একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ৩৪

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ৩৪
সাদিয়া জাহান উম্মি

প্রাহির গাড়িটা এসে থামলো পাঁচতলা একটা ভবনের সামনে।এইটা পুরোটাই অর্থ’র অফিস।প্রাহি লম্বা শ্বাস ফেলে আস্তে ধীরে নেমে দাড়ালো গাড়ি থেকে।শাড়িটা একটু ভালোভাবে সামলে নিয়ে টিফিনবক্সটা হাতে নিয়ে গেটের কাছে আসতেই থেমে গেলো প্রাহি।গেটের কাছে দোরোয়ান দাঁড়ানো তাকে দেখে মিষ্টি করে হাসলো প্রাহি।বিনয়ের সাথে সালাম জানালো।দারোয়ানও হাসলো প্রাহির এই অমায়িক ব্যাবহারে।গেট খুলে দিতেই প্রাহি ভীতরে প্রবেশ করলো।অফিসে প্রবেশ করতেই রিসিপশনের কাছে গিয়ে সেখানে কর্মরত মেয়েটাকে বললো,

‘ এক্সকিউজ মি মিস।এখানে অর্থ শিকদারের কেভিনটা কোথায়?’
মেয়েটা প্রাহির দিকে কেমনভাবে যেন তাকালো।অনেকটা রুক্ষভাবেই বলে,
‘ আপনি তাকে দিয়ে কি করবেন?’
প্রাহি ভড়কালো।চারদিকে তাকালো সবাই ওর দিকেই তাকিয়ে।কেমন যেন লাগছে প্রাহির।প্রাহি আমতা আমতা করে বলে,
‘ আসলে একটু দরকার। আপনি একটু উনার কেভিনটা কোথায় একটু বলে দিন প্লিজ।’
‘ সরি! কিন্তু পরিচয়টা দিন আগে আপনার?’
প্রাহির কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে।অর্থ’র স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিতে।প্রাহি নিজেকে সামলে নিলো।মুচঁকি হাসি দিয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ আমি মিসেস অর্থ শিকদার। এইবার বলুন উনার কেভিনটা কোথায়?’
মেয়েটি ভয় পেয়ে গেলো।ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,
‘ আ’ম সরি ম্যাম।আমি এক্সট্রেমলি সরি।আমি জানতাম নাহ যে!’
‘ ইট্স ওকে।এটা আপনার কাজ।আমি দেখে খুশি হলাম আপনি আপনার কাজ নিষ্ঠার সাথে পালন করছেন!’
মেয়েটি সস্থির শ্বাস ফেললো।তারপর প্রাহিকে অর্থ’র অফিসরুমটা কোথায় বলতেই প্রাহি সেদিকে চললো।লেফটে উঠে তিনতলায় গিয়ে পৌছালো।সবাই কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে।প্রাহির কেমন যেন নিজেকে এলিয়েন মনে হচ্ছে।প্রাহি অর্থ’র কেভিনের দরজায় আলতো টোকা দিলো।
অর্থ,আরাফ আর হেমন্ত মাত্রই বসেছিলো লাঞ্চ করার জন্যে।হঠাৎ দরজায় টোকা দেওয়ায় বিরক্ত হলো অর্থ।বললো,

‘ এখন কোন কাজের বিষয়ে কথা হবে না।আমরা লাঞ্চ করতে বসেছি বললাম নাহ?কমনসেন্স নেই?’
প্রাহি হাসলো।গলার কন্ঠস্বরটা একটু চিকন করে বলে,
‘ স্যার, প্লিজ অনেক ইম্পোর্টেন্ট একটা বিষয় স্যার।’
বলেই ঠোঁট টিপে হাসলো প্রাহি।আরাফ বলে,
‘ বাদ দে অর্থ।হবে হয়তো কোন দরকার।আসতে দে।কিছু হবে না।’
অর্থ আর কথা বাড়ালো না।গম্ভীর কন্ঠে বলে,
‘ কাম ইন!’

তারপর আবারও খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।দরজার দিকে তাকালো নাহ আর।
প্রাহি অর্থ’র অনুমতি পেয়ে দরজাটা আলতো ধাক্কা দিয়ে খুলে মাথাটা ঢুকিয়ে উঁকি দিলো।হেমন্ত আর অর্থ দরজার দিকেই তাকিয়ে ছিলো প্রাহিকে দেখে দুজনেই দাঁড়িয়ে গেলো।হা করে তাকিয়ে আছে।প্রাহি ইশারায় বসতে বললো।আর চুপ থাকতে বললো।আরাফ আর হেমন্ত বুঝতে পেরে সেইভাবেই বসে পরলো। প্রাহি ভীতরে প্রবেশ করে অর্থ’র পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।অর্থ নিজের পাশে কারো অস্থিত্ব অনুভব করলো।আঁড়চোখে কোন মেয়েকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে রেগে গেলো।দাঁতেদাঁত চিপে বলে,

