এক মুঠো প্রণয় গল্পের লিংক || লেখনীতে একান্তিকা নাথ

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ১
লেখনীতে একান্তিকা নাথ

“ছিঃ ছিঃ রাত দুপুরে একঘরে একটা জোয়ান ছেলে আর একটা যুবতী মেয়ে থাকে কোন আক্কেলে আম্মা!তাও আবার এই ভরা বিয়ে বাড়িতে।মা যেমন ন’ষ্টা চরিত্রের ছিল মেয়েও ঠিক তেমনই ন’ষ্ট চরিত্রের তৈরি হয়েছে।রাজের মতো ভালো ছেলে দুটো আছে?সে ছেলেকে পর্যন্ত ফাঁ’সি’য়ে এসব ন’ষ্টা’মো’তে জড়িয়ে নিল ও?তারপরও আপনি বলবেন ওর কোন দোষ নেই আম্মা?ও একদম ধোঁয়া তুলসী পাতা?”

বিয়ে বাড়ির এত লোকের সামনে আমার চুলের মুঠি ধরে চিৎকার করে কথাগুলো বলেই থামল সেঝ চাচী।কন্ঠে উনার ক্ষোভ আর রাগ।আম্মা অন্য পুরুষের হাত ধরে নতুন সংসার বাঁধার পর এমন একটা দিনও যায়নি যে আমাকে আম্মার চরিত্র তুলে কথা শোনানো হয়নি।আব্বা তো উঠতে বসতেই রেগে যান আমার উপর।আব্বার দ্বিতীয় স্ত্রী,মানে ছোট আম্মাও যখনই পারেন আমাকে কথা শুনাতে ছাড়েন না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

একটু থেকে একটু হলেই সোজা গালে চ’ড় পড়ে।থাকার মধ্যে আছে শুধু দাদী।আমার খাওয়া, দাওয়া, ঘুমানো, থাকা সব দাদীর সাথেই।তবে দাদী ও যে একদম আদরে আমায় মাথায় তুলে রাখেন এমন নয়।দাদী বেশ কঠোর প্রকৃতির।দাদী ভালোবাসলে তা অল্প প্রকাশ করবেন, কিন্তু রেগে গেলে তা ভয়ানক রূপ ধারণ করে।

আর মেহেরাজ ভাই হলো আমার কিশোরী বয়সের প্রথম অনুভূতি,প্রথম ভালোবাসা।বুকের ভেতর অনুভূতিরা ডানা ঝাপটালে আমার তার নামই সর্বপ্রথম মনে পড়ে।অলস দুপুর বেলায়, কিংবা মধ্যরাতে হুটহাট আমি তাকে নিয়েই ভাবি।চঞ্চলতায় মগ্ন থাকা আমি হঠাৎ হঠাৎ এই বিষাদের সাগরে ডুব দিই উনাকে মনে করেই।উনার প্রতি একটা ভালোলাগা ছোটবেলা থেকেই ছিল।

তবে কৈশোর থেকে যখন বুঝতে শিখেছি ভালো লাগা, ভালোবাসা তখন থেকেই মেহেরাজ ভাইয়ের প্রতি আমার আকর্ষন গাঢ় হলো।উনার কথা বলা, চলাফেরা, রাগ সবই ভালো লাগত।যদিও তা আমি কখনোই প্রকাশ করিনি।তবুও দাদী যেন কিভাবে টের পেয়ে গেল আরো প্রায় বছর দুই আগে। দাদীই প্রথম জানতে পেরেছিলেন মেহেরাজ ভাইয়ের প্রতি আমার দুর্বলতার কথা।

এখন নিশ্চয়ই দাদীও আমায় দোষী ভাবছে।নিশ্চয় ভাবছে আমিই মেহেরাজ ভাইয়ের সাথে খারাপ কোন কিছু করতে চেয়েছিলাম।দাদীর কঠোর রূপ বেশ ভয়ঙ্কর।এই কারণেই দাদীকে আমি ভীষণ ভয় পাই। ভয়ে ভয়ে দাদীর দিকে তাকালাম।দাদীর কুচকানো গাল যেন রাগে লাল হয়ে আছে। চোখ রাঙ্গিয়ে আমার দিকেই যেন আগুন ঝারছেন।আমি ভয়ে শুকনো ঢোক গিললাম। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়েই বলে উঠলাম,

