এক চিলতে রোদ সিজন ২ পর্ব ২৬+২৭+২৮+২৯+৩০

এক চিলতে রোদ সিজন ২ পর্ব ২৬+২৭+২৮+২৯+৩০
Writer Nondini Nila

মাঝরাতে একটা ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল আমার। ইহানের সাথে সময় কাটানোর চাও পর যতটা মন ভালো ছিল তার থেকে দ্বিগুন খারাপ হয়ে গেল স্বপ্ন দেখার পরে। সারা শরীর আমার ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। কপালে ঘাম হাত দিয়ে মুছতে মুছতে চিৎকার করে উঠে বসেছি বিছানার উপর। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আমি। ভয়ে আমার হাত পা অনবরত কাঁপছে।‌ এসির মধ্যে আমি এতোটা ঘেমে গেছি। লাইট জ্বালিয়ে দেখলাম তিনটা বাজে।

এমন একটা বাজে স্বপ্ন কেন দেখলাম! বাবা তো আজ বাসায় নাই। আগেও কত সময় বাবা বাসার বাইরে থেকেছে ক‌ই কখনো তো এমন খারাপ স্বপ্ন দেখি নাই। আজ তাহলে কেন? তাহলে কি বাবার কোন বিপদ হলো? আমি ভয়ে ছুটে এলাম আম্মুর রুমে। আমাকে এমন হাঁপাতে দেখে আম্মু ঘুম থেকে উঠে বসলো ধরফরিয়ে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে? আমি কথা বলতে পারছিনা আমাকে জাপ্টে ধরে স্বপ্নের কথা বললাম। আম্মু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস। এ সব স্বপ্ন সত্যি হয় নাকি। ভয় পাসনা শয়তান আমাদের এমন বাজে স্বপ্ন দেখিয়ে বিভ্রান্ত করে। স্বপ্ন কখনো সত্যি হয় না। কি অবস্থা করেছিস সামান্য স্বপ্ন দেখে এতটা হাইফাই হয়।’
আমি বললাম, ‘আমার খুব ভয় করছে তুমি আব্বুকে একটা কল করো না প্লিজ! সুস্থ আছে কিনা জিজ্ঞেস করো! না হলে আমি ঘুমাতে পারবো না।’
আমার ভীতু মুখ দেখে আম্মুর ও চিন্তা হচ্ছে কিন্তু আমার কাছে প্রকাশ করছে না। আমার জন্য কল করলো কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। তাই বললো,
‘তোর আব্বু ঘুমাচ্ছে। মাঝ রাতে কে জেগে বসে আছে বলতো। এখন ফোন ধরবে না সকাল কথা বলে নিছ এখন ঘুমা।’

আমি মানলাম না আরো কয়েকবার কল করলাম পঞ্চম বার আব্বু ঘুমধুম কন্ঠে রিসিভ করে হ্যালো বলল। এবার আমি শান্তি পেলাম। কথা না বলেই ঠাস করে আম্মুর বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আব্বুর কন্ঠ শুনে আমি নিশ্চিন্ত হয়েছি আব্বু সুস্থ আছে এখন আমি শান্তি। আম্মু আব্বুর সাথে দুইএকটা কথা বলে রেখে দিলো।
পরদিন বিকাল বেলা আব্বু বাসায় আসে। আব্বুকে কাছে পেতে‌ই জাপ্টে ধরে বসে ছিলাম। স্বপ্নটা একদম বাস্তব এর মতো লেগেছে মনে হয়েছে আমি হারিয়ে ফেলেছি আব্বুকে। আব্বু আমার ছেলেমানুষি দেখে হাসাহাসি করলো। কিন্তু আমার কোন হেলদোল হলো না। আমি সত্যি ভয় পেয়েছি
আমাকে ছুয়ে তার বুকে মাথা রেখে আমার ভয়টা কেটেছে।

আজ শুক্রবার আব্বু বাসায় আছেন। দুপুরবেলা ডিনার করতে ডাইনিং টেবিলে বসে আছি সবাই। আববু আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবে সেই নিয়ে কথা হচ্ছে। তখন কলিং বেল বেজে উঠল। এই সময় আবার কে আসলো তিনজনে দরজার দিকে তাকিয়ে আছি। আমি উঠতে যাবো। আমার আগে আম্মু চলে গেল দরজা খুলতে। আমি আব্বুর সাথে ঘুরতে যাওয়া নিয়ে পরিকল্পনা করছে কোথায় যাব। আব্বু দুইদিন ছুটি নেবে আমাকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার জন্য। কথা বলতে বলতে তাকিয়ে দেখি ইহান। হাসি মুখে আম্মুর সাথে কথা বলতে বলতে আসছে। আমার কথা থেমে গেলো। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। এই সময়ই ইহান এখানে কি করছে? আমি বড় বড় চোখ করে ইহানের দিকে তাকিয়ে আছি। ইহান আমার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে আব্বুর দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো। দাঁড়িয়ে থেকে এক দৃষ্টিতে আব্বুর দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ও মা অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবছি পাগলের মতো দাঁড়িয়ে পরলো কেন?
আচমকা আমার আব্বুকে চাচচু বলে চিৎকার করে জাপ্টে ধরলো ইহান। আমি ও মা হা করে তাকিয়ে আছি। আব্বু নিজেও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পরেছে চেয়ার থেকে‌।

দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে তারা পূর্ব পরিচিত। খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তাদের মধ্যে। আব্বুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চোখ ছল ছল করছে। ইহান আব্বুকে ছেড়ে বললো,
‘ চাচ্চু তুমি? কতোদিন পর তোমাকে দেখলাম। কিন্তু আমার তোমাকে চিনতে একটু ও কষ্ট হয় নি। তোমাকে কতো মিস করেছি জানো। হুট করেই কোথায় হারিয়ে গেছিলে তুমি? সবাইকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে আমার সাথে রাগারাগী করতো তাই আস্তে আস্তে আর তোমাকে খুঁজতাম না। আর আজ হঠাত করে তোমাকে খুঁজে পেলাম!’
বাবা বললো, ‘ কেমন আছিস তোরা?’
‘বাকি সবার কথা জানিনা কিন্তু আমি তো ভালো নেই! তুমি কেন আমাদের ফেলে চলে এসেছো। কেন আর বাড়ি ফিরে যাও নি। দাদু কত কান্না করা তোমার কথা ভেবে। আর তখন আব্বু বকা দেয়। আব্বু এমন কেন করে?’

‘ আমি যে তার কথা শুনি নি তাই।’
‘কি কথা শোনোনি তুমি?’
‘মা কেমন আছে রে?’কথা ঘুরিয়ে বলল।
‘ দাদু বেশি ভালো না। বয়সের সাথে নানান রোগ বাসা বেধেছে বিছানা থেকেই তো উঠতে পারে না।কয়েদিন সুস্থ তো কয়েকদিন বিছানায় পরে থাকে।’
‘ আর ভাইয়া ভাবি কেমন আছে?’
‘ ভালোই। ‘
‘ তুই এখানে কি করে?’
একথা জিজ্ঞেস করতেই ইহান মাথা ঘুরিয়ে আমারও মার দিকে তাকালো। আমি আর মা একসাথে দাঁড়িয়ে তাদের কোথায় গিলছিলাম। ইহান আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘আমার মাথায় কিছু ঢুকছে চাচ্চু তুমি এখানে! আন্টি আর ঊষার সাথে কি করছো?’
ইহানের কথা শুনতেই আব্বু বলে উঠলো, ‘ তোর চাচি। আর ঊষার আমার একমাত্র মেয়ে। তোর বোন।’
‘ হোয়াট? হাল্কা চেঁচিয়ে উঠলো। তারপর ঊষার দিকে তাকিয়ে বলল,‌ বোন!! ইমপসিবল।’
আমি বোকার মতো সব কথা শুনলাম। আর এতোক্ষণে আমার মাথায় সব ঢুকলো। ইহান আমার বড় চাচার ছেলে। আমার আব্বু রা তিন ভাই। ইহান বড় চাচার ছেলে। আমার দাদি আছেন। আর আমার মেজ চাচারা নাকি বিদেশ থাকেন। আমার আমার আব্বু তিনি বাসা থেকে দূরে আছেন। কারণ তিনি তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে আমার আম্মুকে বিয়ে করেছেন। এটা কেউ মানতে পারেনি। এজন্য বাবা বাসা ছেড়ে বের হয়ে এসেছিল আম্মুর হাত ধরে। তারপর থেকে তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে।

ইহানকে নিয়ে আমরা খেতে বসলাম। আমি খাচ্ছি কম দুজনের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছি বেশি। ইহান ও আব্বু দুজনে উজ্জ্বল মুখে গল্প করে যাচ্ছে।
খাওয়া শেষে আমি ফিসফিসিয়ে আম্মুকে বললাম,
‘ আম্মু তুমি ইহানকে চিনলে না কেন?’
‘ আমি কি করে চিনবো আমি কি ওকে আগে দেখেছি নাকি!
‘ আব্বুর সাথে বিয়ের পর কি একদিন ও আমার দাদুর বাসায় যাওনি তুমি?’
‘ একদিন গেছিলাম। সেদিন শুধু তোর বড় চাচা, চাচি আর তোর দাদিকে দেখেছি আর কাউকে দেখি নি তো।’
‘ ওহ্।’

ইহানের সাথে আমার আর কথা বলা হলো না। তিনি বিকেল ভর আব্বুর সাথে কাটালো। তারপর সন্ধ্যায় চলে গেলো। আব্বু থাকার জন্য অনুরোধ করছিলো। কিন্তু ইহান থাকে নি। বাসায় এসব জানাতে না করলো আব্বু। কিন্তু দাদুর সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করতে বলেছে ইহান কে।
ইহানের চলে যাওয়ার সময় আমি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিলাম।

আজ আমি আমার দাদুর বাড়িটা ও খোঁজে পেলাম। এতে আমার আনন্দ হ‌ওয়া উচিত নাকি তারা আমাদের নানু বাসার সবার মতো ঘৃণা করে ভেবে কষ্ট পাবো বুঝতে পারছি না। ইহান সম্পর্কে আমার ভাই। কিন্তু আমি তো তাকে ভাই ভাবি না আর ভাবতেও পারবো না। আচ্ছা আব্বুর সাথে তাদের ঝামেলা না হলে আমি ছোট থেকেই ইহান কে চিনতাম। একসাথে থাকতাম। একবাসায়। উফ কি ভালোটাই না হতো কিন্তু তা তো সম্ভব না। আচ্ছা নানুবাড়ির সবার সাথে যেমন আমাদের ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেছে সেই ভাবেই যদি দাদা বাড়ির সবার সাথেও হয়ে যেতো কত্তো ভালো হতো।

দাদু বাড়ির হদিস পাওয়ার পর থেকে সে বাড়িতে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছা পোষন করলাম নিজের মধ্যে। কিন্তু সেই বাসায় আমি যাবো কিভাবে। আব্বু তো কখনো যাবেনা। গালে হাত দিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে এইসব ভেবে যাচ্ছি। হুট করেই ইমা আপু্র কথা মাথায় এলো তিনি তো ইহানের বোন তারমানে আমার চাচতো বোন।‌ তার মাধ্যমে তো আমি যেতে পারি। যেই ভাবা সেই কাজ।আপুর সাথে আমার একটা ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়ে গিয়েছিল। তাই তার নাম্বারটা আমার কাছে আছে। আমি ছুটে এসে আপুকে কল করলাম। ইহান একটা ছেলে মানুষ তার মাধ্যমে তো আর তার বাসায় যেতে পারি না।

আধা ঘন্টার মত আপুর সাথে কথা বললাম।আপু তার বাসা যাওয়ার কথা অনেক বার বললো। আগে আমি মানা করলেও আজকে আমি এক কথায় রাজি হয়ে গেছি।
আমি আপুকে বললাম ঠিকানা দিয়ে দাও আমি চলে আসব একাই। আপু বলল না আমি তোমাকে গিয়ে নিয়ে আসব তোমার ঠিকানা আমাকে দাও। আমি জড়াজড়ি করে বললাম,
‘আমি একা আসতে পারবো তুমি চিন্তা করো না
তুমি শুধু আম্মুর সাথে একটু কথা বলো! না হলে আমাকে যেতে দেবে না।’

আপু আচ্ছা বলে আম্মুকে ফোন দিতে বলল। আমি ছুটে গিয়ে আম্মুর কাছে ফোন দিলাম। আম্মু কে কার সাথে কথা বলবো! এসব জিজ্ঞেস করে অস্থির করে ফেলছে। আমি উত্তর না দিয়ে তার কানে দিয়ে বললাম,, ‘ কথা বলো। ‘
আম্মু কথা বলতেছে। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছি। ফোন রেখে আমার দিকে‌ বাড়িয়ে বললো,
‘ আচ্ছা যা। কিন্তু তোর আব্বু যেন নি জানে তুই ওই বাসায় গিয়েছিস।’
‘কিচ্ছু জানবে না আম্মু কিন্তু তুমি কিভাবে বুঝলে ইমা ওই পরিবারের কেউ?’
‘বোকা মেয়ে! প্রথম দিন‌ই যে ইহানকে ইমার বোন বলেছিলি এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি!’
আমি ইশ বলে জিভ কামড়ে চলে এলাম আমি একদম মন ভোলা ধ্যাত।

দুইদিন পর ইমা আপু ফ্রী আছে শুনেই চলে এলাম সকাল সকাল। এখানে আসার পর আমার খাতির যত্নের অভাব হচ্ছে না। সবাই মিলে আমার খাতির যত্ন করছে। আমি সবাইকে মন ভরে দেখছি। বাসার সবাইকে দেখছি। এটা তো আমারই বাড়ি। আব্বুর সাথে যদি তাদের দ্বন্দ্ব না হতো তাহলে তো আমি এখানে বড় হতাম আমার ছেলেবেলা আমার শৈশব কৈশোর সব এইখানে কাটতো। আমাকে একাকিত্ব ভোগ করতে হতো না। তখনই ইমা আপুকে আমি ছোটবেলা থেকেই আপু বলতে পারতাম। ইশ কতো ভালো হতো। মন খারাপ হয়ে গেল। আমার যে দাদু তিনি পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে রাখে। তার সাথে আমার একবার কথা হয়েছে। তিনি রুমের বাইরে আসতে পারে না তার হাঁটু ব্যথা। ব্যথা কমলে লাঠি ভর করে একটু আকটু হাঁটেন। কিন্তু ইদানিং নাকি ব্যথা বেরেছে এজন্য তিনি নড়াচড়া করেন না। তাই তার কাছে গিয়ে আমি দেখা করে এসেছি গল্প করেছি।

