তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ২৬

তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ২৬
Israt Bintey Ishaque

সূর্যাস্তের পর নজরাত বিষন্ন মনে গার্ডেনে হাঁটা হাঁটি করে। তিন দিন হলো রূপক ইতালি চলে গেছে। এখনো পর্যন্ত তার কোন খবর পাওয়া যায়নি! আদৌও ঠিক মতো পৌঁছেছে কিনা আল্লাহ তা’আলা জানেন। রাহা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লে তাকে রাদ এ বাসায় নিয়ে আসে। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করছে না মেয়েটা। তার মতো সবাই খুব দুশ্চিন্তায় আছে। নজরাত জায়নামাজে বসে বসে আল্লাহ তা’আলা কে বলে চোখের পানি ফেলে। শরীর টা ও ইদানিং ভালো যাচ্ছে না তার।

কিছুদিন আগে কলেজে গিয়ে সেকি কান্ড! স্যার যখন ক্লাস নিচ্ছেন তখন হঠাৎ মাথা কেমন লাগতে শুরু হলো, মনে হলো আশেপাশের সব কিছু যেন ঘুরছে! কিছুক্ষণ পর সহ্য করতে না পেরে দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে মাথায়, চোখ মুখে পানির ঝাপটা দিতে নিলে গলগল করে বুমি করে ভাসিয়ে দেয়। তারপর কোন রকম ক্লাসরুমে ফিরে আসলে শোভা বিচলিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–” হঠাৎ দৌড়ে গেলি কোথায় বুঝতে পারলাম না। কি হয়েছে তোর? শরীর খারাপ করছে? ডাক্তার দেখাবি? নাকি ভাইয়া কে খবর দিব?
নজরাত ধীর কন্ঠে বলে,
–” না, কিছু করতে হবে না। একটু বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ।

সেদিন শোভা একা ছাড়ার সাহস পায়নি নজরাত কে। তাই মেয়েটা কষ্ট করে নজরাত কে বাসায় পৌছে দিয়ে যায়। সাজেদা চৌধুরী শুনে তখনি ডাক্তার দেখাতে চাইলে নজরাত বলে সে এখন সুস্থ আছে, ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন নেই। তবে নজরাত এর বান্ধবী প্রথমবার এসেছে তাকে খালি মুখে যেতে দেয়নি সাজেদা চৌধুরী। ঐ দিন টা অনেক বলে কয়ে রেখে দেয় শোভা কে। শ্বাশুড়ি মায়ের প্রতি নজরাত এর শ্রদ্ধা বেড়ে যায় দ্বিগুণ। পুরো বিকাল থেকে সকাল পর্যন্ত দুই বান্ধবী গল্প করে কাটিয়েছে। রাদ ও সেদিন বাঁধা দেয়নি একাই থেকেছে নিজের ঘরে।

একমাত্র ভাইয়ের চিন্তায় বার বার দীর্ঘশ্বাস ফেলে নজরাত। ঘরের ভিতরেও কেমন দম বন্ধকর পরিস্থিতি লাগে। মনে নানা রকম খারাপ দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খায়। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেনা নজরাত। সবকিছু কেমন অসহনীয় লাগছে। ভাইয়ের কথা মনে হতেই বড় বড় দুখানি চোখ টসটসে জলে ভরে উঠল। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায় নজরাত!
প্রায় দশ পনেরো মিনিট এভাবেই পরে থাকে। পরে মালি দেখতে পেয়ে দৌড়ে খবর দেয় সাজেদা চৌধুরী কে। খবর পেয়ে সাজেদা চৌধুরী, রাহা এবং মণি সবাই দৌড়ে আসে।

গার্ডেনে গাছের মাঝে মাঝে পাকা রাস্তায় পড়ে কপাল কেটে গেছে। ক্ষ’ত বেশি গভীর না হ‌ওয়ায় র’ক্ত গরিয়ে পরছে না। সবাই মিলে ধরাধরি করে ঘরে এনে সোফায় শুইয়ে দিলে মণি দ্রত গিয়ে বালতি ভরে পানি নিয়ে আসে। মাথায় দিতে দিতে আল্লাহ তা’আলার রহমতে জ্ঞান ফিরে। সাজেদা চৌধুরী একজন গাইনোকলজিস্ট কে কল করে বাসায় নিয়ে আসেন। ভদ্রমহিলা নজরাত কে কিছুক্ষণ পরীক্ষা করে বললেন,