“আমি মেহেরাজ ভাইকে…”
বাকিটা আমি শেষ করতে পারলাম না।তার আগেই বাম গালে দাদীর শক্তপোক্ত হাতের চ’ড় পড়ল।সঙ্গে সঙ্গে গালটা জ্বলে উঠল।হাত দিয়ে গাল ঘষতে ঘষতেই দাদীর দিকে নিষ্প্রভ চাহনিতে তাকিয়ে রইলাম আমি।দাদীর ভেতরটা নরম হলেও বাইরেটা পাথরস্বরুপ।

আমি সেই পাথরস্বরূপ রূপটাকেই ভয় পাই বেশি।চ’ড় খেয়ে যেন কোন কথায় আমার মুখ দিয়ে আসল না আর।মাথাটা যেন একেবারে শূণ্য হয়ে গেল।বোকার মতো এদিক ওদিক চাইলাম।পায়ের নখ দিয়ে উঠোনের মাটিটাকে খা’মচে ধরে কান্না আটকানোর চেষ্টা করতে লাগলাম।কিন্তু কাজ হলো না।কান্নারা দম মানল না।আর সে কান্না দেখেই বোধহয় দাদী আরেক দফা বিরক্ত হলেন।নিজের হাত জোড়া দিয়ে আমার চুলের মুঠি ধরেই সেঝ চাচীর থেকে ছাড়িয়ে নিলেন।দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলেন,

” এত রাইতে তোর কি কাম থাকতে পারে ওর লগে ?এত্ত বড় একটা দেঙ্গী মাইয়া হইয়া এত বড় পোলাসহ এক ঘরে ক্যান থাকবি এত রাইতে?এইসব শিখাইছি তোরে? তোর মায় তো তার চরিত্তির জানান দিয়া কুকিত্তি কইরা বেড়াইয়া আমাগো মুখ পুঁ’ড়াইল।চোয়ারম্যানের পোলার হাত ধইরা রাইতের আন্ধারে ঢ্যাং ঢ্যাং কইরা চইলা গেল।তাই বইলা তুইও?তোরে যে কষ্ট কইরা ছোড থেইকা মানুষ কইরলাম তার এই প্রতিদান দিলি তুই?”

দাদীর কথাগুলো শুনেই কান্নার বেগ দ্বিগুণ হলো আমার।মাথা তুলে এক পলক তাকানোর আগেই দাদীর হাত থেকে কেউ আমাকে টে’নে হিঁ’চ’ড়ে নিয়ে গেল অন্য পাশটায়। তারপরই বলিষ্ঠ হাতে দুই গালে দুটো দাবাংমার্কা চ’ড় বসিয়ে দিল।আহ!গালটা যেন ভে’ঙ্গে গেল!ব্যাথায় অস্ফুট স্বরে কাঁত’রাতেই চোখে পড়ল আব্বার ভয়ঙ্কর চাহনী।আব্বার হাত বেশ শক্তোপোক্ত!ছোটবেলায় মা চলে যাওয়ার পর আব্বার হাতে অনেকবার চ’ড় খেয়েছি আমি।প্রত্যেকবারই চ’ড় মা’রা’র পর জ্বর চলে আসত আমার।সে জ্বর এক সপ্তাহের আগে ছাড়তই না।আমি হতবিহ্বল চাহনী নিয়ে আব্বার দিকে তাকিয়ে থাকার মাঝেই আব্বা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠলেন,

” বেয়া’দব মেয়ে!এসব করে বেড়াচ্ছিস তুই রাত-বিরাতে।ছিঃ!কোন কুক্ষণে যে তোর মাকে বিয়ে করেছিলাম।তার মাশুল আজ এতবছর পরও আমায় দিতে হচ্ছে।গেছিলই যখন পালিয়ে সাথে করে তুই নামক আপদটাকেও নিল না কেন?”