কথায় কথায় তাকে আমি দাদু বলে ও ডেকেছি। তিনি আমাকে দাদু বলে ডাকার সম্মতি ও দিয়েছেন। দশটার দিকে এ বাসায় এসেছি তারপর দুপুরে লাঞ্চ করেছি। ইমা আপুর বোন ইলা অপুকেও এক ঝলক দেখেছিলাম তিনি খুব একটা কথা বলেনা অহংকারি টাইপের। তার মাকেও আমার তেমনই লাগে। কিন্তু আমার সাথে ভালো বিহেভ‌ই করেছে।
সবকিছু মন মত হলেও সবাইকে পেয়ে আনন্দিত হলেও এই সবকিছু মাঝে আমি ইহান কে মিস করেছি। আসার পর থেকে আমার দু’চোখ তাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে চারপাশে ঘুরেছি। কিন্তু তার দেখা পাইনি।

তিনি আদৌ বাসায় এসেছে কিনা। তার খবর আমি জানিনা। কথায় কথায় ইহানের রুমে এক নজর দেখে ছিলাম। কিন্তু সেই দিকে যাওয়ার সাহস হয়নি। আর ইমা আপুর রুমে আর ইহানের রুমের অনেকটা ব্যবধান। মাঝখানে দুইটা রুম পরে। তাই আমি শুধু তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে সে দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কিন্তু বিকেলে গল্পের সময় জানতে পেলাম ইহান নাকি কাল থেকে বাসায় নাই। ফ্রেন্ডের জন্মদিন ছিলো কাল সেখানে আছে। আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল ইস ইহান বাসায় থাকলে কত ভালো হতো। আমাকে দেখে চমকে যেত তা রিয়াকশন আমি দেখতে পারলাম না। আর কতদিন ধরে হামকে দেখে না তাকেও আমি দুচোখ ভরে দেখতে পারতাম। কিছুই হলো না মন খারাপ করে ইমা আপুকে বললাম,,

‘ এখন আমি চলে যাব আপু।’
‘এই না আজকে তুই থাকবি। আজ কোনো যাওয়া হচ্ছে না। কাল আমি তোকে তোর বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবো।’
‘কি বলছে সারা দিন তো থাকলাম। রাত থাকতে পারবো না আব্বু আম্মু খুব রাগ করবে।’
‘ কিছু হবে না আমি তাদের ম্যানেজ করে নেব তুই কোন চিন্তা করিস না নিশ্চিন্তে বসে থাক।’
‘আরেক দিন এসে থাকবো প্রমিজ। প্লিজ আজকে জোর করো না আজকে চলে যায়।’
আপু নাছোড়বান্দা আমাকে আজকে যেতে দেবেই না। তিনি ফোন করলো আম্মু কে আর মাও কি সুন্দর রাজি হয়ে গেলো। লাউড স্পিকার ছিল তাই আমি তাদের কথোপথন সব শুনতে পেলাম। এবার আর কি থাকতেই হলো। আমার মনটা ভালো নাই। ইহান আজ ও নিশ্চিত আসবে না বাসায় বন্ধুর বাসায় থেকে যাবে। এখানে থাকলে আরো তার কথা মনে পড়ে বেশি। কারণ রুম ভর্তি তাদের ফটোর অভাব নাই। কিন্তু আব্বুর একটা ফটোও এই বাসায় খুঁজে পেলাম না। এতটাই রাগ যে আব্বুর একটা ফটো ও রাখিনি।

ডিনারের পর ইমা আপুর রুমে শুয়ে পরলাম। আপু ল্যাপটপে কি যেন কি করছে আমি দুই একটা কথা বলি ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল সকালই উঠে পরলাম। রাতে অনেকবার জেগে ছিলাম অন্য জায়গায় আমার ঘুম ভালো হয় না কিন্তু চোখ বন্ধ করে পড়ে ছিলাম আমি। সকালের আলো ফুটতেই উঠে বাইরে চলে এলাম। সারা বাড়ি শুনশান নিস্তব্ধ। এত সকালে কি বোধ হয় ওঠেনা।নামাজ পড়ার জন্য আমার সকাল সকালে উঠতে হয় কিন্তু আবার আমি ঘুমায় যাই। কিন্তু আজকের ঘুমালাম না নিস্তব্ধ বাড়িতে আমি একাই এদিক ওদিক ঘুরঘুর লাগলাম। আমি এত আস্তে আস্তে পা ফেলে হাঁটছি কেউ আমাকে এখন দেখবে চোর‌ই ভাববে। ঘোরাঘুরি করতে করতে এখানে দরজার সামনে এসে দাড়ালাম। তিনি তো বাসায় নাই। তাই আমার রুমের ভেতরে ঢোকার ইচ্ছা জাগল। ইহানের রুমটা দেখার ইচ্ছা সংযত করতে পারলাম না। আশেপাশে আরেকবার তাকিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। এবার আমি ইহানের রুমটা দেখবো খুব ভালো করে।

আমার হার্ট বিট জোরে জোরে বিট করছে। বুকে হাত দিয়ে নিজেকে শান্ত করে পেছনে ঘুরলাম। বেডরুমের জানলা দরজার সবকিছু বন্ধ তাই বাইরের মৃদু আলো রুমে আসতে পারেনি। ডিম লাইটের আলোতে আমি কিছুই যেন দেখতে পেলাম। তাই বড় বড় পা ফেলে চলে গেলাম জানলার কাছে আর পর্দা সরিয়ে বাইরের আলো ভেতরে ঢোকার রাস্তা করে দিলাম। লাইট জ্বালালাম না এইবার রুমটা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। আর এই বাইরে মৃদু আলোতে বিছানায় দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম। চাদর মুড়ি দিয়ে কে যেন শুয়ে আছে বিছানায়।

ইহান তো বাসায় নেই তাহলে এখানে কে শুয়ে আছে! ভূওওওওত নয় তো। আমি চিৎকার করতে গিয়ে ও মুখে হাত চেপে ধরলাম। থরথর করে কাঁপছি আমি। রুম দেখার শখ নিমিষেই দূর হয়ে গেছে। আমি ভয়ার্ত চোখে বিছানার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার হাঁটু কাঁপছে। ঘনঘন পলক ফেলছি। আমি কাঁপা চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে আছি। কমপক্ষে দশ কদম যেতে হবে বের হতে চাইলে তা সম্ভব না। ভূত টা আমাকে দেখলেই ঘাড় মটকে দেবে। আমি শব্দ হীন পায়ে পা ফেলতে লাগলাম। মনে মনে দোয়া দরুদ পড়তেছি। কেন যে পাকনামো করে এই রুমে আসতে গিয়েছিলাম। আমি বিছানা ক্রস করতে যাব তখন চাদর গায়ে ভূত টা নরে উঠলো। আমি এটা দেখে ভয়ে আরো কাপাকাপি করতে লাগলাম। আর অসাবধানতা বিছানায় সাথে পায়ে বেজে

ধপাস করে বিছানায় পরে গেলাম। আল্লাহ বাঁচিয়ে দাও এবারে মতো। আমি আর জীবনে পাকনামো করবে না। বলেই কান্না করতেছি। বিছানার পরে আমি ধরেই নিয়েছে আমাকে এবার মেরেই ফেলবে এই ভূত টা‌। আমি ঠাস করূ বিছানায় পরতেই ভূতের ঘুম উবে গেল। তিনি চাদর ফেলে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। আমি চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে দোয়া-দরুদ পড়ছি। আর ভূতটা বিরক্তিকর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
‘হোয়াট ইজ দিস? হোয়াট আর ইউ ডুইং হেয়ার?’ ইহানের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেছে।
পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর কানে আসতেই আমার দোয়া পড়া বন্ধ হলো। আমি অবাক চোখ তাকালাম। তাকাতেই দেখলাম আমার সামনে উদাম গায়ে বসে আছে। ঘুমঘুম ভাব চোখে মুখে। আমাকে দেখে আশ্চর্য মাত্রায় পৌঁছেছে।
ইহানকে দেখেই আমার ছুটে গেছে আমি বেড থেকে উঠে বসলাম। আর বোকা গলায় বললাম,

‘ আপনি শুয়ে ছিলেন তার মানে? আর আমি কতো কিছু ভাবছিলাম। ইশ কি ভয়টায় না পেলাম। আগে যদি জানতাম এটা আপনি। তাহলে আমাকে শুধু শুধু এতো ভয় পেতে হতো না।’
ইহান চমকানো গলার স্বরে বললো, ‘ তততুমি আমার বাসায় আমার বেডরুমে কি করছো?’
‘ আগে আমার কথার উত্তর দিন। আপনি না কাল আপনার ফ্রেন্ড এর বাসায় ছিলেন। আপনার ফ্রেন্ডের জন্মদিন। বাসায় আসলেন কখন??’
‘ তুমি জানলে কি করে আমার ফ্রেন্ডের জন্মদিন??’
‘ যেভাবে এখানে এসেছি সেই ভাবেই জেনেছি। বলুন বাসায় কখন আসলেন?’
‘ রাতেই এসেছি। আর তুমি এই বাসায় কিভাবে এলে এতো সকালে সত্যি করে বলো?’ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইহান আমার দিকে।

‘ ইটস ম্যাজিক!’
আমার কথা শুনে ইহান চোখমুখ কঠিন করে ফেললো। আমার বাহু শক্ত করে ধরে টেনে বিছানা থেকে নামলো।
‘ফাইজলামি না করে সত্যি করে বলো তুমি এই ভোরে আমার রুমে আমার বাসায় কি করে এলে?’
‘আরে এমন করছেন কেন? এটাতো আমারও দাদু বাসা। আমিতো এখানে আসতে পারি তাইনা। চাচাজানের সাথে যদি আব্বুর ঝামেলা না হতো তাহলে কি আমি বাড়ির বাইরে থাকতাম? তখন কি আমাকে এভাবে বলতে পারতেন?’
‘উফফ, একদম নাটক করবেনা তুমি বাসায় আছ তাতে আমার কোন সমস্যা নাই। কিন্তু তুমি আমার রুমে কি করছ সেটা বলো। একটা ছেলের রুমে তুমি এভাবে ঢুকে পড়লে লজ্জা করে না তোমার??’

‘ লজ্জা করবে কেনো আমি কি জানতাম যে আপনি রুমে আছেন! আমিতো ভেবেছি আপনি বাসায় আসেনি না। ইমা আপু তো তাই বলল আপনি হয়তো আসবেন না। এর জন্যই তো আমি আসলাম না হলে কি আমি আসতাম নাকি!’
ঊষা নিচের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে আর লজ্জায় লাল-নীল হচ্ছে এটা দেখে ইহান ব্রু উঁচু করে জিজ্ঞেস করল,
‘কি হচ্ছে তুমি এমন লজ্জায় লাল হচ্ছ কেন? পাগল হয়ে গেলে নাকি! আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলো তুমি এবাসায় কবে এলে কার সাথে এলে?’

আমি মাথা তুলে বললাম, ‘আমার না লজ্জা করছে!’
ইহান আমার কথা শোনে ভ্রু জোড়া আরো কুঁচকে বললো, ‘ হোয়াট? বলতে বলতে নিজের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারল কারণটা। বিরক্তিকর একটা শ্বাস ফেলে বলল,
‘ ঢং,একটা নিষ্পাপ ছেলে নিজের রুমে ঘুমিয়ে আছে। আর তোমার মত ধানি লঙ্কা এসে তাকে অত্যাচার করে ঘুমের মধ্যে এসে বলছে কিনা সে আবার লজ্জা পায়!!’
‘ কি বললেন আপনি আমি ধানি লঙ্কা আর আপনি নিষ্পাপ ছেলে!’
‘ এই যাও তো তুমি যেভাবে আসার এসেছ আমার রুম থেকে বিদায় হও। সকাল সকালে এসে হাঙ্গামা শুরু করে দিছো। বের হও আমার রুম থেকে আমি ঘুমাবো।’

বলেই ঠাস করে ইহান বিছানায় শুয়ে পড়ল। আমি কটমট চোখে ইহানের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ইহান চোখ বন্ধ করে ছিল হুট করেই চোখ বন্ধ অবস্থায় বলে উঠলো,
‘ একটা ছেলের দিকে এমন করে তাকিয়ে থাকতে লজ্জা করে না। যাও বের হ‌ও আমার রুমে থেকে।’
এতো বড় অপমান? রুমে এসেছি বলে এইভাবে তারিয়ে দিলো। খাটাশ একটা। বিরবির করে বকতে বকতে বেরিয়ে এলাম ঠাস করে দরজা খুলে।
ইহান চোখ মেলে আমার যাওয়া দেখে ঘুমিয়ে পরলো।

সকালে খাবার টেবিলে বসে আছি। ইহান এমন ভাব করে বসে আছে যেন আমাকে চেনেই না‌ আমি ভেংচি কেটে খাবার খাচ্ছি। ইমা আপু হসপিটালে যাবে তাই তার সাথেই চলে এলাম বাসায়। ইহান আমাদের আগেই চলে গেছে খাবার খেয়ে তিনি বেরিয়ে গেছে কোথায় জানি। আসার আগে আমি দাদুর সাথে আরেকবার দেখা করে এলাম। তিনি আমার দিকে স্নেহের চোখে তাকিয়ে ছিলো।

আজ আব্বুর সাথে আমি আম্মু ঘুরতে যাচ্ছি। সারাদিন আজ ঘুরবো। রাতে ডিনার করে বাসায় আসবো। আম্মুকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। বেগুনি কালারের শাড়ির পরেছে। আব্বু আর আমি সোফায় বসে আম্মুর জন্য ওয়েট করছিলাম।
আম্মু আসতেই দেখলাম আব্বু এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমমু্ এলেই আমরা বেরিয়ে পরলাম। সারাদিন ঘোরাঘুরি করে আটটায় রেস্টুরেন্টে এসে বসলাম ডিনার করার জন্য সবাই ক্লান্ত এখন। আম্মু বলল খাবার প্যাক করে নেওয়ার জন্য। আমিও তাই বললাম। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিয়ে খাওয়া যাবে। এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। আব্বু তাই বললো আচ্ছা। খাবার আসা অব্দি বসে ওয়েট করেছি তখন ইহানকে দেখলাম আমি।‌
ফারিয়া আর ইহান পাশাপাশি বসে আছে। ফারিয়া কি কি জানি বলছে আর কাঁদছে। ইহান বিরক্তিকর চোখে তাকিয়ে আছে। সাথে ফারিয়াকে শান্ত করার চেষ্টা ও করছে। আমি হাঁ করে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ আম্মু ইহানকে দেখলো। আর দেখেই চিৎকার করে উঠলো,

