এক মুঠো প্রণয় পর্ব ৩১

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ৩১
লেখনীতে একান্তিকা নাথ

মাঝখানে কয়েকটা দিন কেঁটে গেল এভাবেই।জ্যোতির পা এখনও সারেনি তবে কাঁটা আঘাত গুলো সেরে উঠেছে। মেহেরাজের আচরণে এই কয়েকদিন স্পষ্ট অজানা অনিভূতির আভাস টের পেলেও জ্যোতি সরাসরি জিজ্ঞেস করে উঠতে পারেনি।

সরাসরি জেনে নিতে পারে নি সে সব চাপা কথা, চাপা অনিভূতি আর জটিল স্বীকারোক্তি। পরনের ওড়নাটা মাথা অব্দি টেনে নিয়ে জানালা দিয়ে রাতের আকাশে চোখ রাখল জ্যোতি। নিঃশব্দে ভাবল কেবল একজনকে নিয়েই।হঠাৎই কি মনে করে মোবাইলটা হাতে নিয়ে একবার কল করে বসল মেহেরাজকে।মেহেরাজ কল তুলল না। পরক্ষনে কলও করল না। জ্যোতির মন হঠাৎ উদাস হলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

কয়েকটা দিন একইভাবে বসে, শুঁয়ে থেকে বিষন্ন অনুভূতিতে মনে বিষন্নতা বাঁধা বেঁধেছিলই।এই মুহুর্তে সেই বিষন্নতার সুর যেন গাঢ় হলো।জ্যোতি চোখ বন্ধ করে হেলান দিল বিছানার সাথে। জানালা দিয়ে আসা ফিনফিনে বাতাসে শীতল অনুভূত হলো শরীর।কিয়ৎক্ষন সেভাবেই কাঁটল বোধ হয়।তারপর হঠাৎ সে শীতল অনুভূতি কাঁটিয়ে তার কানে আসল মেহেরাজের জমাট গলা,

” তুই কি চোখ বুঝে রেখে ভুলবশত আমায় কল দিয়ে দিয়েছিস জ্যোতি?”
জ্যোতি সঙ্গে সঙ্গেই চোখ মেলে তাকাল। অফিস থেকে মাত্র ফেরা যুবকটিকে দেখে নিল সূক্ষ্ম চাহনিতে। ঘর্মাক্ত শার্ট আর ক্লান্ত মুখ থেকে নজর সরিয়ে বলল,
” ঠিকবশতই দিয়েছি।বিরক্ত হয়েছেন আপনি ? ”
মেহেরাজ এগিয়ে এল।জ্যোতির পাশে খাটের এককোণ বসে পায়ের মোজা খুলতে ব্যস্ত হয়েই ত্যাড়া গলায় জবাব দিল,

” তা জেনে কি করবি?”
জ্যোতির মুখের উদাস ভাব এবার আরো ঘন হলো। মনে মনে ভেবেই নিল মেহেরাজ বিরক্ত হয়েছে। বিরক্ত হয়েছে বলেই কল তুলে নি। স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠল,
” কিছুই নয়।বিরক্ত হলে পরে আর কল দিব না।তাই জিজ্ঞেস করছি।”
মেহেরাজ ভ্রু উঁচু করে একনজর তাকাল। মোজা জোড়া খুলে একপাশে রেখে হাত দিল গলার টাইয়ে। ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,

” তুই তো দরকার ছাড়া কল দিস না।তো কি দরকারে কল দিয়েছিলি?”
জ্যোতি তাকাল। স্পষ্ট স্বরে প্রশ্ন ছুড়ল,
” দরকার ছাড়া কি আপনাকে কল করা যাবে না মেহেরাজ ভাই?”
মেহেরাজ খানিকটা ত্যাড়া গলায় দাঁতে দাঁত চেপ বলে উঠল,
” দরকার ছাড়া তুই কেন কল করবি?প্রেমালাপ করার জন্য?”