আমি ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলাম।ততক্ষনে দাদী এসে আমার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াল।আমাকে আগলে নিতে নিতেই চেঁচিয়ে বলল,
” আহ আনোয়ার!আমি ওরে শাসন করতাছি দেখস না?এত বড় মাইয়ার গায়ে হাত তোলার সাহস হয় কি কইরা তোর?ঠোঁট কাঁইটা রক্ত ঝরতাছে মাইয়াডার।”

দাদীর কথা শুনেই ঠোঁটের কোণে হাত রাখলাম।তরল কিছু অনুভব করেই বুঝলাম কেঁ’টে গেছে আব্বার চ’ড়ের আ’ঘা’তে।মা পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই আব্বা আমাকে তেমন একটা সহ্য করতে পারে না।শুধু আব্বা না,এই বাড়ির কেউই আমাকে পছন্দ করে না। মেহেরাজ ভাইও আমায় খুব একটা পছন্দ করেন না।উনার সাথে পরিচয় সেই ছোটবেলা থেকেই।পাশাপাশি বাড়ি আমাদের।

মেহেরাজ ভাইয়ের মা বাবা নেই। শুধু একটা বোন আছে।নাম মেহেরিন।আমি মেহু আপু বলেই ডাকতাম।আপু আমায় বেশ ভালোও বাসত।কিন্তু মেহেরাজ ভাই আমায় কোনকালেই তেমন একটা পাত্তা দেয়নি।ছোটবেলায় বেহায়ার মতো উনার আশপাশটায় পড়ে থাকতাম আমি।উনার সাথে খেলার জন্য কত কান্না করতাম।কিন্তু উনি প্রতিবারই আমায় কোন না কোন কিছু বলে বা করে কষ্ট দিয়েছেন।

কোন বার ঝাল তরকারি খাইয়ে, নয়তো কোনবার উঠোনে রোদে দাঁড় করিয়ে শাস্তি দিতেন।একবার তো কি ভীষণ নির্দয়ভাবে হাতে মেরেছিলেন উনি।বড় হওয়ার পর অবশ্য মেহু আপু,মেহেরাজ ভাই কাউকেই তেমন কাছ থেকে দেখিনি।মেহেরাজ ভাইদের শহরের বিল্ডিংটা তৈরি করার পর উনারা ওখানেই থাকতেন।মাঝেমাঝে গ্রামে আসতেন।দাদীর সাথে ভালো সখ্যতা থাকায় আমাদের বাড়িতেও আসতেন।

আসলে এক পলক দেখা হতো।বেশ ঐটুকুই!তারপর যখন থেকে বুঝতে পারলাম মেহেরাজ ভাইয়ের প্রতি আমার কোন এক দুর্বলতা কাজ করে,তখন থেকেই আমি মেহেরাজ ভাইয়ের দিকে কখনো মুখ তুলে তাকাইনি। বরাবরই এড়িয়ে চলেছি।উনি আমাদের বাড়ি আসলে ঘর থেকে বের হতাম না যাতে উনার সম্মুখীন না হতে হয়।মেহু আপু উনাদের বাসায় বারবার যেতে বললেও কখনো যাইনি ঐ একই বাসায় মেহেরাজ ভাইও থাকেন বলে।

এত এড়িয়ে যাওয়ার পরও দেড়বছর আগে অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনা ঘটল। মেহেরাজ ভাই কিভাবে যেন আমার ডায়েরীটা হাতে পেয়ে গেল।তারপর কি ভীষণ অপ’মান করলেন পুকুর পাড়ে নিয়ে গিয়ে।আমি যে উনার যোগ্য না তা উনার প্রত্যেকটা কথায় পরতে পরতে বুঝিয়ে দিলেন।শুধু এইটুকুতেই থেমে ছিলেন না। শাস্তিস্বরুপ কাঁচের টুকরোর উপর হেঁটে পা জোড়া র’ক্তা’ক্ত ও করতে হয়েছিল আমায়। আমার অপরাধ ছিল উনার প্রতি আমার অনুভূতিগুলো আমার ডায়েরীর পাতায় জড়ো করেছিলাম।

যখন কাঁচের টুকরো গুলো পায়ের চামড়া ভেদ করে পুকুরের সিঁড়িটা র’ক্তা’ক্ত করছিল তখন আমার কলিজা ছি’ড়ে যাচ্ছিল।যন্ত্রনায় শরীরের শিরা উপশিরা কাঁ’তরে উঠছিল।কিন্ত উনি আমার এই কষ্টে একটুও কষ্ট পেলেন না।উনার মুখে ছিল পৈশাচিক এক আনন্দানুভূতি।সেইদিনের পর আমি মেহেরাজ ভাইকে চরম রকমে ঘৃণা করি।মানুষটার নাম শুনলেই ঘৃণায় নিং’ড়ে উঠে মন, রন্ধ্রে রন্ধ্রে এক বিষাক্ত অনুভূতি রাজ করে।

