একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ২৭

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ২৭
সাদিয়া জাহান উম্মি

প্রাহি ভয়ে মুখ কাচুমাচু করে রেখেছে।আর অর্থ গভীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এখনো ওর দিকে তাকিয়ে আছে।প্রাহি অর্থ’র এমন ভয়ানক দৃষ্টি দেখে ওর গলা শুকিয়ে আসছে বারবার।তাও মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে বললো,
‘ এইভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? হ্যা?’
অর্থ নিজের স্থান বজায় রেখে বলে,

‘ কিভাবে?’
প্রাহি মুখটা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে কোনরকম বলে,
‘ মনে হচ্ছে আমাকে খেয়ে ফেলবেন এমন দৃষ্টি দিচ্ছেন!’
অর্থ ঝুকে এলো প্রাহির দিকে।প্রাহি ভড়কালো,থমকালো। দৃষ্টি হলো এলোমেলো।অর্থ প্রগাঢ় কন্ঠে আওড়ালো,
‘ পারলে তোমাকে খেয়েই নিতাম।তাহলে মনে মনে শান্তি তো পেতাম যে তুমি আমার ভীতরে আছো।কিন্তু আমি তো তা কর‍তে পারছি না।এখন তোমায় নিয়া আমার মাথায় একগাদা টেন্সন সবসময় ভর করে থাকে।অসহ্য,কেয়ারলেস একটা মেয়ে!’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

প্রাহি খারাপ লাগলো অর্থ’র কথায়।অর্থ’ প্রতি একবুক অভিমান নিয়ে ভালো হাতটি দিয়ে অর্থকে ঠেলেঠুলে সরিয়ে দিতে চাইলো।অর্থ বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে বলে,
‘ কি সমস্যা এমন করছো কেন?’
‘ সরুন!’ প্রাহি কন্ঠে কান্নার আভাস স্পষ্ট টের পেলো অর্থ।চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরে গেলো অর্থ।যা মন চায় করুক।আর কিছু বলবে না অর্থ।কিছু বললেই হলো কেঁদেকেটে সমুদ্র বানিয়ে ফেলে।আর সেই কান্না দেখে অর্থ’র বুকে ব্যাথা উঠে।তাই অর্থ ওকে আর কিছু বলবে না।যা মন চায় করুক প্রাহি। ও শুধু তামাশা দেখবে মেয়েটার।যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে অর্থ এইবার আর নিজেকে থামিয়ে রাখবে না।কষে চড় মেরে দিবে।অনেক বার বেড়েছে মেয়েটা!

অর্থ টানটান হয়ে সুয়ে চোখের উপর হাত দিয়ে সুয়ে পরলো।প্রাহির অভিমান আরো একধাপ বারলো।প্রাহি ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করতে করতে নিশব্দে বিছানা থেকে নেমে দাড়ালো।কথা বলবে না প্রাহি আর লোকটার সাথে।কিভাবে ওকে ছাড়াই ঘুমিয়ে পরলো।প্রাহি আজ যাবেই না বিছানায় ঘুমোতে।ও বারান্দার ফ্লোরে পাতানো বিছানায় গিয়ে বসলো।অভিমানি দৃষ্টি নিয়ে তাকালো নীকষ কালো আসমানের পানে।কিযে হয় প্রাহির প্রাহি নিজেও বুঝে না।এই লোকটার সামনেই কেন এতো কান্না পায় প্রাহির?কেন এতো দূর্বল হয়ে পরে?লোকটা সামনে থাকলে প্রাহি কেমন যেন অনেক আহ্লাদি হয়ে যায়।বাচ্চাদের মতো করে কেমন সবসময়।ভালোবাসলে কি তাহলে মানুষ তবে নিজের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলে?হয়তো! তাইতো প্রাহির সাথেই এসব হচ্ছে।প্রাহি আকাশের দিকে একমনে তাকিয়েই মনে মনে বলে,