‘ হোয়াদ দ্যা?তোমার সাহস কিভাবে হলো এখানে এসে দাঁড়ানোর?’
অর্থ রেগে উঠে দাড়িয়ে এইবার ভালোভাবে তাকাতেই প্রাহিকে দেখে মুখটা হা হয়ে গেলো।মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকলো নির্নিমেষ প্রাহির দিকে।অর্থ’র এমন দৃষ্টি দেখে লজ্জায় আড়ষ্ট হলো প্রাহি।দৃষ্টি হলো নত।লাজুক হাসলো।অর্থ ঘোরলাগা কন্ঠে বলে,
‘ মাশা-আল্লাহ! লুকিং সো গোর্জিয়াস! ‘
আরাফ আর হেমন্ত ঠোঁট টিপে হাসলো অর্থ’র অবস্থা দেখে।আরাফ গলা খাকারি দিয়ে বলে,
‘ সালা আমরাও এখানে আসি সেই লেহাজ কর।তুই এমন নির্লজ্জ কবে থেকে হলি দোস্ত?’
হেমন্ত মাথা চুলকে মিনমিন করে বলে,

‘ আমার ভাই তো দেখি প্রাহির প্রেমে পুরো কুপোকাত হয়ে আছে।আহা কি প্রেম।বরের জন্যে খাবার নিয়ে এসেছে।আর আমারজন নিষ্ঠুর এক মহিলা নিজের স্বামির জন্যে একটু মায়া দয়া নেই।এ কাকে বিয়ে করলাম আমি।বেষ্টফ্রেন্ডকে বিয়ে করলে বুঝি এমনি জ্বালা সহ্য করতে হয়?’
এদিকে অর্থ’র কোন হুশ নেই। ও এখনো তাকিয়ে আছে প্রাহির দিকে।নেভিব্লু কালারের শাড়িটা চমৎকার লাগছে দেখতে প্রাহিকে।সেই সাথে চোখে গাঢ়ো কাজল দেওয়া আর ঠোঁটে হালকা লিপগ্লোস দেওয়া।চুলগুলো বেনি করে একসাইডে এনে রাখা।অর্থ হৃদস্পন্দন দ্বিগুন বেড়ে গেছে প্রাহির এমন রূপ দেখে।প্রাহি এইবার আলতো কন্ঠে বলে,

‘ কি করছেন?এইভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?সবাই দেখছে প্লিজ।’
অর্থ থতমত খেয়ে গেলো।নিজেকে সংযত করলো।লম্বা লম্বা বার কয়েক শ্বাস ফেলে বলে,
‘ তুমি কখন আসলে?আর আসবে আমাকে ফোন করবে নাহ?একা একা কেন আসতে গেলে?’
প্রাহি মিষ্টি করে হাসলো।বলে,
‘ আমি তো আপনাকে সার্প্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।তাই আপনাকে জানাই নি।আর চিন্তা করবেন না।আমি বাড়ির গাড়ি দিয়ে এসেছি জাহাঙ্গীর কাকার সাথে।আপনি তো আজ বাড়ি যাবেন না বলেছেন।তাই ভাবলাম আমিই রান্না করে আপনাদের জন্যে লাঞ্চ নিয়ে যাই।এতে আপনারা বাড়ির খাবারও খেতে পারবেন আর আমাকে দেখে সার্প্রাইজ্ড হয়ে যাবেন!’

আরাফ আর হেমন্ত একে-অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে চিৎকারের মতো করে বলে,
‘ ওহহো সার্প্রাইজ দিবে!’
প্রাহি ওদের এমন করায় লজ্জা পাচ্ছে ভীষন।অর্থ বুঝতে পেরে মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বলে,
‘ এই তোরা দুটো এমন করছিস কেন?চুপচাপ থাকবি?নাহলে কিন্তু তোদের দুটোকে আমি একটুও খাবার দেবো না।’
আরাফ আর হেমন্ত তাড়াতাড়ি করে বলে,
‘ নাহ নাহ ভাই।আমরা আর এমন করবো না।প্রাহির হাতের রান্নাও আমরাও খাবো।’
প্রাহি বলে,
‘ আপনারা বসুন আমি খাবার বেড়ে দিচ্ছি।’

প্রাহি গিয়ে হাত ধুয়ে আসলো।তারপর অর্থ,আরাফ আর হেমন্তকে খাবার বেড়ে দিলো।আরাফ আর হেমন্ত ওদের খাবার পেয়ে দুজনে খাবার হাতে উঠে দাড়ালো।প্রাহি এতে ভড়কে যায়।বলে,
‘ কি হলো ভাইয়া আর হেমন্ত?আপনারা দাড়িয়েছেন কেন?’
আরাফ প্রসস্থ করে হাসে।বলে,
‘ আমি আর হেমন্ত চলে যাচ্ছি।তোমরা ইনজয় করো।কাবাবে হাড্ডি হতে আমরা চাই না।চল হেমন্ত। আর হ্যা থ্যাংস ফোর দ্যা লাঞ্চ প্রাহি।আসি।’

হেমন্ত প্রাহিকে চোখ টিপ দিলো।তারপর আরাফের পিছে পিছে সেও বেড়িয়ে গেলো।ওরা যেতেই অর্থ দ্রুত গিয়ে দরজা আটকে দিলো।অর্থকে এমন করতে দেখে বলে,
‘ কি হলো?আপনি দরজা আটকালেন কেন?কি হলো আপনার?’
অর্থ কিছু না বলে দ্রুত পায়ে প্রাহির কাছে আসলো।প্রাহিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্রাহির কোমড় আকঁড়ে ধরে ওকে নিজের কাছে এনে প্রাহির ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো।হঠাৎ অর্থ’র এমন আক্রমনে প্রাহি অবাক।পরক্ষনে নিজেকে সামলে নিয়ে অর্থ’কে দুহাতে আকঁড়ে ধরলো।মিনিট পাচেঁক পর সরে আসে অর্থ।প্রাহি চোখ খুলে তাকায় অর্থ’র দিকে।অর্থ বাঁকা হেসে বলে,

‘ আ’ম রেয়েলি সার্প্রাইজড বউ।এমন সার্প্রাইজ আমি প্রতিদিন চাই।অনেক সুন্দর লাগছে বউ তোমাকে।’
প্রাহি অর্থকে হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো।বললো,
‘ প্রসংসার জন্যে ধন্যবাদ।আর হ্যা আজ এসেছি বলে যে প্রতিদিন আসতে পারবো এটা ভাববেন না।আপনি হলেন আস্তো একটা অসভ্য।নাহলে এমন অফিসের ভীতরে কেউ এসব করে?’
অর্থ প্রাহিকে পিছন হতে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘ আমি করি।কি করবো বলো?আমার বউটা এতো সুন্দর যে আমার কন্ট্রোল হয়না তাকে আদর করতে যেতে।’
প্রাহি সরে আসলো।মুখ বাকিয়ে বলে,

‘ হয়েছে আপনার কথা।এইবার আসুন খেয়ে নিবেন।খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে তো।’
অর্থ হেসে গিয়ে বসলো চেয়ারে। খাবার হাতে নিয়েই প্রাহির দিকে তাকালো।প্রাহি তখন অর্থ’র পাশে চেয়ার টেনে বসিয়েছে।অর্থ এইভাবে তাকালে প্রাহি বলে,
‘ কি হয়েছে?’
অর্থ’র গম্ভীর কন্ঠ,
‘ তুমি খেয়েছো?’
প্রাহি ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো।অর্থ হালকা রাগি গলায় বলে,
‘ কতোবার বলবো প্রাহি। আমার জন্যে অপেক্ষা করবে না।আমি তাই তোমাকে সবসময় জানিয়ে দেই না আসতে পারলে।তাও তুমি এমন করো।টাইম মতো মেডিসিন না নিলে পরে যদি সমস্যা হয় মেয়ে।তোমাকে আমি দুদিন ঘরবন্দি করে রাখবো।’
প্রাহি অসহায় চোখে তাকালো।সে জানতো এই বকাটা ওর খেতেই হবে।তাই আর কিছু বললো না।অর্থ আবার বলে,

‘ মেডিসিন এনেছো?’
‘ হ্যা গুড।নাহলে আরো বকা খেতে।অবশ্য আজ তোমাকে বকা দিতে ইচ্ছে করছে না।আদর করতে ইচ্ছে করছে শুধু।অনেক সুন্দর লাগছে।আমি তো চোখই সরাতে পারছি না।’
‘ হয়েছে আর বলতে হবে না।বকা দিয়ে এখন আবার মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে।’
‘তো কি হয়েছে?আমি বকা দিবো আবার আমিই আদর করবো।তুমি চাইলে এখনি করতে পারি।আমার কোন প্রোবলেম নেই।’
প্রাহি ভয় পেয়ে গেলো।এই লোক দিয়ে বিশ্বাস নেই।দ্রুত বলে,

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ৩৩

‘ নাহ নাহ! দরকার নেই।আপনি খাবার খান প্লিজ।আর কথা বলিয়েন নাহ!’
অর্থ বাকা হাসলো।বুঝলো প্রাহি লজ্জা পাচ্ছে।তাই কথা না বাড়িয়ে খাবার মাখিয়ে প্রাহির মুখের সামনে ধরলো।প্রাহি মুচঁকি হেসে তা খেয়ে নিলো।অর্থও খাচ্ছে সাথে প্রাহিকেও খাইয়ে দিচ্ছে।এইটাই তো ভালোবাসা।স্বামি স্ত্রীর অটুট বন্ধন।ভালোবাসা বেচে থাকুক চিরকাল।

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ৩৫