জ্যোতির মুখ থমথমে হয়ে গেল। উত্তর দিল না। কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে মেহেরাজকে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতে দেখেই গলা ঝাড়ল। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠল,
” একটা প্রশ্ন করব মেহেরাজ ভাই?”
মেহেরাজ পেছন ঘুরে চাইল। গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
” কয়েক মিনিট পর এসে শুনছি।”

কথাটা বলেই ওয়াশ রুমে ডুকল। বের হলো বেশ খানিকটা পর। চুলগুলো ভেজা৷ পরনের শার্টটার বোতাম গুলো লাগানো নেই, হাতাগুলোও গুঁটানো নেই। মুখে ফোঁটাফোঁটা পানির অস্তিত্ব।জ্যোতি একনজর তাকাতেই প্রথমে চোখে পড়ল বোতাম না লাগানো শার্টের মাঝের উম্মুক্ত পুরুষালি বক্ষ।মুহুর্তেই চোখ নামাল। মেহেরাজ তা খেয়াল করেই বোধহয় হালকা হাসল। হাত দিয়ে বোতাম লাগাল সময় নিয়ে।তারপর হাতাগুলো গুঁটিয়ে নিয়েই আচমকা ভেজা চুল নিয়ে জ্যোতির পাশের জায়গাটুকুতে গা এলিয়ে দিল।বালিশে মাথা রেখে চোখ বুঝে বলে উঠল,

” এবার বল, ভালো করে শুনব। ”
জ্যোতি প্রশ্নটা করতে পারল না।কেন জানি না গলা পর্যন্ত এসেও মুখ পর্যন্ত এসে পৌঁছাল না তার প্রশ্নটা।এই মুহুর্তে প্রশ্নটা কিভাবে করা উচিত তাও বুঝে উঠল না ঠিক। সবসময় স্পষ্ট ভাবে কথা বলে আসলেও এখন যেন প্রশ্নটা স্পষ্ট ভাবে করতে বাঁধল কোথাও। যার দরুণ চুপ হয়েই থাকল সে।মেহেরাজ সেই চুপ থাকার কারণেই চোখ মেলে তাকাল। জ্যোতি জড়োসড়ো চাহনী আর ভাবুক মুখ দেখে শান্ত স্বরে বলল,

” প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে নিলে যদি অস্বস্তি কমে তো জিজ্ঞেস করে নেওয়া উচিত। বলে ফেল। ”
জ্যোতি মেহেরাজের মুখের দিকে তাকাল৷ ভেজা আর শীতল চাহনীতে চোখ রেখেই বলে উঠল,
” পরে করি?আমি ঠিক বুঝে উঠছি না কি প্রশ্ন করা উচিত।”
মেহেরাজ ভ্রু উচাল৷টানটান মুখে গম্ভীর অথচ দৃঢ় গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,
” কেন? প্রশ্নগুলো প্রেমবিষয়ক? ”

মেহেরাজ প্রশ্নটা ছোড়া মাত্রই জ্যোতির মুখভঙ্গি ফ্যাঁকাসে হলো যেন। মেহেরাজ তা দেখেই মনে মনে হাসল। প্রশ্নটা সে যতোটা টানটান মুখ করে আর দৃঢ় ভাবে বলেছে ভেতরে ঠিক ততোটাই উৎফুল্ল অনুভব করল।ভ্রু নাচিয়ে ফের বলে উঠল,
” কি হলো?”
জ্যোতি অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠল,
” হ্ হু?”

মেহেরাজ আড়ালে চাপা হাসল। পরমুহুর্তেই গম্ভীর গলায় বলে উঠল,
” মানুষ প্রেম নিয়ে নিজের প্রেমময় মানুষের কাছে বলতে গেলে কিছুই বুঝে উঠে না, কিছুই খুঁজে পায় না বলার জন্য। ভুল না হলে তুইও প্রেমময় বাক্য ছুড়বি?”
তৎক্ষনাৎ জ্যোতির উত্তর এল,
” না, ঠিক তেমন নয়।”

মেহেরাজ অতি উৎসাহ নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
” তাহলে কেমন? ”
মৃদু আওয়াজে জ্যোতি বলল,
” কৌতুহল। শুধুই কৌতুহল। ”
মেহেরাজ উঠে বসল। জ্যোতির চোখের দিকে কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল।তারপর দাম্ভিক স্বরে বলে উঠল,