‘ আচ্ছা অর্থ আপনি কি এই দুমাসেও কি আমায় ভালোবাসতে পারেননি?ভালোবাসেন না আমায়?
আপনি কি মোহ পড়ে আমায় বিয়ে করেছেন?মোহ কেটে গেলে তো আমারও কোন দাম থাকবে না আপনার জীবনে।তখন হয়তো নিশ্চয়ই ছুড়ে ফেলে দিবেন আমায়।কিন্তু আমি? আমি কিভাবে থাকবো আপনাকে ছাড়া?আমি তো নিঃস্ব অর্থ।আমার যে কেউ নেই! আমি বড্ড ভালোবাসার কাঙ্গাল অর্থ।আপনার ভালোবাসার কাঙ্গাল।’
প্রাহির গাল বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পরলো।বাবার কথা মনে পরছে খুব করে।প্রাহি বিরবির করে বলে,

‘ বাবা,আমি তোমায় বড্ড মিস করছি। তুমি আমাকে কেন এইভাবে ফেলে চলে গেলে বাবা।তোমার প্রিন্সেসের কথা কি তোমার আর মনে পরে না বাবা?আমার তো তোমার কথা খুব করে মনে পরে।আমি ব্যর্থ সন্তান বাবা।আমি তোমাকে বাঁচাতে পারিনি।না পারছি তোমার খুনিকে শাস্তি দিতে।আমি যে কোন পথ দেখছি না বাবা।আমি যে বড্ড দূর্বল।আমি কিভাবে সবকিছু সামলাবো বাবা।তুমি থাকলে ভালোবেসে মাথায় হাত রাখো না বাবা।তুমি থাকলে আমার কোন কিছুই কঠিন মনে হয়না।কিন্তু তুমি তো আসো না বাবা।আমি তোমায় এতো ডাকি তাও তুমি আসো না।’

প্রাহি চোখের জলগুলো মুছে নিলো। টেবিলের ড্রয়ারের লক খুলে ডায়রীটা হাতে নিলো।আজ ও আর ঘুমাবে না।আজ নিজের জীবনের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো পড়বে আর তা কল্পনা করে রাত কাটিয়ে দিবে প্রাহি।সেই সাথে ওদের ফ্যামিলি এলবামটাও নিলো।তারপর চুপিসারে আবারও বারান্দায় চলে গেলো।প্রাহি রুম থেকে যেতেই অর্থ চোখ মেলে তাকায়।অর্থ সজাগই ছিলো। প্রাহিকে বুকে না নিয়ে কি ওর ঘুম আসবে?উহুঁ কখনো না।

সারারাত তাহলে ছটফট করে কাটাতে হবে ওকে।অর্থ কোন আওয়াজ না করে চুপিসারে বারান্দার দরজার সামনে আড়াল করে দাড়িয়ে রইলো।আর একদৃষ্টিতে নিজের উদাসিন স্ত্রীকে দেখতে থাকলো।এভাবে কেটে গেলো প্রায় একঘন্টা।প্রাহি ওর ডায়রী আর ফ্যামিলি এলবাম দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পরেছে।অর্থ দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো।প্রাহির ঘুমানোর অপেক্ষা করতে করতে অর্থ’র পা দুটো ঝিম ধরে গিয়েছে।অর্থ প্রাহির কাছে বসে ওকে নিস্তব্ধে কোলে তুলে নিলো।খুব সাবধানে সুইয়ে দিয়ে আবারও বারান্দায় চলে এলো।

ডায়রী আর এলবামটা গুছিয়ে রাখতে হবে। এলবামটা হাতে নিয়ে যখন ডায়রীটা হাতে নেয় অর্থ।ভ্রু-কুচকে যায় ডায়রীর প্রথম লিখাটা পরে।ডায়রীর উপরে সুন্দরভাবে লিখা ”My Family,Happinesses And My Love!’।অর্থ ডায়রীটা হাতে নিয়েই একপলক তাকায় ঘুমন্ত প্রাহির দিকে। My Love লিখাটা ভাবাচ্ছে অর্থকে।কে প্রাহির ভালোবাসা?ডায়রীটা অনেক পুরনো প্রায় সাত বছর আগের তারিখ দেওয়া আছে তা দেখেই বুঝেছে অর্থ।কিন্তু সাতবছর যাবত কাকে ভালোবাসে প্রাহি?অর্থ কি একবার ডায়রীটা খুলে দেখবে?

