এক চিলতে রোদ সিজন ২ পর্ব ৩১+৩২+৩৩+৩৪+৩৫

এক চিলতে রোদ সিজন ২ পর্ব ৩১+৩২+৩৩+৩৪+৩৫
Writer Nondini Nila

ইমা আপুর রুমে আমাকে থাকতে দিয়েছেন আমি বেলকুনিতে বসে ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে যাচ্ছি।খাবার টেবিলে জানতে পারে আব্বু আম্মু এসে ছিল কিন্তু চাচাজান তাদের কে অপমান করে বের করে দিছে। এসব শুনে আর আমি খাবার গিলতে পারিনি। খাবার না খেয়েই চলে এসেছি আর নিচে যায় নি। সবাই হয়তো সন্দেহ করেছে আমার এমন রিয়েক্টে কিন্তু আমি তা পাত্তা দেয়নি। আমার খুব কষ্ট‌ হয়েছে। আব্বু আম্মু আবার ও কষ্ট পেলো আর আমি সেখানে উপস্থিত ই ছিলাম না। যারা আমার আব্বুকে সহ্যই করতে পারেনা আমি সেই বাড়িতে খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুরে বেড়াচ্ছি। এসব ভেবে খাওয়ার ইচ্ছা টা আরো মরে গেছে।

জেরিন কে আসতে দেখে চোখ মুছে স্বাভাবিক করলাম নিজেকে। জেরিন আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
‘না খেয়ে ওমন করে চলে আসলে কেন?’
আমি বললাম, ‘ টায়ার্ড লাগছিল খুব। খেতে ভালো লাগছিলো না।’
‘ তোমার নাক মুখ লাল হয়ে আছে যেন কান্না করেছো?’
‘ মাথা ধরেছে তাই এমন লাগছে।’
‘ ওহ আমার আগের বিহেভিয়ার জন্য সরি। আমরা কি ফ্রেন্ড হতে পারি?’
‘ অবশ্যই!’
মুখে হাসি টেনে বললাম। জেরিন গল্প করলো কিছু সময়। ওর মা ডাকতেই ছুটে চলে গেল। আমি অবাক হয়ে ভাবছি এর আবার কি হলো এত ভালো বিহেভ করল আমার সাথে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

কিন্তু মন খারাপ কিছুটা কমেছে। আমি রুমে এসে বিছানায় শুয়ে পরলাম। মনটা আবার খারাপ লাগছে আমি ওইভাবে চলে আসলাম আর ইহান একবার আমার খোঁজ নিলোনা। একটু আমার জন্য চিন্তা করে না। এই উনার ভালোবাসা।
চোখ ভিজে উঠলো আবার। আমি উঠে দাঁড়ালাম। অনেকেই আগেই শুয়ে পরেছে কিন্তু কয়েকজন ড্রইংরুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে। জেরিন আছে সেখানেই। আমি উঁকি মেরে ইহানকে খুঁজলাম নাই‌। আমি তার রুমের দিকে যাওয়া ধরালাম চোরের মত কেউ আবার দেখে নেবে না তো? কাছাকাছি আসতেই সেদিনের অপমানের কথা মনে পরলো। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম আমি। আজ নিশ্চয়ই বকবে না। আজ আর সেদিন তো আলাদা ছিলো। আমি খুশিমনে ভেতরে চলে গেলাম।

সম্পন্ন রুম ঘুরেও তাকে খুঁজে পেলাম না। তার মানে তিনি রুমে নাই। গেছেন কোথায়? মন খারাপ করে ছোট টেবিলের উপর ইহানের ছবির দিকে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইলাম।কোথায় আমার কাছে আসবে আমার মন ভালো করার চেষ্টা করবে তা না আমি তাকে উল্টা খুজছি আর তিনি লাপাত্তা হয়ে আছেন। অভিমানী চোখে তাকে কিছুক্ষণ অভিযোগ করে উঠে দাড়াতেই,

জেরিনের আগমন ঘটলো, জেরিন ইহান ব্রো বলে ডাকতে ডাকতে এ ঘরে আসছে। আমি লাফিয়ে উঠে এদিকে ওদিকে তাকিচ্ছি কোথায় যাব জেরিন যদি আমাকে দেখে সন্দেহ করে। আমি এঘরে কি করছি? দৌড়ে আলমারির আড়ালে লুকিয়ে পরলাম। জেরিন খুঁজতে খুঁজতে বারান্দায় চলে গেল আমি দেখছি লুকিয়ে মাথা বের করে। জেনিন ভেতরে আসতে আবার লুকিয়ে পারলাম। জেরিন বেরিয়ে গেল ডাকতে ডাকতেই। আমিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তারাতাড়ি বেরিয়ে এলাম। তখনই দেখা হলো ইলা আপুর সাথে। ফোন হাতে এগিয়ে আসছে। আমাকে ইহানের রুম থেকে বের হতে তিনি দেখে নিয়েছেন মাথা তুলে। আমি এক পলক দেখে ইমা আপুর কথা ভেবে ফেলেছিলাম কিন্তু ইমা আপু তো শ্বশুর বাড়ি ভাবতেই মনে পড়লেই এটা ইলা আপু। উনি প্রশ্ন তোক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে দাঁড়িয়ে পড়ল,

আমি ইহানের রুমের দরজার সামনে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে হাতের তালু চুলকাচ্ছে। উনি কিছু জিজ্ঞেস করলে আমি কি উত্তর দেবো সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। ভয়ে আমার বুক ধুকপুক করছে। ইলা আপু গলা উঁচিয়ে রুমের ভেতরে তাকিয়ে বলল ইহানকে রুমে আছে?
আমি তোতলানো গলায় বললাম, ‘না আপু!’
‘ ইহানকে দেখলে আমার সাথে দেখা করতে বলো।’
বলেই আমাকে ক্রস করে চলে গেল। আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি।এমনভাবে আমাকে কথাটা বলল যেন ইহানের সাথে আমি সব সময় থাকি তাই খবর পৌছানোর দায়িত্বটা আমার। কিন্তু উনি এই দায়িত্ব আমাকে কেন দিলো?
ভাবতে ভাবতে তাঁরাতারি চলে এলাম।
ইহানের দেখা মিলিছে রাত সাড়ে দশটায়। আমি তখন বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম।
ইহান কোথা থেকে এলো জানিনা।এসেই আমাকে টেনে নিজের রুমে নিয়ে এলো। আর আমাকে এক প্লেট খাবার দিলো খাওয়ার জন্য।

‘ দুঘন্টা পর আসছে দরদ দেখাতে। লাগবে না এমন আদিখ্যেতা।’
ইহান জ্যাকেট খুলে আমার সামনেই শার্ট খুলে ফেলল আমি তা দেখে চিত্কার করে উঠলাম। আমার চিৎকার শুনে ইহান বিরক্তকর চাহনি দিয়ে বলল, ‘কি ব্যাপার মেন্টালের মত চিৎকার করলে কেন? তুমি যে আমার রুমে আছো তা সারা দুনিয়াকে না জানালে তোমার চলছে না?’
আমি তারাতাড়ি মুখ চেপে বললাম, ‘ আপনি নির্লজ্জের মত আমার সামনে শার্ট খুললেন কেন? লজ্জা করল না একটা মেয়ের সামনে শার্ট খুলতে!’
‘আশ্চার্য! শার্ট খুলেছি তো কি হয়েছে? আমি কি তোমার সামনে খালি গায়ে বসে থাকব নাকি। আমি চেঞ্জ করছি দেখো না ঘেমে একাকার হয়ে গেছি‌। আর নির্লজ্জের কি হলো এখানে আমি কি প্যান্ট খুলেছি যে তুমি এমন করে চিৎকার করলে অদ্ভুত।’

ইহান ওয়াশরুমে চলে গেল টি-শার্ট গায়ে জড়িয়ে। হাত মুখ ধুয়ে আমার অপর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। আর আমার দিকে তাকিয়ে বলল খাবারটা খেয়ে প্লেট টেবিলের উপর রেখে চলে যেতে দরজা চাপিয়ে।
আমি বললাম, ‘ আপনি কোথায় গিয়েছিলেন সত্যি করে বলুন।’
‘শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিলাম হ্যাপি এবার খাবারটা শেষ করো!’
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘কিহ! শশুর বাড়ি গিয়েছিলেন মানে। আপনি বিয়ে করলেন কবে?’
‘ এতো কথা বলো কেন দেখছো না আমি ক্লান্ত তাও আমাকে ডিস্টার্ব না করলে তোমার শান্তি হচ্ছে না তাই না!’
‘ আপনি উত্তর দিচ্ছেন না কেন উত্তরটা দিলে তো আথ আমি জিজ্ঞেস করি না।’
‘খাবার শেষ করা ততক্ষণ আমি জিরিয়ে নেই তারপরে সব বলবো!’
আমি তারাতাড়ি খাওয়া শেষ করলাম।
‘ খাওয়া শেষ এবার বলুন সব।’

ইহানের কোন রেসপন্স পেলাম না। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম মনে হচ্ছে গভীর ঘুম। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম। ঘুমন্ত অবস্থায় অন্য রকম লাগছে আমি আলতো হাত বাড়িয়ে ইহানের নাক চেপে ধরলাম। সাথে সাথে ইহান ধরফরিয়ে উঠে বসলো। আর আমার দিকে রাগী চোখে তাকালো। আমি মুখ টিপে হাসছে।
‘ আর ইউ ম্যাড। তুমি আমার নাক চেপে ধরেছে কেন ইডিয়েট।’
‘ বেশ করেছি। এবার বলুন কোথায় গেছিলেন।’
‘ বললাম তো শশুর বাড়ি।’
‘ আবার মিথ্যা বলছেন সত্যি বলেন’
‘চাচুর সাথে দেখা করতে। আমি তাকে কায়দা করে আনলাম কিন্তু সঠিক সময় তার পাশে থাকতে পারলাম না। এবারও তিনি অপমানিত হয়ে গেছেন নিজেকে খুব অপরাধী লাগছিল তাই আমি গেছিলাম সেখানে আর চাচুর সাথে কিছুটা সময় কাটালাম।
আমি আর কিছু বললাম না। ইহান আমার দিকে তাকিয়ে বললো,’ তোমার মন খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি বাবা চাচুকে মেনে নেবে আর বাড়িতে ফিরিয়ে আনবে।’
আমি বললাম, ‘ সত্যি?’
” হুম!’