আর সেই ঘৃণাটা এখন আরো বেশি জলজ্ব্যান্ত হয়ে উঠল।এই মুহুর্তে যা যা ঘটছে সবকিছুর জন্য তো উনিই দায়ী।অথচ উনার উপর একটাবারও কোন কথা উঠল না।এতে যে আমার কোন দোষ নেই উনি একটাবারও তা বলে গেলেন না।একটা মেয়ের চরিত্রে কলঙ্ক লাগিয়ে উনি উনার প্রেমিকার রাগ ভাঙ্গাতে চলে গেলেন।কি ভীষন নির্দয় মানুষ উনি।আজ নিশ্চয় আম্মা থাকলে এমন কিছুই হতো না।

আম্মা থাকলে সবাই আমাকে পছন্দ করত।মেহেরাজ ভাইও হয়তো পছন্দ করত ।আমার চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন উঠত না।আব্বাও আমায় এভাবে মারতেন না। তবে আব্বা আমারে মা’রু’ক,পি’টু’ক আব্বার প্রতি আমার কোনকালেই কোন অভিযোগ নেই।

আমার সকল অভিযোগ শুধু আমার আম্মার প্রতি।হয়তো গরিব ছিলাম আমরা কিন্তু কোনকিছুরই তো অভাব ছিল না। কেন মা আমাকে আর মিথিকে একা ছেড়ে পালিয়ে গেল?এর সকল দায়ভার কি শুধু আমারই?এই যে সারাজীবন সবাই আমারে মায়ের জন্য কথা শুনাল, মায়ের চলে যাওয়ার কারণটা কি আমি ছিলাম?আম্মা কেন আমাকে সকলের চোখের বালি করে রেখে গেল?কেন?

আমার ভাবনার মাঝেই আব্বা আবারও তেড়ে এলেন আমায় মা’র’তে। এবার হাতে একটা বাঁশের মতো লাঠি।আমি আৎকে উঠলাম।ভয়ে গুঁটিশুঁটি মেরে দাদীর আঁচলটা খা’মচে ধরেই নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করলাম।আব্বা রাগে কাঁপতে কাঁপতেই যেন লাঠিটা দিয়ে মে’রে উঠবেন। সেঝ চাচা আর ছোট চাচা ধরে বেঁধেও আব্বাকে আটকাতে পারল না যেন।আব্বা তেড়ে আরো দু পা এগোতেই দাদী আমার হাতটা শক্ত করে ধরে টে’নে নিয়ে গেল ঘরে। তারপর হনহনিয়ে ঘর থেকে বের হয়েই বাইরে দিয়ে দরজা লাগাল।আমি দম ফেললাম।দরজার ওপাশ থেকে শোনা গেল আব্বার ক্ষ্রিপ্ত গলা।

” ও ওর চরি’ত্রহীন মায়ের মতোই তৈরি হয়েছে আম্মা।এরপরও শাসন করব না বলছেন?সারাজীবন খাইয়ে পড়িয়ে একটা কালসাঁপ পুষে এসেছি।ভাগ্যিস আজ বাড়ির কেউ দেখল ব্যাপারটা। নয়তো জানতামই না এই বেয়াদব মেয়ে কিসব করে বেড়াচ্ছে। ইচ্ছে করছে জুতো দিয়ে পি’টি’য়ে জ্যা’ন্ত মাটিতে পুঁ’তে দিতে।”
দাদীও বলে উঠল কর্কশ গলায়,

” চুপ কর আনোয়ার।ও তোর মাইয়া হয়।”
দাদীর কথা শেষ হতেই শোনা গেল ছোট আম্মার গলা।ছোট আম্মা যেন এরই অপেক্ষাতেই ছিল এতক্ষন।অবশেষে সুযোগ পেয়ে মুখটা খুলেই ফেললেন।
” তা আপনার গুণধর নাতনি বুঝি খুব একটা সাধুকাজ করেছে আম্মা? আপনিই ওকে আস্কারা দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছেন।আপনার জন্যই আজ এই মেয়েটা এমন কুকৃত্তি করার সাহস পেয়েছে বুঝলেন।শেষে মুখ তো পু’ড়বে আমাদের।”