কিন্তু কেমন যেন বিবেগ ওকে বাধা দিচ্ছে।এইভাবে কারো পার্সোনাল জিনিসে হস্তক্ষেপ করা অর্থ পছন্দ করে না।কিন্তু আজ কেমন যেন মন চাচ্ছে ডায়রীটা খুলে পড়তে।প্রাহির মনের কথাগুলো তো এই ডায়রীতেই লিখা তা নিজেও পড়ে অনুভব করতে চাইছে অর্থ।প্রাহি তো ওর স্ত্রী।স্ত্রীর সবকিছুতে ওর অধিকার আছে।পড়তেই পারে অর্থ ডায়রীটা।যেউ ভাবা সেই কাজ।এলবামটা জায়গা মতো রেখে দিলো অর্থ।ডায়রীটা নিয়ে বিছানায় সুয়ে টেবিলল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিলো।

হঠাৎ প্রাহি একদম অর্থ’র কাছে এসে ওর সাথে লেপ্টে গুটিশুটি মেরে সুয়ে পড়লো।অর্থ নিশব্দে হাসলো।আধশোয়া হয়ে প্রাহিকে নিজের বুকে অতি সাবধানে আগলে নিলো।যাতে মেয়েটা ব্যথা না পায়। প্রাহিও অর্থ’র বুকের উষ্মতা পেয়ে আরো গুটিয়ে গেলো অর্থ’র বুকে।অর্থ প্রাহির এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে ওর কপালে সময় নিয়ে দীর্ঘ এক ভালোবাসার স্পর্শ দিলো।ঘুমের ঘোরেই প্রাহির ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো।একহাতে প্রাহিকে জড়িয়ে নিয়ে আরেকহাতে ডায়রী খুলে পড়া শুরু করে দিলো অর্থ।কিন্তু যতো পড়ছে ততোই অবাক হচ্ছে অর্থ।জীবনে মনে হয় এতোবড় ঝটকা ও কখনো পাইনি।বারবার বিষ্ময় নিয়ে প্রাহির দিকে তাকাচ্ছে অর্থ।পুরো ডায়রীটা পড়া শেষে অদ্ভূত হাসি ফুটে উঠলো অর্থ’র অধর কোণে।ডায়রীটা সন্তর্পনে বিছানার সাথে এটাচ্ড টেবিলের ড্রয়ারে তালা মেরে রেখে দিলো।তারপর এসে প্রাহিকে ভালোভাবে বুকে জড়িয়ে নিয়ে চোখ বুজে বিরবির করলো,

‘তোমার জন্যে অনেক বড় সার্প্রাইজ আছে জান।শুধু তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও।আমি যে আর অপেক্ষা করতে পারছি না।এ কি করলে তুমি আমার।আমার বুকের তোলপাড়গুলো কিভাবে থামাবো আমি প্রাহি? তোমার ছোট্ট মনে যে এতোকিছু ছিলো তা এইভাবে আমার থেকে লুকিয়ে ভালো করোনি জান। এরজন্যে তোমাকে কিযে করতে মন চাইছে।শুধু অসুস্থ তাই কিছু বললাম নাহ।জলদি সুস্থ হয়ে যাও।’

বিছানার এককোনায় বসে পা দুলিয়ে একের-পর এক চকলেট খাচ্ছে ইশি।আর ওর দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে আছে হেমন্ত।ইশি যে ওকে ইচ্ছে করে জ্বালাচ্ছে তা বেশভ ভালোভাবে বুঝতে পারছে হেমন্ত।একঘন্টা লাগিয়ে এই রাতে গোসল করেছে ইশি।সেই সাথে হেমন্ত’কেও ঠেলেঠুলে গোসল করার জন্যে বাধ্য করেছে।আর এখন এই একঘন্টা ধরে মনের সুখে চকলেট খাচ্ছে।হেমন্ত এইবার ধুপ-ধাপ পা ফেলে ইশির কাছে গেলো।ইশি দেখেও না দেখার ভান ধরে রইলো।হেমন্ত দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,

‘ তুই কি এইভাবেই রাতটা পার করে দিতে চাইছিস?’
‘ ঘরটা অনেক সুন্দর করে সাজিয়েছে তাই নাহ?তোর আরো দশহাজার টাকা বেশি দেওয়া উচিত ছিলো। ‘ ইশির এমন খাপখেয়ালি কথা শুনে হেমন্ত’র মন চাচ্ছে ইশিকে বারান্দা থেকে ছুড়ে ফেলে দিতে।কিন্তু নিজের একমাত্র বউ বলে কিছু করছে না হেমন্ত!রাগ নিয়ে হেমন্ত বললো,