” তোর চোখ শুধুই কৌতুহল বলছে না। মিথ্যে বলতে ও পারিস না জ্যোতি?”
জ্যোতি চোখ তুলে তাকাল। নরম গলায় বলতে লাগল,
” তেমন নয় মেহেরাজ ভাই। কিছু কৌতুহল খুব আকাঙ্ক্ষার হয়। কিছু কৌতুহল খুব আশার হয়। আমার চোখে হয়তোবা সেই সুপ্ত আশা কিংবা আকাঙক্ষাটাই ফুটে উঠছে। ”
মেহেরাজ আর তাকাল না জ্যোতির দিকে।পা বাড়িয়ে যেতে যেতেই রুমের দরজার কাছে গিয়ে থামল। তারপর ভরাট গলায় শুধাল,

“হুট করে সেই আশা কিংবা আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়ে গেলে তোর প্রতিক্রিয়া কি হবে জ্যোতি?”
জ্যোতি স্তব্ধ হয়ে চাইল।মেহেরাজ অবশ্য ততক্ষনে আর রুমে দাঁড়িয়ে নেই।দরজা পার হয়ে চোখের অদৃশ্য হয়েছে মুহুর্তেই। জ্যোতি তখনও তাকিয়ে রইল সেদিক পানে৷ সত্যিই কি করবে? যদি সে আকাঙ্ক্ষা বা আশাটা ইতিবাচক উত্তর দিয়ে পূরণ হয়ে যায়? তখন তার প্রতিক্রিয়া আসলেই কি হবে?

মেহু বিছানায় গা এলিয়ে দিল মাত্রই। নাবিলাদের সাথে ফিরবে ভেবেও পরে জ্যোতির পায়ের অবস্থার কথা ভেবে আর যাওয়া হয়নি নিজ শহরে। জ্যোতির পা ঠিক হলেই একবার ঘুরে আসবে৷ পথে প্রান্তরে কোথাও সাঈদকে দেখার প্রার্থনাও বুকে পুষে নিয়ে যাবে। কথা না হোক, অন্তত একবার চোখের দেখা তো হোক।ক্ষতি তো নেই?বালিশে মাথা রেখে মোবাইল হাতে নিতেই চোখে পড়ল সাঈদের কিছু ছবি।

সোশ্যাল মিডিয়ায আপলোড করা ছবি। সাঈদের পাশে অত্যন্ত সুন্দর এক রমণী। পরনে বিদেশিনীদের মতো লং শার্ট,জিন্স।চুলগুলো লালচে অনেকটা। দেখতে ধবধবে সাদা। মেয়েটার চোখ,মুখ, গায়ের রং,গড়নে সবকিছুতেই ফরেইনার ভাব স্পষ্ট আন্দাজ করা গেল। মেহু সুচালো চাহনীতে তাকাল ছবিগুলোর দিকে। দুয়েকটা ছবিতে সাঈদের সাথে একটু বেশিই ক্লোজ দেখাল যেন।

লোকেশন আর ছবির দৃশ্য দেখে বুঝা গেল সাঈদ দেশে নেই। মেহুর বুকের ভেতর জ্বলে উঠল হঠাৎ। চোখ বুঝে নিয়ে বারকয়েক জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে হঠাৎই মোবাইল বন্ধ করে ছুড়ে রাখল একপাশে। জানালা মেলে অপর পাশের জানালাটায় তাকাতেই চোখে পড়ল বাচ্চা মতো একটা ছোট্ট ছেলে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।মেহু অবাক হলো। ঘড়িতে রাত তখন এগারোটা।এতো রাত অব্দি একটা বাচ্চা জেগে থাকবে কেন? মেহু ভ্রু কুঁচকাল। কিয়ৎক্ষন একই চাহনীতে তাকিয়ে থাকতেই বাচ্চাটা লাফ দিয়ে নেমে গেল জানালা ছেড়ে৷ তারপর আর দেখা গেল না বাচ্চাটাকে। মেহু অবশ্য সেভাবেই তাকিয়ে থাকল ঘন্টার পর ঘন্টা।