আমি গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে আছি। ফারিয়ার সাথে ইহানকে দেখে আমার একটু ও ভালো লাগছে না।
ইহান আম্মুর কথা শুনেই চমকে আমাদের দিকে তাকালো। আর সাথে সাথে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে এগিয়ে এলো।
আম্মু আব্বুর সাথে কথা বলছে। আমি তাদের কথা গিলছি। আর আড়চোখে ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। ফারিয়া এবার কান্না থামিয়ে আমার দিকে কটমট চোখে করে তাকালো। তারপর উঠে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। ফারিয়ার পোশাক দেখে আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম। ছিঃ নির্লজ্জ বেহায়া মাইয়া। কি ছোট টপস পরছে। কালো টপস গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। হাতা কাটা গলা বড় অর্ধেক শরীর বেরিয়ে আছে। আমি চোখ সরিয়ে বিরবির করে বললাম,

‘ শরীর দেখিয়ে ইহানকে বশ করতে চায় বেহায়া কোথাকার!’
ইহান ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ ফারিয়া এটা আমার ছোট চাচা- চাচী। আর চাচ্চু এটা আমার ফ্রেন্ড ফারিয়া।’
চাচ্চু বলতেই ফারিয়া জোর পূর্বক হেসে হাই আন্টি আঙ্কেল বললো। আম্মু কেমন করে জানি তাকিয়ে আছে। আম্মুর যে ফারিয়া কে একটুও পছন্দ হয়নি বোঝায় যাচ্ছে। ফারিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ ও এখানে কি করছে??’ বলে ইহানকে প্রশ্ন করলো।
ইহান আমাকে কি বলে পরিচয় করায় তা দেখতে তাকিয়ে আছি। কিন্তু আমার আর জানা হলো না‌। তার আগেই আমার আম্মু বলে উঠলো,

‘ আমাদের একমাত্র মেয়ে ঊষা।’ বলেই আমার দিকে একবার তাকিয়ে হাসলো আম্মু।
ইহান কে আমাদের টেবিলে বসতে বললো। ইহান বসলো। আব্বুর সাথে‌ কথা বলছে। ফারিয়া ও অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসলো। আম্মু ফারিয়ার কাছে আমাকে নিয়ে কথা বলছে আমি মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছি। আব্বু খাবার এখানেই দিতে বলেছে ইহানের দেখে। তাই হলো। ডিনার রেস্টুরেন্টের করতে হলো। ফারিয়া আর ইহান চলে গেলো। আমি ভেবেছিলাম বাইক এনেছে ইহান কিন্তু না ইহান গাড়ি নিয়ে এসেছিলো। সেটা করে চলে‌ গেলো বিদায় নিয়ে আমরাও চলে এলাম।

আমি খালি ভাবছি ইহান আর ওই ফারিয়া একসাথে বসে করছিলো কি? কি কথা বলছিলো আর ও ফারিয়া কাঁদছিলো কেন? আমাকে তো দেখতেই পারে না দেখলেই রাগী চোখে তাকিয়ে থাকে। ওরা একসাথে একা ছিলো ভেবেই খারাপ লাগা এসে ঘিরে ধরলো আমাকে।
আমি এগারোটার দিকে ইহানকে কল করলাম। আমার ঘুম আসছে না বিছানায় এপাশ ওপাশ করে ফোন করেই বসলাম। কিন্তু রিসিভ হলো না। আবার করলাম। হলো না। রেগে আর করলাম না।

আরমোড় ভেঙে বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ না হয়েই বাইরে চলে এলাম। আসার অবশ্য কারণ আছে।কারণটা হলো বাইরে আমি হাসির শব্দ পাচ্ছি জোরে জোরে। এই ভোরে কে এসেছে বাসায় যার সাথে আম্মু আব্বু এমন হাসাহাসি করছে। আব্বু বাসায় আছে কিন্তু হাসিতে আমি একটা অপরিচিত হাসির শব্দ পাচ্ছি ঠিক চিনে উঠতে পারছিনা। এটা আম্মু-আব্বুর না মনে হচ্ছে তিনজনের হাসি। হাসির রহস্য উদঘাটন করতে আমি ‌ বিছানা থেকে নেমে ড্রয়িং রুমে চলে এলাম। ড্রইং রুমে আসতেই ইহানের হাসি মাখা মুখটা ভেসে উঠলো। তিনজনে বসে কি যেন কথা বলছে আর গলা ফাঁটিয়ে হাসছে। আমি কপালে সুক্ষ্য চিন্তার ভাঁজ ফেলে ভাবছি,কি কথা বলে এত হাসছে তারা! আর সকাল সকাল ইহান‌ই বা এখানে কি করছে?

কালকের রাতের কথা মনে পড়তেই রাগে আমার নাক লাল হয়ে গেল। দুই বার ফোন করেছিলাম রিসিভ করেনি। এত ভাব দেখাতে পারে। গা জ্বলে উঠে আমার।আমি কপালে আর মুখে এলোমেলো হয়ে আসা চুল গুলো সরাতে সরাতে রাগে ফুঁসছি।হঠাৎই ইহান হাসতে হাসতে আমার দিকে তাকাল আর সাথে সাথে ওর হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। আমি চোখমুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছি। কিন্তু ইহানের চাহনি একদম আলাদা। হা করে তাকিয়ে আছে।পলক ফেলছে না। আমি কটমট দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছি। কিন্তু ইহানের দৃষ্টি আমার কাছে নেশাময় লাগছে। অপলক তাকিয়ে আছে। আমি ইহানের এমন দৃষ্টি দেখে কিছুটা থতমত খেয়ে গেলাম। আমার চোখ রাঙ্গানি কি তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি এমন হা করে তাকিয়া আছে কেন?

আমি চিন্তা করতে করতে নিজে দিকে তাকালাম। আর দিলাম এক চিৎকার সাথে সাথে উল্টা ঘুরে ভৌ দৌড়। ওরনা বিহীন প্লাজো আর গেঞ্জি পরেই চলে গিয়েছিলাম ঘুমঘুম চোখে। ওই ভাবে দেখে নিয়েছি আমাকে ইহান তাই তো ওমন হা করে তাকিয়ে ছিলো। ছিঃ কি বেশরম ছেলে!! পেছনে থেকে আম্মুর ডাক শুনেছি কিন্তু আমি থামিনি।
ফ্রেশ হয়ে রুমেই বসে আছি আমার হাতে ফোন। স্ক্রিনে ভেসে উঠছে ইহানের নাম্বার। ইহান কল করছে আমি রিসিভ করছি না। করবো না। রুম থেকেও বের হবো না ভাবছি। ইহান না যাওয়া পর্যন্ত আমি রুমের বাইরে যাব না। কিন্তু আম্মুর ডাকে টিকতে পারলাম না। যেতেই হলো।

আব্বুর খাওয়া শেষ। আমার দেরি হলো কেন জিজ্ঞেস করেছে আমি কোন রকম কাটিয়েছি মিথ্যা বলে। তারপর আব্বু উঠে বেরিয়ে গেলো অফিসে। আমি ইহানের সামনের চেয়ার টেনে বসলাম। চুপচাপ খাচ্ছি। ইহান ফিসফিস করে কি যেন বলছে আমি পাত্তা দিচ্ছি না।
খেয়েই রুমে চলে এলাম। আমি আসার কিছুক্ষণ পর‌ই ইহান ও রুমে এলো আর দরজা আটকে ফেললো। আমি লাফ দিয়ে নেমে পরলাম বিছানায় থেকে।
‘ এ-একি আপনি আমার রুমে এসেছেন কেন? আর দরজা আটকালেন কেন??’
আমার কথার উত্তর দিলো না ইহান। সারা রুমে চোখ বুলাতে লাগলো। তারপর বিছানায় গিয়ে পা ঝুলিয়ে বসে পরলো আয়েশি ভঙ্গিতে তারপর বললো,

‘ বাচ্চাদের মতো রুম সাজিয়ে রেখেছো দেখছি। এ রুমে আসলে তো সবাই বাচ্চা খুজবো কিন্তু তোমাদের বাসায় কোন পিচ্ছি বাচ্চা নাই। আছে সেতো বড় বাচ্চা।’
একথা শুনতেই আমার মনে পরে গেলো আমিও ইহানের রুম দেখতে গেছিলাম আর ইহান কি ভাবটাই না নিয়েছিলো।
আমি বললাম, ‘ বের হোন বলছি আমার রুম থেকে। আপনি কোন সাহসে আমার রুমে এসেছেন? নিজের রুমে গেছিলাম বলে কতো অপমান করেছেন এখন আবার আমার রুমে এসে আমার বিছানায় বসে আছেন উঠুন আর বের হোন।’

আমার কথা কানে নিলো না ইহান। ঠাস করে বিছানায় শুয়ে পরলো।
‘ আরে আরে কি করছেন! বের হতে বলছি শুতে না। আমার বিছানায় শুচ্ছেন কেন? আমাকে অপমান করেছিলেন আপনার রুমে গিয়েছিলাম বলে এখন আমার রুমে আসতে লজ্জা করলো না আপনার।’
‘ না তো লজ্জা করবে কেন? আমি তো আর কারো ঘুমের সুযোগ নিয়ে আসে নি। আর তাছাড়া আমার এতো লজ্জা নাই। লজ্জা তো নারীর ভুষণ আমি নারী না।’
আমি তেরে বিছানায় কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। রাগ না আমার অভিমান হচ্ছে এখন।আমি অভিমানী গলাতেই বললাম, ‘ কি বললেন আমি সুযোগ নিয়েছি কি করেছি? আমি তো বলেছি আমি জানতাম না আপনি বাসায় আছেন জানলে কি যেতাম। আর তাছাড়া ও গিয়েছি বলে ওইভাবে অপমান করবেন কেন?’
ইহান কিছু বললো না। আমি আবার বললাম,

‘ কাল কল করলাম রিসিভ ও করলেন না এতো ভাব কেন আপনার। ভাবে মাটিতে পা পরে না যেন। কল করলে রিসিভ করেন না বাসায় আসলেও কথা বলতে চাইলে আমাকে এমনভাবে ইগনোর করেন যেন আমাকে চেনেন ই না। আর ভুল করেও যদি কখনো ফোন রিসিভ করেন যা তা বলে ফোন রেখে দেন। আপনি আমার সাথে এমন করেন কেন আপনি জানেন আপনি আমার সাথে এমন করলে কত কষ্ট লাগে আমার। সবকিছু অসহ্য লাগে। রাগ হয়। অভিমান হয়। কান্না পায়।

আবার সব ভুলে সেদিন আপনাদের বাসায় গিয়েছি বলে কেমন করলেন। ওটাতো আমার ও দাদু বাসা। আমি কি সেখানে যেতে পারব না। আজ যদি আব্বুর সাথে চাচাজানের সমস্যা না হত তাহলে কি আমি ও বাসার বাইরে থাকতাম। আপনার মত আমিও ওই বাসায় বড় হতাম। আগে না হয় আপনি আমার অপরিচিত ছিলেন। কিন্তু এখন তো তা না এখন তো আপনি আমার সম্পর্কে ভাই হোন।এটা জানার পর থেকে আমি আপনার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলার চেষ্টা করছি আর আপনি আমাকে সম্পূর্ণ ইগনোর করছেন। কেউ তার বোনের সাথে এরকম করে বোনের সাথে কেউ ভাব দেখায়? আগে তো এমন করতেন না। আর এখন আমি আপনার পরিবারের কেউ জানার পর থেকেই এমন ভাব দেখানো শুরু করছেন কেন ? বড় ভাই কি বোনের সাথে এরকম করে বলুন!’ অভিমানে আমার চোখ দুটো ভড়ে উঠেছে। পলক ফেললেই তা গাল বেয়ে পরবে।

ইহান ফট করেই উঠে দাঁড়ালো। আর সোজা আমার সামনে এসে দাড়ালো। আমি গাল মুছে ইহানের দিকে তাকাতেই কেঁপে উঠলাম। ভয়ে পিছিয়ে গেলাম। ইহান রক্ত লাল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ইহানের রাগের কারণটা বুঝতে পারছে না। আমি তো ভেবেছিলাম যে আমার কথা শুনে উনি ইমোশন হবেন আর আমার সাথে ভালো করে কথা বলবে। ক্ষমা চাইবে। কিন্তু এ তো দেখি উল্টা হলো উনি তো রেগে বোম হয়ে গেছে মনে হচ্ছে‌।
ইহান এগিয়ে আমার কাধ চেপে ধরলো শক্ত করে আর কঠিন গলায় বলল, ‘ কি বললে তুমি ভাই? বোন মাই ফুট! গাধা আরেকদিন ভাই বোনের ভালোবাসা দেখাতে ফোন বা কথা বলতে আসলে থাপ্পড়িয়ে গাল লাল করে ফেলবো ইডিয়েট। মাইন্ড ইট।’

বলেই গটগট করে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। আমার আম্মু সাথে পাশের বাসার রিতা আন্টি দেখা করতে আসায় তাকে নিয়ে আম্মু রুমে গিয়ে কি যেন করছিলো। ইহানকে সোফায় বসিয়ে। তখন ইহান সুযোগ পেয়েই আমার রুমে এসেছিলো। এখনো আম্মু রুমেই আছে। ইহান রাগে গজগজ করছে সোফায় বসে। আম্মু আসলেই চলে যাবে তাই উপরের দিকে তাকাচ্ছে। আমি তো থ মেরে কতোক্ষণ ওইখানেই স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এদিকে আম্মু তাড়াতাড়ি চলে এলো রিতা আন্টি কে নিয়ে। তখন আম্মু কে ইহান বায় বলে হতদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো।
আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সবটাই লক্ষ্য করলাম। আমার মাথায় হাত ইহান আমাকে ভাই বোনের ভালোবাসা দেখাতে মানা করলো কেন? আমাকে কি বোন ভাবা যায় না এতটাই অপছন্দ করেন উনি আমাকে।
নাকি???