” দেখ মেঝ বউ তোমার লগে তো জ্যোতিরে নিয়া কোন কথা কইতাছি না।যাক,যাও ঘরে যাও হগ্গলে।ঘটনা কি ঘটছে না ঘইটছে তা নিয়া কাইলকাই কথা হইব। এহন এইহানে হগ্গলে নাই।হগ্গলের সামনেই কথা হইব।সেঝ বউ সইত্ত কইছে কিনা তারও তো ঠিক নাই।তাই কইতাছি,যাও ।কাইলকাই কথা হইব এই নিয়া।”
দাদীর শেষের কথাগুলোতে যেন সেঝ চাচী বড্ড দুঃখ পেলেন।গলা নিচু করেই বললেন,

” সে কি আম্মা?আমি মিথ্যে কথা বলব এই ব্যাপারে?ওকে কি আমি ছোট থেকে বড় করিনি?মেয়ের মতো দেখিনি?ওর চরিত্রে দোষ দিয়ে আমার লাভ কি?”

” তা আমি কেমনে জানুম? রাতদুপুরে এমনে চিৎকার দিয়া এতগুলা মানুষরে কথাডা জানাইয়া লাভ কি হইছে তোমার? মাইয়ার মতো দেখলে তো তুমি এই কাম করতা না। যাও ঘরে যাও, ঘুমাও।”
তারপর আর কেউ দাঁড়াল না। সবাই যার যার মতো ঘরে চলে গেল।আমি একটা তপ্ত শ্বাস ফেললাম।মাথার উপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, এই জীবনের শেষ হবে কবে!

আজ আরমান ভাইয়ের হলুদ ছিল।আরমান ভাই আমার ফুফাত ভাই।ফুফা মারা যাওয়ার পর থেকে ফুফু আর আরমান ভাই এখানেই থাকেন।আরমান ভাইয়ের হলুদের অনুষ্ঠানের আয়োজন বাড়ির সামনে খালি জায়গাটায় করা হয়ছে।বেশ বড়সড়ো খোলামেলা জায়গায়।এখনো সবাই সেখানেই হৈ হুল্লোড়ে মেতে আছে।আমার এসব হৈ হুল্লোড় ভালো লাগে না।তবুও ভাই-বোনদের চাপে পড়ে একটা বাসন্তীরাঙ্গা শাড়ি পরে উপস্থিত হতে হলো সেখানে ।

খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হতেই কোন রকমে তাদের বুঝিয়ে বাড়িতে আসলাম।বাড়িতে তখন চাচী,ফুফু সহ অল্প কয়েকজন মুরুব্বি ছিল।আমি কলে গিয়ে মুখ চোখ ধুঁয়ে দাদীর ঘরে গেলাম।দাদীর ঘরটা টিনের,মাটির মেঝে, ভীষণ স্যাঁতস্যাঁতে। আসবাবপত্র বলতে দুই রুমে দুটো খাট, একটা কাঠের আলমারি,একটা কাপড় রাখার আলনা, একটা পড়ার টেবিল আর দুটা কাঠের পুরোনো চেয়ার ।ঘরটায় এক রুমে আমি আর অন্যরুমে দাদী থাকেন।পাশ দিয়ে চালা দেওয়া রান্নাঘর।ব্যস! এই হলো আমার আর দাদীর ছোটখাটো সংসার।

আমি দু পা বাড়িয়ে আমার রুমে উঁকি দিলাম।ফুফু সহ আরো বেশ কয়েকজন জড়োসড়ো হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে।ধীর পায়ে দাদীর রুমে গেলাম।দাদীর রুমের ছিটকিনিটা নষ্ট।দরজা লাগানো যায় না।ঘরে শুধু আমি আর দাদী থাকি বলে ছিটকিনি লাগানোর প্রয়োজন ও পরেনি এতদিন।আমি দরজা ভিড়িয়ে ফ্যানের সুইচ দিলাম।মাথা ব্যাথা আর শাড়ি পরার অস্বস্তিতে বিরক্তি লাগছিল।দাদীর রুমটা ফাঁকা দেখেই তৃপ্তি পেলাম।