জ্যোতির দিকে ফিরেই মেহেরাজ চোখ বুঝে আছে।অথচ পাশে শুঁয়ে থাকা জ্যোতির চোখে ঘুম নেই। চোখেমুখে শুধু ব্যাপক অস্থিরতা।পেটের উপর মেহেরাজের ভারী হাতটা বারকয়েক সরালেও মেহেরাজ সরিয়ে নিল না। একইভাবেই হাতটা দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে। জ্যোতি চোখ বুঝল। ঘুমানোর চেষ্টা চালাল। লাভ হলো না।প্রশ্নটা না করা পর্যন্ত অস্থিরতা মিলিয়ে যাবে না ভেবেই মৃদু আওয়াজে ডেকে উঠল,

” মেহেরাজ ভাই?”
মেহেরাজ চোখ মেলে তাকাল না৷ ঘুম জড়ানো গলায় শাসিয়ে বলে উঠল,
“উহ্ হাত সরানোর কথা বলবি? ”
জ্যোতি উত্তরে বলল,
” আমার কিছু কথা আছে মেহেরাজ ভাই৷ ”
মেহেরাজ শুনল ঠিক। তবে উত্তর দিল না সাথে সাথে। কিয়ৎক্ষন পর চোখজোড়া অল্প মেলে চাইল। ভরাট কন্ঠে শুধাল,

” ঘুমাবি না? ”
জ্যোতি স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিল,
” ঘুমাব।”
” তবে?”
জ্যোতি এবারে উত্তর দিল না। কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে কিছু ভবল। বার কয়েক শ্বাস ফেলে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজাল দ্রুত।তারপর মেহেরাজের চাহনীতে চাহনী রেখে শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করল,

” ভালোবাসার আগমন কি জীবনে দুবার হতে পারে মেহেরাজ ভাই?”
মেহেরাজ এবার সচেতন হয়ে চাইল। শুধাল,
” এই প্রশ্ন?”
জ্যোতি এবার থামল না। সরাসরি বলে দিল,

” আপনি কি সত্যিই আমায় ভালোবাসেন?এতোটা সময় পর সত্যিই কি আমার প্রতি আপনার কোন অনুভূতি জম্মেছে মেহেরাজ ভাই?যদি না জম্মায় তবে নিশ্চয় আপনার ব্যবহার, আচরণে এসবে এমনকিছুর আভাস পাওয়া যেত না। ”
মেহেরাজের ঘুমঘুম ভাব যেন কেঁটে গেল। জ্যোতির দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে শুধাল,
” উত্তরটা ঠিক কি দেওয়া উচিত আমার? ”
জ্যোতির স্পষ্ট কন্ঠে ভেসে এল,

” যেটা সত্যি। ”
মেহেরাজ আড়ালে ঠোঁট চওড়া করে নিঃশব্দে হাসল। পরমুহুর্তেই মুখে গম্ভীরতা টেনে ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল,
” তোর কি মনে হয়? উত্তরটা কি হবে?”
জ্যোতি মৃদু আওয়াজে বলল,

” আমার মন যা বলছে তা সত্য ভাবার সাহস করে উঠতে পারছি না৷ তা বাস্তব ভাবারও সাহস নেই। সত্যি বলতে আমি যা ভাবছি তা আমি বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না।পরমুহুর্তেই যদি তা মিথ্যে প্রমাণিত হয়? আর আমার ভাবনাটা যদি শুধুই ভাবনা এটা প্রমাণিত হয়?”
মেহেরাজ এবার দৃঢ় স্বরে উত্তর দিল,

” হবে না। আমি তা প্রমাণিত হতে দিব না।”
জ্যোতি ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” মানে?”

