

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ২৯