একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ৩৫

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ৩৫
সাদিয়া জাহান উম্মি

নদীর স্রোতের ন্যায় সময় গড়ায়।সময় চলে আপন গতিতে। কারো জন্যে সময় থেমে থাকে না।দেখতে দেখতে কেটে গেছে চার চারটি মাস।বেশ ভালোই চলছে অর্থ,প্রাহি আর হেমন্ত, ইশির দাম্পত্য জীবন।আরাফ আর হিয়া জমিয়ে প্রেম করছে।কারন ওদের প্রেমের মাঝে কোন বাধা নেই।আরাফ নিজের মনের কথা অর্থ’র কাছে প্রকাশ করেছে।যেহেতু আরাফ এখন সাবলম্বি।আর আরাফ খুব ভালো একটা ছেলে।তাই অর্থ আর একপায়ে রাজি।আর রাজি হবেই বা না কেন?যেখানে হিয়াও আরাফকে ভালোবাসে।সেখানে দুটো ভালোবাসার মানুষের কাছে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর কোন মানেই আসে না।

আর অর্থ খুব ভালোভাবে জানে ভালোবাসার মর্মতা।সেখানে অন্য কারো ভালোবাসার মাঝে ও কিভাবে বাধা সৃষ্টি করবে?অর্থ যেহেতু রাজি তাই পরিবারের কারো কোন দ্বিমত নেই।সবাই বেশ খুশি আরাফ আর হিয়ার জন্যে।এই চারমাসে হেমন্ত,ইশি আর প্রাহির অনার্স ফাইনাল ইয়ার এক্সামও শেষ।বেশ ভালো রেজাল্ট করেছে ওরা।আপাততো কয়েকদিনের জন্যে রেস্টে আছে সবাই।তারপর আবার মাস্টার্সে ভর্তির জন্যে এপ্লাই করবে।তবে এর মাঝে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটেছে বেশ ওদের পরিবারের সাথে।অর্থ’র গাড়ির ব্রেক ফেল করে দিয়েছিলো কেউ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ভাজ্ঞিস গাড়ি চেক করার সময়েই তা দেখে নিয়েছিলো।বেশ আশ্চর্য হয়েছিলো অর্থ কারন গাড়িটা কিনেছে বেশিদিন হয়নি।সেখানে ব্রেকফেল হওয়ার তো কোন কথা নেই।আবার একদিন প্রাহিকে রাস্তায় একটা ট্রাক ধাক্কা দিতে দিতে বেঁচে গিয়েছে প্রাহি।তবে অর্থ সময় মতো পৌঁছে প্রাহিকে সরিয়ে ফেলেছিলো।তা নাহলে তো সর্বনাষ হয়েই যেতো।হিয়াকে কয়েকজন বখাটে ছেলেরা একা পেয়ে ওর সাথে অসভ্যতামো করতে চেয়েছিলো।হিয়া ক্যারাটে জানতো তাই বেশ অনেকক্ষন আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলো।আর সময় মতো আরাফ আর অর্থ চলে এসেছিলো।কারন হিয়ার ক্লাসমেট হিয়াকে কয়েকজন ছেলে এইভাবে টানাহেঁচড়া করতে দেখেই ও সাথে সাথে অর্থকে কল করে সব জানিয়ে দিয়েছিলো।হেমন্ত’র বাইক এক্সিডেন্ট হয়েছিলো।বেশি একটা ক্ষতি হয়নি।তবে হাত পা ছিলে গিয়েছিলো অনেক।এতো এতো ঘটনা বেশ ভাবিয়ে তুলেছিলো শিকদার বাড়ির প্রতিটি সদস্যদের।তাই অর্থ,আরাফ আর হেমন্ত।বেশ গোপনে ওদের পুরো পরিবারের জন্যে সিকিউরিটি বাড়িয়ে দিয়েছিলো দ্বিগুন।পুলিশদেরও ইনফোর্ম করা হয়েছে।এতো এতো ভয়াবহ ঘটনার মাঝেও বেশ আছে ওরা সবাই।

