এক মুঠো প্রণয় পর্ব ৩৪

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ৩৪
লেখনীতে একান্তিকা নাথ

চুলায় তরকারির কড়াই। জ্যোতি মনোযোগ দিয়ে সেদিক পানেই খেয়াল করল।বাসায় মেহু, মেহেরাজ কেউ না থাকাতে রাতের রান্নাটা সেই করার সিদ্ধান্ত নিল। হঠাৎই কলিং বেল বাঁজায় কান সচেতন হলো৷ তিন চারবার বাঁজতেই দ্রুত পায়ে এগিয়ে দরজা খুলতেই মেহেরাজকে দেখতে পেল। মেহেরাজের মুখে প্রথম দফায় হাসির রেশ দেখা গেলেও পরের দফায় হঠাৎই মুখটা গম্ভীর দেখাল।জ্যোতি একনজর চাইল। সকালের চুম্বনের কথা মনে উঠতেই দ্রুত পা সরিয়ে প্রস্থানের জন্য প্রস্তুতি নিল। ঠিক তখনই মেহেরাজ বাসায় ডুকে দরজা লাগাল। চাপা স্বরে বলল,

” এভাবে আর দরজা খুলতে আসবি না। মাথায় থাকবে? ”
জ্যোতি বুঝল না কথার অর্থ। পেছন ফিরে ভ্রু কুঁচকে নিতেই মেহেরাজ তাকাল। আবার বলল,
” যদি আমার জায়গায় অন্য কোন পুরুষ থাকত? এভাবে আসবি না দরজা খুলতে। ”
জ্যোতি এবারেও বুঝল না। প্রশ্নটা ছুড়েই দিল এবারে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

” কিভাবে এসেছি? ”
মেহেরাজ থমথমে স্বরে উত্তর দিল,
” কিভাবে এসেছিস জানিস না? ”
জ্যোতি স্পষ্ট স্বরে বলে উঠল,
” না বললে বুঝব কি করে? ”
মেহেরাজ এবারে গলা ঝাড়ল হালকা। শাসানি সুরে বলল,
” ওড়না কোথায় তোর?”

আকস্মিক প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল জ্যোতি। নিজের দিকে তাকিয়েই বুঝতে বাকি রইল না যে তার বুকে ওড়না নেই। রান্নাঘরে কাজের ফাঁকে গরম লাগছিল বলই একপাশে খুলে রেখেছিল। কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে এতোটা তাড়াহুড়োয় ছুটে এসেছে যে খেয়ালই করা হয় নি গায়ে ওড়না না থাকার বিষয়টা। মুখ কালো করল জ্যোতি।

অস্বস্তিতে হাত পায়ের তালু ঘেমে উঠল। এভাবে ওড়না হীন সম্মুখ পুরুষটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভাবতেই দ্রুত পা বাড়িয়ে গিয়ে থামল রান্নাঘরে। একপাশে রাখা ওড়নাটা তাড়াতাড়ি বুকে জড়িয়ে মাথায় ঘোমটা টানল৷ আর একবারও মেহেরাজের সামনে না গিয়ে ওখানেই ঠাঁই বসে রইল। ছিঃছিঃ! কি লজ্জ্বাকর পরিস্থিতি।মেহেরাজ কি এটা জ্যোতির ইচ্ছাকৃত কাজকর্ম ভাবছে? কথাটা ভাবতেই চোখ বুঝে নিল জ্যোতি।অনেকক্ষন সেভাবেই বসে বারকয়েক শ্বাস টানল৷ নিজেকে স্বাভাবিক করে চুলায় ভাত বসাল মুহুর্তে।রান্নাঘরে আরে গোছগাছ সহ টুকটাক কাজে ব্যস্ত হলো। তার কিছুক্ষন পরই বুক টানটান করে টাউজারের পকেটে হাত গুঁটিয়ে হাজির হলো মেহেরাজ। কিঞ্চিৎ গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,

” কি আশ্চর্য! তুই কি আজ সারারাত রান্নাঘরেই কাঁটিয়ে দিবি নাকি জ্যোতি? ”
জ্যোতির অস্বস্তি আবার বাড়ল। অস্ফুট স্বরে উত্তর এল,
” হ্ হু?”
মেহেরাজের মেজাজ কিঞ্চিৎ চটে গেল। এতক্ষন যাবৎ রুমে বসে থেকেএ জ্যোতির উপস্থিতি না পেয়ে এখানে এসেছিল। এখানে এসে প্রশ্ন শুধানোর পর ন শোনার ভান করে হু শোনাটা ব্যাপক বিরক্তিকর। দাঁতে দাঁত চেপে শুধাল,

” হু কি? তোর কানে সমস্যা আছে? ”
জ্যোতি গলা ঝেড়ে বলল,
” না,রান্না করছিলাম তো।তাই।”
মেহেরাজ ফের ত্যাড়া স্বরে প্রশ্ন শুধাল,
” রান্না করতে কে বলেছে?”
জ্যোতি তাকাল৷স্বাভাবিক স্বরে বলল,