‘তখন আমার খুব খারাপ লেগেছিল! চাচাজান আব্বু কে নিয়ে কতোটা খারাপ মন্তব্য করেছিল। আমি খাবার টেবিলে আর এক সেকেন্ড থাকলে কেঁদে দিতাম!’
ইহান আমার হাত আলতো করে ধরে বললো, ‘ গান শুনবে?’
আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, ‘ হুম। শুনাবেন?’
ইহান হাসলো কিছু বললো না। গিটার হাতে বেলকনিতে যেতে লাগলো। আমিও পেছনে গেলাম। ইহান বসে আমাকেও বসতে বললো। আমিও বসে পড়লাম।
ইহান গান ধরলো,
তোমার এলোমেলো চুলে আমার সাদা মনে,
হারিয়ে যেতে চাই কোন হুটতলা রিকশায়,

এক মুঠো প্রেমে নিয়ে আমার শূন্য পকেটে হারাতে দ্বিধা নাই অচেনা গলিতে, এক শহর ভালবাসা দিতে চাই….
গান শুনতে শুনতে আমি ইহানের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরছি‌। ইহান তা দেখে গান থামিয়ে চাঁদের আলোয় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল, ”খুব ভালোবাসি ঊষারানী’
সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে ইমা আপুর রুমে পেয়েছি। রাতে আমি শেষ ইহানের গান শুনতে ছিলাম। তারপর আর কিছু মনে নাই। তারমানে উনিই আমাকে এখানে দিয়ে গেছে তাই হবে হয়তো।
সকালে কোন রকম খাবার খেয়েই আমি চলে এলাম। ইহান আমার সাথে এলো। রিকশায় উঠে বসলাম দুজন। ইহান গাড়ি আনতে চেয়েছিলো আমি মানা করে দিছি। ইহান আর অমত করে নি।
আমি ইহানের দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘ আব্বু জেনে গেছে আমি আপনাদের বাসায় এসেছি। ইমা আপু আপনার বোন সব কিছু তাই না‌।’
ইহান আমার কথা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ হ্যাঁ।’
‘ আমি বাবার সামনের কি করে দাড়াবো। মিথ্যা বলা আমার উচিত হয়নি।’
ইহান আমার দিকে বিরক্তকর চাহনী দিয়ে বললো, ‘গাল ফুলালে এক থাপ্পর মারব ইডিয়েট‌।’
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম।
‘ মানে কি থাপ্পড় মারবেন কেন?’
‘ বাসায় কিছু বলবে না কাল আমি সব জানিয়েছি চাচু কে।’
‘ কিছু বলে নাই‌।’
‘ সেসব জানতে হবে না। কিছু বলবে না তাই চিন্তা করা অফ কর।’

‘ তো এমন গম্ভীর গলায় বলার কি দরকার? একটু নরম গলায় বলা যায় না।‌ আর আমার দিকে একটু তাকান। সামনে তাকিয়ে কি দেখেন? কাল থেকে তো আর আমাকে দেখতে পাবেন না। এখন আমায় দেখবেন তা না সামনে তাকিয়ে আছেন। আপনি কি আমাকে একটুও মিস করবেন না?’
‘ আরেকটা কথা বললে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো রিকশা থেকে। যতসব আজাইরা কথা বার্তা!’ ধমক স্বরে বলল ইহান।
ইহান অন্যদিকে তাকিয়ে বললো বিরবির করে, ‘ এজন্য এই গাধাটাকে জানাতে চাইনি ভালোবাসি। এখন সারাক্ষণ এসব নিয়ে পেছাল পারবে। এদিকে আমার যে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে অন্যরকম বাজে চিন্তা মাথায় আসে। তাকিয়ে থাকতে পারিনা। খারাপ চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায়। এই যে আজ কমলা রঙের থ্রী পিস পরেছে এই রং টাতেও কি অপূর্ব লাগছে আমি চোখ সরাতে পারছি না।

ইহান আমার কথায় রাগ দেখালো তাই রাগ করে পরে বসে আছি। হঠাৎ ইহান আমার কাঁধ চেপে নিজের দিকে টেনে আনলো। আমি চমকে উঠে ইহানের হাঁটু খামচে ধরলাম। ঝাঁকুনিতে এই মুহূর্তে পরতে নিচ্ছিলাম। সময় মতো ইহান আমাকে নিজের দিকে না আনলে আমি শেষ।
বুক এখনো ধুকপুক করছে ভয়ে।
‘ ননসেন্স। এখনি একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলছিলে।
এতো কিনারায় কেন বসেছো আমার সাথে গা ঘেঁষে বসলে কি গায়ে ফোসকা পড়বে নাকি হোয়াই?’
আমি নিচে দিকে তাকিয়ে চুপ করে আছি। ইহানের রাগী কথা শুনে তখন আমি একদম কিনারায় ঘেঁষে বসেছিলাম। তার জন্য ই এমন একটা কান্ড ঘটছিলো। বাসার সামনে আসতেই নেমে পরলাম। ভেতরে ঢুকার পর ইহান তারা দেখিয়ে চলে গেলো। আমি মলিন মুখে তাকিয়ে র‌ইলাম।
বেলকনিতে গিয়ে তাকিয়ে র‌ইলাম। ইহান কাকে যেনো ফোন করছে। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কল করেছে। আমি ভ্রু কুটি করে তাকিয়ে আছি।

আমার হাতের ফোনটা বেজে উঠলো। আমি তাকিয়ে দেখি ইহানের নাম জ্বলজ্বল করছে আমি খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম। তার মানে তখন আমাকে কল করছে। আমি তারা তারি রিসিভ করলাম।
‘ হ্যালো। পেছনে ঘুরেন আমি বারান্দায় দাড়িয়ে আছি।’
‘ জানি‌। আর তখনকার ধমকানোর জন্য সরি। ‘
‘ এখন ভালোবাসা দেখানো হচ্ছে। আপনি আমাকে ধমকালেন কেন?’
‘তো কি করতাম। তখন ভালোবাসা দেখাতে কি চুমু খাওয়া দরকার ছিলো।’
‘ ছিহ কি সব বলছেন?’
‘এখন ছিহ বলছো কেন তুমি এটাই চাইছিলে আমি জানি। ওকে আবার দেখা হলে উসুল করে দিবো।’
‘ আরে আমি।’
ইহান কল কেটে দিয়েছে। আমি গোল গোল করে তাকিয়ে আছি।

ইহান সামনে নাই কোথায় গেলো কথা বলায় এতোটাই মগ্ন ছিলাম কখন চলে গেছে টের পায় নি।
রাতে ডিনার টেবিলে মাথা নিচু করে বসে আছি। আব্বু কে মিথ্যা বলেছিলাম তাই খুব কষ্ট পাচ্ছি। আব্বু কিছু বলবে ভেবে কিন্তু এসব নিয়ে কিছুই বললো না তিনি। স্বাভাবিক ভাবেই কথা বললো। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
নানু বাড়ি যাবার সিদ্ধান্ত হলো আমি আর আম্মু যাবো। আব্বু বাসায় থাকবে তার অফিস আছে।
ইহানকে কল করে জানিয়ে দিয়েছি। এক সপ্তাহের মতো থাকবো।

এই এক সপ্তাহ ইহানের সাথে দেখা হবে না ভাবতেই খারাপ লাগছে যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু তা তো বলা যায় না কিছুদিন আগের যাওয়ার জন্য পাগল ছিলাম হঠাৎ না যেতে চাইলে কি বলবো।
নানু বাড়ি এসেই দুপুরের খাবার খেলাম। তারপর এক ঘুম দিলাম‌। বিকেলে উঠেই আমি আর লিনার সাথে হাঁটতে বের হলাম। সন্ধ্যায় বেরিয়েছি তাই একটু গিয়ে ফিরে এলাম। তখন জানতে পারলাম তুষারের সাথে ওর কথা বলা অফ হয়ে গেছে। ও তুষারের কথা বলতে গিয়ে মলিন মুখে ছিলো। পছন্দ করত বুঝা যাচ্ছে। আম্মুকে কথা দেওয়ায় সে পথে আর পা বাড়ায় নি। আমি ঢোক গিলে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। ইহানের কথা বলেও জানতে দেওয়া যাবে না।
এখন সমস্যা হলো ওর সাথে থেকে আমি ইহানের সাথে কথা বলবো কি করে? চিন্তায় নখ কামড়াচ্ছি।
তা দেখে লিনা জিজ্ঞেস করলো আমি এতো কি চিন্তা করছি।’
আমি থতমত খেয়ে বললাম কিছু না।

লিনার পাশে আমাকে সাবধানে থাকতে হবে। ও জানতে পারলে আম্মুকে জানাতে এক সেকেন্ড নিবে না। রাতে ইহানের কল এলো কিন্তু লিনার জন্য রিসিভ করতে পারলাম না। রাগে আমি দাঁত কিড়মিড় করে সামির রুমে এলাম‌। ছোট মামি ওকে বকা ঝকা করে পড়াচ্ছেন। আমি সেখানে বসে থেকে বিরক্ত হয়ে দিনা নিসার রুমে গেলাম দুজনে কলম নিয়ে ঝগড়া করছে। আমি রুমে বড় কাউকে না দেখে সাথে পারত ইহান কে কল করলাম কিন্তু রিং হ‌ওয়ার আগেই দেখলাম মামা আসছে তারাতাড়ি ফোন লুকিয়ে ফেললাম। আর হাসার চেষ্টা করে মামাকে বললাম,

‘ এক কলম নিয়ে দু’জন কেমন ঝগড়া করছে দেখেন মামা‌।’
মামা বললো, ওদের ঝগড়ার কারণ নাই। শত এনে দাও তাও এরা ঝগড়া করবেই কিছু না কিছু নিয়ে। এই পাজির দল যা খেতে ডাকছে আম্মু খেয়ে আয়।’
দুজনেই মামার কথা শুনে ছুটে চলে গেলো। আমি ও বেরিয়ে এলাম। রাগ মাথায় নিয়ে শুয়ে আছি। লিনা বের হলে আমি কল করবো কিন্তু ও বের হলো না তুষারকে নিয়ে দুঃখের কথা বলছে আমি বিরক্ত হয়েই শুনছি কখন ঘুমিয়েছি জানি না।

সকালে উঠে অনেকগুলো মিসকল দেখলাম। আর সাথে সাথেই ঘুম ছুটে গেলো। আমি উঠে ফোন কানে নিলাম। কোন দিকে নজর না দিয়ে কল দিলাম কিন্তু নো রিসিভ। সামি দৌড়ে এসে বললো,
‘ বাইরে আসো তাড়াতাড়ি ঊষা আপু।’
আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে দেখলাম সবাই খেতে বসে পরেছে। আটটা দশ বাজে সবাই খাওয়া শেষের দিকে। আমি যেতেই আম্মু বললো, খেয়ে নে ফ্রেশ হয়েছিস?
‘ হুম।’
খাওয়া হতেই দিনা নিসা আমার হাত ধরে বললো,
‘ আপু চলো পুকুর পাড়ে যাই। ছোটো কাকা মাছ ধরছে‌!’
আমি অবাক গলাতেই বললাম, ‘ কিহ? মামা মাছ ধরতাছে?’
‘ হুম চলো। দেখে আসি।’
‘ আচ্ছা।’