রুমে বসে টিভি দেখছিলো প্রাহি।ইদানিং অনেক একঘেয়ামি লাগে ওর।সারাদিন বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে আর ভালো লাগে না প্রাহির।কোথাও ঘুরতে যাবে। তারও কোন উপায় নেই।অর্থকে কোন মুখে ও কিছু বলবে?লোকটা সারাটাদিন যেই খাটাখাটুনি করে।রাত্রে ক্লান্ত দেহটা কোনরকম টেনেটুনে এনে বিছানায় শরীর ছেড়ে দেয়।প্রাহি জুতোমুজো খুলে দৌড়ে একগ্লাস ঠান্ডা লেবু পানি বানিয়ে এনে দিলেই যেন একটু শক্তি পায়। তারপর আস্তে ধীরে ফ্রেস হয়ে আসে।প্রাহির খাবার খাইয়ে দিতে হয়।প্রাহির বেশ লাগে অর্থকে খাইয়ে দিতে।

তবে এতো এতো ব্যস্ততার মাঝেও লোকটা ওর যত্ন নিতে একদম ভুলে না।প্রাহি আর সাহস পায়না অর্থকে কিছু বলার।নতুন বিজনেসটা বেশ ভালোই চলছে।নতুন নতুন কোম্পানিদের ডিল সাইন করছে অর্থ’রা।তাই কাজের চাপ অনেক বেশি।প্রাহি মন খারাপ করে টিভির চ্যানেল বদলাতে থাকে।হঠাৎ একটা নিউজের চ্যানেলে নজর আটকে যায় ওর।যেখানে স্পষ্ট নিউজ রিপোর্টটি বলছে ভারতের মুম্বাই শহরের হোটেল রুমে লাশ পাওয়া গিয়েছে এক যুবকের।গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে।পুলিশ কোন প্রমান পায়নি খুনির। তবে খুন হওয়া ব্যাক্তিটির সকল কিছু তদন্ত করে জানা গিয়েছে লোকটি বাংলাদেশি।আর তা আর কেউ না জয়।

জয়ের ছবি দেখাতেই হাত পা অসাড় হয়ে আসে প্রাহির।থরথর করে কাঁপছে প্রাহির পুরো শরীর।কি বিভৎস দৃশ্য।প্রাহি সহ্য করতে পারলো না।গা গুলিয়ে আসলো ওর।দ্রুত ওয়াশরুমে ছুটলো প্রাহি।কিছুক্ষন বাদ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ধপ করে বেডে বসে পরলো প্রাহি।এটা কিভাবে হলো?কে করলো এই কাজটা?জয়কে কে খুন করবে?কার হাত এর পিছনে?আচ্ছা,জয়কে যে খুন করেছে সে কি কোনভাবে ওর বাবা’র মৃত্যুর জন্যে আর ওর মায়ের এই অবস্থার জন্যে দায়ী নয়তো?নাহ ভাবতে পারছে না প্রাহি আর কিছু।চোখজোড়া ঝাপ্সা হয়ে আসছে।প্রাহি এলোমেলোভাবে বিছানায় সুয়ে সেইভাবেই চোখ বুজে পরে রইলো।একসময় ঘুমিয়েও গেলো।

রাত নয়টা অর্থ আর আরাফ আজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে এসেছে।অর্থ আর হেমন্ত এসে সোফায় এসে সোফায় বসলো।ইশি দুগ্লাস ঠান্ডা পানি এনে ওদের দুজনকে দিলো।অর্থ পানিটুকু খেয়ে ইশিকে জিজ্ঞেস করলো,
‘ প্রাহি কোথায় হিয়া?দেখছি না যে?এই টাইমে তো ও এখানেই থাকে?’
ইশি গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলে,
‘ ঘুমোচ্ছে প্রাহি।আমি একটু আগে গিয়ে দেখলাম।’
অর্থ’র ভ্রু-কুচকে এলো।চিন্তিত কন্ঠে বলে,
‘ ও তো এমন সময় ঘুমায় না।আমার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করে।’
হেমন্ত উঠে দাঁড়ায়।ভাইকে বলে,

‘ ভাই তুমি গিয়ে দেখো হয়তো শরীর ভালো নেই।যাও দ্রুত।’
অর্থ হ্যা বলে উপরে চলে গেলো।অর্থ যেতেই হেমন্ত ইশির হাত টেনে ধরলো।ইশি ঘাবড়ে গিয়ে আশেপাশে তাকালো।বললো,
‘ কি করছো?তুমি যাও আমি আসছি তো।’
‘ উহু! তুমি আমার সাথেই চলো।’ হেমন্ত ইশিকে টেনে নিজের সাথে করে নিয়ে গেলো।
ইশি আর হেমন্ত এখন একে-অপরকে তুমি করে বলে।তাও অনেক চেষ্টার পরে অবশেষে দুজন সফল হয়েছে।প্রথম প্রথম কয়েকদিন তো তুমি ডাকলেই দুজন হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেতো।আস্তে আস্তে এখন সব ঠিক হয়েছে।