মেহেরাজ প্রশ্নটাকে অতোটা গুরুত্ব দিল না যেন।আকস্মিক আগের মতো চোখ বুঝে নিল। হাতের বাঁধনটা কিছুটা শক্ত করে নিজের শরীরটা আরেকটু এগিয়ে জ্যোতির গা ঘেষে রাখল।জ্যোতির কানের কাছে শীতল স্বরে সেভাবে চোখ বুঝে রেখেই বলল,

” ভেবে নে তা বাস্তব।চোখ বুঝে বিশ্বাস করে নে তোর ভাবনা গুলো সত্যি। এবার বল, এসব জেনে তোর ভেতর কেমন অনুভূতি কাজ করছে এখন?”
জ্যোতি চোখের চাহনী কিঞ্চিৎ বড় করল। এতোটা কাছে পুরুষালি অস্তিত্ব আর কানের কাছে উষ্ণ নিঃশ্বাস উপচে পড়তেই আঙ্গুল খিচে বিছানা জড়িয়ে ধরল। পরমুহুর্তেই কথাগুলো বোধগম্য হতেই বোধহয় বুকের ভেতর ছলাৎ করে উঠল। অস্ফুট স্বরে কেবল বলল,

” হ্ হু?”
মেহেরাজ দাঁতে দাঁত চাপল এবারে। গুরত্বপূর্ণ প্রশ্নের গুরুত্বপূর্ণ উত্তরের বিনিময়ে হুহ শব্দটা বলা নিঃসন্দেহেই রাগের কারণ হবে। বলল,
” শুনিস নি?”
জ্যোতি নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল।শান্ত কন্ঠে উত্তর দিল,
” শুনেছি।”
মেহেরাজ ত্যাড়া সুরে বলে উঠল,
” তবে?”

জ্যোতি ফের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করা সত্যটাকে অবজ্ঞা করে শুধাল,
” আমার ভাবনাটা বোধ হয় আপনি বুঝে উঠতে পারেননি মেহেরাজ ভাই। ”
মেহেরাজ মুহুর্তেই জড়ানো স্বরে উত্তর দিল,
” যদি বলি তোর মনের সবটুকু ভাবনাই বুঝে নিয়েছি?”

জ্যোতি এবারে আর কিছু বলতে পারল না। অনাকাঙ্ক্ষিত অনুভূতিতে হৃদয়ে ছুুঁয়ে গেল খুব গভীরভাবে৷ এতোটাই গভীর ভাবে যে সে অনুভূতি শরীরের রক্তকণিকায় কণিকায় ছেয়ে গেল মুহুর্তেই। সুখ নাকি আনন্দ ঠিক বুঝা গেল না। বুঝা গেল না দুঃখ নাকি কষ্ট তাও। শুধু বোধ হলো পাশের পুরুষটির হৃদয়ে তার স্থান হয়েছে।পাশের পুরুষটির উপর তার অধিকারের স্বীকারোক্তি পেয়েছে। পাশের পুরুষটিকে স্বামী ভাবতে এবার বোধ হয় আর জড়তা নেই, শঙ্কা নেই, ভয় নেই। নেই তৃতীয় ব্যাক্তির সম্বোধন।

মেহুর ঘুম ধরল জানালার পাশে বসেই।জানালাটা খোলাই থাকল। মাথাটা জানালার গ্রিলে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। আকস্মিক ঘুম ভাঙ্গল মাথায় কিছু একটার আঘাত পেয়ে। মেহু তৎক্ষনাৎ চোখজোড়া মৃদুভাবে মেলে তাকাল।ঘুমুঘুমু চোখে দেখল একটা স্টেথোস্কোপড! চোখজোড়ায় বিস্ময় টেনে তাকিয়ে থাকতে পরমুহুর্তেই আবারও ওপাশে জানালা থেকে কেউ ছুড়ে দিল একটা ঘড়ি। মেহু অবাক হলো। চোখ জোড়া দিয়ে ওপাশের জানালায় কাউকেই দেখা গেল না।মেহু বিরক্ত হলো। কিঞ্চিৎ গলা উঁচিয়ে বলে উঠল,

” কি আশ্চর্য! এসব এখানে ছুড়ে ফেলছেন কে?কেনই বা ছুড়ে ফেলছেন? ”
মেহুর কথায় দম মানল না ওপাশের ব্যাক্তিটি।আবারও ছুড়ে মারল একটা ব্রাশ আর টুথপেস্ট। টুথপেস্টটা ঠিক মেহুর কপালে এসেই লাগল। মেহুর বিরক্তি এবার তুঙ্গে উঠল। একে এসব করে ঘুম ভাঙ্গাল, দ্বিতীয়ত মাথায় আঘাত পাওয়া সব মিলিয়ে রাগে ঝাড়ি দিয়েই বলে উঠল,