মামা মাছ ধরবে শুনে অবাক হয়েছি। নানু বাহির দক্ষিণ পাশে একটা পুকুর বেশি পানি নাই‌ কাঁদা পানি সেখানে ছোটো মামা সাথে আর অনেকে আছে তাদের আমি চিনি না। সামি এসেই লাফিয়ে পরলো কাঁদাতে তা দেখে এক ধমক দিলো মামা।
দিনা নিসা ও একদম কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি করছে। আমি উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছি। আগে কখনো নিজে চোখে মাছ ধরা দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আজ আমি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছি। তখন ইহানের কল এলো আমি রিসিভ করেই উৎসাহিত গলায় বললাম,

‘ আমি মাছ ধরা দেখছি। ছোট মামা কাঁদায় নেমে মাছ ধরছে।’
‘ তাই আমিও তো দেখছি‌। তোমার ও ধরার ইচ্ছে আছে নাকি?
‘ ধুর আমি কেন ধরবো? ছিহ কি ময়লা নোংরা পানি আমার তো দেখেই কেমন লাগছে। এটা দেখতেই আমার ভালো লাগছে নামার শখ নাই। কিন্তু আপনি দেখলেন কি করে?’
‘ ইটস ম্যাজিক!’
‘ কি আবুল তাবুল বলছেন। আপনি মাছ ধরা কোথায় দেখেছেন বলেন? কে ধরেছে?’
‘ তোমার মামা।’
‘ আপনার মাথা গেছে।আমার মামাকে আপনি মাছ ধরতে দেখলেন কি করে? এখন আপনি কিন্তু আমার সাথে ফাজলামি করছেন!’

‘ তাই। আচ্ছা কাল ফোন রিসিভ করলে না কেন?? সকালের কল করলাম পাত্তা নাই। মামা বাড়ি এসে ভাব বেড়ে গেছে তাই না আমাকে ভাব দেখাচ্ছ?’
‘ অনেক ঝামেলায় আছি আমি। আর যতদিন আছি আপনার সাথে কথা বলা যাবে না। ওই লিনাটা সারদিন আমার সাথে চিপকে থাকে। ‘
বলতে বলতে সামনে পা বাড়াচ্ছি। আমার সামনে যে এতো বড় পুকুর আমার খেয়াল নাই। এই ইহানের সাথে কথা বলতে গেলে আমি সব ভুলে খেয়ে ফেলি। এখনো তাই হচ্ছে। আমি পাটা ফেললেই পুকুরে গরিয়ে যাব‌। তখন ইহান চেঁচিয়ে উঠে বললো,
‘ তারাতাড়ি পিছনে যাও। স্টুপিড পরে গেলে তো!’
আমি বুঝতে না পেরে পা রেখে কিছু বলতে যাব পেছনে থেকে একটা হাত আমাকে টেনে পেছনে নিয়ে বললো,
‘ এই তোর মাথা গেছে নাকি এখনি তো গড়িয়ে পুকুরে পরতি‌। এতো অন্যমনষ্ক হয়ে কার সাথে ফোনে কথা বলছিলি হ্যা।

লিনার কথা শুনে ফোন লুকিয়ে বুকে ফূ দিতে থাকি‌‌। এখানে থেকে পরলে মরতাম না কিন্তু ব্যাথা পেতে আর কাঁদায় নাকানিচোবানি খেতাম। ইহান আমাকে সাবধান হতে বললো কি করছ উনি আমার এই খবর পেলো কিভাবে? কি হচ্ছে এসব?

আমি ফোন কানে নিতেও পারছি না। কিন্তু বুঝতে বাকি রইলো না। হঠাৎ সামনে পুকুরের অপর পাশে চোখ যেতে হতবিহ্বল হয়ে গেলাম। ইহান দাঁড়িয়ে আছে কাঁধে একটা ব্যাগ আর মুখে হাসি আমি তাকাতেই হাই দিলো।
আমি ইহানকে দেখে আর এক সেকেন্ড ওখানে দাঁড়ালাম লিনার হাত ধরে টেনে নানুর বাসায় চলে এলাম। এছাড়া তার উপায় ছিল না। লিনা যদি ইহানকে দেখে তাহলে তো ধরে ফেলবে ও এমনিতেই আমার বয়-ফ্রেন্ড মনে করত ইহানকে। আর এখন যদি এখানেই ইহানকে এখানে দেখে তাহলে তো ভাববে আমার জন্য ইহান এসেছে। আমি রিক্স নিতে পারলাম না। তাই বিস্ময়ের সাথে ভয় পেয়ে দৌড়ে চলে এসেছি। ইহান পেছনে থেকে অবাক চোখে আমাদের যাওয়া দেখলো। তারপর হো হো করে হেসে উঠলো।

বাসায় আসতেই লিনা আমাকে চেপে ধরলো,
‘ এই তুই আমাকে এইভাবে টেনে আপনি কেন? কি হয়েছে?’
‘ আমার না খুব পানির পিপাসা লাগছিল তাই।’
‘ তো তুই আসতি আমাকে কেন টেনে আনলি। এমন ভাবে আনলি যেনো ভূত দেখছিস?’
‘ এমন না আসলে..
‘ এই তুই তোতলাচ্ছিস কেন?’
‘ ক‌ই না তো দাঁড়া পানি খেয়ে আসি।
রান্নাঘরে থেকে পানি খেয়ে আসতেই লিনার কথা থমকে গেলাম।
‘ এই ঊষা তারাতাড়ি চল তো‌ ওইখানে আমি ইহান ভাইকে দেখলাম মনে হলো। চল তো দেখি উনি এখানে কি করছে?’
‘ ক‌ই না তো আমি তো কাউকে দেখলাম না। কি দেখতে কি দেখছিস তুই তাকে ইহান বানিয়ে দিলি‌। চল রুমে যাই ফেসবুক একটা জিনিস দেখাবো নি। ওইখানে আর যেতে ইচ্ছে করছে না। ‘

বলেই আমি লিনার হাত টেনে ধরলাম। লিনা হাত ছাড়িয়ে বললো,
‘ না না আমি এখন কিচ্ছু টি দেখবো না। তুই যা রুমে আমি দেখে আসি আগে।’
‘ আরে দাঁড়া যাস না তুই ভুল দেখছিস ইহান এখানে কেন আসবে একবার ভাব।’
‘ সেটাই তো ভেবে যাচ্ছি। উনি এখানে কি করছে আমার জানতেই হবে।’
আমি চেয়েও লিনা কে আটকাতে পারলাম না। মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি। এখন কি হবে উনি এখানে কেন এসেছেন? এখন কি হবে?
আমি পায়চারি করছি একবার যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছি তো পিছিয়ে নিচ্ছি। হঠাৎ আম্মু এসে আমাকে বললো,
‘ কিরে এমন হাঁসফাঁস করছিস কেন?’
‘ না মানে আম্মু!’
‘ কিসের মানে করছিস চল আমার সাথে’
বলেই হাত ধরে হাঁটতে লাগলো।

‘ আম্মু তুমি আবার আমাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?’
আম্মু কিছু বলবে তখন ই ইহানের আওয়াজ শুনে আমার পিল চমকে উঠলো। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি ইহান সামি আর লিনা এগিয়ে আসছে। আমমু্ ইহানের আওয়াজ শুনে আমার হাত ছাড়িয়ে হাসিমুখে চলে গেলো। ইহান আম্মুর সাথে হেসে কথা বলছে। আম্মু ইহানকে জিজ্ঞেস করছে,
‘ আসতে কোন অসুবিধা হয়নি তো?’
‘ একটুও না এ তো সোজা রাস্তা।’
‘ তোমার চিন্তায় করছিলাম। চলো ভেতরে চলো ফ্রেশ হয়ে কিছু খেয়ে নিবে।’
ইহান মাথা দুলিয়ে ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। লিনা সামি ও গেলো আমি বোকা চোখে তাকিয়ে আছি। কিছু আমার মাথায় ঢুকছে না। আমি স্তব্ধ হয়ে আছি। ইহান কয়েক টা এগিয়ে আবার ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মারলো। আমি চমকে এদিক ও দিকে তাকাতে লাগলো।

আমি দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছি আর ড্রাইনিং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে ড্রাইনিং টেবিলে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। যেখানে বাসার সবাই একজনের আদর আপ্যায়নে বিজি। সেই মানুষটি আর কেউ না ইহান। যাকে দেখে আমার ভয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হতে যাচ্ছিল এখন সেই কিনা স্পেশাল গেস্ট হিসেবে খাবার ভর্তি টেবিলে বসে আছে। সবাই তার তদারকি করছে। সবাই যখন জানতে পেরেছে ইহান

আমার বড় চাচার ছেলে তখন থেকেই সবাই ইহানের দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছে। খুব খেয়াল রাখছে। আম্মুর থেকে জানতে পারলাম। ইহান নাকি কাল কল করে আম্মু কে বলেছে ও কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবছে কিন্তু কোথায় যাবে বুঝতে পারছে না। তখন আম্মু না কি অফার করেছে এখানে আসতে। আর ইহান তো এটাই চাইছিল তাই সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেছে।আর সকাল সকাল চলে এসেছে। ভাবা যায় কি একটা অবস্থা। আমাকে আগে জানালে কি হতো? আমার কি অবস্থা হচ্ছিল। খাটাশ একটা।
আমি দাঁত কিড়মিড় করে তাকিয়ে আছি।

ইহান নানুদের শ্যাওলা পড়া ছাদে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে সন্ধ্যায়। আমি তা দেখে এদিক ওদিক তাকিয়ে বড় বড় পা ফেলে ইহানের পেছনে এসে দাঁড়ালাম। কান খাড়া করে কথা শুনছি ইহান ফারিয়ার সাথে কথা বলছে। রাগে আমার নাকের পাটা ফুলে উঠছে।
ইহান আমার দিকে তাকাতেই আমি বললাম,
‘ আপনি এতো খারাপ কেনো বলেন তো?’
ইহান মোবাইল পকেটে রেখে এক হাত পকেটে পুড়ে আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে র‌ইল। কথা বলছে না।আমি কপাল‌ কুঁচকে আবার বললাম,

‘ কথা বলছেন না কেন? আপনি এইভাবে এখানে চলে এলেন! আর আমাকে একটু বললেন ও না!’
‘কেন বললে কি করতে? আমার জন্য সেজেগুজে অর্ধেক রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে নাকি?’
‘ বাজে বকছেন কেন? আপনি জানেন তখন ওইভাবে আপনাকে দেখে আমি ভূত দেখার মতো চমকিয়েছি! আবার বাসায় এলে আম্মুর সাথে এতো প্ল্যান উফ কিচ্ছু টি আমি জানতে পারলাম না। সব আমার অগোচরে হলো!’
‘ এটা তোমার জন্য সারপ্রাইজ ছিলো ঊষা। আগে থেকে বলে দিলে কি তুমি সারপ্রাইজ হতে?’
‘ এমন অদ্ভুত সারপ্রাইজ কে দিতে বলেছে আপনাকে? যত্তসব ফালতু কাজ।’
‘ তুমি অন্য কোন কারনে রাগ করেছো? আই মিন জেলাস ফিল করছো মনে হচ্ছে রাগটা আমার না বলে আসায় না অন্য জায়গায়!!’