তুলির সাথে সব শেয়ার করার পর জানতে পারলাম ইহান আমাকে হয়তো খুব ভালোবাসে এজন্য বোন বলায় রাগ করেছে নাহলে খুব অপছন্দ করে এজন্য কিছুই ভাবতে চায় না। আমি চিন্তায় পরে গেলাম। ইহান আমাকে কি সত্যি ভালোবাসে? আমার তো মনে হয় না। ভালো বাসলে এতোটা খারাপ বিহেভ করতে পারতো বলে মনে হয়না।
আমি আর তাকে নিয়ে ভাববো না বলে ভাবলাম। কিন্তু আমার ভাবনাকে সত্যি হতে দেবে না বোধহয় প্রকৃতি। ইহানের ওপর দুর্বলতা নিজের মধ্যে পেয়েছিলাম।

সেটা আমি কাটিয়ে নিতে চেয়েছিলাম দূরে থেকে কিন্তু এখন তো দেখছি একদম সারাদিন আমার তার সাথেই থাকতে হবে এমন বন্দোবস্ত হয়ে গেলো। চোখের সামনে তিনি ঘুরঘুর করবেন।কিন্তু নিজের দাদা বাড়ি আপন মানুষদের সাথে মেশার, থাকার লোভটা তো আমি সামলাতে পারলাম না এজন্যই তো ইমা আপুর বিয়ের খবর শুনেই আমি যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেলাম। আব্বু আম্মুকে ও দাওয়াত করেছে ইমা আপু এসে। কিন্তু অদ্ভুত হলো ইমা আপু আব্বুকে চাচচু বলে নি। অপরিচিতদের মতো কথা বলেছে সৌজন্য নিয়ে। পরে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়েছে আপু যখন আব্বু আম্মুকে রাজি করালো তারপর যখন আমাকে ফিসফিস করে বলল,

‘ঊষা আমি কিন্তু জেনে গেছি তুই আমার চাচাতো বোন। আমার ছোট্ট মিষ্টি বোন। কিন্তু আমি
তাদের এখনই সবটা জানাতে চায় না যে আমি তাদের ভাইয়ের মেয়ে। জানলে তারা বিয়েতে কখনো যাবেনা। আর তারা না গেলে কখনই তারা মুখোমুখি হবেনা। আর তাদের মুখোমুখি হওয়া টা খুব দরকার।’
বিয়েটা যেহেতু কমিউনিটি সেন্টারে হবে এ জন্য একদিন আগে ইমা আপু দের সাথে আমার সেখানে যেতে হবে। আর আব্বু রাজি হয়েছে তারা শুধু বিয়ের দিন যাবে এর আগে যেতে পারবেন। ইমা আপু তাতে কোন আপত্তি করেনি।
১. মেহেন্দি, ২.গায়ে হলুদ, ৩. বিয়ে।

তিন দিনের অনুষ্ঠান। ইমা উডবি রিফাত ভাইয়া রা ও সেখানে উপস্থিত হবে খুব মজা হবে। ইমা আপুরা একদিন আগেই যাবে সেদিন আমাকে তাদের বাসায় যেতে হবে। সেখান থেকে কমিউনিটি সেন্টারে তাদের সাথে যাব। তার আগেরদিন একদিন আপু আমাকে নিতে এসেছিল বিয়ের শপিং করার জন্য। সেদিন ইহান ও ছিলো সেখানে আমার সাথে কথাও বলেছে স্বাভাবিক ভাবেই। সেদিনই রিফাত ভাইকে দেখেছি। আপু আমাকে জোর করে একটা ড্রেস কিনে দিয়েছে আমি অবশ্য নিতে চাইনি
কিন্তু এমন ভাবে জোর করলো না নিয়ে ও পারলাম না। ড্রেসটা আমি বাসায় আনিনি বিয়েতে যেতে হবে তখন যেন নিয়ে যায় সেটা বলে দিয়েছি।

আজ‌ই সেই দিন আমি ইমা আপুদের বাসায় চলে এলাম। বাসা ভর্তি লোকজন। সবাই কমিউনিটি সেন্টারে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। আমি ভেতরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি কাউকে চিনি না সবাই অপরিচিত। এ বাসায় আমি ইমা আপু, ইলা আপু, ইহান, চাচি জাদু আর চাচাকে ছাড়া কাউকে চিনি না। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হাঁটছি তখন কারো সাথে জোরে ধাক্কা খেলাম। আর ধাক্কা খেয়ে দুজনেই পরে গেলাম আমি অসাবধানতায় তার উপর পরলাম। আমি মানুষটার হাঁটুতে বসে পরেছি। তাকিয়ে দেখলাম একটা ফর্সা মেয়ে। বিদেশিদের মতো ফর্সা আমি আঁতকে ওঠে দাঁড়িয়ে পরলাম। আর মেয়েটা ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিয়েছে। আমি অসহায় মুখ কথূ তাকিয়ে সরি বলছি। মেয়েটা ভালোই ব্যাথা পেয়েছে কারণ তার কোলে বসে পরেছিলাম আমি। আমি ঢোক গিলে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখছি কেউ আমাকে লক্ষ্য করেছে কিনা আমি উল্টা ঘুরে দৌড় দিলাম।মেয়েটা আমাকে দেখে নি কারন সে হাঁটু ধরে কাঁদছে।

আমি দৌড়ে ইহানে সামনে এসে পরলাম ইহান কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ হোয়াট হ্যাপেন্ড? হুয়ে আর ইউ রানিং লাইক দ্যাট?’
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। আমতা আমতা করে বললাম,
‘ ক‌ই কিছু না তো এমনি। সবাই আমাকে রেখে চলে গেল কিনা ভেবে দৌড়াচ্ছি।’
ইহান কতোটুকু বিশ্বাহ করলো জানি না বললো, ‘ মনে হল চুরি করে ধরা খাওয়ার ভয়ে দৌড়াচ্ছ!’

আমি কিছু বলতে যাব। পেছন থেকে চেঁচামেচি আসতেই ইহান আমাকে রেখে এগিয়ে গেলো আমিও গেলাম সেই মেয়েটাকে নিয়ে সবাই আদিখ্যেতা করছে। আর মেয়েটা ফর্সা মুখ লাল করে ফেলেছে কাঁদতে কাঁদতে।
ইহান ও মেয়েটার কাছে গিয়ে চোখের জল মুছে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, ‘ কি হয়েছে মিষ্টি? কাঁদছিস কেন?’
ইহানের এত কেয়ার করা দেখে আমার রাগে সারা শরীরে আগুন ধরে উঠলো মনে হয়। আমি জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছি। ইহানের এমন কেয়ার করা আমার মোটেও ভালো লাগছে না একটুও না।

দুইটা বাচ্চা ছেলে মেয়ে একটা চেয়ার নিয়ে ঝগড়া করছে। মেয়ে বাবুটা বসে ছিলো ছেলে বাবু টা মেয়ে বাবুটা কে থাপ্পর মেরে টেনে নিচে নামায়। এবার মেয়েটা কান্না করে দিয়ে খামচি দিল ছেলেবাবুকে তারপর তাকে ধরে টেনে নামায়। এবার দুজনেই টানাটানি করছে আর এক চেয়ারের দুজনের এক জন রাজত্ব করার জন্য ঝগড়া করছে। আমি বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম এবার দুজনেই ভালো গড়াগড়ি খাচ্ছে এগিয়ে যাব ভাবছিলাম তখনই তাদের মা এলো দুজনকে বকতে বকতে। মেয়েটা তার মা’র কাছে গিয়ে ছেলেটার নামে বিচার দিলো।

এবার ছেলেটার মা ও এলো দুজন দুজনের মায়ের কাছে গিয়ে বিচার দিতে লাগলো। দুজনের বিচার দেওয়া আর গাল ফুলিয়ে নিজেদের দিকে তাকাতে দেখে আমি হেসে দিলাম। কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে গেছি দশ মিনিট হলো। সবাই রুম ঠিক করে বিশ্রাম নিচ্ছে। আমি একাই একজন রুমে ঢুকে ফ্রেশ না হয়েই আবার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এইসব কীর্তিকলাপ দেখছিলাম।

‘একা একা দাড়িয়ে হাসছো কেন?’ পুরুষালী কন্ঠ কানে এসে বারি খেতে আমার সমস্ত ধ্যান-ধারণা ভেঙে গেলো। চমকে পাশ ফিরে তাকাতেই ইহানকে ভ্রু যুগল কুটি করে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে থেকে থমকালাম। আস্তে ধীরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আচমকা কানের কাছে কারো কথার আওয়াজ পেয়ে ভয় পেয়ে গেছিলাম।
‘হুয়াই আরন্ট ইউ টকিং অ্যাবাউট ইউর প্রবলেম?’

‘নো প্রবলেম! একা কোথায় আমি তো ওই বাচ্চা দুটোর কান্ড দেখে হাসছিলাম।’ বলেই হাত বাড়িয়ে সামনে দেখলাম। ইহান ভ্রু কুটি করে সামনে তাকালো।
সামনে কাউকে না দেখে বলল, ‘আর ইউ ম্যাড? কি সব বলছো! ক‌ই বাচ্চা?’
আমি চমকে সামনে তাকিয়ে দেখলাম ফাঁকা কেউ নাই। এরা কোথায় গেল। সিওর মাকে বিচার দিতে দিতে চলে গেছে।
‘এখানেই ছিল। খুব ঝগড়া করছিলো। চলে গেছে এখন।’
‘ তো তারা চলে গেছে তুমি এখনো এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছো কেন? সবাই ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে আর তুমি তার কোন কিছু করছ না। উল্টা বাচ্চা দের মতো দাঁড়িয়ে থেকে বাচ্চাদের কীর্তিকলাপ দেখছো? গাধা একটা। রুমে যাও আর ফ্রেশ হ‌ও গিয়ে।’

বলেই বড় বড় পা ফেলে সামনে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি নাকের পাটা ফুলিয়ে তাকিয়ে আছি‌। আমাকে গাধা বললো। গন্ডার কোথায় তুই গাধা তো ব‌উ গাধা। বিরবির করে বকতে বকতে রুমে চলে এলাম। রুমে আরেকজন আছে। ইহানের মামাতো বোন ফারজানা আপু। আমাকে তার সাথে থাকতেই দিয়েছে। তিনি বিছানায় শুয়ে হাট উঁচু করে পায়ের উপর পা তুলে ফোন টিপছে। আমাকে দেখেই মিষ্টি করে হেসে বললো,
‘ ঊষা তুমি কোথায় ছিলে তোমাকে ডাকলাম আমি যাও হাত মুখ ধুয়ে আসো।’

আমি বাথরুমে ঢুকে গোসল করতে গেলাম। ফারজানা আপুকে আমার প্রথম সাক্ষাতেই খুব ভাল পছন্দ হয়েছে। উনি ইহানের সেম ব্যাস। যাকে আমি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলাম সেই মেয়েটা হচ্ছে আমি আমার মেজ কাকার মেয়ে কলেজে পরে নাম জেরিন। সেই সেই ধাক্কা খেয়ে বাড়ি মাথায় তুলেছিলো আমি প্রথমে মেয়েটার উপর তীব্র রাগ প্রকাশ করলেও নিজেরই বড় বোন হয় জানার পরে রাগ মাটি হয়ে গেছিলো। ইহান তো বোন বলেই এতো কেয়ার করছিল আর আমি কিনা কি ভাবছিলাম।
নিজের বোকামী তিনি নিজেই অবাক।

বাইরে এসে দেখলাম ফারজানা আপু ঘুমিয়ে গেছে আমি তার পাশে শুয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো দুপুরে। বাইরে আসতেই ইমা আপু টেনে আমাকে খাবার রুমে নিয়ে গেলো। আপুর সাথে আমাকে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু ওই জেরিন তা হতে দেয়নি। জোর করে আপু সাথে থেকেছে আপু তিনজন মিলে থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু জেরিন আমাকে এলাও করলো না। আমিও আপুকে মানিয়ে ফারজানা আপুর সাথে তার রুমে চলে এলাম।
খাবার টেবিলে বসে আরেক ঝটকা খেলাম। আমার পাশের চেয়ারে জেরিন বসেছে। আমি বসতেই ফিসফিস করে কানের কাছে বললো,
‘ ইউ প্রসেড মি ইন দি মর্নিং। আই নো ইউ।’

জেরিনের কথা শুনে আমি বিহ্বল হয়ে তাকালাম ওর দিকে। জেরিন আমার দিকে বাঁকা হেসে তাকিয়ে আছে। আমি ঢোক গিলে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি কেউ শুনে ফেললে সর্বনাশ হবে। আমি ভেবেছিলাম মেয়েটা কিছুই দেখেনি এ তো দেখছি সব জানে। কিন্তু তখন মেয়েটা আমার কথা কাউকে বললে না কেন। সবাই জানলে খুব বকবে নিশ্চয়ই আমাকে। জেরিনকে নিয়ে সবাই কতটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল আমি দেখেছি। এখন আমার কি হবে। ধুর কি আবার হবে আমি ইচ্ছে করে পড়েছিলাম নাকি।

তখন ইহান এসে বসলো আমার ডান পাশের সিটে। আমি চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম। আশেপাশে আর একটা সিট ও খালি ছিলো না তাই বোধহয় এখানে বসেছে। কিন্তু ইহানের পাশে বসে খেতে হবে ভেবেই অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। ইহানকে দেখে জেরিন কথা থামিয়ে দিলো। আর কিছু বললো না। আমি অবশ্য প্রথম কথা ছাড়া আর কোন কথাও শুনিনি ও।
আমি আড়চোখে ইহানের দিকে তাকাতে তাকাতে খাবার না দেখেই মুখে পুরে নিলাম। প্লেটে যে আমার জাত শত্রু আছে তা দেখলাম ও না। ওইভাবেই চিংড়ি মাছের বড়া দিয়ে খেয়েই যাচ্ছি। অন্য কিছু নিচ্ছি না।

এতোটাই অন্য মনষ্ক ছিলাম যে চিংড়ি তে যে আমার মারাত্মক এলার্জি আছে মনেই ছিলো না। খাওয়ার মাঝেই আমার গলা গাল চুলকানি উঠলো। স্বাভাবিক ভাবেই চুলকাচ্ছি। এবার পিঠ হাত চুলকাচ্ছে ধ্যাত এতো চুলকাচ্ছে কেন শরীর। ঘুমানোর আগে তো গোসল ও করেছি। তাহলে চুলকানি হচ্ছে কেন? খাওয়া অফ করে চুলকাচ্ছি। হঠাৎ জেরিন চেঁচিয়ে উঠলো,

‘ ও মাই গড কি হয়েছে এসব।’ বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পরলো। আমি বোকা চোখে তাকিয়ে আছি। হাত এখনো আমার গলায়। জেরিনের কথা শুনে সবাই আমার দিকে তাকাতেই আতকে উঠলো। আমি বুঝতে পারছি না এমন করে তাকিয়ে আছে কেন সবাই আমার দিকে। ফারজানা আপুর কথা শুনে আমি নিজের গলায় ও হাতের দিকে তাকালাম। লাল লাল ফোসকা পড়ে আছে। যেখানেই চুলকাচ্ছি সেখানেই এমন হয়ে যাচ্ছে
আমি চোখ বড় করে দেখছি এমন তো আমার চিংড়ি গেলে হয় এখন এমন হলো কেন? আমি তো আজ চিংড়ি খায়নি। প্লেটে তাকাতেই চমকে উঠলাম। ছিটে সরে গিয়ে বললাম,

‘ আমাকে চিংড়ি দিয়েছেন কেন এটাতে তো আমার খুব এলার্জি আমি সহ্য করতে পারিনা। এখন কি হবে।’
সারা শরীর লাল করে ফেলেছি আমি চুলকাতে চুলকাতে। ইহান একবার আমার প্লেট তো একবার আমার দিকে তাকিয়ে তেরে এলো আমার দিকে।আমার রেখে চিৎকার করে বললো,
‘ তোমার মতো অপদার্থ আমি আর একটাও দেখিনি। মাথা খারাপ নাকি তোমার। সমস্যা আছে তাও কোন সাহসে এটা মুখে দিয়েছো ইডিয়েট। কোন কমনসেন্স নাই তোমার!’

আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। ইমা আপু দৌড়ে আমার কাছে এসে পানি খাওয়ালো তারপর আমাকে নিয়ে রুমে এলো। ওষুধ বের করে হাতে দিলো। আমি ওষুধ খেয়ে ও শান্ত হতে পারছি না। শরীর ব্যাথা করছে। নিস্তেজ হয়ে আসছে।
ইহান দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মনে মনে রাগে ফুঁসছে এতটা কেয়ারলেস কেন মেয়েটা!!

ঘুম ভাঙলো রাতে চুলকানি কমেছে ফোসকা ও চলে গেছে হালকা লাল হয়ে আছে শুধু এখন‌। ইমা আপুর রুমেই এখনো শুয়ে আছি। পাশে মলম রাখা আপু দিয়ে দিয়েছিলো বোধহয়। রুমে কেউ নাই আমি একাই তাই উঠে পরলাম ফটাফট।
বাইরে এসে দেখলাম সবাই গোল হয়ে বসে আছে। আর কালকের প্লান করছে রিফাত ভাইয়ার কাল আসবে এখানে। আমি ও তাদের যাওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। তাদের কাছ অবধি পৌঁছাতে পারলাম না। হঠাৎ কেউ আমার হাত শক্ত করে ধরে নিলো। হাঁটা থামিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখি ইহান। আমি বললাম,
‘ কি হয়েছে?’ প্রশ্নতুক চোখ তাকিয়ে বললাম।

‘ কোথায় যাচ্ছ?’ আমার কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ইহান পাল্টা প্রশ্ন করল।
‘ ওই যে ওইখানে। সবাই গল্প করছে আমি একাই রুমে শুয়ে ছিলাম। তাই তাদের সাথে গল্পে জয়েন করতে যাচ্ছি।’
‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে! এই শরীর নিয়ে এখন আড্ডা দিতে যাচ্ছ। চুপচাপ রাতের খাবার খেয়ে ওষুধ খেয়ে শুয়ে থাকো যাও।
কি আমি তো। তিন ঘণ্টার মত ঘুমিয়ে ছিলাম এখন আবার ঘুমাবো কেন? আর আমি এখন একদম ঠিক আছি।’
‘স্টুপিড গার্ল তোমার মত মাথামোটা আমি দুটো দেখিনি চিংড়িতে যেহেতু তোমার সমস্যা তারপরও তুমি ওইটা কোন আক্কেলে খেয়েছিলা?’

আমি ধপ করে মাথা নিচু করে ফেললাম আর ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। কি করে ইহানকে এখন বোঝাবো যে আমি শুধু মাত্র তার জন্য কতটা অস্বস্তি আর অন্যমনস্ক ছিলাম।এতটাই অন্যমনস্ক ছিলাম যে চিংড়ি মাছ খেয়ালই করিনি চিংড়ি মাছ কে অমৃত ভেবে খেয়ে গিয়েছে।
‘কি হল কথা বলছো না কেন? তোমার মত কেয়ারলেস মেয়ে আমি দুটো দেখি নাই!’
‘আচ্ছা আমি না হয় কেয়ারলেস তাহলে ইহান ভাইয়া আপনি না হয় আমার একটু টেক কেয়ার করুন! এখানে তো আর আমার আব্বু আম্মু নাই যে তারা টেক কেয়ার করবে। আর আপনি আমার বড় ভাই হিসেবে একটু না হয় আমার খেয়াল রাখুন‌।’

‘ আবার ভাইয়া বললে? তোমাকে আমি ভাইয়া বলতে মানা করেছিলাম না?’
‘কেন মানা করেছিলেন? আপনি তো আমার ভাই হোন। তাহলে ভাইকে কি আমি এখন মামা বলবো?’
‘ মামা!! হোয়াট? কিছুই বলার দরকার নাই।’
‘ কেন দরকার নাই। অফকোর্স দরকার আছে ভাইয়া আপনি এত বড় আমার থেকে আপনাকে কি নাম ধরে ডাকা যাবে। মামা, ভাইয়া, খালু, চাচা কিছু একটা তো বলতেই হবে তাই না। এখন আপনি বলুন আপনাকে আমি কি বলব? ভাইয়া বলতো যদি সমস্যা হয় তাহলে আমাকে মামা কাকাই বলতে হবে!!’

ইহান আমাকে টেনে রুমে নিয়ে আসলো। বিছানার উপর সাজানো প্লেট দেখতে পেলাম। মুরগির গোশত দিয়ে ভাত রাখা। আমাকে সামনে বসিয়ে খেতে বলল, আজেবাজে কথা বলা অফ করে।
আমি তাও বললাম, ‘ এত ইম্পর্টেন্ট একটা কথা আপনার কাছ আজেবাজে মনে হচ্ছে বলেন না আমি আপনাকে কি বলবো?
‘ উফফ এতো পাগলামো করছো কেন? আচ্ছা ভাই ই ব‌ইলো। মামা কাকা থেকে এটা বেটার।’
আমি দাঁত কেলিয়ে বললাম, ‘ ওক্কে ভাইয়া!’
‘ এখনো কি চুলকায়?’

মুখের খাবার ফিনিশ করে বললাম, ‘ নাহ। কিন্তু শরীর ব্যথা হয়ে আছে হালকা।’
আমার কথা শুনে ইহান বিছানায় থেকে উঠে দাঁড়ালো আর বেরিয়ে গেলো। ইহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আরেক লুকমা ভাত মুখে তুলে নিলাম। খাওয়া শেষ হতেই ইহান হাতে ট্যাবলেট নিয়ে আমার সামনে এসে দাড়ালো। আমি ভ্রু কুটি করে বললাম,
‘এটা আবার কিসের ওষুধ?’
‘ব্যথার ওষুধ খেয়ে নাও ব্যথা কমে যাবে!’

‘ না না আমি আর ওষুধ খাব না। আমি এমনিতেই ঔষধ খেতে পাই না আমার মনে হয় গলায় বিধে আছে। তখন খুব খারাপ লাগছিল তাই খেয়েছিলাম। এখন আমি আর কোন ঔষধ খাব না।এই ব্যাথা এমনিতেই সেরে যাবে।’
‘ কিভাবে সারবে সেটা আমি তোমার কাছে শুনতে চাইনি। ওষুধ এনেছি তাড়াতাড়ি ফিনিশ করো। বাড়তি কথা শুনতে চায় না।’
‘আরে আপনি আমাকে জোর করছেন কেন? আর আপনার কথা মত আমি এটা খাব কেন! আপনি কি ডাক্তার? ইমা আপু তো আমাকে এটা দেন নি। এই ঔষধ আমিটা খাব না।’

‘ জেদ করো না ঊষা। একটা ব্যথার ওষুধ তোমার শরীর ব্যথা থাকবে না এটা খেলে। ইমা আপু তখনই বলেছিল এটা খাওয়ার কথা কিন্তু তুমি তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলে এজন্য আর ডাকিনি ডাকলে তুমি আরো চুলকাতে শরীর। এতে তোমার অবস্থা খারাপ হতো।’
‘ আমি চুলকানোর মধ্যে ঘুমালাম কি করে?’
‘এলার্জি ট্যাবলেট এর সাথে তোমাকে ঘুমের ওষুধ ও খাইয়েছিলে।’
‘তবুও আমি এখনই ওষুধ খাব না কিছুতেই না!’

ইহান যখন আমাকে কোন ভাবেই বলে রাজি করাতে পারল না তখন রেগে গেলো। রেগে গেলে হিতাহিত জ্ঞানশুন্য হয়ে পড়ে। আচমকা ইহান আমার বাহু শক্ত করে চেপে ধরল। এমনিতেই শরীর ব্যথা তার ওপরে আর এমন শক্ত করে খামচে ধরায় আমি ব্যাথায় আহ করে উঠলাম।
ইহান সেদিকে লক্ষ্য করলো না আমার দু গাল চেপে ধরে ঔষধ মুখের ভিতর ঢুকিয়ে দিল। আমি যে ফেলবো তারও উপায় নাই। ওভাবে চেপে ধরে পানি আমার মুখের ঠেলে দিচ্ছে। এদিকে ওষুধ মুখে না গিলে রাখার জন্য মুখ আমার তেতো হয়ে গেল। বমি পাচ্ছে আমার এখন না গিলে কি উপায় আছে। অজ্ঞতা আমাকেই খেতেই হলো।
বিতৃষ্ণার মুখ আমার তেতো হয়ে গেছে। ইহান আমাকে ছাড়তেই কাঁদো কাঁদো মুখ করে তার মুখের দিকে তাকালাম। ফাজিল আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে। তা দেখে রাগ আমার মাথায় উঠে গেল। রাগের মাথায় ইহানের উপর ঝাপিয়ে পড়লাম। দুহাতে কিল ঘুষি মারতে লাগলাম।

‘তোমার তো সাহস কম না তুমি আমার গায়ে হাত তোল!’
‘আমার অনেক সাহস বুঝেছেন। দেখেন কি করেছেন এমনিতেই শরীর ব্যথা হয়ে আছে। তার উপর আপনি আবার আমার হাত আর গাল টিপে আঘাত করেছেন।’ গাল ফুলিয়ে বললাম।
ইহান আমার দিকে তাকিয়ে এক হাত উঁচু করে গালে স্পর্শ করল। আমি তা দেখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছি ইহানের দিকে। আমার অস্বস্তি হচ্ছে এভাবেই স্পর্শ করায়।
তারপর হঠাৎ করেই গাল ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। আর বললো,
‘ ব্যথার মলম এনে দিচ্ছি লাগিয়ে নিও। আমার কথা ভালোমতো শুনলে তো আর ব্যথা পেতে হতো না। দোষ এখানে তোমারি বেশী।’

বলে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
আমি আশ্চর্য মাত্রায় অবাক হয়ে তাকিয়ে র‌ইলাম। তারপর আমিও বেরিয়ে সবার সাথে গিয়ে বসলাম।
পরদিন দুপুরের পর‌ই দেখলাম ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে উপস্থিত হলো ইহানের ফ্রেন্ডের দল। আমি দেখলাম ফারিয়াকে ভালো করে ছিঃ একটু ও লজ্জা বলতে নাই। কি বাজে পোশাক টাই না পরেছে ছিঃ।
নাক ছিটকালাম আমি। রাতে মেহেদীর অনুষ্ঠান কে কি করবে তাই নিয়ে সবাই প্লান করছিলো। তখন এদের আগমন। মুক্তা আপু সবার সাথে কথা বলে আমাকে দেখে জরিয়ে ধরলো। আর কেমন আছি জিজ্ঞেস করল।
আমি হেসে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ভালো আছেন?

‘ আমিও খুব ভালো আছি। বিয়ে খেতে এসেছি ভালো না থেকে পারা যায়।’
ইহান এখানেই ছিলো বন্ধুদের পেয়ে উঠে তাদের নিয়ে ভেতরে চলে গেলো। সবার রুম ঠিক করে দিতে। আমরা আবার বসে পরলাম সবাই। নাচ গান করবে কে সেসব কথা হচ্ছে আমাকেও নাচে জয়েন করতে বললো। কিন্তু আমি সরাসরি মানা করে দিলাম এসব আমার দ্বারা সম্ভব না। কিন্তু জেরিন নাচের কথা শুনে লাফিয়ে উঠলো। ও চেঁচিয়ে বললো, ‘ আমি ডান্স করবো।’

মেয়েটা বিদেশে ছোট থেকে বড় হয়েছে তবুও বাংলায় স্পষ্ট কথা বলতে পারে। এটা আমাকে অবাক করেছে। ও তো আমার বোন ওর সাথে এই দ্বন্দ্ব আমার একদম ভালো লাগছে না। সব ঠিক করে নিতে চাইছি কিন্তু হচ্ছে না। ও আমাকে সহ্য করতেই পারে না। এখানে আসার পর আমি ইলা আপুকে দেখিনি। তিনি আছেন কোথায়? তার বোনের বিয়ে অথচ তার খবর নাই। এক রকম দেখতে দুজন আমি ভাবছিলাম তাদের একসাথে দেখে দেখবো দুজনের অমিল কি আছে কিন্তু হায় কপাল আমার এখানে আসার পর আর তার দেখা পেলাম না‌। ইমা আপু আমাকে নিজের এক পাশে ও আরেকপাশে জেরিনকে বসিয়েছে। আমি ইমা আপুকে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ আপু, ইলা আপু ক‌ই? আসার পর থেকে তাকে দেখলাম না তো।’
‘ ও তো বান্দরবান গেছে।’
‘ বিয়েতে উপস্থিত থাকবে না?’
‘ আজ তো র‌ওনা হয়েছে। সন্ধ্যার আগে পৌঁছে যাবে।’ বলেই মিষ্টি করে হাসলো। আমি ও হাসলাম।
রাতে যারা নাচবে তারা প্র্যাকটিস করতে লাগলো। আর আমরা যারা নাচবো না তারা দর্শকের ভূমিকা পালন করলাম। গালে হাত দিয়ে সবার নাচ দেখছি সবাই মোটামুটি সুন্দর নাচে। জেরিন কে দেখে মনে হচ্ছে অর ডান্স এর অভিজ্ঞতা ভালো।কথায় কথায় একটা মেয়ে জিজ্ঞেস করল জেরিনকে,
‘তুমিতো খুব সুন্দর ডান্স পারো তুমি কি আগে ডান্স শিখতে?’

‘ হ্যা। আর আমি তো সমস্ত অনুষ্ঠানের ডান্স করি স্কুল-কলেজ সব জায়গায় ডান্সে পারফরম্যান্স করে সব সময় ফার্স্ট হ‌ই। আমাকে কেউ হারাতে পারে না। আমার অনেক গুন আছে কিন্তু এখানে অনেকে আছে যারা সব কিছুতেই কাঁচা।’ গর্ব করে বললো।
কথাটা একটু জোরেই বলেছে বলার পর আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ছিল। আমাকে শোনানোর জন্য বলেছে বুঝতে পারলাম। কিন্তু আমি একটু হিংসে হলো না আগের হলে হয়তো করতাম কিন্তু আমার নিজের আপন লোক তাকে আমি হিংসা কেন করব!

