এক মুঠো কাঁচের চুরি পর্ব ১৮

এক মুঠো কাঁচের চুরি পর্ব ১৮
Fabiha bushra nimu

আট নাম্বার কেবিনের পেশেন্ট মারা গেছে।উনার বাসার লোক জনদের খবর দাও,রফিকুল।বলেই সাদা শাড়ি পরিহিতা নার্সটি চলে গেলো।
রোকেয়া বেগম ও’ তানহার দৃষ্টি নার্সটির চলে যাওয়া’র দিকে বিদ্যমান।তানহা কিছু বলতে যাবে।তখনই আরেকটা নার্স এসে বলল।

–জরুরি বিভাগের পেশেন্টর বাড়ির লোকজন কে কে আছেন।দ্রুত এক ব্যাগ A+ রক্তের ব্যবস্থা করুন।রোগীর প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে।আবরার ইফাদের বাসার লোক জনদের বলেছি।তানহা দ্রুত বলে উঠলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–আমরা আবরার ইফাদের বাসার লোক।
–আমি কি বললাম শুনেছেন।দ্রুত রক্তের ব্যবস্থা করুন।বলেই নার্সটি চলে গেলো।
–আম্মা আপনার রক্তের গ্রুপ কি?
–আমার রক্তের গ্রুপ B+ ইফাদের বাবার রক্তের গ্রুপ A+ ছিল।
–চৈতালির রক্তের গ্রুপ কি?
–চৈতালির রক্তের গ্রুপ B+ মনে হয়।

–আচ্ছা আপনি অপেক্ষা করুন।আমি দেখছি।বলেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো তানহা।তানহা চলে যেতেই চৈতালি আসলো।চৈতালি মাকে দেখতে পেয়ে,মায়ের কাছে আসে।রোকেয়া বেগমকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো চৈতালি।রোকেয়া বেগম-ও মেয়েকে ধরে কান্না করে দিল।এতক্ষণ বহু কষ্টে নিজেকে শক্ত রেখেছিল।চৈতালির কান্না দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না।

–আম্মু ভাইয়ার কিছু হবে না তো’।আমার ভাইয়া ঠিক হয়ে যাবে তো’।ভাইয়ার কোনো কমনসেন্স নাই।রাস্তার মাঝখানে দিয়ে কেউ হাঁটে।ভাইয়ার সাথে আমি প্রচুর ঝগড়া করবো।
–কান্না করিস না মা।আল্লাহর কাছে ভাইয়ের জন্য দোয়া কর।সোনা মেয়ে আমার কান্না করিস না।এর মধ্যে তানহা চলে আসলো।হাতে রক্তের ব্যাগ।

–আম্মা ব্লাড ব্যাংকে-ই রক্ত ছিল।আমি অন্যের রক্ত দিতে চেয়ে ছিলাম না।কার রক্ত কেমন।শরীরে কোনো রোগ-বালাই আছে কি না।কিন্তু এখন কিছু করার নেই।যেটা পেয়েছি নিয়ে আসলাম।
–তানহা তুমি দেরি করো না।তাড়াতাড়ি নার্সকে ডেকে রক্ত দিয়ে আসো।

তানহা অর্ধেক রাস্তায় যেতেই নার্স নিজেই এগিয়ে আসছিল।তানহার হাতে থেকে দ্রুত রক্তের ব্যাগ নিয়ে চলে গেলো।এক ঘন্টা পরে জরুরি বিভাগ থেকে ইফাদকে বের করে কেবিনে দেওয়া হলো।মাথায় প্রচন্ড আঘাত পাওয়া কারনে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল ইফাদ।মাথায় বেশি আঘাত পেয়েছে।হাত-পা ছুলে গিয়েছে।শরীরের কিছু কিছু জায়গায় ভালোভাবেই ক্ষত হয়েছে।মাথায় ব্যান্ডেজ,হাতে স্যালাইন এক হাত কপালে দিয়ে দু’টো বন্ধ করে আছে ইফাদ।একটু আগেই জ্ঞান এসেছে তার।চুপচাপ সবকিছু দেখছে।দু-চোখ খুলে তৃষ্ণার্থ চক্ষু তানহাকে খুঁজে ছিল।এক পলক তানহাকে দেখার জন্য মনটা উতলা হয়ে আছে।ধীরে ধীরে সাড়া শরীরে ব্যথা অনুভব করতে পারছে ইফাদ।

–আপনাদের রোগীকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে।আপনারা সবাই দেখে আসতে পারেন।তবে ওনাকে দিয়ে বেশি কথা বলাবেন না।মাথায় চাপ পড়ে এমন কোনো কথা বলবেন না।মাথায় বেশি আঘাত পেয়েছে।বলেই চলে গেলো’।তিনজন মিলে ইফাদের কেবিনে চলে গেলো।

রোকেয়া বেগম ছেলের গালে হাত দিয়ে আদর করতে লাগলো।ইফাদ চোখ মেলে তাকালো।মুখটা মলিন হয়ে গেছে।চেহারায় বিধ্বস্ততার বহিঃপ্রকাশ পাচ্ছে।ছেলের এমন চেহারা দেখে,রোকেয়া বেগমে’র বুকের ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে।বুকের মাঝখানে হাহাকার পড়ে গেছে।নিজের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে,কান্না নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।অবাধ্য অশ্রুধারা কিছুতেই হার মানবে না।না চাইতে-ও চোখ দিয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ল।

–আম্মু কান্না করছো কেনো?
–কথা বলিস না।আমি আর কান্না করবো না।
–ভাইয়া তুমি খুব খারাপ।খালি সুস্থ হয়ে নাও।তোমার সাথে আমার যুদ্ধ হবে।
চৈতালির কথায় ইফাদ মলিন হাসলো।ইফাদের চোখ গেলো দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তানহার দিকে।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।কান্না করতে করতে চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে।চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।তানহার মুখের দিকে তাকালেই যে,কারো মায়া হবে।ইফাদের বুকটা কেঁপে উঠলো তানহার এমন অবস্থা দেখে।

–সারাদিন তোদের কিছু খাওয়া হয় নাই।আমরা বাসায় গিয়ে রান্না করে নিয়ে আসি।চৈতালি তুই ভাইয়ের কাছে থাক।
–আম্মু আমি তোমার সাথে যাচ্ছি।ভাবি ভাইয়ার কাছে থাকুক।
তানহা অভিমান করে বলল।
–সমস্যা নেই চৈতালি।তুমি ছোট মানুষ তুমি আম্মাকে সাহায্য করতে পারবে না।আম্মার-ও শরীর ভালো না।আমি রান্না করে নিয়ে আসবো।তুৃমি বসে থাকো।

–তুমি কথাই বলতে পারছো না ঠিকমতো।তোমার কথা গলায় আঁটকে আসছে’।তুমি আবার রান্না করবে।তাহলে ভাইয়ার আর খাওয়া হবে না।আম্মু চল তো’।
–চৈতালি তুমি থাকো।আমি আম্মার সাথে যাচ্ছি।আম্মা চলুন।বলেই রোকেয়া বেগমে’র হাত ধরে চলে যেতে লাগলে ইফাদ ডাক দিল।

–তানহা তুমি থাকো।চৈতালি যাক আম্মুর সাথে।
–দেখো ভাবি ভাইয়াকে ডক্টর মাথায় চাপ দিতে নিষেধ করেছে।ভাইয়া যখন বলেছে তুমি ভাইয়ার কাছে থাকবে।তারমানে তুমি ভাইয়ার কাছে থাকবে।বলেই রোকেয়া বেগম’কে নিয়ে চলে গেলো।
তানহা দরজার কাছে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।কোনো কথা বলছে না।পুরো রুম জুড়ে নীরবতা বিরাজমান করছে।নীরবতা ভেঙে ইফাদ বলল।

–দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেনো?আমার কাছে এসে বসো।
তানহা বিনাবাক্যে ইফাদের কাছে গিয়ে বসলো।
–ঘুরতে নিয়ে যায়নি বলে রাগ করেছো।ইফাদের কথা শুনে,তানহা অবাকে’র শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেলো’।মানুষটা অসুস্থ।উনি এখনো ঘুরতে যাওয়া’র কথা ধরে বসে আছেন।খুব রাগ হচ্ছে তানহার।

–কথা বলবে না আমার সাথে।
–আপনি আমার সাথে কথা বলবেন না।ডক্টর কাউকে কথা বলতে নিষেধ করেছে।
–সুস্থ হলে ঘুরতে নিয়ে যাব।
–আপনার কোনো কান্ড জ্ঞান নেই।রাস্তায় মাঝখানে দিয়ে কেউ হাঁটে।কত করে বলি বাহিরে গেলে সাবধানে থাকবেন।আপনি আমার একটা কথা-ও শুনেন না।আপনার কিছু হলে আমি কি নিয়ে বাঁচবো।বলেই হাউমাউ করে কান্না করে দিল তানহা।

–তোমার মাঝে দেখে ছিলাম।আমি আমার সর্বনাশ।যে,মাথায় তুমি থাকো।সেই মাথায় অন্য কিছু কিভাবে প্রবেশ করবে বলো।আমি তোমার কথা যখন ভাবতে শুরু করি।তখন পৃথিবীর কোনোকিছু আমার খেয়াল থাকে না।
তানহা ইফাদের কথা উত্তর দিল না।ইফাদের কথা ভেবে কান্নার আওয়াজ কমিয়ে দিল।ফুঁপিয়ে কান্না করছে তানহা।
–তানহা’।

তানহা চোখ মেলে তাকালো ইফাদের দিকে।ইফাদের দিকে তাকানো মাত্রই তানহার মনে হলো,কেউ তার কলিজা কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলছে।তবু্ও নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে।
–ব্যথা করছে।
–কোথায়?
তানহা ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

–ঐদিকে কোথায় যাচ্ছো।এদিকে এসো।
–আপনার সমস্যা হচ্ছে ডক্টরকে ডেকে দিয়ে আসি।
–আমার ডক্টর তো’ আমার সামনেই আছে।নতুন করে ডক্টর ডাকতে হবে না।
–মানে?

–দূরে দূরে থাকো কেনো?আমার কথা বলতে সমস্যা হচ্ছে।আমার কাছে আসো।
তানহা কোনো কথা না বলে,ইফাদের পাশে গিয়ে বসলো।
–তোমাকে বললাম আমার ব্যথা করছে।কোথায় তুমি আমাকে দেখবে।তা-না তুমি বাহিরে চলে যাচ্ছো।
–কোথায় ব্যথা হচ্ছে আপনার।

ইফাদ বুকের মাঝখানে দেখিয়ে দিয়ে বলল এখানে।বিশ্বাস না হলে কান রেখে দেখো।তানহা ইফাদের বুকে হালকা করে মাথা রাখলো।ইফাদের ধুকপুকানির আওয়াজ তানহা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে।ইফাদের দিকে তাকিয়ে বলল।
–আপনি আমার সাথে মজা করছেন।

–তুমি আমার বান্ধবী লাগো।তোমার সাথে আমি মজা করবো।তুমি আমার বউ।তোমার চোখে পানি দেখলে আমার বুকের মাঝখানে লাগে।দেখতে পারছো না।তোমার চোখে পানি দেখে,ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।আমি নিজের ব্যথা সহ্য করে নিব।কিন্তু তোমার চোখের পানি সহ্য করবো না।আমার সামনে কান্না করলে।আমি এবার সত্যি মারা যাব।
–একদম বাজে কথা বলবেন না।

–তানহা চিৎকার করছো কোনো?ডক্টর ইফাদের মাথায় চাপ দিতে নিষেধ করেছে।
–স্যরি আম্মা ভুল হয়ে গেছে।আর হবে না।
–সারাদিন সবাই না খেয়ে আছোসবাই মিলে খেয়ে নাও।
–আম্মা আজান দিচ্ছে,নামাজ পড়ে খাব।

–ভুল কিছু বলোনি।চৈতালি চল আমরা নামাজ পড়ে আসি।তিনজন মিলে হসপিটালের নামাজ ঘরে চলে গেলো।নামাজ পড়ে ইফাদের কাছে আসলো।তানহা খুব সাবধানে ইফাদকে তুলে বসালো।রোকেয়া বেগম ইফাদকে খাইয়ে দিচ্ছে।তানহা ইফাদকে ধরে আছে।ইফাদের খাওয়া শেষ হলে,তিনজন মিলে খেয়ে নিল।

আজকে সাতদিন পরে হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরলো ইফাদ।প্রাণ ভরে শ্বাস নিচ্ছ।শরীরে ক্ষত শুকিয়ে আসতে শুরু করছে।শরীরের ব্যথা কমতে শুরু করেছে।তানহা ইফাদকে ধরে বাসায় মধ্যে নিয়ে আসছে।এই কয়দিনে ইফাদের যত্নের কোনো কমতি রাখে নাই তানহা।ছায়ার মতো পাশে থেকেছে।তানহার প্রতি ইফাদের ভালোবাসা দিগুণ বেড়ে গিয়েছে।এই কয়দিনে চৈতালির অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে তানহা।ইফাদের অসুস্থতার জন্য কিছু বলতে পারে নাই।সারাদিন ফোন নিয়ে থাকে।আগে থেকে ফোন ব্যবহার করা বেশি হয়েছে।পড়াশোনা-ও কম করছে।

–চৈতালি ফোন রেখে পড়তে বসো যাও।তানহার কঠিন গলা শুনে,চৈতালি উঠে চলে গেলো।ইফাদ তানহা’র ঘাড়ে ভর দিয়ে নিজের রুমে যাচ্ছে।রুমে এসে বিছানায় বসে পড়ল ইফাদ।
–আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছি তাই না তানহা।আমার জন্য ঠিকমতো ঘুমোতে পারো না।সঠিক সময়ে খেতে পারো না।একটু বিশ্রাম নিতে পারো না।সব সময় আমার সাথে থাকতে হয়।বিরক্ত হয়ে যাও না।
–আপনি আর আমি কি আলাদা নাকি।আপনি মানেই আমি।আর আমি মানেই আপনি।এখানে বিরক্ত হয়ে যাওয়ার কি দেখলেন।

–তোমার প্রতি ভালোবাসা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।
–আপনি আমাকে ভালোবাসেন।এটা কোনোদিন বিশ্বাস করবো না।
–এটা আমি কথার কথা বলছি।
–ওহ্।

–মন খারাপ করলে কেনো?ফ্রেশ হয়ে এসো ঘুমাবে।এই কয়টা দিন একদম ঘুম হয় নাই তোমার।
–আপনার এত ভাবতে হবে না।রাতে নামাজ পড়ে ঘুমাবো।বলেই রুম থেকে চলে গেলো তানহা।ইফাদ শব্দ করে হেসে ফেললো।

–আমি জানি তানহা তুমি কেনো রাগ করেছো?তুমি যতটা চাইছো।তার থেকে বেশি কিছু তোমাকে দিব।শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা।বিছানায় পা’ তুলতে গিয়ে পায়ে ব্যথা অনুভব করলো ইফাদ।অনেক চেষ্টা করে-ও নিজে নিজে পা তুলতে পারছে না।বাধ্য হয়ে তানহাকে ডাকলো।মেয়েটাকে আর কষ্ট করাতে ইচ্ছে করে না ইফাদের।সে-ও নিরুপায়।একা একা চলাফেরা করতে সমস্যা হয়।ইফাদের ডাক শুনে রুমে আসলো।

–কি হয়েছে রান্না করছি।
–এত রাগ দেখাচ্ছো কেনো?পা তুলতে পারছি না।একটু পা টা বিছানায় তুলে দাও।তানহা যত্ন সহকারে ইফাদের পা বিছানায় তুলে দিল।
–আমার পিঠের নিচে একটা বালিশ দিয়ে দাও।শুইয়ে থাকতে থাকতে বিতৃষ্ণা হয়ে গেছি।তানহা ইফাদের পিঠের নিচে বালিশ রেখে দিল।ইফাদ বালিশে হেলান দিয়ে বলল।
–তুৃমি চুলে কি শ্যাম্পু ব্যবহার করো।অনেক সুন্দর ঘ্রাণ আসছে।তোমার চুল ঘ্রাণ আমাকে খুব করে টানে।মাতাল করা ঘ্রাণ একদম।

–প্রথমত আমি চুলে মদ ব্যবহার করি না।যে,আমার চুলের ঘ্রাণে আপনি মাতাল হয়ে যাবেন।আর দ্বিতীয়ত আপনি ছোট মানুষ নাকি যে,আমার চুল আপনাকে টানবে আর আপনি চুলের সাথে চলে আসবেন।নাটক দেখতে দেখতে বুড়ী হয়ে যাব।বলেই চলে গেলো।

এক মুঠো কাঁচের চুরি পর্ব ১৭

–আল্লাহ আমার বউ এত চেতে গেলো কোনো?ইফাদ অসহায় দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলো।বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে,ফেসবুকে ঢুকলো।

এক মুঠো কাঁচের চুরি পর্ব ১৯