আমি থতমত খেয়ে গেলাম। হাত উঁচিয়ে চুল ঠিক করার বাহানায় জ্বিভে কামড় দিলাম। ইহান বুঝে গেল নাকি আমি ফারিয়ার সাথে কথা বলা শুনে জেলাস হয়েছি? এই মানুষটা সব বুঝে যায় কি করে?
‘ মুখ লুকিয়ে কি হবে? আমি তো যা বুঝার বুঝে গেছি।’
‘ কি বুঝলেন?’
‘ তুমি ফারিয়ার সাথে কথা বলাটা সহ্য করতে পারো না। বাট আমি তোমার জন্য ফারিয়ার সাথে কথা বলা অফ করতে পারবো না। শি ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড। ও আমাকে নিয়ে যাই ভাবুক না কেন এসবের আগে আমরা বন্ধু। আর তোমার আমাকে নিয়ে সন্দেহ করার কোন মানে দেখছি না। কারণ আমার যদি ফারিয়াকে গ্ৰহণ করার হতো আমি আগেই করতে পারতাম। কিন্তু…
‘ কিন্তু কি?”

‘ এখন তো আমি অন্য কারো মায়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছি। এখন আর কিভাবে ওর প্রতি আমার ফিলিংস আসবে।’
‘সেই অন্য কেউটা কে?’
আমার কথা শুনে এগিয়ে আমার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি ধরা খেয়ে চোরের মত মুখ করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। ইশ ইহান সব বুঝে যায় কিভাবে। ইহান ঝুঁকে পড়ে আমার কানের মুখ নিয়ে বলে উঠল,
‘এই যে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।এই বাচ্চা মেয়েটা। যার জন্য এতো কষ্ট করে আমি এখানে চলে এলাম আর তুমি কিনা আমাকে দেখে পালিয়ে এলে। ইটস নট ফেরার ঊষা।’

আমি চোখ খিচে বন্ধ করে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। ইহান এতো কাছে আসছে কেন আমি তো মরে যাব এবার। ইহান আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো,
‘ এতো কাঁপছো কেন?’
‘ আপনি প্লিজ সরে দাঁড়ান আমার কেমন জানি লাগছে!’
‘ কেমন লাগছে?’
‘ জানি না। দূর থেকে কথা বলেন এতো কাছে আসেন কেন। আমি তো সহ্য করতে পারি না।’
‘ তাই তাহলে আরেকটু কাছে আসি।’
বলেই ইহান ফট করেই ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো আমার গলায়। আমার সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। দুহাত উঁচু করে ইহানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম।
আর জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলাম।

বেরাতে বের হয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমার আর বেড়ানো হবে না। কারণ সামনে যে বড় বাসের একটা পুলের রাস্তা দেখছি। এটা পার হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় এটা দেখেই তো আমার হাঁটু কাঁপা শুরু হয়ে গেছে। বাচ্চা সামি ও এটা পার করে ফেললো আর আমি পা রাখতে পারলাম না।
ইহান তো সবার আগে পার হয়েছে। আমি এ পাশে হাতল ধরে চেচিয়ে বললাম,
‘আমি রাস্তা পার হতে পারব না আমি বেড়াতে যাব না। লিনা তোরা চলে যা আমি বাসায় ফিরে যাব।’
আমার কথা শুনেই রেগে আগুন হয়ে আমার দিকে তাকাল। এতক্ষণ লোকটা আমার কথা ভুলে গেছো।
যাবে না কেন তিনি তো ছবি তুলছিলো‌। উনি যে এত ফটোগ্রাফি করে আগে আমার জানা ছিল না। কিছুটা মন ক্ষুন্ন ও হয়েছি ওনার এমন ব্যবহার। ইহান সাথে সাথে আবার পুল পেরে আমার কাছে চলে এলো।

‘হোয়াট ঊষা কি সব বলছো তুমি যাবে না মানে কি??’
‘যাব না মানে যাব না এটার আবার মানে কি আছে?’
‘যাবে না কেন? এত বড় রাস্তা করে রাখছে তাও তুমি ভয় পাচ্ছ এত ভীতু তুমি!’
‘একদম আমাকে ভীতু বলবেন না। কেমন বাঁশ নরবর করছে আমি এটার উপর যে কিছুতেই যাব না। একবার এটা ভেঙে গেলে আমি এই নদীতে পড়ে যাব।আর আমি সাতার পারি না তখন আমি নদীতে ডুবে মরব দরকার নাই ভাই আমার বেড়ানোর।’
‘কি বললে তুমি?’

‘আমি আবার কী বললাম! আপনি কালা নাকি। কানে শুনতে পান না এক কথা কতবার বলব?’
‘তুমি আমাকে আবার ভাই বললে! এবার কিন্তু থাপ্পর মেরে গাল লাল করে দেব চল আমার সাথে।’
বলে হাত ধরে বাশেরপুল এর উপর টেনে তুলল। আমি আঁতকে ওঠে চিৎকার করতে লাগলো।
‘আমি যাব না বললাম তো আমি পড়ে যাব মরে যাব। ‘
‘তুমি যেমন চেচাচ্ছো আর লাফালাফি করছো এমন করলে সত্যি পড়ে হয়ে যাবে। আর এইটা তো এক বাঁশের না। কতগুলা বাশ দিয়ে বড় রাস্তা তৈরি করেছে কত ছোট ছোট বাচ্চারা যাচ্ছে কিচ্ছু হচ্ছে না তুমি এখানে ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে আছো।’

সামনে তাকিয়ে ছিলাম সত্যি কথা 3 বছরের বাচ্চার মায়ের হাত ধরে যাচ্ছে। আমি খানিক লজ্জা পেলাম। কিন্তু বাশ অনেকগুলো থাকলেও তো ফাঁকা ফাঁকা আমার মনে হয় আমার পা ওইখান দিয়ে ঢুকে যাবে।
দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে রাস্তা পার হলাম। নড়াচড়া হলেও সত্যি আমি সুস্থ মতোই এপারে আসতে পেরেছি। এই পাশে এসে আমি লাফিয়ে উঠলাম। আমার অগোচরে ইহান অনেক গুলা পিকচার তুলে নিল। যা আমি জানতেই পারলাম না।

নদীর এই বছরটা বাগানের মত আছে। গাছগাছালি পরিবেশ টা দারুন। নিরিবিলি। অনেক মানুষ এখানে বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে। মনটা ফুরফুর হয়ে ওঠে এখানে মুক্ত বাতাসে। আমার খোলা চুল তো এই বাতাসে শুধু দোল খাচ্ছিল। আমি সামলে উঠতে পারছিলাম না। দিনা নিসার পরীক্ষাগুলোর আসতে পারেনি। ওদের জন্য একটু মন খারাপ হয়েছিল।

লিনা কে নিয়ে আমি যে ভয় পেয়েছিলাম ও তেমন কোনো সন্দেহ করেনি। আরো আগে ওরকম সন্দেহ করেছিল বলে লজ্জা পেয়েছে কারণ ও এখন জানতে পেরেছি ইহান আমার চাচাতো ভাই। তাই এমন সন্দেহ আর করে না। ইহানের সাথে ওর ও অনেক ভাব হয়ে গেছে।
দুইদিন থেকেই ইহান চলে গেল। আমরা এক সপ্তাহ পরেই ঢাকা এলাম। এর মধ্যে লুকিয়ে চুরিয়ে কথা হয়েছে আমার ইহানের সাথে। মাঝে মাঝে লিনার সামনে পরে গেছি কিন্তু অদ্ভুত ও তেমন কিছুই বলেনি। স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছে। বুঝলাম না ও কি ভাই শুনেছে বলেই এমন করছে!

ঢাকা আসার পর‌ই কলেজ ভর্তির প্রস্তুতি নিতে হলো। সময় ভালোই যাচ্ছিল। ইহানের সাথে কথা বলা মাঝে মাঝে ফোন না ধরার জন্য আমার রাগ করা‌, রাগ ভাঙাতে ইহানকে আমাদের বাড়ি আসতেই হতো কারণ আমি তো ফোন অফ করে রাখতাম।
এবার ও তাই হয়েছে কাল ইহানকে আমি অনেক কল করছি কিন্তু রিসিভ করেনি। তাই আমি রাগ করে ফোন অফ করে রেখেছি। আমার কথা তুই যত‌ই বিজি থাক না কেন রিসিভ করে আমাকে বললে কি ক্ষতি। না কারণ সারাদিন আমার একটা কল ও রিসিভ করে নি‌। কি এত ব্যস্ততা তার যে এক একটা দিন কল রিসিভ করলো না। সব সময় এক দুই ঘন্টা রিসিভ করে না কিন্তু কাল তো।

শুধু কি তাই ফোনটা অফ করে রেখেছে একদম কল তো ঢুকেই নি। আমি সিউর আমার কল না ঢুকতে পারে যেন এমনটা ভেবেই এমন করেছে।

আমি তাই আরো রেগে আছি। সকাল থেকে আমি মেইন দরজার দিকে তাকিয়ে আছি। এই বুঝি ইহান এলো। দিন গরিয়ে বিকেল হয়েছে এখনও আসিনি। আমি মনখারাপ করে বসে আছি। আজ কি তাহলে আসবে না। আমার রাগ ভাঙাতে। কি হলো উনার! দুশ্চিন্তা হতে লাগলো। আমি ফোন বের করে অন করলাম। এখনো ইহানের নাম্বার অফ আমি ফোন হাত নিয়ে পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ির নাম্বারে কল করলাম। বাসার নাম্বারে কল রিসিভ করলো কাজের ছেলে। আমি ওর থেকে যা শুনলাম তা শুনে আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ইহান এক্সিডেন্ট করেছে বাইকে। বাইক এক্সিডেন্ট খুব খারাপ। বাইক এক্সিডেন্ট এ অহরহ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। আর বেঁচে থাকলেও পঙ্গু হয়ে যায়। ইহান কেমন আঘাত পেয়েছে জিগ্গেস করলে বলে,