ইহানকে দেখলাম ফোন কানে ধরে এগিয়ে আসছে। এখানে সবাই নাচতে দেখে আর এগিয়ে এলো না। পেছনে ঘুরে চলে যাওয়ার ধরলো। কিন্তু কি ভেবে জানি আবার এগিয়ে এসে আমার দিকে তাকালো। আমি সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিলাম। ইহান ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেলো গটগট করে। আমি ও উঠে দাঁড়ালাম আর হাঁটতে হাঁটতে পশ্চিম পাশে চলে এলাম। দুপুরের কিছুটা আগে রিফাত ভাইয়া রাও এসে হাজির হয়েছে। এক পাশ তাদের জন্য বরাদ্দ অপরপাশ আমাদের। বর কনে সবাই হাজির দারুন। এদের মেহেদী গায়ে হলুদ সব একসাথে হবে মজার ব্যাপার।
এপাশে আসতে আমার রিফাত ভাইয়ার আম্মুর সাথে দেখা হয়ে গেলো আর তিনি আমাকে দেখে মিষ্টি করে হেসে জিজ্ঞেস করল কেমন আছি। আমি ভালো আছি আপনি কেমন আছেন আন্টি?

আন্টি আমার কথা শুনে বলল, তুমি যেন ইমার কি হও?
আমি সাথে সাথে বলতে গেলাম, ‘আমি তো ইমা আপু বোন।’
আন্টি বলল,’ কেমন বোন?’
এবার আমি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলাম। এবার কি বলবো। আমি কেমন বোন হয় এটা তো কেউ জানে না। এখন যদি টা সত্যিটা বলে দিই তাহলে যদি ঝামেলা হয় না না থাক সত্যি বলবো না।
আমার দিকে উনি তাকিয়ে আছেন প্রশ্ন তুক চোখে। আমি সেদিন রাস্তায় দেখা হওয়ার ঘটনা বললাম। তারপর আপুর আমাকে আপন করে নেওয়ার কথা বললাম।
উনি সব শুনে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর চলে গেছো আমি ঘুরতে ঘুরতে আবার এদিকে চলে‌ এলাম।
রাতে ইমা গোলাপি রঙের লেহেঙ্গা পরেছে। সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। চোখ ফেরানো দায় হয়ে যাচ্ছে। খুব মিষ্টি লাগছে।

জেরিন টিয়ার মধ্যে গোলাপি মিক্সড করা লেহেঙ্গা পরেছে। ওকেও খুব সুন্দর লাগছে। সবাই কমবেশি সেজেছে। আমি পরেছি মিষ্টি রঙের টা। এটাই সেদিন ইমা আপু চয়েজ করে কিনে দিয়েছিলো। আজ সেটাই পরলাম। আমাকে ফারজানা আপু সাজিয়ে দিয়েছে। সাজ কমপ্লিট করে বেরিয়ে এলাম। ইমা আপুর কাছে এসে বসলাম তাকে মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছে। আমি তার মেহেদীর সাজ দেখছি। ইমা আপু আমাকে দেখেই বললো,
‘ মাশাআল্লাহ, আমার পিচ্চি বোনটাকে তো খুব কিউট লাগছে। ‘
‘ ধন্যবাদ আপু‌। তোমাকে যা লাগছে না দুলাভাই দেখলে আর চোখ ই সরাতে পারবে না। দুদিন পরের বিয়ে আজ করতে চাইবে।’

আপু লজ্জা মিশ্রিত হাসি দিলো। তখন রিফাত ভাইয়ার এগিয়ে এলো‌। ইহান ও তাদের সাথেই এসেছে। সামনে নাচ চলছে। এক দল যেতেই জেরিন এলো প্রথমে একাই নাচলো তারপর সবাইকে টেনে নিলো। ইমা আপুকে ও ছারলো না।তাকেও নেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু আপুর অনুরোধে তাকে ছেড়ে দিল। তাকে ছেড়ে আচমকা আমার হাত টেনে ধরে।আমি চমকে গেলাম।
‘ আমি না আমাকে টানছো কেন আমি তো নাচতে পারি না প্লিজ প্লিজ আমাকে না।’

কিন্তু কে শুনে কার কথা জেরিন আমাকে অনুরোধ করতে করতে উঠে টানতে টানতে ড্যান্স ফ্লোরে নিয়ে গেল। আমি লজ্জায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি।এখন অবশ্য ডান্স ফ্লোর ফাকা না ভর্তি অনেকে নাচছে। তার মধ্যে ফারিয়া কেউ দেখতে পেলাম এই এতক্ষণ তাকে আমি দেখি নাই। বেগুনি কালারের লেহেঙ্গা পড়েছে পেট পুরো বেরিয়ে আছে।লেহেঙ্গা টা সুন্দর দেখতে সুন্দর লাগছে কিন্তু এমন অসভ্যের মত পেট বের করে রেখেছে বলে আমি আবার নাক ছিটকালাম। হিন্দি মেহেন্দি মে নাচনে ওয়ালা গানটা চলছে। আর সবাই উরাধুরা নাচছে। জেরিন এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে নাচাতে লাগল। এক হাতে ধরে রেখেছিলাম লেহেঙ্গা। লেহেঙ্গা এমনিতেই একটু লম্বা। এজন্য ধরে রেখেছিলাম। কিন্তু এবার আমার হাত থেকে পড়ে গেল লেহেঙ্গা। আর এদিকে জেরিন আমার কথা শুনছেই না আমি যে বলতেছি আমি নাচবো না ছারো। কি একটা ঝামেলা বলুন তো!!

জেরিন আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল আরেক দিকে আমি মাঝখানে এসে পড়েছি। আর নাচের সবার ধাক্কাধাক্কিতে আমার অবস্থা নাজেহাল। কোনরকম সবাইকে ধাক্কিয়ে দুক্কিয়ে বেরিয়ে আসতেই হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু তখন পাশ থেকে কেউ আমার পিঠে ধাক্কা মেরে দিলো আমি আঁতকে উঠলাম।নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেও পারলাম না কারণ লেহেঙ্গায় পা বেজে গেছে এবার সোজা হতে পারছি না। পরে যাচ্ছি আমি। চিৎকার করে উঠবে তখনই একটা পুরুষালী ঠান্ডা হাত আমার কোমর জড়িয়ে ধরে পরা থেকে বাঁচিয়ে দেয়।আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে থরথরিয়ে কাঁপছি‌। লোকটা আমাকে টেনে সোজা করে নিরিবিলি জায়গা এনে দাড় করালো। আমি চোখ খুলে ইহানকে দেখলাম। মিষ্টি কালারের শার্ট পরেছে মারাত্মক লাগছে।

এদিকে ইহান ঊষাকে বকার জন্য টেনে নিয়ে এসেছে কিন্তু ওর দিকে তাকিয়ে আর বকতে পারছে না।
অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অপূর্ব লাগছে ঊষাকে।
ইহান দৃষ্টি সংযত করে বলল, ‘ মেহেদি দিয়েছো??’
আমি বললাম, ‘না!’
“কেন দিবে না? যেটা পারো না সেটা করতে যাও কেন আমি বুঝতে পারিনা‌। এখনই তো পরে একটা কেলেঙ্কারি বাজাতে। হাত পা ভেঙ্গে।’
‘ আমি কি ইচ্ছে করে গিয়েছি নাকি আমাকে জেরিন আপু জোর করে নিয়েছে। কতো মানা করলাম শুনলোই না। আর এখন আমি পড়ে যেতাম না। কেউ ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছে আমাকে।’
‘ তোমার মত গাধাকে সবাই ধাক্কা আর জোর‌ই করবে। যাও মেহেদী দাও সবাই দিচ্ছে দেখছো না।’
‘এই আপনি আমার মেহেদী দেওয়া নিয়ে পাগল হয়েছেন কেন? আমার ইচ্ছা হলে দেবে না হলে নাই। সেটা নিয়ে আপনি মাথা ঘামাচ্ছেন কেন?’

ইহান দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘তোমার হাত যদি আমি খালি দেখি। তাহলে তোমার খবর আছে।’
বলেই ইহান চলে গেলো। আমি মুখ কালো করে ইহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি। কি ডেঞ্জারাস ছেলে রে বাবা কিভাবে থ্রেট দিয়ে গেল। যেন আমি ওনার গার্লফ্রেন্ড।
হলুদ শাড়ি পড়ে সবাই রেডি হয়ে নিয়েছি। বাঙালি স্টাইলে শাড়ি পড়েছি। শুধু আমি না সবাই এক স্টাইলে। এক রকম কাপড় পরেছি। সবাই এক সারি বেঁধে দাঁড়ালে কেউ কাউকে চিনতেই পারবে না শুধু লম্বা আর শর্ট এই টুকুই ডিফারেন্স। এ ছাড়া আর কোন ডিফারেন্স নাই। ছেলেরা টিয়া কালারের পাঞ্জাবি পরেছে। জাস্ট অসাম লাগছে সবাইকে।

ঠোঁটে গাঢ় করে লাল লিপস্টিক, কানে ঝুমকা, হাত ভর্তি লাল হলুদ মিক্সড চুড়ি, কোমরে বিছা, চুল বিনি কানের কাছে তাজা গোলাপ ফুল, কপালে টিপ, চোখে মোটা কাজল। আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখছি। নিজেকে দেখে নিজেই চোখ সরাতে পারছি না। কি সুন্দরী না লাগছে আমাকে। এতো সাজ আমি রিমার বোনের বিয়েতেও সাজিনি। আহা রিমার কথা মনে পরে গেলো বেচারা খুব আসতে চাইছিলো কিন্তু ওর কপাল খারাপ। রিমার বোন রিমঝিম আপুর ননদের বিয়ে আর ইমা আপুর বিয়ে এক সাথে পরেছে। তাই ও সেখানেই গেছে যাবে নাই বা কেন ওখানে যে ওর বয়ফ্রেন্ড আছে।

আমি সব বাদ দিয়ে নিজেকে দেখে নিজেই ক্রাশ খাচ্ছি। কপালের টিকলি নাড়াচাড়া করে ঠিক করে গুনগুন করতে করতে বেরিয়ে এলাম। স্টেজের কাছে যাব বলে আমি হেলেদুলে হেঁটে যাচ্ছিলাম তখন কারো বুকের সাথে বাড়ি খেলাম। কপাল ঘঁষে রেগে সামনে তাকালাম। একটা ছেলে হ্যাবলার মতো হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার রাগ তুরুঙ্গে উঠে গেলো। একেতে ধাক্কা দিয়েছে তার উপর আবার সরি না বলে হা করে তাকিয়ে আছে কেমন লুচু ছেলে।

আমি দুহাতে তালি দিয়ে তার ধ্যান ভাঙিয়ে বললাম,
‘ মশা মাছি ঢুকে পেট খারাপ হয়ে গেলো আপনার ছিঃ হা অফ করুন। ‘ নাক ছিটকে বললাম।
ছেলেটা আমার কথা শুনে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো
আর সাথে সাথে মুখ বুজে ফেললো। আমি আবার বললাম,
‘ ভদ্রতা শেখেননি। ধাক্কা দিয়ে সরি বলার প্রয়োজন বোধ করলেন না উল্টা হা করে তাকিয়ে ছিলেন। যতসব ফালতু লোক।’

বলেই আমি পাশ কাটিয়ে চলে‌ এলাম। ছেলেটা আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে ও তাকিয়ে ছিলো আমি লক্ষ্য করলাম না।
ইমা আপু আর রিফাত ভাইয়া পাশা পাশি বসে আছে। তাদের মাঝে পাতলা এটা আবরণ জাস্ট। দুপাশ দিয়ে দুজনকেই হলুদ দেওয়া হচ্ছে। কেবল শুরু হয়েছে মনে হয়। কারণ কেবল বড় রা দিচ্ছে।
আমি এক সাইডে দাড়িয়ে তাকিয়ে আছি। আমার কাছে এসে দাড়ালো ফারিয়া। ওকে দেখে আবার রাগ হলো। পাতলা নেটের হলুদ শাড়ি পরছে। আমার কাছে এসে বললো,
‘ হাই ঊষা!’

আমি কিছু বললাম না। সামনের তাকিয়ে র‌ইলাম। তা দেখে ফারিয়া রেগে গেলো তা দেখে। রেগে কিছু বলতে যাবে তার আগে কোথা থেকে ইহান চলে এলো। ইহানকে দেখে কটমট চোখে তাকিয়ে চলে গেলো ফারিয়া। ইহান আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখতে লাগলো। কপাল কুঁচকে। আমি মুখে হাসি এনে তাকিয়ে আছি। ইহান নিশ্চয়ই আজ আমার রুপের প্রশংসা করবে। আমি সেই খুশিতে দাঁত কেলিয়ে ভাব নিয়ে চেয়ে আছি।
ইহান আমাকে পরোক্ষ করা শেষ করে আরেক পা এগিয়ে এসে আমার মুখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। ওর চোখে মুখে আমি নেশা দেখতে পাচ্ছি। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি তো এমন দৃষ্টি দেখে সুখের সাগরে ভাসছি।
আমার তো প্রশংসা শুনার জন্য আর তর স‌ইছে না তাই আমি আহ্লাদী সুরে বললাম, ‘ আমাকে কেমন লাগছে?’
আমার কথা ইহানের কানে যেতেই ইহানের সম্মতি ফিযে আসে। আর ছিটকে দূরে সরে যায়। অপ্রস্তুত ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘ কি বললে?’
‘আমাকে কেমন লাগছে?” আবার বললাম।
ইহান আমার কথা শুনে ভ্রু কুটি আরে তাকিয়ে আছে। আমি শুনার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। আমার সমস্ত আশা ভঙ্গ করে ইহান তাচ্ছিল্য করে বললো,
‘ জগন্য লাগছে। আটা ময়দা মেখে একদম প্রত্নীর মতো লাগছে। একটু মানায়নি তোমাকে। এমন বাজে করে কে সাজিয়ে দিয়েছে তোমাকে। এর থেকে তো কম সাজেই মুটামুটি ভালো দেখায়।
বলেই চোখ মুখ কেমন করে ফেললো। আমার হাসি খুশি মুখটা নিমিষেই কালো হয়ে গেলো। ইহানের কথা শুনে আমার কান্না পেয়ে গেলো। আমি অনেক কষ্টে কান্না আটকে হাতের মুঠোয় শাড়ির এক অংশ ধরে দাঁড়িয়ে আছি।
ইহান চলে গেছে আমার চোখের কোনে জল জমে উঠেছে। আমি তা মুছে নিলাম। ইমা আপু আমাকে হলুদ দেওয়ার জন্য ডাকছে আমি যেতে পারছি না। আমার আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে ভালো লাগছে না।

চলে যাব তখন আবার সেই ছেলেটা এসে হাজির
হলো। যে ছেলের সাথে ধাক্কা খেয়েছিলাম। ছেলেটা আমার কাছের এসেই হেসে বললো,
‘ হাই বিউটিফুল গার্ল! আই এম শুভ্র! ইউ?
আমি কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে আচমকা ছেলেটা আমার হাত ধরে আটকে ফেললো। আমি চমকে উঠলাম,
‘ সরি সরি কিছু মনে করবেন না। আপনার কি মন খারাপ??