” কেউ বলতে হবে কেন? এটা তো আমার দায়িত্ব মেহেরাজ ভাই। তাছাড়া এতক্ষনে বাইরে থেকে ফিরে আপনি রান্না করতেন? ”
মেহেরাজ এবারে হেসে দিল আড়ালে৷ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে জ্যোতির একদম কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ঝুঁকে গিয়ে দূরত্ব গুঁছাতে গুঁছাতে বলল,

” বাহ! পার্ফেক্ট বউ বউ ভাব দেখাচ্ছিস নাকি তুই?বউয়ের দায়িত্ব ও পালন করছিস? ”
জ্যোতি উত্তর দিতে পারল না। শুধু তাকিয়ে থাকল স্পষ্টভাবে। মেহেরাজ হঠাৎ চোখ টিপল। দুষ্টুমি ভরা হাসি দিয়ে জ্যোতিকে বাহুতে আঁকড়ে নিয়ে বলল,
” সংসার করবি আমার সাথে? একদম বাঙ্গালি বউদের মতো শাড়ি পরে, রান্না করে, বাচ্চাকাচ্চার মা হয়ে সংসার করবি নাকি?তোর চলন ফেরন তো সুবিধার লাগছে না রে জ্যোতি। অন্য দৃষ্টিতে দেখছিস নাকি আমায়?”
জ্যোতি একইভাবে চেয়ে থাকল। বলল,

“জ্ জ্বী? ”
মেহেরাজ আরেকটু ঝুঁকল। মুখটা আরো একটু কাছে নিয়ে জ্যোতির মুখে ফু দিল। বলল,
” উহ, জ্যোতি। বুঝিস না কিছুই? ”
জ্যোতি অবুঝ নয়৷ সবটুকু বুঝেও না বুঝার ভান ধরে শুকনো ঢোক গিলল। প্রসঙ্গ পাল্টাতে নিজেকে স্বাভাবিক করেই বলে উঠল,

“আপনার কিছু চাই মেহেরাজ ভাই? কফি করে আনব? ”
” না, কফি না। ”
” তাহলে? ”
মেহেরাজ ঠোঁট বাকিয়ে হাসল। আরো খানিকটা ঝুঁকে জ্যোতির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে শুধাল,
” এই মুহুর্তে তোকে চাইছি। দশ মিনিট সময় দিচ্ছি, একটা সুন্দর শাড়ি পরে আমার সামনে হাজির হবি। ”
অস্ফুট স্বরে কথা আসল,

” হ্ হু?”
মেহেরাজ জ্যোতিকে ছেড়ে দিল হঠাৎ। দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে থমথমে সুরে বলল,
” মেজাজ খারাপ হয় তোর না বুঝার ভান ধরা এই হু শব্দটা শুনলে জ্যোতি। তবে যেটা বলেছি তার অন্যথা হলে খুব খারাপ হবে। বলে রাখলাম।”
জ্যোতি মৃদু আওয়াজে বলল,

” আমি শাড়ি তেমন পরিনি কখনো।সে যে আরমান ভাইয়ের বিয়েতে শাড়ি পরেছিলাম, তাও অন্যরা পরিয়ে দিয়েছিল। ”
ভ্রু নাচিয়ে শুধাল মেহেরাজ,
” মানে শাড়ি পরতে পারিস না? ”
” না।”

মেহেরাজ শাড়ি পরাতে পারে না। তবুও বাঁকা হেসে উত্তরে বলল,
” ঠিক আছে, আমি পরিয়ে দিব শাড়ি। কুঁচি করা হতে,কুঁচি গুঁজে দেওয়া, আঁচল ঠিক করা সব করে দিব। চল। ”
জ্যোতির কান হঠাৎ উষ্ণ হয়ে উঠল লজ্জ্বায় অস্বস্তিতে।ইতস্থত স্বরে বলে উঠল দ্রুত,
” না, থাক। আমি পরতে পারব মেহেরাজ ভাই। ”
মেহেরাজ হাসল। একহাতে জ্যোতির কোমল গালে হাত রেখে আলতো ছুুঁয়ে বলল,

” গুড গার্ল। কথাটা একটু আগে বলে দিলেই তো হয়ে যেত।তাই না? ”
জ্যোতি আর কিছু বলল না। চুপচাপ পা বাড়িয়ে রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে নিতেই মেহেরাজ ফের বলে উঠল,
” শোন, এক কাপ কফি চাই।শাড়ি পরে আমার জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে রাখবি। আমি বাইরে থেকে আসছি কিছুক্ষনের মাঝে।দরজা বাইরে থেকেই লক করে যাচ্ছি। হুহ?”
জ্যোতি কিছু বলল না। শুধু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়াল। মেহেরাজ হাসল কিঞ্চিৎ। তারপর আপন মনে বেরিয়ে গেল পকেটে হাক গুঁজে হাঁটতে হাঁটতে।