–” পেসেন্ট যে প্রেগন্যান্ট আপনাদের জানায়নি?
এ কথা শুনে দুঃখের মাঝেও আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে পড়ে সকলে। সাজেদা চৌধুরীর চোখে পানি টলটল করে। আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন।

নজরাত চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ভাইয়ের দুশ্চিন্তায় কোন কিছুই ভালো লাগছে না তার। সে গতকাল ই জানতে পারে যে সে মা হতে চলেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে কাউকে জানানোর আগ্রহ জাগে তার মধ্যে। তাই কাউকেই কিছু বলেনি এবং কি রাদ কে ও না।
রাহা খুব কেঁদেছে। চোখের কোল ভারী। মুখখানা থমথমে। তবু একটু রক্তাভ উজ্জ্বলতা দেখা যায় তার মুখশ্রীতে। নজরাত এর মাথার কাছে নিয়ে বসে। ভাঙা গলায় বলে,

–” এতো বড় খবরটি চেপে রেখেছো কেন গো? খবরটা শুনে কিছুটা হলেও তো আনন্দ পেতাম।
নজরাত চোখ মেলে তাকায়। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু কণা। ডাক্তার কানা স্থানে মেডিসিন লাগিয়ে দিয়ে বললেন,

–” মিসেস চৌধুরী? আপনি যথেষ্ট বোঝবান তাই আশা করি ভবিষ্যতে এরকম অনিয়ম করবেন না। সাবধানতা অবলম্বন করবেন। এ সময়ে খাবারের অনিয়ম একদম ভালো হবে না। আপনি খাবার গ্রহণ করলে তবেই ভ্রুন বেড়ে উঠবে। কথাটা খেয়াল রাখবেন। আমি কিছু মেডিসিন লিখে দিচ্ছি এগুলো নিয়মিত সেবন করবেন। তারপর একমাস পর চেক‌আব করাবেন। যদি এর মধ্যে কোন প্রবলেম হয় তবে এর আগেই আমার সাথে যোগাযোগ করবেন।
সাজেদা চৌধুরী হতাশ গলায় বললেন,

–” এমন হ‌ওয়ার কারণ কি ছিল ম্যাডাম?
ডাক্তার আস্বস্ত করে বললেন,
–” এই সময়ে একটু আধটু মাথা ঘুরবে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার কিন্তু উনি নিয়মিত খাবার না খাওয়ার ফলে শরীর দূর্বল হয়ে পড়ে। যার ফলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেননি।
সাজেদা চৌধুরী নিস্তেজ গলায় বললেন,

–” একটা দুঃখের সময় পার করছি আমরা। তাই কারোই মন ভালো না। সে জন্যই খাবারের অনিয়ম হয়ে গেছে। এর পর আর হবে না। আমি নিজে খেয়াল রাখবো বৌমার।

ডাক্তার চলে গেলে। সাজেদা চৌধুরী নজরাত এর কাছাকাছি বসে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন। নজরাত তার হাতটা ধরে কেঁদে উঠে। তাদের সাথে সাথে মণি ও কাঁদে। সবাই কে বোঝায় আল্লাহ তা’আলা সব কিছু ঠিক করে দিবেন। ক্ষনিকের জন্য পরীক্ষা নিচ্ছেন মাত্র।

সবাই যখন নিস্তব্ধ ঘরে, নিস্তেজ হয়ে বসে থাকে তখন নজরাত এর ফোনে কল আসে। মণি ফোনটা এগিয়ে দিলে নজরাত ফোনের স্ক্রিনে বিদেশি নাম্বার দেখতে পেয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠে বসে। কল রিসিভ করে কাঁপা কাঁপা গলায় সালাম দিলে অপর পাশ থেকে সালামের জবাব শুনে প্রাণটা জুড়িয়ে যায় নজরাত এর। ভাঙা গলায় কেঁদে ওঠে বলে,

–” ভাইয়া তুমি ঠিক আছো তো? এতো সময় লাগল কেন? কল করতে।
রূপক বোন কে আস্বস্ত করে বলল,
–” আমি ঠিক আছি বোনু। একটু ঝামেলা হয়েছিল তাই আর কি।
এর মধ্যে রাহা অস্থির হয়ে নজরাত এর থেকে ফোন নিয়ে গেল। কেঁদে কেটে ভাসিয়ে জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে তার? কল করতে এতো দেরি হল কেন?