” কথা বললে শুনতে পাননা? আপনাদের জন্য তো দেখা যাচ্ছে জানালা মেলে বসাই যাবে না।ভদ্রতার কিছু শিখছে বলেই মনে হচ্ছে না।”
এবারে মেহুর জোরালো আওয়াজ শুনেই বোধ হয় মুহুর্তেই এক যুবক ছুটে এল। যুবকটির অগোছাল চুল আর ঘুমঘুম চোখ-মুখ দেখে বোধ হলো মাত্রই ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে এসেছ। নিভু নিভু চোখে তাকিয়েই ঘটনা বুঝে উঠার চেষ্টা করে যুবকটি শুধাল,

” এক্সিউজ মি, আপনি কি আমাকেই বলছেন?”
মেহু চোখ তুলে তাকাল। পরমুহুর্তেই অবাক হলো।যুবকটিকে সে চেনে।অনেক আগে থেকেই চেনে। একমুহুর্তের জন্য অবাক হয়ে তাকালেও পরমুহুর্তেই ঝাঝালো স্বরে বলে উঠল,

” আপনার মধ্যে এখনো কোন ভদ্রতা তৈরি হয়নি? এখনো মানুষকে বিরক্ত করে বেড়ান আগের মতো?এভাবে সকাল সকাল মানুষের ঘরে জিনিসপত্র ছুড়ে মারছেন কোন আক্কেলে? শিক্ষিত হয়েছেন ঠিক তবে ভদ্রতা শিখলেন না।”
যুবকটির মুখ হঠাৎ থমথমে হয়ে গেল। গোল গোল চোখে কিয়ৎক্ষন মেহুর দিকে তাকিয়ে থেকেই জানালার পাশ থেকে সরে গেল। পরমুহুর্তেই চোখে চশমা পরে হাজির হলো।অবিশ্বাস্য চাহনীতে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল,

” তুমি? তুমি এখানে? ”
মেহু দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” হ্যাঁ, আমি।মেহু। আমি বলেই আপনি এই বেয়দবিটা করার সাহস পেয়েছেন? ”
যুবকটি ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিল। বলল,
” কি বেয়াদবি?”
মেহু রাগ নিয়ে বলল,

” স্টেথস্কোপড ছুড়ে মেরেছেন কেন? আমি কি ডাক্তার আপনার মতো?ছেলেদের ঘড়ি পরে ও তো আমার কাজ নেই।সর্বশেষ, ব্রাশ আর টুথপেস্ট!আমার বাসায় কি ব্রাশ আর টুথপেস্ট নেই যে দাঁত ব্রাশ করতে পারব না?”
যুবকটি চমৎকার হাসল। বলে উঠল,
” নাও থাকতে পারে। তুমি তো দশটা এগারোটায় ঘুম ছেড়ে উঠতে। আধৌ ব্রাশ করো ততোক্ষনে ঘুম ছেড়ে উঠে? আমার সন্দেহ হয়।”
মেহু রেগে উঠল আবারও।বলল,

” আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি দাঁত ব্রাশ করি না?”
” তোমাকে দেখে তো কতকিছুই মনে হয় না। অথচ অনেককিছুই তো করে বেড়াচ্ছো। তাই না?”
” আমি যাই করি, আপনার মতো মানুষের বাসায় জিনিস ছুড়ে ফেলছি না।”
যুবকটি হঠাৎ ত্যাড়া সুরে উত্তর দিল,
” বেশ করেছি ছুড়ে মেরেছি। কি করবে তুমি?”
মেহু অবাক হয়ে শুধাল,

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ৩০

” কোন অনুশোচনাবোধই নেই আপনার মাঝে। আশ্চর্য!”
” না, নেই। ”
কথাটা দাম্ভিক স্বরে বলেই যুবকটি ঝুকল জানালার নিচের দিকে। মুহুর্তেই একটা বাচ্চা ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে মেহুর মুখের উপর জানালাটা বন্ধ করে দিল। মেহু অবাক হলো। এই লোকের সাহস দেখে কিঞ্চিৎ রাগও হলো ভেতরে ভেতরে। একবারও স্যরি বলল না?

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ৩২