কক্ষের দরজা খুলে ভীতরে প্রবেশ করলো অর্থ।বিছানায় এলোমেলো অবস্থায় ঘুমন্ত প্রাহিকে দেখে মুঁচকি হাসলো।প্রাহির কাছে গিয়ে বসলো।অনেকক্ষন নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকলো প্রাহির মুখের দিকে।কি মায়া এই মেয়েটার মুখে?দুনিয়ার সব মায়া যেন উপরওয়ালা এই মেয়েটার মাঝেই ঢেলে দিয়েছে। অর্থ চেয়েও চোখ সরাতে পারে না।অর্থ প্রাহির মুখের উপর এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলগুলো আলতো করে গুছিয়ে দিলো।তারপর ঝুকে গিয়ে প্রাহির কপালে ভালোবাসার স্পর্শ দিলো।কেঁপে উঠলো প্রাহি।নড়েচড়ে খানিকক্ষন তারপর পিটপিট করে চোখজোড়া মেলে তাকালো।সম্মুখে অর্থকে দেখে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো।কি প্রানবন্ত সেই হাসি।অর্থ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো।প্রাহি উঠে বসলো।এগিয়ে গিয়ে অর্থ’র প্রসস্থ বুকটায় লেপ্টে রইলো।অর্থ’ও আগলে নিলো নিজের স্ত্রীকে।প্রাহি ঘুমজড়ানো গলায় বলে,

‘ কখন এসেছেন?আর আজ এতো তাড়াতাড়ি? ‘
অর্থ প্রাহির চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
‘ আজ থেকে তাড়াতাড়িই আসবো। কাজের প্রেসার অনেকটা কমেছে!’
প্রাহি খুব খুশি হলো কথাটা শুনে।ঘুম যেন উধাও হলো চোখ থেকে।ডাগর ডাগর আঁখি জোড়া মেলে তাকালো অর্থ’র দিকে।উচ্ছাসিত কন্ঠে বললো,
‘ সত্যি?’
‘ হ্যা!’
‘ তাহলে আমার একটা কথা রাখবেন?’
‘ কি কথা?’

‘ আমাকে একদিন সময় করে লংড্রাইভে নিয়ে যাবেন?আমি আপনার সাথে এই রাতের শহরে একা একা ঘুরতে চাই।’ বলেই হাসলো প্রাহি।অর্থ প্রাহির হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।কিভাবে বলবে মেয়েটাকে যে ওদের ফ্যামেলির উপর অনেক বড় বিপদ দাঁড়িয়ে আছে।সেটা না শেষ করতে ওদেরকে নিয়ে এইভাবে একা চলাফেরা করা খুব রিস্কি একটা ব্যাপার।অর্থ’র এইসব বলে আর প্রাহির মন খারাপ করতে ইচ্ছে হলো না।তাই সম্মতি জানালো প্রাহির কথায়।যেদিন যাবে সেদিন নাহয় প্রাহির অগোচরে সিকিউরিটি নিয়েই বের হবে ওরা।প্রাহি অর্থ’র সম্মতি পেয়ে খুশি হয়ে অর্থকে আবার জড়িয়ে ধরলো।অর্থ হেসে দিলো।বললো,

‘ তা ম্যাডাম আজ সারাদিন কি কি করলেন?’
মুহূর্তেই প্রাহির একটু আগের ঘটনা মনে পরে গেলো।অর্থকে দেখে ও তো সব ভুলেই গিয়েছিলো।মুহূর্তেই প্রাহি ভয় পেয়ে একদম সিটিয়ে গেলো অর্থ’র সাথে।হালকা কাঁপছে প্রাহির শরীর।অর্থ প্রাহিকে এমন করতে দেখে অস্থির কন্ঠে বলে,
‘ কি হয়েছে প্রাহি?এমন করছো কেন?কাঁপছো কেন তুমি?’

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ৩৪

প্রাহি বড় বড় শ্বাস নিলো।অর্থকে জানাতে হবে সবটা।প্রাহি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
‘ জয়…… জয় ভাইয়া খুন হয়েছে অর্থ।কে যে..যেন ওর গ..গলায় ছুড়ি চা..চালিয়ে দিয়েছে। আমি সন্ধ্যার দিকে নি..নিউজে দেখেছি অর্থ।ভীষন ভয়ানক দৃশ্য অর্থ।’

একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব ৩৬