মেহেরাজের হাতে লাল টকটকে গোলাপগুচ্ছ। কাছাকাছি ফুলের দোকানে এই গোলাপের গুচ্ছই পাওয়া গেল। তা নিয়ে দ্রুত বাসায় ফিরে এল। একবার রুমে গিয়ে ঘুরফাঁক খেয়ে কোথাও জ্যোতিকে না দেখতে পেয়ে ভ্রু কুঁচকাল। দু পা বাড়িয়ে এবার রান্নাঘরের সম্মুখে দাঁড়াল। মুহুর্তেই চোখে পড়ল কৃষ্ণবর্ণীয় জ্যোতির শাড়ি পরিহিত রূপ। লাল টকটকে শাড়িতে সত্যিই অপরূপ বোধ হলো।যেন রাঙ্গা ঘরোনী তার।

আঁচলের এক কোণা কোমড়ে গুঁজে আছে সে। চুলগুলো খোঁপা করা। চুলায় অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে কোনকিছু করতে ব্যস্ত সে। মেহেরাজ মনে মনে হাসল কিঞ্চিৎ৷ অপলক তাকিয়ে থেকে পা বাড়াল ধীরে ধীরে। তারপর একদম জ্যোতির পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই নিজের পুরুষালি বুকটায় গিয়ে ঠেকল জ্যোতির পিঠ।সঙ্গে সঙ্গে মেহেরাজ তার বলিষ্ঠ হাতজোড়া বাড়িয়ে জড়িয়ে নিল সম্মুখের রমণীর শরীর।শাড়ির আড়ালে ডান হাতটা আঁকড়ে ধরল জ্যোতির মসৃন পেটের একাংশ। গভীরভাবে পুরু ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া আঁকল জ্যোতির ঘাড়ে।ফলস্বরূপ অদৃশ্য কম্পনে কেঁপে কেঁপে উঠল জ্যোতির শরীর। চুলায় বসানো কফিটা মগে ডালতে গিয়েও পারল না সে। অস্ফুট স্বরে বলল,

” মে হে ্ রাজ ভাই!”
মেহেরাজ সে কাঁপা স্বরকে পাত্তা দিল না। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে ঠোঁটজোড়া একইভাবেই জ্যোতির ঘাড়ে ছুঁইয়ে স্বাভাবিকভাবে বলল,
” শুনছি বলতে পারিস। ”
” কাজ করছি মেহেরাজ ভাই। ”

মেহেরাজ এবারে আমলে নিল না। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে শুধাল,
” হ্যাঁ তো? আমি কি অকাজ করছি এখানে?”
জ্যোতি অস্বস্তিতি জড়োসড়ো হয়ে চুপ থাকল কিয়ৎক্ষন। জোরে জোরর বারকয়েক শ্বাস টেনে পরমুহুর্তে বলল,
” কফি বানাচ্ছি।ছেড়ে দিন,অস্বস্তি হচ্ছে।”
মেহেরাজ ত্যাড়া সুরে উত্তর দিল,
” হোক অস্বস্তি, ছাড়ব না। ”

জ্যোতি অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকল।অস্বস্তিতে পায়ের নখ দিয়ে ফ্লোরটা ঘষে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। পরমুহুর্তেই বুদ্ধি খাটিয়ে বলল,
” আপনার না কফি চাই? ”
মেহেরাজ বাঁকা হাসল। ফিচেল আর নেশালো কন্ঠে শুধাল,
” এখন অন্যকিছু চাই। ”
” কি?”

মেহেরাজ এবারে চুপ হয়ে গেল। মনে মনে কেবল হাসল। কি চাই তা মুখে বললে সম্মুখ নারীটি কিভাবে নিবে? লজ্জ্বায় কুঁকড়ে মরবে? নাকি অস্বস্তির চরম শীর্ষে পৌঁছিয়ে মুখ নত করবে?ভেবেই উত্তরটা আড়াল করল। জ্যোতি ফের আবার বলল,
” ক্ষিধে পেয়েছে? খাবার বাড়ব মেহেরাজ ভাই? ”
মেহেরাজের দাঁতে দাঁত চাপল। বলল,
” বলেছি আমি?”

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ৩৩

জ্যোতি কি বলবে বুঝে উঠল না। অপরদিকে ঠিক তখনই মেহেরাজের ফোনটা বেঁজে উঠল। মুহুর্তেই জ্যোতিকে ছেড়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করল মেহেরাজ। মেহুর নাম্বার দেখে দ্রুত কল রিসভিড করতেই ওপাশ থেকে মেহু বলে উঠল দ্রুত,
” আমি ভেবে দেখেছি ভাইয়া। সে ছেলের বিয়ের প্রস্তাবে আমি রাজি।তুমি যদি চাও বিয়েতে এগোতে পারো।”

এক মুঠো প্রণয় পর্ব ৩৫