‘ইহান বাবাজি হাসপাতালে আছেন। বাড়ির সবাই সেইখানে গেছে। কিরম ধুক্কু পাইছে জানি না। মেডাম যে মন ক‌ইরা কাদতাছিল। তাতে মনে হ‌ইতাছে ভালোই লাগছে।’
তার কথা শুনে আমার কলিজা কেঁপে উঠলো। আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম।
আমি ফুপানির আওয়াজ শুনে আম্মু দৌড়ে এলো।
‘ কি হয়েছে কাঁদছিস কেন?’
অবাক গলাতেই জিগ্গেস করলো। আমি কাঁদতে কাঁদতে সব খুলে বললাম। আম্মু ইহান কথা শুনে ইমোশনাল হয়ে গেলো। কয়েকদিন এ অনেক ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। সাথে আমাকে এভাবে কান্না করতে দেখে বিস্মিত হয়েছে।

‘ আম্মু আমি ইহান ভাইকে দেখতে যাব প্লিজ।’
‘ সে তো আমি যাব কোন হসপিটালে জানিস?”
‘ না তো। দাঁড়াও জেনে নেই।”
বলেই আমি আবার কল করলাম। এবার রিসিভ করে বললো, ‘ হাসপাতালে যাইবা ক্যা বাসায় আহ। ইহান বাবাজি কে নিয়ে তো সবাই বাড়ি আসছে।’
‘ ব্যাথা কেমন পাইছে!’
‘ খুড়াতে খুড়াতে হাঁটছে। মাথায় ব্যান্ডেজ ।’
আম্মু কে সব বললাম। বাসায় তো আম্মু যেতে পারবে না। তাই কি করবে ভাবছে আব্বুকে ও কল করে জানিয়ে দিয়েছে।

‘তোমরা যেতে না পারলেও আমি তো পারবো। আমাকে যেতে দাও।’
‘ তুই যাবি! রাত হয়ে এসেছে।’
‘ হ্যা আম্মু প্লিজ। আমি গিয়ে ভালো করে দেখে খবর নিয়ে আসি। আব্বুকে তুমি বলে দিও আমি রেডি হয়ে আসছি।’
বলেই রুমে চলে এলাম। আম্মু আমার এমন ছটফটানি দেখে অবাক হতেই আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু বলবে না তিনি। আমমু কিছু একটা সন্দেহ করলো। আর চুপ করেই সম্মতি দিলো। সন্ধ্যা বিধায় আমাকে বাসার ড্রাইভার কাকাই দিয়ে এলো। সারা রাস্তা আমার কেমন লেগেছে বুঝাতে পারবো না। ইহান এক্সিডেন্ট করে বসে আছে আর আমি কিনা রাগ করে গাল ফুলিয়ে ছিলাম ছিহ।

এই সন্ধ্যায় আমাকে দেখে বাসার সবাই হলো এ বাসায়। আমি ইহানের জন্য কোন কিছু না ভেবে যে চলে এসেছি এবার কি বলবো? কিন্তু ইমা আপুকে এ বাসায় দেখে যেন কিছুটা হলেও স্বস্তি পেলাম।
আপুই আমাকে সব প্রশ্ন থেকে বাঁচিয়ে দিলো। কেউ আর কোন প্রশ্ন করলো না। আপু সাথে আসতেই আপু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো,
‘ তুই ইহানের খবর পেলি কি করে? আর খবর পেয়েই এইভাবে ছুটে এলি এখন যে রাত সেটা দেখেছিস! এতো ভালোবাসিস আমার এই ভাইটাকে।’

আমি বড় বড় চোখ করে আপুর দিকে তাকালাম। লজ্জা আমার কান গরম হয়ে উঠলো। আপু জানালো কি করে আমি ইহানকে ভালোবাসি‌। আমাকে এইভাবে আস্তে দেখেই মনে হয় সন্দেহ করেছে। আমি ঢোক গিলে বললাম,
‘ কি যাতা বলতো আপু? এমন কিছু না। আববু আম্মু শুনেই পাগল হয়ে উঠেছে তারা তো আসতে পারবে না তাই আমাকে পাঠিয়েছে। আর উনি আমার ভাই হন ভালো তো বাসবোই।’
‘ শুধু কি সেই ভালোবাসা নাকি আরো কিছু আমি জানি সব। আমাকে গল্প বানিয়ে বলার দরকার নাই। ইহান যে প্রেমে দেওয়ানা হয়ে একদম মামা শ্বশুর এর বাড়ি চলে গেছিলো আমি কিন্তু সব জেনে গেছি।’

আমি বিষ্ময়ের চরম সীমায় পৌছে গেলাম। আপুর কথা শুনে। ইহান কি তাহলে সব আপুকে জানিয়ে দিয়েছেন ইশ কি লজ্জা এই ভাবেই আমাকে লজ্জা দিলো। আপু আর লজ্জা রাঙ্গা মুখ দেখে হো হো করে হেসে উঠে গাল টেনে দিলো। তারপর ইহানের রুমের সামনে এসে বললো,
‘ যা ভেতরে আছে ইহান দেখা করে আয়।’

বলেই আপু চলে গেলো।আমি হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ইহানের কথা মাথায় এতেই সব ভুলে ভেতরে চলে গেলাম। ইহান চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। পায়ে ব্যান্ডেজ মাথায় ব্যান্ডেজ। মুখটা শুকিয়ে গেছে। আমি আস্তে আস্তে শব্দহীন পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ালাম একদম কাছে। ইহান মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছে। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটু করে হাত ছুঁয়ে দিলাম। ইহানের বড় কোন ক্ষতি হয়নি ‌ দুইদিন রেস্ট নিলেই সেড়ে উঠবে আপু বলেছে। আমি সরে এসে চলে আসার কথা ভাবলাম। আপীল রুমে দিয়ে গেছে এখন বেশি সময় একা থাকলে কিছু মনে করে যদি আমি চলে যাই দেখা তো হল‌ই। আর ইহানকে ডাকতেও ইচ্ছে করছে না উনি রেস্ট নিক। আমার তো দেখা হলোই‌।

আমার ভাবনা ভেবে আর সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে আসতে গেলে হাতে টান পরে। ইহান হাত ধরে তাকিয়ে আছে। আমি চমকে পেছনে ফিরে তাকিয়েছি।
‘ আপনি উঠে গেছেন?’
‘ তুমি রাতে এখানে এলে কি করে?’
‘ বাসার গাড়ি নিয়ে এসেছি। চলে যাব এখন।’
‘ তোমার এভাবে আসা উচিত হয়নি। চাচি কি ভাবছেন কে জানে।’
‘ আমি এক্সিডেন্ট এর খবর শুনে খুব বিচলিত হয়ে পরে ছিলাম। আপনার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিল এক নজর না দেখে থাকতে পারতাম না তাই…

‘ সবাই কি ভাববে এই ভাবে কেউ আসে আমাকে কল করতে পারতে!’
‘ আমি কল করেছিলাম অনেকবার কিন্তু নাম্বার অফ কাল থেকে।’
‘ ওহ শিট চার্জ নাই তাই তো বন্ধ হয়ে গেছিলো ফোন পরে বাসায় এসে চার্জ দিয়ে কল দিবো ভেবেছিলাম কিন্তু রাস্তা ওই এক্সিডেন্ট তারপর তো আমি রাতে ওইখানেই ছিলাম। সারাদিন তো সব আত্নীয় রা দেখতে এসে ভীর করেছে হাসপাতালে তাই আমি আর ফোনের খোঁজ নিতে পারিনি।’
‘ ওহ আমি খুব রাগ করেছিলাম আপনার উপর পরে যখন উসমান আলীর থেকে জানতে পারলাম আপনি এক্সিডেন্ট করেছেন খবরটা শুনে আমার তো দম বের হয়ে আসছিলো‌। আমার এক মুহূর্তে জন্য মনে হচ্ছিল আমি আপনাকে হারিয়ে ফেলেছি।’

ইহান টেনে আমাকে নিজের পাশে বসতে ইশারা করলো। আমি নিঃশব্দে বসে পরলাম। ইহান হাত বাড়িয়ে আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
‘তুমি এতো ছিদকাদুনি হলে কবে থেকে? আরে আমি তো মরে যাই নি‌। সামান্য আঘাত। এজন্য কেউ এমন পাগলামী করে।’
আমি নাক টানতে টানতে বললাম, ‘ আপনি আমাকে ছিদকাদুনি বললেন??’
‘ তো কি বলবো। এই টুকু তে একদম নাকের জল চোখের জল এক করে ফেলেছো‌। আমি যদি সত্যি মরে যেতাম তো কি করতে?’
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম।

‘ আপনি আসলে খুব খারাপ। এই কথা বলতে আপনার কলিজা কাপলো না। একেতে এমন অবস্থা করে সবার কাছ আমাকে নির্লজ্জ করে তুলেছেন। ইমা আপুকে সব কেন বলেছেন হ্যাঁ। ইশ কি লজ্জাটাই না পেলাম। আপনি এটা কেন করলেন। আর বললেন তো বললেন আমাকে জানালেন ও না। আমি আপুকে মুখ দেখাবো কি করে।’
‘ হোয়াট ইমা আপুকে এসব কে বলেছে? আমি তো কিছু বলিনি। কি সব বলছো?’
‘ফাজলামি পেয়েছেন আপনি না বললে কে বলেছে শুনি!’

‘ আমি কি জানি? কিন্তু আমি কিছু বলিনি। পাগল নাকি বড় বোনকে প্রেমের হিস্টুরি বলতে যাব।’
এবার আমি টেনশনে পরে গেলাম ইহান না জানালে এসব কে বললো। আপু ই বা জানলো কি করে?
টেনশন মাথায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। নিচে আসতেই চাচির মুখোমুখি হলাম। কেমন চোরা চোখে তাকিয়ে আছে। আমি ঢোক গিলে ইমা আপুকে খুঁজছি।

‘ তোমার বাবা মা আসতে দিলো এই রাতের বেলা ইমার সাথে দেখা করতে!’
আমি বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ মানে।’
‘ আরে তোমার বাবা মা তো দেখি বেশি চিন্তা ভাবনা করে না মাইয়া নিয়া। না হলে কি আর আসতে দেয়। ইমা তো এই কয়দিন আছেই এই রাতে না আইসা
কাল ও তো ওর সাথে দেখা করতে পারতা ।’
আমি এবার বুঝতে পারলাম ইমা আপু বোধহয় বলেছে আমি তার সাথে দেখা করতে এসেছি। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললাম,

‘ সমস্যা নাই। গাড়ি নিয়ে এসেছি বাসা তো বেশি দূরে না যেতে সমস্যা হবে না। আসি ভালো থাকবেন।’
ইহানের পরিক্ষা চলে আসায় ও লেখাপড়া নিয়ে বিজি হয়ে গেছে আজ আমি ও কলেজে ভর্তি হওয়া নিয়ে ব্যস্ত। ইহানের কলেজে ভর্তি পরিক্ষা দিয়েও আমি চান্স পেলাম না। তাই মন খারাপ করে ছিলাম। কিন্তু ইহান ফোনে সেদিন বললো,