রূপক নানা কথাবার্তা বলে ব্যাপারটা এরিয়ে গেল। মূলত তার একটা ছোট খাটো এক্সিডেন্ট হয়েছে। ইতালিতে পৌঁছে বাসায় ফেরার পথে ঘটে এই অঘটন। মাথায় চোট পেয়ে র’ক্তক্ষরণ হয়। হসপিটালে ভর্তি করানোর পর চিকিৎসারত থাকে এ কয়দিন। তাই যোগাযোগ করতে পারেনি। সবাই এমনিতেই দুশ্চিন্তা করছে তাই আসল ঘটনা আর জানালো না রূপক।
অনেক কিছু বুঝিয়ে রাহা কে যখন শান্ত করে রূপক তখন রাহা নজরাত এর প্রেগন্যান্সির খবর জানায়। রূপক শুনে খুশি হয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে। তার কোর‌আনের একটা আয়াতের কথা স্মরণ হয়।

“অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করবো কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, জান-মালের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের”। [১]
আরো একটি সুন্দর আয়াত আছে,
আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদারগণ,তোমরা ধৈর্য্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো।নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সংঙ্গে আছেন। [২]
রাহা কে বললে রাহা বলে,

–” তুমি ঠিক বলেছো গো। আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা চাইলে সব কিছু সম্ভব। তিনি চাইলে মুহূর্তেই সব কিছু বদলে দিতে পারেন। আলহামদুলিল্লাহ।

রূপক এর সাথে কথা বলা শেষ করে রাহা কল করে ইমিডিয়েটলি রাদ কে বাড়ি আসতে বলে। নজরাত অসুস্থ শুনে রাদ অস্থির হয়ে পড়ে। বলে, ডাক্তার সাথে নিয়ে আসবে কিনা? অ্যাম্বুলেন্স কল করবে কিনা? রাহা কেন বসে আছে সে কেন ডাক্তার কে কল করেছে না?

রাহা জানায় ডাক্তার দেখে গেছেন। তখন রাদ একটু স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। দ্রুত বাসায় ফিরে যখন নজরাত কে শুয়ে থাকতে দেখে তখন কাছে এসে নজরাত এর মলিন মুখ দেখতে পায়। তারপর একটু খেয়াল করে দেখে কপালে কিঞ্চিৎ কাটা স্থান। সেখানে আলতো হাতে স্পর্শ করতে নজরাত চোখ মেলে তাকায়। রাদ কে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বলে,

–” তুমি! কখন এসেছ? আজকে এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে যে? অন্যদিন তো কতো রাত হয়ে যায়।
–” তুমি অসুস্থ হয়ে পড়েছ শুনেই তো কাজ রেখে চলে এসেছি। কি হয়েছে তোমার? ডাক্তার কি বলল?
নজরাত ক্লান্ত কন্ঠে বলল,

–” নিশ্চ‌ই রাহা জানিয়েছে? মেয়েটা না কি বলবো? তোমাকে কেন বলতে গেল?
–” তুমি অসুস্থ এটা বলবে না? যাই হোক রূপক এর খবর পাওয়া গিয়েছে?
–” হুম। আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া ভালো আছে।
পিছন থেকে আকস্মিক রাহা এসে বলল,

–” ভাইয়া আমার কিন্তু বড়সর একটা ট্রিট চাই! তাড়াতাড়ি বলো দিবে কিনা?
রাদ বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে বলল,
–” কিসের মধ্যে কি বলছিস বল তো?
রাহা বালিকার মতো সরল অকপটে গলায় বলল,

–” কিসের মধ্যে কি আবার? আমি ফুফি হচ্ছি! তুমি বাবা হচ্ছ! মা দাদু হচ্ছে! ভাবীমণি মা হচ্ছে! শ্বশুর বাবা নানা ভাই হচ্ছে! মণি আপা ও ফুফি হচ্ছে! সেখানে তুমি ট্রিট দিবে না আমাদের?
একদমে সব বলে থামে রাহা। এদিকে সব কিছু যেন মাথার উপর দিয়ে গেল রাদ এর। ভাবুক ভঙ্গিতে বলল,
–” মানে কি?
রাহা বলে,

–” আমি কি বলেছি সবটা ভেবে দেখ তবে বুঝতে পারবে।
সবটা ভেবে রাদ শাহমাত লাফিয়ে উঠে। নজরাত কে ঝাপটে ধরে বিকারগ্রস্তের মতো এলোমেলো হয়ে কি বলবে ভেবে পায় না….

তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ২৫

রেফারেন্স:-
[১]সূরা বাক্বারাঃ১৫৫
[২] সূরা বাক্বারাঃ১৫৩

তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব ২৭