‘ নাহ। কিন্তু আপনি আমার হাত কেন ধরলেন হোয়াই?
‘ আই এম ভেরি সরি। আমি আসলে খারাপ ইনটেনশণ থেকে হাত ধরি না। আপনি কি আমার উপর বিরক্ত?’
‘ যেভাবে ধরেন‌ এটা আপনার উচিত হয়নি। আর আমি আপনার উপর শুধু বিরক্ত না রাগ ও। ‘
‘ তখনকার জন্য আই এম সরি। আপনার নামটা কি জানতে পারি?’
‘ না।’
বলেই চলে‌ যাওয়া ধরলাম। ফারজানা আপু এসে আমার হাত ধরে বললো, কি ব্যাপার ক‌ই যাও। আসো সবার হলুদ দেওয়া তো শেষ হয়ে গেল তুমি দিবে না।’
‘ আমার ভালো লাগছে না আপু। তোমরা দাও। আমি রুমে যাবো মাথা ব্যথা করছে।’
‘একি কথা একটু দিয়ে রুমে যে ও। আসো সবাই কত মজা করছে দেখো। ভালো লাগবে।’
আমার কথা না শুনেই টেনে নিয়ে গেলো।না চাইতেও আপুকে হলুদ লাগালাম। আপু ও আমার গালে হলুদ লাগিয়ে দিলো। আর মিষ্টি করে হেসে জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হয়েছে তোর মুখটা আমার কালো করে রেখেছিস কেন?’
আমি কিছুনা বললাম। আপু হাত টেনে বসিয়ে দিলো তার পাশে আর বললো,
‘ সত্যি করে বল। কেউ কিছু বলেছে?’
আমি চুপ করেই আছি। তাকে এখন কিভাবে বলবো তার ভাইয়ের জন্য আমার মন খারাপ। এটা কেমন দেখায়। তাই চেপে গেলাম। আমি উঠে রিফাত ভাইয়াকে ও একটু হলুদ ছুঁয়ে দিলাম।আর স্টেজে থেকে নেমে এলাম। জেরিন রা সবাই হলুদ নিয়ে দৌড়াচ্ছে। আমি ভয়ে এক কোনে দাঁড়িয়ে আছি আমাকে ও না কখন ভূত করে দেয়। তাই লুকিয়ে আছি।

আর সবার দিকে দিকে তাকিয়ে হাসছি। ইহানের জন্য নিজের আনন্দ মাটি কেন করবো। উনাকে তো আমি কেয়ার‌ই করবো না আর। ভাই হয়ে বোনকে এই ভাবে বললো ব‌দমাইশ লোক একটা। কখনো তোর ভালো হবে না দেখিস।
সবার মজা করা দেখে আমি হাসছিলাম কিন্তু কার যেন এই হাসিটা পছন্দ হলো না। তাই তো আমার হাসি কেড়ে নিলো এককা পুরুষালী হাত। আমি কিছু বুঝার আগেই লোকটা আমার বাম হাত মুচড়ে ধরলো। ব্যাথায় আমার চোখের কোনে জল জমতে লাগলো। আমি , কেরে বলে তাকানোর আগেই লোকটা আমাকে টেনে একটা অন্ধকার বদ্ধ ঘরে ঢুকে গেলো। আর ঢুকেই দরজা খট করে লাগিয়ে আমাকে দেয়ালে ঠেসে ধরল। লোকটা একদম আমার গা ঘেষে দাড়িয়ে আছে। ভয়ে আমার বুক কাপছে। লোকটার পারফিউম এর ঘ্রান আমার পরিচিত লাগছে কিন্তু বুঝতে পারছি না। লোকটা যে ইহান দুই মিনিট লাগলো বুঝতে। জানালা বেদ করে এক চিলতে আলোতে আমি তার মুখটা স্পষ্ট দেখলাম। সাথে সাথে আমার ছটফটানি কমে গেলো। আমি বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। উনী আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছে। উনি আমার বাম হাত মুচড়ে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,

‘ হাউ ডেয়ার ইউ! তোমার সাহস কি করে হলো ওই ছেলেটাকে হাত স্পর্শ করতে দেওয়ার??’
আমি কেঁপে উঠলাম ইহানের কথা শুনে। সাথে বিস্মিত হলাম। উনি জানলো কি করে শুভ্র আমার হাত ধরেছে?
‘ আমি ব্যাথা পাচ্ছি!’ নিচু স্বরে বললাম।
আমার কথা কানে যেতে হাত ছেড়ে দিলো। কিন্তু আমার কাছে থেকে দূরে সরে দাঁড়ালো না। তার প্রত্যেকটা শ্বাস প্রশ্বাস আমি শুনতে পাচ্ছি। সব আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আচমকা ইহান আমার পায়ের কাছে বসে পরলো হাঁটু গেড়ে আমি হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে। কি করছেন উনি এমন প্রপোজ স্টাইলে বসছে কেন? আমাকে প্রপোজ করবে নাকি?

আমি ধরেই নিয়েছি প্রপোজ করবে। আমি তো লজ্জায় লাল নীল হচ্ছি কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি আমার বাম পা টেনে ধরলো আমি চমকে পেছাতে চাইলাম কিন্তু সম্ভব হলো না। আমি তো দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আছি পেছাবো কি করে? আমি পা শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছি পা টানছে কেন? উনির মাথা গেলো নাকি?
‘ পা দাও।’
‘ মানে আপনি ঠিক আছেন? এমন করছেন কেন? আমার পা টানছেন কেন?’
‘ স্টুপিড! পা উঁচু করো!’

‘ কিন্তু….
ইহানের রাগী চোখের মনি দেখে ভড়কে গেলাম আমি। আর কাঁপতে কাঁপতে পা উঁচু করলাম।
ইহান আমার পা টেনে নিজের হাঁটুর উপর রেখে একটা পায়েল বের করে পায়ে পরিয়ে দিলো। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি। এটা আমার টা না নতুন এটা। ইহান পায়েল পায়ে পরিয়েই আচমকা নিচু হয়ে ওর ওষ্ঠের স্পর্শ করলো। আমি কোমল স্পর্শ পেয়ে দুহাতে শাড়ি খামচে ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। আমার সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন।আমি টেনে পা সরিয়ে দৌড়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। ইহান এটা কেন করলো? উনি কি তাহলে আমাকে ভালোবাসেন?
বাকিটা সময় আমার স্বপ্নের মতো কাটলো ইহান আমাকে ভালোবাসে। আমি সিউর খুশিতে আমার নাচতৈ ইচ্ছে করছে। আমি নাচতে নাচতে অনুষ্ঠানে চলে এলাম।

রাতে অনুষ্ঠান শেষে সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে। ঘুমানোর চেষ্টা করছে। আর আমি আনন্দে ঘুমাতে পারছি না। তাই উঠে বেরিয়ে বাগানে চলে এলাম। ঝলমলে আলোতে আর আকাশে পূর্ণ চাঁদের আলোতে অপূর্ব লাগছে সময়টা। আমি ইহানের মুখটা ভেবে মুচকি মুচকি হাসছি আর সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ সামনে একজন নর নারী কে দেখতে পেলাম। আমি এগুতে ইহান আর ফারিয়াকে দেখলাম। ইহান ফারিয়ার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে গোলাপ হাতে বলছে ‘ আই লাভ ইউ’

দৃশ্যটা দেখে আমার সব আনন্দ হাওয়া হয়ে গেলো সেকেন্ড এ। আমি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এসব কি হচ্ছে। ইহান ফারিয়াকে ‘ ভালোবাসি’ বলছে কেন? উনি তো আমাকে ভালোবাসে। তাহলে কি আমার ভাবনা সব ভুল ছিল? উনি আমাকে ভালোবাসেন না। আমার কি যেন হলো ইহান আমাকে ভালোবাসে না ভাবতেই তীব্র কষ্ট হতে লাগল। আমার মাথার যন্ত্রনা হতে লাগল। আমি ওখানেই জ্ঞান হারাতে লাগলাম। তখন দেখতে পেলাম শুভ্র নামের ছেলেটি আমাকে আঁকড়ে ধরেছে। আর আমার দিকে উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করছে,

‘হ্যালো এই যে ম্যাডাম কি হয়েছে আপনার? কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলুন আমাকে!’
আর কোন কথা শুনতে পেলাম না। আমি অচেতন হয়ে লুটিয়ে পড়লাম তার বাহুতে‌ই।
এদিকে ফারিয়া নিজের রুমের বারান্দায় থেকে ইহানকে বাগানে দেখতে পেয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। এতো রাতে না ঘুমিয়ে বাগানে একা একা কি করছে দেখার জন্য। এগিয়ে এসেই দেখতে পায় ইহান হাঁটু গেড়ে বসে চোখ বন্ধ করে কি যে বলছে। কাউকে প্রপোজ করছে। আবেগ-অনুভূতি মিশানো বাক্য ছেড়ে যাচ্ছে। ফারিয়া শব্দ হীন পায়ে হেঁটে ইহানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এখন যে কেউ দেখলে বলবে ইহান ওকেই প্রপোজ করছে।
এই দৃশ্যটা দেখেই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।

ইহান চোখ ঝট করেই খুলে ফেলে কারো উদ্বিগ্ন গলার আওয়াজ শুনে। ঝট করেই তাকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সামনে ফারিয়াকে দেখে ওর কপাল কুঁচকে আসে। সাথে সাথে হাতে গোলাপ পকেটে ঢুকিয়ে নেয়। ফারিয়াকে কিছু জিজ্ঞেস করবে তখন অদূরে ঊষাকে একটা ছেলের কোলে দেখে মাথায় রক্ত উঠে যায়। দৌড়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে ইহান শুভ্রকে বলে,

‘ এসব কি হচ্ছে? আপনি ওকে কোলে তুলছেন কোন সাহসে?’ রাগান্বিত স্বরে বলল ইহান।
বলতে বলতে কেড়ে নিলো শুভ্রর কোল থেকে। আমাকে অচেতন অবস্থায় দেখে ভাবলো হয়তো শুভ্রর জন্য আমি অচেতন হয়েছি। এটা ভেবে শুভ্রকে ধমক দিয়ে বললো,
‘ কি করেছেন ওর সাথে ও জ্ঞান হারিয়েছে কেন? ওর সাথে খারাপ কিছু করার চেষ্টা করে থাকেন আমি আপনাকে খুন করে ফেলবো। আগে ঊষাকে জাগাতে হবে। তারপর আপনাকে দেখে নিচ্ছি।’
বলেই ইহান বড় বড় পা ফেলে ভেতরে ঢুকে গেলো।নিজের রুমের বিছানায় ওকে শুইয়ে দিয়ে পানি এনে ছিটা দিতে লাগলো।

আমি চোখ মেলে ইহানকে খুব কাছে অনুভব করলাম। ইহান আমার হাত ধরে বসে আছে। আমি চোখ মেলতেই উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলো,
‘ ওই স্কাউন্ড্রেল তোমার সাথে কি করেছিলো। যার জন্য অজ্ঞান হয়ে গেলে। সব বলো আমাকে ওকে আমি খুন করে ফেলবো। ‘
আমি বোকা চোখে তাকিয়ে ভাবছি কার কথা বলছে। কার জন্য আমি অজ্ঞান হয়েছি। কি সব বলছে আমি তো উনার জন্য অজ্ঞান হলাম আর উনি আবার কার কথা বলছে? শুভ্র নামের সেই ছেলেটার কথা নয়তো?
‘কি এত ভাবছো? ওই ছেলেটা তোমাকে কি করেছিল ? আর তুমি এত রাতে বাগানে কেন গিয়েছিলে? কি এমন হয়েছিলো তুমি জ্ঞান হারালে? অ্যানসার মি!!’

তখনকার কথাটা মনে পরতেই আবার আমার শরীর নিস্তেজ হতে লাগল। ছলছল চোখে ইহানের চোখের দিকে তাকালাম। উনিত ফারিয়াকে প্রপোজ করে ভালোবাসি বলেই দিয়েছে। আমাকে উনি বোন ই ভাবতে পারেনা ভালো আবার কিভাবে বাসবে। কিন্তু তখন তাহলে পায়ে নূপুর পড়িয়ে দেওয়া এসব কি ছিলো?
আমি হঠাৎই হুহু করে কেদে উঠলাম। আমার না দেখে ইহান ব্যস্ত হয়ে গেল। ব্যস্ত গলায় জিজ্ঞেস করতে লাগলো,
‘হোয়াট হ্যাপেন্ড! কাঁদছো কেন?’
আমি কিছু বললাম না। নিজের কান্না থামানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। ইহান আমার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে আছে। আমার হঠাৎ কান্না মানে খুঁজে পাচ্ছে না। এদিকে এত প্রশ্ন করছে। আমি উত্তর দিচ্ছি না। তাই খানিকটা রাগ ও হচ্ছে উনার। এবার উনি রেগে উঠলো আর আমার দু কাঁধে হাত রাখল শক্ত করে। আর ঝাকাতে ঝাকাতে জিজ্ঞেস করতে লাগলো।

উনার এমন করা দেখে এবার আমি রাগে দুঃখে চিৎকার করে বললাম, ‘বারবার কি বলছেন! খুন করে ফেলবো! খুন করে ফেলবো! নিজেকেই কি আপনি নিজে খুন করে ফেলবেন? ওই শুভ্র ছেলেটার জন্য আমার কিছু হয়নি। আমার যা হয়েছে সব আপনার জন্য হয়েছে!’
‘ হোয়াট? আমার জন্য হয়েছে আমি আবার কি করলাম?’ বিস্ময় হতবম্ভ হয়ে জিজ্ঞেস করল।
আমি নাক টানতে টানতে বললাম, ‘আপনি আপনার ফ্রেন্ড ফারিয়াকে প্রপোজ করেছেন। ‘আই লাভ ইউ’ বলেছেন আমি সব দেখে ফেলেছি। একদিন ওই ফারিয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য আপনি আমাকে মিথ্যে গার্লফ্রেন্ড সাজালেন। আর আজকে আপনি তাকে নিজের গার্লফ্রেন্ড বানানোর জন্য প্রপোজ করছেন।’

‘হ্যাভ ইউ লস্ট ইউর মাইন্ড? হোয়াট আর ইউ টকিং এবাউট! আমি ফারিয়াকে প্রপোজ কখন করলাম?’
‘ কি মিথ্যাবাদী মিথ্যুক।আমি নিজের চোখে দেখেছি আপনি ফারিয়ার সামনে হাঁটু গেড়ে গোলাপ হাতে আই লাভ ইউ বলছেন। আর এখন বলছেন আপনি ফারিয়াকে প্রপোজ করেনি। হাটে হাড়ি ভেঙে গেছে এখন আমাকে মিথ্যা কথা বলতে এসেছেন।’

‘হুয়ে সুড আই লাই টু ইউ ইউ? কে তুমি? গার্লফ্রেন্ড নাকি বউ? যে তোমাকে মিথ্যা কথা বলতে আসবো!’
আমি চুপ করে ইহানের কথা শুনছি আসলেই তো। ইহান আবার বলল,
‘ শুনো মেয়ে আমি কাউকে প্রপোজ করলে বা ভালোবাসি বললে এতো লুকিয়ে-চুরিয়ে করবো না সবার সামনে গলা ফাটিয়ে ভালোবাসি বলবো। আমি এত ভীতু না ওকে। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে আমি যদি কাউকে আই লাভ ইউ বলে ও থাকি তাহলে সেটা দেখে তোমার এই অবস্থা কেন হলো? তুমি এমন রিএক্ট কেন করলা হোয়াই?’
আমি লজ্জায় চুপ করে মাথা নিচু করে আছি।এবার কি বলবো আমি ইহানকে?