‘ তুমি আমার ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারো নি বলে এতো মন খারাপ কেন করছো! আমি তো মাস্টার্সে এখানে পারবো না। তাহলে এখানে চান্স পেলে তোমার কি লাভ হতো শুনি? এতো গাধা কেন তুমি!!’
আমি নিজের বোকামি বুঝতে পেরে লজ্জায় পেয়েছিলাম। ইহানের তো অনার্স পড়া শেষ। এখন পরিক্ষা দিলেই আর ওই কলেজে যাবে না। আমি তাই জিজ্ঞেস করলাম আপনি কোন ভার্সিটিতে পরবেন আমি সেখানের কলেজে পরব।
তখন ইহান বললো, ‘ আমি যেখানে পারবো সেখানে কলেজ নাই।’
‘ তাহলে আপনার সাথে আমার এক কলেজে পরা হবে না।’ মন খারাপ করে বললাম।

ইহান তখন বললো, ‘ তুমি এতো ছোট কেন বলো তো। আর একটু বড় হতে পারলে না। আমি এতো পিচ্চি ব‌উ বুঝাতে বুঝাতেই বুড়ো হয়ে যাব। আরে এক কলেজে পড়ার কি দরকার? তুমি যখন চাইবে আমি তখনি তোমার কাছে চলে যাব। এক কলেজে থাকার প্রয়োজন নাই‌।’

কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম। তুলি রা কেউ আমার সাথে ভর্তি হতে পারিনি। একেক জন একেক কলেজে ভর্তি হয়েছে। সবার ই এজন্য মনটা খারাপ। পাঁচবছর এক সাথে পরেছি এখন আলাদা হয়ে গেলাম। কিন্তু কিছু করার নাই‌। আমাদের বাসা থেকে একটু দূরেই আমার কলেজ। এজন্য আব্বু বাসা চেঞ্জ করতে চাইছে। কিন্তু কেনার মতো ফ্লাট পাচ্ছে না। কলেজ হোস্টেলে থাকতে চাইছি আমি এজন্য। কিন্তু আব্বু তা থাকতে দিবে না। বাসা একটা ভাড়া করেই চলে এলাম কলেজের কাছে এখন আব্বুর অফিস দূরে হয়ে গেছে। আমাদের বাসা চেঞ্জ করা শুনে ইহানের জন্য অসুবিধা হয়ে গেছে। কারণ এখন আমাদের বাসার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে অনেক। কিন্তু আমি কি করবো ওই বাসা থেকে কলেজে যাওয়া আসা করা দূরে হয়ে যেতো। এক ঘন্টা আগে বাসা থেকে বের হতে হতো।

নতুন বাসায় আসার পর আর ইহান আসেনি। আসার সুযোগ ই পায়নি। তিনি তো পরিক্ষা নিয়ে বিজি‌। কথাও এখন খুব কম হয়। আমিও এতে রাগ করিনা। আমার জন্য তার ক্ষতি হোক এমনটা আমি চাইনা।
ইহানের পরিক্ষা চললো এক মাস। আমাদের দেখা হয়না স হলো। আমার সময় এখন নতুন জায়গায় সবার সাথে পরিচয় সম্পর্ক গড়ে তুলে যাচ্ছে। নতুন কলেজে নতুন ফ্রেন্ড হয়েছে। তনিমা, কনা।

নতুন কলেজ আর ফ্রেন্ডদের নিয়ে আমার সময় ভালোই কাটছে। আমরা এখন ছয়তলা বিল্ডিং এর চার তলায় থাকি‌। আব্বু জায়গা কিনে বাসা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি আর আম্মু তাকে থামানোর চেষ্টা করছি। কারণ দুই বছর পর যখন আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হবো তখন তো আবার জায়গা চেঞ্জ করতে হবে। এতো জায়গায় বাড়ি করে কি হবে অযথা টাকা অপচয়।

নতুন বাসায় আসার আজ একুশ দিন হলো‌। আজ ছাদে এসে আমি ঝটকা খেলাম। ছাদে এসে যে আমার শুভ্রর সাথে দেখা হবে কল্পনাতেও ভাবিনি‌। শুভ্র আমাকে দেখে আমার থেকে ও বেশি শক খেয়েছে। হা করে ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি হতবাক হয়ে ভাবছি এই ছেলে এখানে কি করছে?
‘ ও মাই গড! আমি টি স্বপ্ন দেখছি নাকি বাস্তব? আমার সামনে ঊষা তুমি দাঁড়িয়ে আছো? আমার তো বিশ্বাস ই হচ্ছে না।’

বলেই হাত এগিয়ে এনে আমার হাতে ফট করেই চিমটি কেটে দিলো। আমি বিরক্তে মুখে ‘চ’ উচ্চারণ করে সরে হাত ঠলতে ঠলতে বললাম,
‘ এসব কি ধরনের ভদ্রতা আপনি আমার হাতে চিমটি দিলেন কেন?’
শুভ্র সরি সরি বলতে লাগলো। আমি কপাট রাগ নিয়ে চলে আসতে চাইলাম। শুভ্র বললো,
‘ কিছু মনে করো না। আসলে হঠাৎ তোমাকে দেখে চমকে গেছিলাম। তাই এক্সসাইটেজ হয়ে কাজটা করে ফেলছি। ভেরি সরি। তা তুমি এখানে কি করে আমাদের বাসায় কিছুই তো বুঝতে পারছি না।’

‘ এটা আপনার বাসা?’
শুভ্র বললো, ‘ আমার মানে আমার বাবার।’
‘ ওহ। আমরা এখানে ভাড়া উঠেছি।’
‘ হোয়াট? কবে কয় তলায়?’
‘ আজ একুশ দিন হলো। তার তলায়। আমি আসি।’
বলেই আমি আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিচে চলে‌ এলাম। মেজাজ টাই খারাপ হয়ে গেছে। একটু ছাদের হাওয়া নিতে গেলাম তাও ওই শুভ্র টার জন্য বানচাল হয়ে গেলো‌।
আর এদিকে শুভ্র আমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে খুশিতে বাকবাকুম করছে।
রাতে আমি ব‌ই নিয়ে বসে আছি। আম্মু রান্না করছে। আমি ব‌ই দেখছি আর ফোনের দিকে লক্ষ্য রাখছি। ইহানের কলের অপেক্ষা করছি।

হঠাৎ ইহানের একটা মেসেজ এলো।’ বাইরে আসো’
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছি। বাইরে আসবো মানে কি কোন বাইরে আসবো? হঠাৎ আম্মুর ডাক কানে এলো।
‘ ঊষা দেখ কে এসেছে। কতোদিন পর ইহান এলো। এখানে আসার পর তো আর আসেই নি। বসো আমি আসছি।’
বলেই আম্মু রান্না ঘরে চলে গেল।আমি ছুটে চলে এলাম। ইহান ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আছে। আমি দেখেই রুমে চলে আয়না নিজেকে দেখে চুল আঁচড়াতে লাগলাম। ওরনা সুন্দর করে গায়ে জরিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমাকে দেখেই ইহান নজর কাড়া হাসিটা দিলো। আমি এগিয়ে এসে পাশে দাড়াতেই ইহান বললো,

‘ কেমন আছো?’
আমি বললাম, ‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি আমাকে না জানিয়ে এভাবে চলে এলেন।”
‘ চমকে দিতে পেরেছি কি?’
‘ অন্নেক’
‘ বসো‌। চাচু বাসায় আছেন?’
‘ না আজকে আসতে অনেক রাত হবে। আপনি ডিনার করে যাবেন?’
‘ শশুর বাড়ি খাবো বলেই আজ দুপুরে ও খাইনি‌!’
আমি কিছু বলতে যাব আম্মু চলে এলো। ইহান কে জিজ্ঞেস করলো চা কফি খাবে নাকি ইহান সরাসরি বলে বসলো,
‘ আগে পেট ফুল করা দরকার পরে চা কফি খাবো।’

আম্মু বুঝে গেলো আর বললো টেবিলে বসতে‌। রান্না হয়েই গেছে শুধু নামাবে। আম্মু হাসতে হাসতে চলে গেলো। আমিও মৃদু হাসলাম,
‘ সত্যি আপনার এতো খিদে পেয়েছে।’
‘ হুম। দুপুরে পরিক্ষা শেষ করে ঝামেলায় ছিলাম নাদিমের জন্য। খাওয়ার টাইম পাইনি। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আর দেরি করিনি শশুর বাড়ি চলে এসেছি।‌আমমু খেতে জোর করেছিলো কিন্তু আমি খাইনি।’
‘ কেন আর কি ঝামেলা হয়েছিলো যে খেতেই পারেননি?’
‘ গার্লফ্রেন্ড নিয়ে। ‘

‘ কি ঝামেলা?’
‘ আগে পেট ফুল করতে দাও। আমি এখন কথা বলতে পারবো না এতো। আরেকটা কথা কফি কিন্তু তুমি করবে। শাশুড়ি মায়ের হাতে অনেক কফি খেয়েছে এবার ব‌উয়ের হাতে টেস্ট করবো।’
‘ আমি?’ ঢোক গিলে বললাম। জীবন তো রান্না ঘরের গন্ডি ও পেরায় নি কফি করবো কি করে?
‘ ইয়েস।’
বলেই ইহান ড্রায়নিং টেবিলে চলে গেল। আমমু বসলো না আমাকে বসতে বলল। আমি বসতে চাইলাম না কিন্তু ইহান হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিয়েছে আম্মু তখন রান্না ঘরে থেকে কি যেন আনতে গেছিলো দেখে নি আমি চমকে তাড়াতাড়ি বসে পরেছি।
খাবার শেষে ইহান আমাদের গেস্ট রুমে চলে গেল। আজ ইহান থাকবে বলেছে। বাসায় নাকি ফ্রেন্ডের বাসায় আছে জানিয়েছেন।

আম্মু এদিকের কাজ শেষ করে রুমে চলে গেছে। আমি আমার রুমে ইহান যাওয়ার আগে কফি দিতে বলেছে। আমি রুমে পায়চারি করছি আম্মুর সামনে কি করে কফি করবো। জিজ্ঞেস করলে কি বলবো?
এদিকে ইহান মেসেজ করেই যাচ্ছে। ধুর ফোন রেখে রান্না ঘরে চলে এলাম কফি করতে দেখেছি আগে করিনি। তাই সেই মোতাবেক করতেছি‌। হঠাৎ আম্মুর ডাক শুনে ছিটকে উঠলাম,
‘ কিরে তুই কিচেনে করিস?
আমি ঢোক গিলে আমতা আমতা করতে লাগলাম।

‘কি হলো চুপ করে আসিস কেন? কফি কার জন্য করছিস ইহান কি কফি চেয়েছে? আর আমাকে না ডেকে তুই করছিস কেন?’
‘ আম্মু আসলে আমি নিজে থেকেই চেষ্টা করছি‌‌। আগে তো কখনো করিনি তাই আজ দেখছি পারি কিনা।’
‘ তোকে এখন এসব শিখতে হবে কেন? বিয়ে করার ইচ্ছে হয়েছি নাকি যে রান্না বান্না শিখে প্রস্তুতি নিচ্ছিস?’
আমি কি বলবো এখন আম্মুকে। পেছনে থেকে ইহানের কন্ঠ পেলাম এগিয়ে এসে বলছে।
‘ করতে দাও চাচি। তোমার মেয়ে যে অর্কমার ঠেকি। আজ নিজে থেকে করতে এসেছে করতে দাও দেখি কেমন কফি বানাতে পারে।’

‘ কিন্তু ও তো আগে এসব করে নি। যদি কিছু হয়ে যায়।’
‘ একটু আধটু কিছু হলে সমস্যা কি? এর থেকে কাজে পারদর্শী হবে। কিছুই না পারলে তো ওর ভবিষ্যৎ জামাইয়ের খুব পেরেশানিতে ভুগতে হবে। যে ব‌উ একটু কফিও বানাতে পারেনা।’
আম্মু ইহানের সাথে কথা বলতে বলতে চলে গেল। আমি কফি করলাম দাঁত কিড়মিড় করে। এই ভাবে আমাকে অর্কমার ঠেকি বলল। আজ এমন ভালো কফি বানাবো সারা জীবন মনে থাকবে উনার। এর জন্য আমি কষ্ট করে রান্না ঘরে এলাম আর তিনি কিনা আমাকে অপমান করল খাটাশ একটা। এখন আমার বয়ফ্রেন্ড হয়েও আগের মতোই অপমান করে যায় লোকটা এতো বদমাইশ কেন?!!