ক্লান্ত শরীরটা ধপ করে মেলে দিলাম দাদীর স্যাঁতস্যাঁতে বিছানায়।ঘুমে চোখজোড়া লেগে আসবে ঠিক সেই মুহুর্তেই মনে হলো শাড়ি খুলে জামা পরা উচিত।সবাই এমনিতেও হলুদের অনুষ্ঠানে।কেই বা এখন এখানে আসবে?এই ভাবনা মাথায় নিয়েই দাদীর রুমে আলনা থেকে জামা নিলাম।তারপর একে একে ব্লাউজ থেকে সেইফটিপিন গুলো খুলে ফেলতেই আঁচলটা গড়িয়ে পড়ল মাটির মেঝেতে।

হাত দিয়ে কুঁচিগুলো খুলব ঠিক সে সময়েই বিদ্যুৎ চলে গেল।আমি কপাল কুঁচকে বিরক্ত হলাম।গ্রামের বাড়ি!দিনে চৌদ্দবার বিদ্যুৎ যাওয়া আসা দেখতে দেখতে বিরক্ত হওয়া নিত্যদিনের ঘটনা।অন্ধকারে দু পা হেঁটে টেবিলের ড্রয়ারে কিছুক্ষন মোমবাতি খোঁজার চেষ্টা করলাম।কি আশ্চর্য!একটা মোমবাতিও আজ নেই।আবার ও উল্টোদিক ঘুরে দু পা হাঁটব তার আগে কেউ একজন তীব্র আলো ফেলল আমার চোখে।তৎক্ষনাৎ চোখ কুঁচকে এল আমার।আলোটা আমার দিকে থাকায় লোকটা কে তাও বুঝলাম না।কিছু একটা বলতে যাব ঠিক তখনই লোকটা তার মোবাইলের আলো নিভিয়ে ফেলল।অপ্রস্তুত গলায় বলল,

“বোধবুদ্ধি কিছু আছে তোর মাথায়? র্ রুমের দরজা লাগাসনি কেন?আশ্চর্য!দাদীর জন্য পানের বাটা নিতে বলল চাচী।পানের বাটা কোথায় আছে ?দেখ তো।সামান্তা আসবে, ওকে দিস।”
আমি থমকে গেলাম।এটা মেহেরাজ ভাইয়ের কন্ঠ।উনি এইখানে এই মুহুর্তে আসবে বা আসতে পারে আমি কল্পনাও করিনি কখনো।আমার বুকে যে আঁচল নেই তা বুঝতে পেরে মুহুর্তেই নিজেকে নিজের কাছে ভীষণ ছোট মনে হলো।

ঘন অন্ধকারে আঁচলটা কোনরকমে খুঁজে টেনেটুনে পরব তার আগেই মেহেরাজ ভাই ঠা’স করে পড়লেন আমার উপর।আকস্মিক ধাক্কা আমি সামলে উঠতে পারলাম না।মেহেরাজ ভাইয়ের শরীরের ধা’ক্কায় আমিসহ পড়ে গেলাম মাটির মেঝেতে। ঠিক সেই মুহুর্তেই দরজার ওপার থেকে আবারও কেউ আলো ছুড়ল আর বলতে লাগল,

” রাজ? জ্যোতি তো আছে মনে হয় রুমে।ওকে বললেই তো হয়
পানের বাটা কোথায় আছে ও তো জানে।এই মেয়েটা কোন কাজের না।কি যে করে কিজানি।আম্মা এই মেয়েটারে শুধুু শুধ্……”

বাকিটুকু বলার আগেই সেঝ চাচী আমাকে আর মেহেরাজ ভাইকে এই অবস্থায় লক্ষ্য করলেন।তারপরই চিৎকার দিয়ে সবাইকে ডাকতে লাগলেন।ঘটনার আকস্মিকতায় আমি থম মে’রে গেলাম।কিছুই বোধগম্য হলো না। পরমুহুর্তে চাচী যখন সবাইকে ঘটনার বর্ণনা বলতে লাগল অপমানে আমার শিরা উপশিরা জ্বলে উঠল।ঘৃণ্য অনুভূতিতে মন নিং’ড়ে উঠল।আর ঠিক তখনই সামান্তা আপুও এসে হাজির হলেন।

সামান্তা আপু মেহেরাজ ভাইয়ের চাচাতো বোনও বলা যায় আবার প্রেমিকাও বলা যায়।বছর চারেকের সম্পর্ক উনাদের।এতদিনের ভালোবাসার মানুষ!এতদিনের প্রনয়!সেই মানুষটা সম্পর্কেই এমন ঘটনা শোনার পর সামান্তা আপু নিজেকে সামলাতে পারলেন না।