‘অ্যাক্টিং করতে করতে কি সত্যি আমাকে নিজের বয়ফ্রেন্ড ভাবতে শুরু করলে নাকি?’
আমি কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি তখন আমার পায়ে নুপুর পরিয়ে দিলেন কেন?
আমার কথা শুনে ইহান থতমত খেয়ে গেলো। আর আমতা আমতা করতে লাগলো। আমি ও চেপে ধরলাম তাকে জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছি। কথার মাঝে তার কথাটা বাদ পড়ে গেল।
ইহান বেকায়দায় পড়ে আমাকে বললো, ‘ যাও নিজের রুমে যাও। আমি ঘুমাবো!’
‘না আমি কোথাও যাবে নাকি বলুন তখন কার ও সবকিছু কি ছিলো?’
‘ আমি বলতে বাধ্য না। যাও বের হ‌ও আমার রুম থেকে।’
বলে আমার হাত ধরে টেনে বিছানা থেকে নামালো। আমি বললাম, ‘আপনি আমাকে ভালোবাসেন তাই না?’
ইহান টেনে আমাকে রুম থেকে বের করতে নিচ্ছি ল হঠাৎ আমার কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।
‘ কি সব আবোল তাবোল বকছো। এমন কিছুই না।’

‘ আপনি না বলে ভীতু না ভালবাসলে লুকিয়ে রাখেন না সত সাহসের সাথে বলতে জানেন তাহলে এখন কি করছেন? নিজের মনের কথা লুকিয়ে চোরের মতন ঘুরছেন। আবার নিজেকে সাহসী বলে গলা ফাটান ছিঃ। আপনি একটা ভীতুর ডিম। সৎ সাহস থাকলে স্বীকার করুন আপনি আমাকে ভালোবাসেন।”
ইহান আমার কথা শুনে চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। আমি যে উনাকে রাগিয়ে তুলেছি আমি সেটা জানি। কিন্তু আমার কিছু করার নাই উনার মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটা শুনার জন্য‌ই আমি এমন করছি।
‘ তুমি কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছো ঊষা। এতো সাহসী কিন্তু তুমি না তাই নিজেকে সাহসী প্রমাণ করতে যেও না।’
‘ আপনার কি মনে হয় আমি ভীতু আমি ভীতু হলে আপনার থেকে সাহসী। আপনি আমার থেকেও ভীতু।’

‘ আমি ভীতু না ওকে হ্যাঁ ‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি ‘ এটা আমার মুখে বলার কি প্রয়োজন! সেটা অবশ্যই তুমি আমার তাকানো দেখেই বুঝে গেছো। একটা ছেলে একটা মেয়ে দিকে কি নজরে তাকায় সে মেয়েটা অবশ্যই তার চাহনী দেখি বুঝতে পারে। যে ছেলেটা তাকে ভালোবাসে। আর তুমি যদি না বুঝে থাকো অবশ্যই তুমি একটা গাধা। ভালোবাসলেই সেটা মুখে কেন বলতে হবে? আমার গভীর অনুভূতি মাখা দৃষ্টি দেখলেই তো তোমার তা এক ঝলকে বুঝে যাওয়া উচিত। আর তুমিও যে আমাকে ভালোবাসো সেটা ও আমি জানি। তাহলে তুমি কেন মুখে ভালবাসি না বলে লুকিয়ে গিয়েছো তাহলে তো তুমি আমার থেকেও ভীতু। ভালোবাসি শব্দ টা মুখে উচ্চারণ করলেই সৎ সাহসী হয়ে ওঠা যায়না। ভালোবাসার মানুষটির পাশে থেকে নিজের করার সৎ সাহস থাকা চাই। তাই আমার সৎ সাহস নিয়ে নেক্সট টাইম কথা বলতে আসবেনা। মাইন্ড ইট। নও গেট লস্ট। আই উইল স্লিপ নাও।’

বলেই ধাক্কা দিয়ে দরজার বাইরে বের করে দরজা আটকে দিলো। আমি থ মেরে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম স্তব্ধ হয়ে।
ইহানের মুখে ভালোবাসি শুনে কি আমার খুশি হওয়া উচিত। না কি এভাবে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার জন্য অভিমান করা উচিত কিছু বুঝতে পারছিনা। আমি বিহ্বল হয়ে আর একবার বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে নিজের রুমের দিকে হাটা দিলাম। অদ্ভুত আসলেই অদ্ভুত এই ইহান।অন্য সবার বয়ফ্রেন্ড কি সুন্দর ফুল দিয়ে হাটু গেড়ে আই লাভ ইউ বলে আর মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আর উনি আমাকে ভালোবাসি বলল ধমকের স্বরে আর তারপর ধাক্কা দিয়ে দরজার বাইরে বের করে দিলো। হায় পোড়া কপাল আমার। সব কিছুই অদ্ভুতভাবে হয় আমার জীবনে।

পরদিন ইমা আপুর বিয়ে আজ। বর আসার তারা নাই কারণ বর তো এখানে আছে। তাই বরকে সামনে রাস্তায় দুই পাক ঘুরিয়ে আনা হবে তারপরে গেট ধরবো আমরা। শুভ্র নামের ছেলেটি কে আজকে জানতে পারলাম। সে হলো বরের বোনের দেওর। কালকে ইহানের কাছে ধমক খাওয়ার পর সকাল থেকে কথা বলতে আসেনি কিন্তু গেইট ধরার সময় লেগে গেল তার সাথে ঝগড়া। আমি দূরে ইহান কে দেখলাম আমাকে ইশারা করছে ওখান থেকে সরে আসার জন্য ওই ছেলেটার সাথে কথা বলতে দেখা একদমই সহ্য করতে পারে না ইহান।আমাকে সকালবেলা উঠে হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে বলেছে,

‘ ও শুভ্র নামের ছেলেটির সাথে যেনো তোমাকে আমি কথা বলতে না দেখি আর ওর আশেপাশেও যাবে না মনে থাকবে?’
‘আপনি আমাকে এই সাত সকালে এসব কথা বলতে এসেছেন। কোথায় ভাবলাম এখন থেকে আপনি আমার রিয়েল বয়ফ্রেন্ড হয়ে গেলেন। একটু প্রেম-টেম করবো আপনি আমার সাথে মিষ্টি করে কথা বলবেন তা না কাল থেকে শুধু ধমকে যাচ্ছেন। প্রবলেম কি আপনার?’
‘ কোন প্রবলেম নাই। ওই ছেলের সাথে কথা বললেই
খবর আছে তোমার।’

আমি জেদ করেই আরো গেলাম না। পেয়েছে কি খালি আমাকে হুমকি দেবে আর আমি তা মেনে নেব ইম্পসিবল। একবার ইহানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও রক্তবর্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ঢোক গিলে আমতা আমতা করতে করতে গেইটে থেকে সরে দাঁড়ালাম। অজান্তে আমায় ভয় পেয়ে গেছি না জানি পরে আমাকে হাতের কাছে পেলে কি করে। সেই ভয়ে আর অমান্য করতে পারলাম না।
আমি বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছি আব্বু আম্মু আসছে না কেন? সবাই ব্যস্ত বরকে নিয়ে একটু আগেই বরকে ভেতরে স্টেজে বসানো হয়েছে আর এখন তাদের সামনে খাবার দেওয়া হয়েছে সেখানেই ইহান আছে। আমি ও খাইনি আব্বু আম্মু আসছে খাব তাই।

‘কি হয়েছে মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেন? খাবার খেয়েছো?’
ইহানের আচমকা কন্ঠস্বর শুনে লাফিয়ে উঠলাম।
‘ না।’
‘কেন? চলো খাবে।
‘আব্বু আম্মু তো এলো না তারা কি আসবে না? ফোন দিলাম তখন তো বললো বের হচ্ছি এতো লেট হচ্ছে কেন?’
‘ হয়তো গাড়িতে আছে এজন্য ধরছে না। চলো খাবে।’

আমি আর মানা করতে পারলাম না ইহানের সাথেই চলে গেলাম। মনে মনে একটা কথাই ভাবছি আব্বু আসলে তাকে দেখে সবার রিয়াকশণ কেমন হবে? আল্লাহ আল্লাহ করছি চাচা জানের সাথে যেনো সম্পর্ক ঠিক হয়ে যায়। তাহলে সবার সাথে আমরা থাকতে পারবো ইশ কি আনন্দ হবে। ভাবতেই আনন্দ লাগছে। এখন বাকিটা সময়ের অপেক্ষা।
আজকে ভাইয়া সাদা শার্ট ইন করে পরেছে সাথে কালো কোর্ট পরেছে, কালো প্যান্ট, মানিয়েছে খুব। আমি তার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে

খাবার টেবিলে এসৈ বসলাম। আমি আজ অরেঞ্জ রঙের গাউন পরেছি এটা আমার জন্মদিন আব্বু দিয়েছিলো। খুব ফেভারিট এই পোশাক টা আমার কাছে। তাই এই আনন্দের দিনে এটাই পরেছি।
আমাকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও আমার পাশে বসেছে ইহান। ইলা আপুকে দূরে দেখলাম। লেহেঙ্গা পরেছে জাম কালারের। ইমা আপু তার রুমে বিয়ে পরানোর পর তাকে বাইরে আনা হবে তার আগে বরকে একাই স্টেজে বসে থাকতে হবে। খাবার খেয়ে ইমা আপুর কাছে এসে বসলাম। আম্মু আব্বু এসেছে কিনা তার আর খোঁজ নিতে পারলাম না। আপু কাছে বসে ছিলাম। রেজিস্ট্রেশন কাগজ এনে দিলো সাইন করার সময় কাঁদতে কাঁদতেই আপু শেষ একটু পর হুজুর আসলে কবুল বলার হলো। কবুল বলতেই চারপাশে চিৎকার ভেসে এলো। মানুষ সব গিজগিজ করছে এখানে। এসবের মাঝে আমি আব্বু আম্মুর কথাটা ভুলেই গেলাম

এইসবে আনন্দ করতে লাগলাম ওইদিকে যে ঘুনি ঝড় বয়ে যাচ্ছে তার কোন কিছু আমি জানতে পারলাম না। আব্বু আম্মু হাসিখুশি মুখের ভিতরে প্রবেশ করেছিল কিন্তু তার পরেই যখন তাদের সাথে দেখা হলো চাচা জানের আর আবার ঝগড়া বেধে গেলো। আমার আব্বু তার সাথে মানিয়ে গুছিয়ে ভালো করে কথা বলতে চাইলেও চাচাজান তার কোন কথাই শুনতে নারাজ চিৎকার চেচামেচি করে তাকে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বলল। আব্বু মলিন মুখে বেরিয়ে গেলো। অপমানে তার মুখটা একটু খানি হয়ে গেছে।ইহান ও এই মুহূর্তে এখানে উপস্থিত ছিলো না। ইহান আর আমার চোখের আড়ালে আবারো অপমাণিত হয়ে মুখ ছোট করে বেরিয়ে যেতে হলো।

এক চিলতে রোদ সিজন ২ পর্ব ২১+২২+২৩+২৪+২৫

রিফাত ভাইয়ার গ্রামের বাড়ি রাজশাহী তাই এখন সেখানে যাবে ইমা আপুকে নিয়ে। তাই সন্ধ্যার আগেই বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেলো তারা। আমি ও ইহান সেখানেই ব্যস্ত। বিদায় মুহূর্তে সবার আনন্দের মুহূর্ত নীরবতা ছেয়ে গেলো। সবার চোখে পানি যাতে কাজল লেপ্টে সবারই সাজগোজের বারোটা বেজে গেছে। ইমা আপুকে গাড়িতে উঠিয়ে দিতে তারা চলে গেল।আমি এখনো দাঁড়িয়ে যে রাস্তা দিয়ে ইমা আপু চলে গেছে সে দিকে তাকিয়ে আছি। ইহান এসে আমার হাতের মুঠোয় নিজের হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো তারপর আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল ,

‘সবাই ভেতরে চলে গেছে তুমি এখন এইখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
‘ এভাবেই।
‘ ওহ আচ্ছা ভেতরে চলো তাহলে।’
বলেই কমিউনিটি সেন্টারে ভেতরে নিয়ে এলো। সবাই প্যাকিং করছে একটু পরেই বেরিয়ে যাবে। ভেতরে আসতেই ইহান আমার হাত ছেড়ে চলে গেলো। আমি ভাবছি আম্মু আব্বু আসলো না কেন কল দিলাম রিসিভ করল আম্মু,
‘হ্যালো আম্মু তোমরা আসলে না কেন?’

‘তোর আব্বুর শরীরটা ভালো লাগছে না। এজন্য যায়নি তুই বাসায় আসবি কবে?
‘আজকে অথবা কালকে কেন? আর তোমার গলাটা এমন লাগছে কেন আব্বুর কাছে দাও। আমি আব্বুর সাথে কথা বলব আমাকে কথা দিয়েও কেন আসলো না। আমি জানতে চাই।’
আমার আহ্লাদী আর জেদি গলা শুনে আম্মু রেগে গেল।
‘বললাম না এখন কথা বলবে না বাসায় আয় তারপর যত খুশি কথা বলিস রাখি।’

বলেই খট করে কল কেটে দিলো। আমি হতবিহ্বল হয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে র‌ইলাম। এমন রাগ দেখালো কেন?
সন্ধ্যা হয়ে এলো ইহানদের বাসায় আসতে। আমি চলে যেতে চাইছিলাম। কিন্তু ইহান বলেছে আজ থেকে যেতে কাল দিয়ে আসবে।আমি ও রাজি হয়ে গেছি ইহানের কাছাকাছি থাকার জন্য।

কিন্তু খাবার টেবিলে যা শুনলাম তা শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। খাবার মুখে দিতে গিয়েও তা নামিয়ে ফেললাম। আমার চোখ দুটো জলে ভড়ে উঠলো। আমি ছলছল চোখে ইহানের দিকে তাকালাম। ইহান ও স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি খাবার রেখেই দৌড়ে উপরে চলে এলাম।

এক চিলতে রোদ সিজন ২ পর্ব ৩১+৩২+৩৩+৩৪+৩৫