কফি করে নিয়ে এসে দেখলাম আম্মু আর ইহান সোফায় বসে আছে।আমি কটমট চোখে তাকিয়ে কফি ইহান কে দিলাম। কফি চুমুক দিয়েই ইহানের হাসি হাসি মুখটা হারিয়ে গেলো আমি শয়তানি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছি। আম্মু চলে গেল। আম্মু চলে যেতেই ইহান উঠে দাঁড়ালো। আমি নিজের রুমে যাওয়ার জন্য ছুট লাগাবো তার আগেই ইহান আমার হাত ধরে টেনে আমার রুমে চলে এলো। আর কফিটা গাল চেপে ধরে আমার মুখে দিয়ে দিলো। আমি খক খক করে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। ছিহ কি নুনটা‌। লবণ দিয়ে বিষ বানিয়ে ফেলেছি। ইহানের মুখে হাসি আমি গাল ফুলিয়ে বাইরে এলাম। ইহান চলে গেল।

আমি এখন চিৎকার করে ইহানকে কিছু বলতে ও পারছি না কারণ আম্মু শুনে ফেলবে তাহলে। তাই একাই একাই নিজের রাগ দমন করার চেষ্টা করতে লাগলো।
‘ পিচ্চিদের এতো রাগ করতে নাই। তাই রাগ না করে পড়ায় মনোযোগ দাও। আর তোমার হাতে এই লবণাক্ত কফিও আমার কাছে অমৃত! আর এই অমৃত আমি একা প্রাণ করবো নাকি তাই তোমাকে টেস্ট করালাম।’

ইহানের মেসেজ দেখে আমার রাগ আরো বেড়ে গেল। মন চাইছে ওনার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে।
আব্বু এসেছে সারে এগারোটায়। ইহান বেরিয়ে আব্বুর সাথেও গল্প করলো আমি ইহান বাসায় আছে ভেবেই আর ঘুমাতে পারলাম না। রাগ নিয়ে ব‌ই খোলে বসে ছিলাম। ঘুমাতে ঘুমাতে একটা বেজে গেল। সকালে তাই তো জাগতে পারিনি‌। শুক্রবার ছিল তাই আম্মু ও ডাকে নি। আর আমিও উঠিনি। দশটায় উঠে জানতে পারলাম ইহান চলে গেছে। মনটাই খারাপ হয়ে গেল যাওয়ার আগে আমাকে ডাকল ও না।

ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম কল করেছিল আধা ঘন্টা আগে।
আজ ইহানের জন্মদিন সেই সুবাদে আমি আজ রান্নাঘরে ঢুকেছি। কেকটা নিজের হাতেই তৈরি করবো। এক সপ্তাহ ধরে আমি এটা বানানো শিখেছি। আম্মু আমার এমন ছটফটানি দেখে অবাক হয়। কিন্তু কিছু বলে না। অদ্ভুত ভাবে নিরব থাকে। আমি সব কখনো ভাবিনি। আজ ও ভাবলাম না। আম্মুর স্বাভাবিক আচরণ দেখে আমি আরো সাহস পেলাম। কেক তৈরি করলাম। পাশে‌ আম্মু দাঁড়িয়েই ছিল। আমাকে বলে দিয়েছে কিন্তু আমি কোথাও হাত দিতে দেয়নি একাই করেছি‌। যে এটা আমার পরিক্ষার হল।

আম্মু দিয়ে ইহানকে কল করালাম। ইহান আসবে বলছে কিন্তু নির্দিষ্ট টাইম বলেনি। ইহান আমাদের বাসায় এলো সন্ধ্যায়। সারাদিন বন্ধুদের সাথে পরিবারের সাথে ছিল‌। কিন্তু এবার তেমন বড় আয়োজন করেনি। করার ইচ্ছে থাকলে ইহান করতে দেয়নি। কারণ তাদের এখন একটু হাত খাটা। চাচাজান ব্যবসায়ে খুব বড় একটা লস হয়েছে।‌ তাদের এখন সময় খুব খারাপ যাচ্ছে। এজন্য ইহান বাড়তি খরচ করতে দেয়নি। কিন্তু ইহানের মা তাও করার জন্য লাফালাফি করছে‌। ছেলে তার প্রাণ ভোমরা তার জন্মদিনে করতে না পারলে যেন খুব বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। এজন্য শুধু তার জেদের জন্য ছোটখাটো আয়োজন করেছিল। ইহান এতে রাগ করেছিল কিন্তু কিছু করার ছিল না।

ইহান এসে কিছুই খেল না।‌সারাদিন নাকি খাওয়ার উপরেই থাকতে হয়েছে তাকে। এসব শুনে আমার মুখটা মলিন হয়ে গেল। আজ সারাদিন ইহানের সব আছে এক বার কথা বলেছি কিন্তু আমি উইশ করিনি। নিজের হাতে কেক তৈরি করে তার সামনে দাঁড়িয়ে উইশ করব বলে। আর এখন তিনি বলছে কিছু খেতে টেতে পারবে না শুধু নাকি দেখা করতে এসেছে। আব্বু আম্মুর সাথে গল্প করছে আর আমি দূর দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছি লুকিয়ে। ইহান এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আমাকে খুঁজছে হয়তো যাব না সামনে।

ফোন রুমে উনি ফোনে কি যেন করছে হয়তো আমাকেই মেসেজ করছে।
আমি রুমে আসতে নিলাম তখন ইহান আমাকে দেখে নিল। আমি গটগট করে রুমে চলে এলাম। আমি ইহানকে লুকিয়ে দেখছিলাম ইহান বুঝে ফেলেছে তাইতো এখন হাসছে।
আমি গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ আম্মুর ডাক কানে এলো।
‘ ওই ঊষা ক‌ই তুই কেকটা নিয়ে আয়। ইহান চলে যেতে চাইছে কেকটা কেটে যাক।’
আমি তারাতাড়ি বেরিয়ে এলাম। কিচেনে থেকে কেক এনে দেখি ইহান আম্মুকে বলছে,

‘ এসবের কী প্রয়োজন ছিল। আমি আজ কেক খেতে খেতে শেষ আর খেতে পারবো না জাস্ট কেটেই চলে যাব কিন্তু।’
আমি শক্ত হয়ে কেক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমি এতো কষ্ট করে উনার জন্য কেক বানালাম আর উনি কিনা তা খাবেন না বলছেন। রাগে, কষ্টে আমার চোখে জল চলে এল। আমি কেক হাতে ঘুরে দাঁড়াল দরকার নাই খাওয়ার আমি উনার কে আমার ভালোবেসে দেওয়া জিনিস খাবে কেন? সারাদিন সবাইকে এতো সময় দিয়েছে আর আমাকে এই ভাবে কষ্ট দিল।

‘ এই ঊষা কেক এখানে না এনে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?’
আম্মুর কথায় চমকে দাঁড়িয়ে গেলাম।
‘ রেখে আসতে যাচ্ছি।’
‘ রেখে আসবি কেন এখানে নিয়ে আয়! ইহান কেক কাটবে তো।’
‘ দরকার নাই‌। উনার না বলে আর খাওয়া মুড নাই। সারাদিন অনেক খেয়েছে। না খেতে পারলে কাটার কি দরকার।’
‘ আরে খাবে নি। নিয়ে আয় তো। এতো কষ্ট করলি সারাদিন কেক বানাতে গিয়ে। দিবি না সেটা।’
আম্মুর কথা শুনে ইহান যেন বিস্মিত হলো।

‘ ঊষা কেক বানিয়েছে??’
‘ হ্যা। বললো তোমাকে নাকি কেক তৈরি করে খাওয়াবে। সেদিন নাকি বাজে হয়েছিল কফি তাই আজ ভালো রান্না করে খাওয়াবে।’
ততক্ষণে আমি কিচেনে চলে‌ এসেছি। হঠাৎ ইহানের আগমন কিচেনে। আমি চোখ মুছে নিচ্ছিলাম। ইহান দেখে অন্য দিকে ঘুরে গেলাম।
ইহান এসেই আমার দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে ‘ সরি ‘
বলল। আমি অন্য দিকে ঘুরেই আমি।
ইহান আমাকে টেনে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,

‘ এতো অভিমান? শশুর শাশুড়ি আছে বলে রাগ ভাঙাতে পারছি না। আগে যদি জানতাম আমার এই বাচ্চা ব‌উটা এতো কষ্ট করছে আমার জন্য তাহলে সব ছেড়ে ছুড়ে চলে আসতাম।’
‘ আপনি আমাকে একটু ভালোবাসেন না।’
‘ এই তো শুরু হলো। আমি কি জানি তুমি এমন কান্ড করবে? চলো কেক নিয়ে ছি পুরো কেক আমিই খাবো কাউকে দেব না। পেট ফেটে আমি মরে গেলেও তোমার হাতের কেক খেয়েই মরব।’
আমি ইহানের মুখ চেপে ধরলাম রেগে।

‘ এমন একটা দিনে আপনি এমন বাজে কথা বললেন‌। আপনি খুব খারাপ আমাকে কষ্ট দিতে ভালোবাসেন।’
ইহান আমার হাতের উপর চুমু খেতেই হাত সরিয়ে নিলাম। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। আমি রাগী চোখে তাকালাম।
‘ এখন আর বেশি কথা বলছি না চলো। না হলে শশুর শাশুড়ি চলে আসবে ভিলেন হয়ে।
ইহান কেক হাতে চলে গেল। আমিও পেছনে পেছনে এলাম।