শত হোক নিজের প্রেমিক অন্য মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় ছিল কথাটা মানা যায় না। কান্না করতে করতে উনার অবস্থা খারাপের দিকে গেল।এক পর্যায়ে উনি অসুস্থ হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন।মেহেরাজ ভাই উনাকে কোলে তুলে সঙ্গে সঙ্গে ছুটলেন।বাকি রয়ে গেলাম আমি।তারপর যার যত রাগ, যত অপবাদ, যত অপমান সব আমার নামেই লিখে দিচ্ছে।কেউ একটিবারও আমার কথা শুনতে চাইল না।একটিবারও আমাকে বুঝতে চাইল না কেউ।এমনকি দাদীও না।

এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ গড়িয়ে উষ্ণ পানি বইল।বুকের ভেতর অস্থিরতা অনুভব হলো।এতটা কষ্ট,এতটোা অপমান আমার জীবনে না আসলেই কি হতো না?

ভোর হলো।বাইরে থেকে পাখিদের কিচিরমিচির ডাকের আওয়াজ আসল।জানালার ফাঁক দিয়ে কিঞ্চিৎ আলোও ডুকল ঘরে।আমি উঠে বসলাম। জানালাটা মেলে দিয়েই পর্দা সরালাম।কিছুক্ষন ঠাঁই বসে থেকেই জামাকাপড় নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে কলঘরে গেলাম।একটা গোসল করলে শান্তি লাগবে।গায়ে এক বালতি পানি ঢেলেই কোনভাবে গোসল সেরে বের হয়ে চারদিকে তাকালাম।কেউ কোথাও নেই।সবাই ঘুমোচ্ছে। আমি ভেজা কাপড় গুলো উঠোনের সামনের জায়গাটায় দড়িতে মেলে দিলাম।পরমুহুর্তেই ধীর পায়ে এগোতে গিয়ে মেহেরাজ ভাইকে দেখে চমকে গেলাম।আমি দাঁড়ালাম না। দৃষ্টি সরিয়ে দ্রুত পায়ে চলে আসতে নিতেই মেহেরাজ ভাই গমগমে কন্ঠে বলে উঠলেন,

” জ্যোতি শোন।”
আমার পা জোড়া থেমে গেল।তবে দৃষ্টি পেছন ফিরল না।মাথা নাড়িয়ে বললাম,
” জ্বী, বলেন ভাইয়া।”

মেহেরাজ ভাই আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন।তবুও আমি চাইলাম না তার দিকে।আমার মনে তখন তার জন্য চরম ঘৃণারা জ্যান্ত হয়ে উঠল।উনি চাইলেই পারতেন কালকে সবার সামনে সবটা বলতে।আমাকে এই দোষ থেকে মুক্ত করতে।কিন্তু উনি তা করেননি।আমায় এক সমুদ্র অপমানে ভাসিয়ে দিয়ে উনি গা বাঁচিয়ে পালালেন।সেসব মনে করেই আমি রাগে জ্ব’লে উঠলাম।মেহেরাজ ভাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন।এবার এই অবস্থায় দেখেও যদি কেউ কোন কিছু বলে তাও সব দোষ আমারই হবে।আমি সরে যেতে লাগলেই মেহেরাজ ভাই আবারও বলে উঠলেন,

” দাঁড়াতে বললাম না তোকে?কথা কানে যায় না তোর?”
আমি আবার দাঁড়ালাম।বললাম,
“আমার একটু কাজ আছে।”
” কি কাজ?”
” আপনি কি বলবেন বলুন।”
” এড়িয়ে যাচ্ছিস তুই?তোর স্পর্ধা দিন দিন বাড়ছে জ্যোতি।”
আমি তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসলাম। মৃদু গলায় বললাম,

” কি যে বলেন!কোথায় আপনি আর কোথায় আমি।আপনার নখেরও যোগ্য না। আপনাকে এড়িয়ে যাব?সাধ্য আছে আমার?”
মেহেরাজ ভাই আবারও চুপ রইল।উনি যা বলতে চাইছেন তাতে যেন রাজ্যের সংকোচ। তারপর কিছুটা সময় পর কি বুঝেই বললেন,
“স্যরি,আমি অন্ধকারে পা বাড়াতেই কিছুর সাথে হোঁচট খেয়ে তোর উপর গিয়ে পড়েছিলাম।দোষটা হয়তো আমারই ছিল।”

পুণরায় তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসলাম।উনি এসব বলছেন তা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্যও হলো না।তবুও বিশ্বাস করলাম।বললাম,
” তো?এসব শুনে আমি সবাইকে বলে বেড়াব আমি নির্দোষ?নাকি দোষটা আপনার সেটা বলে বেড়াব?এসব বলার মানে কি মেহেরাজ ভাই?”