‘ আমাকে রাগাস না ইশি।মেজাজ কিন্তু পুরাই ফোরটি নাইন হয়ে আছে।’
ইশি চকলেটে লাস্ট বাইট দিয়ে বিছানা থেকে উঠে যেতে নিলেই এইবার হেমন্ত ইশির হাত ধরে একটানে ওকে নিজের বুকে নিয়ে আসে।ইশি হকচকিয়ে যায় হেমন্ত’র কান্ডে।ইশি কিছু বলবে তার আগেই হেমন্ত ইশির ঠোঁটের চারপাশে লেগে থাকা চকলেটগুলোর দিকে নেশাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নিজের জিহ্বা দ্বারা লেহন দিয়ে তা খেয়ে নিলো।ইশি কেঁপে উঠে হেমন্ত কাধ খামছে ধরে।সারাশরীর ভুমিকম্পের ন্যায় কেঁপে উঠে।হেমন্ত ইশির লজ্জা মিশ্রিত মুখপানে চেয়ে নিজের মুখ এগিয়ে নিলো ইশির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘ ইশি আই নিড ইউ।আই নিড ইউ ফুললি।প্লিজ ইশি।তুই আমার অনেক প্রতিক্ষা,অপেক্ষার ফল।তুই আমার ভালোবাসা ইশি।ভালোবাসি তোকেপ।আজ তোকে পুরোপুরি নিজের করে চাই তোকে ইশি।দিবি সেই অনুমতি?’
ইশি কি বলবে লজ্জায় ওর কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।বারবার শুকনো ঢোক গিলছে ইশি।হেমন্ত ইশির কোন রেস্পন্স না পেয়ে বুঝলো ইশি রাজি না।তাই ইশিকে ছেড়ে দিয়ে সরে আসতে নিতেই।ইশি চট করে চোখ মেলে তাকালো।আৎকে উঠে হেমন্ত’র কলার চেপে ধরলো।হেমন্ত ঘুরে ইশির দিকে তাকাতেই ইশি মুখশ্রী নিচু করে ফেললো।হেমন্ত ব্যগ্র কন্ঠে বললো,

‘ অনেক রাত হয়েছে ঘুমোতে চল ইশি।’
ইশি সাথে সাথে চোখ তুলে তাকায় হেমন্ত’র দিকে।ওর চোখে চোখ রেগে খানিক তাকিয়ে থেকে।হুট করে জড়িয়ে ধরে হেমন্তকে।লজ্জায় আড়ষ্ট কন্ঠে বলে,
‘ ভালোবাসবি না আমায় হেমন্ত?’
ইশির এটুকু কথাই যথেষ্ট ছিলো হেমন্ত’র জন্যে।ঠোঁটের কোনে প্রাপ্তির হাসি ফুটে উঠে ওর।সাথে সাথে ইশিকে কোলে তুলে নিলো। দুষ্টু হেসে বলে,
‘ আজ তো তুমি শেষ সুন্দরী!’

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি বোনাস পর্ব

হেমন্ত’র মুখে তুমি ডাক শুনে মনে মনে শীতল স্রোত বয়ে গেলো ইশির।পরক্ষনে হেমন্ত’র বলা কথাটা স্মরন হতেই লজ্জায় মুখ লুকায় হেমন্ত’র বুকে।ইশিকে বিছানায় সুইয়ে দিয়ে।হেমন্ত ইশির মায়াবী মুখশ্রীর দিকে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।তারপর ইশির শরীরে নিজের শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে ইশির কপালে,গালে,নাকে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে ইশির ঠোঁটজোড়া নিজের ঠোঁটের ভাজে নিয়ে নিলো। আজ সম্পূর্ণভাবে পূর্ণতা পেলো ওদের ভালোবাসা।একে-অপরের অস্তিত্বে মিশে গেলো প্রগাঢ়ভাবে।ভালোবাসার এক অন্য জগতে হারিয়ে গেলো দুজন মানব-মানবী।

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ২৮