ইহান কেক কেটে আব্বু আম্মু কে খাইয়ে দিল। আমরা তিনজন হ্যাপি বার্থডে টু ইউ বলছি চিৎকার করে। আব্বু ইহানকে গিফট দিলো। আমি ইহানের জন্য ঘড়ি আর একটা শার্ট কিনে লুকিয়ে রেখেছিলাম। দিবো কি করে ভাবছি।
আব্বুর অল আসতেই রুমে চলে গেল। আম্মু রান্না ঘরে তখন ফট করেই ইহান এগিয়ে এসে আমার মুখে কেক ঢুকিয়ে দিলো। আর সাথে সাথে সরে দাঁড়ালো।

আমি ও এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে এক টুকরো কেক তুলে ইহানকে খাওয়াতে গেলাম।
ইহান আমার দিকে মিষ্টি হেসে তাকিয়ে কেক খেয়ে নিল। আমি চিন্তা মুখে আছি।
ইহান আমার চিন্তিত মুখ দেখে বলল,
‘ কি হয়েছে? মুখটা ওমন করে রেখেছ কেন?’
‘ এমনি।’
‘ বলো।’
‘ আপনার ফোনটা একটু দিন তো।’
‘ কেন?’ অবাক হয়ে আগে কখনো আমি ফোন চাইনি তাই অবাক হয়েছে ইহান।
আমি বললাম, ‘ দিন না। নাকি ফোনে কোন গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে যা আমাকে জানানো যাবে না?’ সন্দেহ গলাতে বললাম।
ইহান ফোন আমার হাতে দিল।

আমি রুমের দিকে যেতে বললাম। লিফটের কাছে দাঁড়িয়ে থাইকেন আমি আসছি। আপনি এখন চলে যান।
ইহান বোকার মত তাকিয়ে র‌ইলো। কিছু বললেও আমি দাঁড়ালাম না রুমে এসে। দরজা আটকে দিলাম।
ইহান আমার কাজে হতভম্ব হয়ে ভাবছি পাগল হলো নাকি‌। পানি খেয়ে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো। লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইহান। আসছে না কেন?
আমি রুমে এসে ইহানের ফোনের স্ক্রিনে নিজের ছবি দেখে চমকালাম। এ তো দেখি সাজেকের ছবি দেওয়া আমার ঘুমন্ত ছবি ইহানের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছি। আর ইহান মুগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অজান্তেই ঠোঁটের কোনে হাসি চলে এলো।
পাঁচ মিনিট পরেই বেরিয়ে আম্মুকে বললাম,

‘ আম্মু ইহান ভাই কি চলে গেছে?’
‘ হ্যা এই মাত্র গেল কেন?’
‘ উনার ফোন তো রেখে গেছে ভুল।’
‘ বলিস কি? কোথায় ফোন দে তোর আব্বুকে দিয়ে আস্তে আসতে বলি‌ বেশি দূরে যায়নি।
‘ আব্বু তো ফোনে দরকারি কথা বলছে। আমি দিয়ে আসি‌’
‘ এই রাতে তুই যাবি না না তার দরকার নাই। তোর আব্বু কে বলি।’
‘ আরে আম্মু ইহান ভাই নিচেই হবে বড় জোর যেতে দাও প্লিজ।’
‘ না না বললাম তো।’

‘আমমু প্লিজ আমাকে যেতে দাও। আমি দিয়ে আসি!’
আম্মু আবার না করতে গিয়ে ও কি যেন ভেবে থেমে গেল। রাজি হয়ে গেল। আমি কোন কিছু না ভেবে রুমে এসে লুকিয়ে ব্যাগটা নিয়ে বাইরে চলে এলাম।
ইহান লিফটের সামনে পায়চারি করছে। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম,
‘ ধরেন’
” কি এটা?’
‘ আপনার গিফট?’
‘ কিসের গিফট?’
‘ বার্থডে গিফট। কাল এটা পরে আসবেন বাসার সামনে আমি আপনার সাথে ঘুরতে যাব।’
‘ এ্যা’

‘ আর আপনি আমার অনুমতি ছাড়া আমার ছবি তুলেছেন কেন?’
‘ নিজের জিনিসের ছবি তুলতে আবার অনুমতির কি দরকার। তুমি পুরোটাই তো আমার।’
‘ ধ্যাত আপনার সাথে কথায় পারবো না।’
বিরক্তিকর মুখ করে চলে এলাম। পরদিন আমি হালকা সাজুগুজু করে কলেজের নাম করে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এলাম।
নিচে এসেই শুভ্রর সাথে দেখা।
‘ হাই ঊষা!’ হাত নাড়িয়ে উঠলো। আমি ভদ্রতা স্বরুপ হাই দিলাম। শুভ্র আমার কাছে এসে এগিয়ে এলো। আমি ইহানকে খুঁজছি ফোনে বললো এসে গেছি ক‌ই উনি?

‘ হে ঊষা কেমন আছো?”
‘ আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
‘ কলেজে যাচ্ছ?’
‘ হ্যা কাঁধে ব্যাগ দেখছেন না!’
‘ হুম কিছু রঙ ড্রেস তো তাই মনে হচ্ছে না‌ আবার সেজেগুজে এসেছো।”
‘ তো কি হয়েছে রঙ ড্রেসে কি যাওয়া যায় না নাকি।আমি কেবল করেছে ভর্তি হয়েছি এখনো আমরা রঙ ড্রেসে যেতে পারি সমস্যা হয়না।’
‘ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। একেবারে…
‘ ঊষা…

ইহানের আওয়াজ শুনে দেখি রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। শুভ্র ইহানকে দেখে থতমত খেয়ে গেলো।
‘ আরে আপনি এখানে?’ ইহান বলে উঠল।
শুভ্র বললো, ‘ এটা তো আমারই বাসা কিন্তু আপনি এখানে?’
‘ আমি এসেছে ওকে নিতে।’ আমাকে দেখিয়ে বলল ইহান। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ চলো।’
আমি পেছনে পেছনে চলে এলাম। শুভ্র ইহানকে দেখে আর কথা বললো না কারণটা আমার ও অজানা।

‘আবার বাইক নিয়ে এসেছেন একবার এক্সিডেন্ট করে শখ মিটে নি। এখনো এটা চালানো বন্ধ করেননি?’
রেগে বললাম আমি। ইহান উল্টা রাগ দেখিয়ে বলল,
‘ ওই ছেলেটার সাথে কি কথা বলছিলে?’
‘ তেমন কিছুই না। কেমন আছি এসব জিজ্ঞেস করেছে।’
‘ ওই ছেলের সাথে আর কখন কথা বলবে না। তোমার বাবা আর বাসা পেল না। ওই ছেলেটার বাসায় ভাড়া নিল।’
বিরক্তিকর মুখ করে বললো।
‘ তো কি হয়েছে?’ অবাক হয়ে।
‘ কিছু না। কোথায় যাবে?’
‘ যেখানে নিয়ে যাবেন‌’ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি।আমার দেওয়া শার্টটাই পরে এসেছে ইহান।
‘ যেখানে নিয়ে যাব সেখানেই যাবে?’ দুষ্টু হেসে!

‘ হ্যা বললাম তো‌’
‘ তাহলে চলো কাজি অফিসে যাই। বিয়েটা সেরে আসি।’
‘ হোয়াট?’
‘ কেন আমাকে বিয়ে করার ইচ্ছে নাই নাকি?’
‘ আছে কিন্তু তাই বলে এই ভাবে না।’
‘ ধুর। আচ্ছা চলো।’
‘ আগে বলেন এইটা কবে ফালাবেন?”
‘ কখনো না!’
‘ কিহ তাহলে আমি যাব না।’
‘ ওকে না গেলে। আমি ফারিয়াকে নিয়ে যাই‌। ও কাল থেকে আর বেরাতে যাওয়ার জন্য তোষামোদ করছে তোমার জন্য ওকে না করে দিয়েছিলাম। এখন না হয়….

‘ ফাজিল লোক। আপনি ওই মেয়েকে নিয়ে কোথাও গেলে আমি আপনাকে মেরেই ফেলবো।’
বলেই ইহানের পিঠে কিল বসিয়ে দিলাম। ইহান আমার হাত ধরে টেনে গাড়িতে উঠতে বললো।
আমি সাথে সাথে উঠে পরলাম। দূরে থেকে বড় লক্ষ্য করলো শুভ্র।
রাগ করে আমি বেড়াতে এসেও কথা বলছি না ইহানের সাথে। উনি আমার সামনে ওই ফারিয়াকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলল, আজ উনার সাথে আমি কথা বলবো বলে ঠিক করেছি।
‘ কি হলো কথা বলবে না?’

এক চিলতে রোদ সিজন ২ পর্ব ২৬+২৭+২৮+২৯+৩০

আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। ইহান আমার পাশে ঘাসের উপর বসে পরলো আমরা একটা নদীর তীরে বসে আছি নিরিবিলি পরিবেশটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ইহান আমার সাথে কথা বলার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো তাই উঠে চলে গেল আমি আড়চোখে লক্ষ্য করলাম কিন্তু কিছু বললাম না। মনে মনে ভাবছি আমাকে রেখে চলে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে নাকি? কিন্তু না একটু পর আইসক্রিম ও একটা গোলাপ ফুল কোথা থেকে নিয়ে এলো। আমি মনে মনে ভাবছি প্রপোজ করবে নাকি। যাই করুক আমি আজ কথা বলবোই না।
ইহান আইসক্রিম টা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো তারপর আমার পাশে বসে চুলে ফুল গুঁজে দিল।
যত‌ই রাগ করিনা কেন আমি আইসক্রিম কে অবজ্ঞা করতে পারবো না। তাই তো গাল ফুলিয়ে ই খাচ্ছি।
ইহান খালি গলায় গান ধরল,

“” চাইনা মেয়ে তুমি অন্য কারো হ‌ও,
পাবে না কেউ তোমাকে তুমি কারো ন‌ও,(২)
তুমি তো আমারই জানো না ওও, এ হৃদয় তোমারি ওওওও, তোমাকে ছাড়া আমি বুঝিনা কোন কিছু যে ও পৃথিবী জেনে যাও তুমি শুধু আ মা র।(২)
হৃদয়ের নীল আকাশে স্বপ্ন আমার ওরে, ভেঙে যায় হৃদয় আমার অভিমানি ঝড়ে(২)
তুমি তো আমারই জানো না ওও, এ হৃদয় তোমারি ওওওও, তোমাকে ছাড়া আমি বুঝিনা কোন কিছু যে ও, পৃথিবী জেনে যাও তুমি শুধু আ মা র(২)

এক চিলতে রোদ সিজন ২ শেষ পর্ব