” আমার মনে হয়েছে তোকে স্যরি বলা উচিত তাই।আর কিছু না।”
” একটা স্যরিতে সব মিটে গেল?যদি মিটে যেত তাহলে নাহয় বললে লাভ হতো।যাক, বাদ দিন।আমি কষ্ট সহ্য করতে পারি, অভ্যাস আছে আমার।সেভাবে বদনামও সহ্য করে নিব।”
মেহেরাজ ভাই বোধহয় রেগে গেলেন এবার।নিরেট কন্ঠে শুধাল,
“তুই এমনভাবে বলছিস যেন আমি তোর উপর প্রতিশোধ নিতে এসব করেছি।”

” যদি প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করে করেই থাকেন তাহলেও কি?আপনার তো কোন বদনাম হয়নি।তবে আমি কিন্তু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আপনি ইচ্ছে করেই এই প্রতিশোধটা নিয়েছেন।ইচ্ছেকরেই!”
মেহেরাজ ভাইয়ের রাগ দ্বিগুণ হলো।গলাটা কিছুটা উঁচিয়েই বললেন,
” তুই কি বলছিস জানিস তুই?আন্দাজে কথা বলবি না জ্যোতি!”

এবার আমার ভেতরকার অভিযোগ গুলো নড়ে চড়ে উঠল এক মুহুর্তেই।তৎক্ষনাৎ আমার মুখ থেকে বেরিয়ে আসল,
“জানি আমি,সবটা জানি।কেন করলেন এমনটা মেহেরাজ ভাই?কি ক্ষতি করেছিলাম?দেড়বছর আগে সে ডায়েরীটা আপনার সামনে চলে এসেছিল বলে?আমি তো মুখে কিছু বলিনি কোনদিন।শুধু একপাক্ষিক কিছু অনুভূতি বহন করে চলছিলাম।ডায়েরিতে লিখে ফেলেছিলাম।

বিশ্বাস করুন, সেবারের পর আপনাকে নিয়ে আর কোনদিন লিখিনি কিছু।আপনার দিকে তাকিয়েও দেখিনি।দুইবছর আগে আমাকে ভাঙ্গা কাঁচের উপর দিয়ে হাঁটিয়ে মজা নিলেন,উপহাস করলেন।আর এখন এতগুলো দিন পর এই জঘন্য শাস্তিটা?আপনাকে নিয়ে কয়েক পাতা লিখা আমার এমনই জঘন্য অন্যায় ছিল? আমার চরিত্রে এতবড় একটা দাগ না দিলেই কি হতো না মেহেরাজ ভাই?”

মেহেরাজ ভাই কিয়ৎক্ষন চুপ থাকল।বোধহয় রাগ নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করল।তবে বিশেষ লাভ হলো না।পরমুহুর্তেই ক্রোধ নিয়ে বলে উঠলেন,

” তোকে স্যরি বলাটাই ভুল হয়েছে।তুই একটা অসহ্যকর, বিরক্তিকর মেয়ে।শুধুমাত্র কালকে রাতের ঘটনাটার জন্য সামান্তা আমার সাথে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।আমার এতবছরের ভালোবাসা,বিশ্বাস! সব শেষ!কিচ্ছু নেই আমার।কিচ্ছু না।এতকিছুর পরও তোকে স্যরি বলতে আসাটা চরম রকমের বোকামো! ”

তারপর আর দাঁড়ালেন না মেহেরাজ ভাই।চোখ মুখ লাল করে উল্টো দিকটায় হাঁটা দিয়ে সোজা চলে গেলেন।আমি সেদিক পানে তাকিয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেললাম শুধু।মনের ভেতর প্রশ্নরা জমাট বাঁধল।উনি কি অস্পষ্টভাবে উনাদের বিচ্ছেদের দায় দিয়ে গেলেন আমাকে?

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ২