এক প্রহর ভালোবাসার সিজন ২ পর্ব ৬

এক প্রহর ভালোবাসার সিজন ২ পর্ব ৬
নুসাইবা রেহমান আদর

সানার মন চাচ্ছে এরকম নির্লজ্জ লোককে কিছু একটা করা কথা শুনিয়ে দিতে।কিন্তু কি উত্তর দিবে সে ভেবে পাচ্ছে না। রেগে থাকলে যে মেইন মেইন কথাগুলো সে ভুলে যায়।
~আপনার কি এক ফুটাও শরম নাই ,নির্লজ্জের মত হাসতেছেন কেন?
~এই যে আমাকে কামড় দিয়ে দাগ বানিয়ে ফেললে এখন এটা দেখে তো মানুষ ভাববে নতুন বিয়ে করা বউ আমাকে লাভ বাইট দিয়েছে।

সানা রেগে মেগে এমন একটা কাজ করেছে সেটা উপলব্ধি করতে পেরে নিজেরই লজ্জা লাগছে এখন। তাই সাফোয়ান থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ওখান থেকে নিচে চলে যায়। সাফোয়ান ও মুচকি হেসে ড্রেস চেঞ্জ করে। নিচে এসে দেখে সবাই মিলে টেবিলে বসে আছে কিন্তু খাচ্ছে না। এই বাড়িতে একটা নিয়ম এর মধ্যে হচ্ছে যে সবাই যখন বাড়িতে থাকবে তখন সবাই একসাথেই খাবার খাবে। সাফোয়ান নিচে আসার পরে সবাই খাওয়া-দাওয়া শুরু করল। খাওয়া-দাওয়ার এক পর্যায়ে মিসেস শিকদার তাকে জিজ্ঞেস করলেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

~এই কয়দিন কোথায় ছিলে তুমি সাফোয়ান? এভাবে হঠাৎ চলে গিয়েছো আমাদের বলেও গেলে না। তোমাকে নিয়ে যে বাড়ির মানুষ চিন্তা করে সে কথা কি ভুলে গেছো?
~আমাকে নিয়ে কাউকে চিন্তা করতে হবে না। ছোট বাচ্চা নই যে আমাকে চোখে চোখে রাখতে হবে। আর আপনি খুব ভালোভাবে জানেন আমার কাজের বিষয়ে কোন কৈফিয়ৎ দেওয়া আমি পছন্দ করি না।

রাফিয়া বরাবর অবাক হয় এই ভেবে যে, এই বাড়িতে কেউ ভুলেও সাফোয়ান এর উপরে কথা বলে না। সেটা ভয় হোক বা সম্মান থেকে। ইভেন তার শাশুড়ি মা ও সাফোয়ানের সাথে কখনো তর্কে জড়ায় না। এই জিনিসটা তার খটকা লাগে সব সময়। বাড়ির মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি দেওয়া হয় সাফোয়ানের কথাকে। সাইফের তেমন একটা ভ্যালিউ এই পরিবারের নাই তা মনে হয় এখন ব্যক্তিগতভাবে রাফিয়ার । সাইফ নিজেও ভাই বলতে পাগল। ভাইয়ের সম্পর্কে একটা উল্টা পাল্টা কথা শুনতে সে রাজি নয়।

~আগামীকাল থেকে ভোট বিষয়ক অনেক নতুন কার্যক্রম শুর হবে। যদি সাইফ চায় তাহলে সেখানে আমাকে সাহায্য করতে পারে।
~কি বলছ ভাই তোমার সাথে আমি কাজ করার জন্য কবে থেকে অপেক্ষা করে আছি।আর আমার একমাত্র বড় ভাইয়ের এই প্রথম ইলেকশন এমপি হিসেবে সেখানে আমি থাকবো না তা কি হয়?

~গুড এই স্পীড যেনো কাজের সময় নিজের মধ্যে থাকে। আমি ইলেকশন এর মধ্যে কোন গড়বড় দেখতে চাই না। সবাই খুব ভালোভাবে জানেন এই ইলেকশনে আমার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।যদি এই বিষয়ক কোন কিছু বাড়ি থেকে কোথাও লিক হয়েছে বা জানানো হয়েছে সেই লোককে আমি ছেড়ে কথা বলবো না। আমি খুব ভালোভাবে জানি যে এই পরিবারে কে আমার ভালোটা অথবা খারাপ চায়। চুপচাপ আছি দেখেই ভাববেন না আমি কিছু জানি না। ইলেকশন সামনে তাই আমি কোন ঝামেলা চাচ্ছি না দেখে চুপ করে আছি।

সময় হোক কলিজার টেনে ছিড়ে ফেলব আমার সাথে বেইমানি করার জন্য।
খাওয়ার মাঝে সাফওয়ানের হুমকি শুনে রাফিয়ার হিচকি উঠে গেল। সফোয়ান যে এতটা কঠোর মনের মানুষ ঠান্ডা মাথায় মানুষকে খুন করার হুমকি দিতে পারে সে সবকিছুই করতে পারে। এমন এক মানুষের সাথে তার ছোট বোন কিভাবে থাকবে এটা ভেবে পাচ্ছে না সে। মাথা উঁচু করে একবার সানা আবার আরেকবার সাফোইয়ানের দিকে তাকালো। সানার দিকে তাকিয়ে রাফিয়া বুঝতে পারল এই বিষয়ে সানার কোন মাথাব্যথা নাই সে নিজের মতো খেয়েই যাচ্ছে।
~আচ্ছা সানা তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?

শাশুড়ি মায়ের প্রশ্ন শুনে খাওয়া থামিয়ে দেয় সানা।এরপর ভাবলেসহীন ভাবে বলে উঠে।
~যে ক্লাসেই পড়ার পড়তাম তা এখন জেনে কি করবেন? এখন বিয়ে হয়ে গেছে পড়াশোনার কথা আমি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিছি।তাই আমি মনে রাখতে চাচ্ছি না আমি কোন ক্লাসে কোথায় পড়াশোনা করেছি আর ফিউচারে করবো কিনা।
সানার এমন উত্তর শুনে মিসেস শিকদার একদম খুশি হয়নি। তা তার চেহারার অবস্থা দেখে বুঝা যাচ্ছে। সানা যে মুখের উপর কাট কাট উত্তর দিয়ে দিবে এটা সাফোয়ান খুব ভালোভাবে জানে। সানার এই স্বভাব যে সবাই ভালোভাবে নিবে তা নয় কিন্তু।

~সানা এই বাড়িতে সবাই তোমার বয়সে অনেক বড় সেই হিসেবে সবাইকে সম্মান দিয়ে কথা বলবে। এইরকম বেয়াদবি আমি একদম টলারেট করব না। নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছি বলেই এই না যে তোমার সকল অন্যায় আর খারাপ ব্যবহার গুলো মেনে নিব। আরেকবার যদি এরকম বেয়াদবের মতো আচরণ করতে দেখি বেশি থাপ্রে সোজা করে ফেলব কিন্তু তোমাকে আমি। আর আপনাকে বলছি আমার স্ত্রী কি করবে না করবে তার ব্যাক্তিগত ব্যাপার সেখানে অন্যকারো হস্তক্ষেপ আমি সহ্য করব না।

সানা কোন উত্তর দিল না খাওয়া শেষে সেখান থেকে উঠে চলে গেল। সানার এমন ব্যবহারে সবাই আশ্চর্য হয়ে বসে আছে। হঠাৎ হয়েছেটা কি এর সবার সাথে এরকম আজব ব্যবহার করছে চায়টা কি সে আসলে। সাফোয়ান যতোই ওর মায়ের সাথে কথা না বলুক ,তার থেকে দূরে থাকুক তার মায়ের অপমান সে সহ্য করবে না এবার সে যেই হোক। মা যেমনই হোক সন্তানের কাছে সে জান্নাত। পরিবারের সবার আলাদা আলাদা জায়গা আছে তার জীবনে। সে একজনকে বেশি প্রায়োরিটি দিবে এবং অন্যজনকে একদমই দিবেনা এইরকম মানুষ সাফোয়ান না। তাই মা এব্যং স্ত্রী দুজনের জায়গা সমান ভাবে দিয়েছে সে।

গভির রাতে কেউ খান ভিলার দেওয়াল টপকে খান ভিলায় প্রবেশ করে। ধীরে ধীরে খুব সাবধানতার সাথে খান ভিলার পিছন দরজা দিয়ে ঢুকে গেলো। রেজওয়ান খুব নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। কারণ সামনে ভোটের অনেক কাজ। তাই কাল থেকে সেই কাজে লেগে পড়তে হবে আর তখন ঘুম দেওয়া হারাম হয়ে যাবে তার জন্য । ঘুমের মধ্যে কারো চিৎকারে রেজোয়ান খানের ঘুম ভেঙ্গে যায়। তড়িঘড়ি করে উঠে বসে পরে সে। আর্তনাদের শব্দ তার বাবা মায়ের রুম থেকে ভেসে আসছে। বাবা-মায়ের রুম থেকে কে চিৎকার করবে সে ভেবে পাচ্ছে না।

এক মুহূর্ত দেরি না করে রেজওয়ান খান ছুটে চলে যায় নিচের তলায় তার বাবা মায়ের কক্ষে । সেখানে গিয়ে এরকম ভয়ানক দৃশ্য দেখবে সেটা কল্পনাও আনতে পারে নাই রেজোয়ান খান। বাবা – মা বলে চিৎকার করে ফ্লোরে বসে পড়ে রেজয়ান। অপর পাশের ফ্লোরে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে রেজোয়ান খানের বাবা মা। বাবা মায়ের এমন অবস্থা দেখে জ্ঞান শূন্য হয়ে বসে আছে সে। কি থেকে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না রেজোয়ান খান, পকেট থেকে মোবাইল বের করে গার্ড দের কল দিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসতে বললো।

মা – বাবার কাছে গিয়ে দেখে দুজনের ই গলা কা,, টা সেখান থেকে গলগল করে বেরিয়ে যাচ্ছে র ক্তে র ধারা ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে। রেজোয়ানের বাবা মা চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।এমন মনে হচ্ছে যে সে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে ।এক ভয়ানক অবস্থা। রেজোয়ান খানের যখন জ্ঞান আসলো নিজের মধ্যে সে ফিরে আসলো তখন উপলব্ধি করতে পারলো সে তো তার রুমে থেকে মায়ের চিৎকার শুনেছে তাহলে হয়তো খুনি এখনো বাড়ি ছেড়ে বের হতে পারে নাই।

যত তাড়াতাড়ি হোক যেভাবেই হোক তার বাবা-মায়ের খুনিকে খুঁজে বের করতেই হবে। রেজয়ান যতই নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করুক না কেন সে তার বাবা মাকে খুব বেশি ভালোবাসতো। মনে মনে প্রচন্ড ভেঙে পড়েছে সে। পুলিশদেরকে ফোন করে জানালো তার বাড়িতে তাড়াতাড়ি চলে আসার জন্য। সেও রুম থেকে বের হয়ে পুরো বাড়ি তো নতুন করে খুঁজতে লাগলো কেউ আছে নাকি।

অন্যদিকে শিকদার বাড়িতে সানার এক ফোঁটাও ভালো লাগছে না। তার মনে হচ্ছে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে। প্রায় এক থেকে দেড় ঘন্টা যাবৎ সে ব্যালকনিতে একা একা বসে মশার কামড় খাচ্ছে। কি অজানা এক কারনে সানার ঘুম পাচ্ছে না। তার পাশে বেহুশের মত ঘুমন্ত সাফয়ান কে দেখে তার রাগ তিরতির করে বাড়তে লাগলো। এত রাতে তার ঝগড়া করার ইচ্ছে ছিল না বিধায় একা একা ব্যালকনিতে গিয়ে বসে আছে। জীবনটা খুব এলোমেলো হয়ে আছে তার ।সে তার এই জীবনের কোন হিসাব মিলাতে পারছি না।

যতবার এসব নিয়ে ভাবছে ততবারই ব্যর্থ হচ্ছে। কখন কোন আপন মানুষ যে পিছন থেকে ছুরি মেরে ক্ষতবিক্ষত করে দেয় তা বলা যায় না। মানুষ কিভাবে মুখোশ পরে চলাফেরা করে সেটা আমরা বলতে পারব না। সব সময় সাবধানে চলাফেরা করতে হবে এবং সবাইকে অন্ধ বিশ্বাস করলে চলবে না। কেউ নিজের কোন স্বার্থ ছাড়া কাউকে ভালোবাসে না অথবা তার তাকে সাহায্য করে না। সে তার নিজের স্বার্থের জন্য সাফোয়ান কে বিয়ে করে এই বাড়িতে এসেছে সেটা ভুলে গেলে চলবে না। অন্যদিকে সাফোয়ান নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য বিয়ে করেছিল সানাকে।

তাই দুজন নিজেদের স্বার্থ পূরণের জন্যই বিয়ে করেছিল ভালোবেসে নয়। যদি বিয়ের আসর থেকে রাফিয়া পালিয়ে না যেত তাহলে আজ দুলাভাই হতো সাফোয়ান। জীবন বড়ই অদ্ভুত জিনিস কখন কাকে কোন মোড়ে নিয়ে এসে দাঁড় করায় তা কেউ বলতে পারবে না। আজ সাফওয়ানের স্ত্রী হিসেবে এই বাড়িতে আছে তা হয়তো আল্লাহ তার তকদির আগেই লিখে রেখেছেন। সানা ও চায় সংসার করতে তবে সংসার করার আগে তার কাঁধে যে দায়িত্বটা আছে তা পূরণ করতে হবে। মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানুষটাকে সবার সামনে বের করে আনতে হবে।

সানার নিজের চিন্তা ভাবনায় এতটাই মশগুল ছিল যে কখন সাফোয়ান তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে তা সে টেরই পাইনি। যখন সাফোয়ানের উষ্ণ নিশ্বাস সানার ঘাড়ে পড়েছে তখন সে পিছু ফিরে তাকিয়ে সাফোয়ানকে দেখতে পায়। সানা কে এত রাতে ব্যালকনিতে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাফোয়ানের রাগ হয় প্রচুর।

~এই মেয়ে এতো রাতে একাএকা এখানে কি করছেন? এক ফুটাও ভয় কাজ করে না আপনার মাঝে তা আমি জানি। কিন্তু এতো রাতে আপনার মতো পেত্নীকে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখলে তেনারাও ভয় পেয়ে যাবেন। তাই এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে রুমে আসুন। বেয়াদব মেয়ে , রাত নাই দিন নাই সব সময় অবাধ্য হবেই। মন চায় কষে একটা দিয়ে গাল লাল করে দেই।

রাগে সাফোয়ানের মাথা ফেটে যাচ্ছে। এত রাতে ঢং করে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা দরকার কি ছিল মেয়েটার। বিপদ তো আর বলে কয়ে আসে না। সব সময় সতর্ক থাকতে হবে তার। অথচ অর্ধেক রাতে মেয়েটা না ঘুমিয়ে একা একা ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়েছিল। যদি কোন বিপদ আপদ হতো তো‌তাহলে কে দায়ভার নিতো? তার উপরে সেই তো সব দোষ পরতো সব। সানা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাফোয়ানকেই দেখে যাচ্ছে। লোকটার রাগের মাঝেও তাকে শাসন করছে। সাফোয়ানের মাঝে নিজেকে নিয়ে স্পষ্ট ভয় দেখতে পাচ্ছে সানা। কিন্তু এই ভয় কি নিয়ে এটা উপলব্ধি করতে পারছে না সে। তবুও আজ সে সাফোয়ানের কোন কথায়‌ রাগ না করে চুপচাপ সাফোয়ানের পাশে গিয়ে বসল খাটে। তারপর শান্ত কন্ঠে সাফোয়ান কে বলে উঠলো,,,

এক প্রহর ভালোবাসার সিজন ২ পর্ব ৫

~আপনি প্লিজ উত্তেজিত হবেন না। আমার ঘুম আসছিলো না সেইজন্য আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এত কিছু ভাবি নাই আপনি রাগ করবেন না। অনেক রাত হয়ে গেছে ঘুমিয়ে পড়ুন ।আমি আর কখনো রাত বিরাতে ব্যালকনিতে যাবো না প্রমিস।

এক প্রহর ভালোবাসার সিজন ২ পর্ব ৭