এ মন মেলুক পাখনা শেষ পর্ব 

এ মন মেলুক পাখনা শেষ পর্ব 
ইফা আমহৃদ

“খুব ক্ষুধা লেগেছে মোমবাতি, আমার জন্য একটু খাবার নিয়ে আসতে পারবেন? আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে।” নতুন কোনো প্রশ্ন করা হলো তার মিনতির কাছে। নিঃশব্দে সায় দিয়ে চললাম রান্নাঘরের দিকে। ফেরার পথে আমড়া আর লাউ শাক নিয়ে এসেছিলাম।

আমড়ার ঝোল আর লাউ শাক ভাজি করেছি। পরিমাণ থেকে অনেকটা কম ভাত নিয়ে ফিরত এলাম ঘরে। অভ্র স্যার মোজা খুলছেন পা থেকে। থালা ও পানির গ্লাসটা বিছানায় রেখে মৃদু স্বরে বললাম, “আপনি খেয়ে নিন, আমি খুলে দিচ্ছি।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“মোজার গন্ধের মতো বিশ্রী গন্ধ পৃথিবীতে আর হয়না মোম। আমি খুলছি, আপনি যদি পারেন তবে আমাকে একটু খাইয়ে দিন।” বেসামাল কথায় বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। আমার প্রত্যুত্তর না পেয়ে পুনরায় বলে উঠলেন, “ঠিক আছে, আমি খেয়ে নিবো। আপনাকে খুব বিরক্ত করলাম, তাই না?”

“না।”
“আমার আসাতে খুশি হয়েছেন?”
“না।”
অভ্র স্যার মুচকি হেসে মোজা খোলা শেষ করলেন। আঙুল দিয়ে টেনে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকালেন। তার কাণ্ডে হেসে ফেললাম আমি। মৃদু স্বরে বললাম, “ঠিক আছে, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”

পরপর দুটো লোকমা মুখে তুলে দিতেই তিনি বললেন, “আপনি জানেন, আমি স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন? তবুও হাত না ধুয়ে খাবার খাওয়ালেন।”

নির্বোধ বোধ করলাম। তার মতো এত স্বাস্থ্য সচেতন না হলেও ‘খাবার গ্রহণের পূর্বে হাত ধুয়ে নেওয়া’ কখনো ভুলে যাইনি। অভ্র হাসলেন। তার টোল পড়া গালের দিকে আমি দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। সন্দিহান গলায় বললাম, “আপনি এত ঘনঘন হাসেন না। তাছাড়া আপনার হাসিতে গালে টোল পড়ে না। শুধু অগ্নি স্যারের হাসিতেই গালে টোল পড়ে।”

কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার ভাব লক্ষ্য করলাম অভ্রর মাঝে। আমতা আমতা করে বললেন, “আপনি খেয়াল করেননি আগে। তাছাড়া বিয়ের কথা আপনি আর আমি ছাড়া কে জানে?”

শেষ বাক্যটিকে ক্ষান্ত হলাম। খাবার শেষ করে এঁটো থালা নিয়ে রান্নাঘরে গেলাম। হাত ধুয়ে ফিরে এসে দেখলাম হাত পা টান টান করে শুয়ে পড়েছেন অভ্র। হুট করে হাত টেনে বলে উঠলেন, “আমি একটা কথা ভেবে নিয়েছি মোম। আপনার সাথে আমি আমার ভবিষ্যৎ জুড়ে দিতে চাইনি, কিন্তু জুড়ে গেছে। আমার মেয়েকে একটা মায়ের প্রয়োজন। আমি ওদের একটা মা দিতে চাইছি।”

আমি লজ্জায় কাবু হলাম। আচমকা হাতে প্রবল টান পড়ল। ভারসাম্য হলাম রাখতে ব্যর্থ হয়ে হুমড়ে পড়লাম অভ্রর হৃদমাঝারে। এবার দুহাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আপনি সর্বদা আমার হৃদমাঝারে মোমের মতো মৃদু আলোতে জ্বলতে থাকুন।”

দুহাত দিয়ে সরিয়ে আনার প্রবল চেষ্টা করলেও পারলেন না বিছিন্ন করতে আমায়। আমার দুহাত যে দৃঢ় করে আবদ্ধ তার গলায়। রাত কাটল অন্যরকম। স্মৃতি মধুর হয়ে রইল। আমাকে দোটানায় ফেলে পরদিন সকাল দশটা নাগাদ অভ্র স্যার দ্বিতীয় দফা বাড়িতে এলেন। অথচ সাতটা নাগাদ সে চলে গেছে। হাই তুলতে তুলতে দরজা খুলে অভ্র স্যারকে দেখে মৃদু হেসে লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে বললাম, “একা কেন এলেন? উদিতা ঊষাকে নিয়ে আসতেন।”

“ওরা স্কুলে না গিয়ে আপনার কাছে কেন আসবে? তাছাড়া আপনি অফিসে আসেন নি কেন?”
নিজ থেকে অভ্রকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “রাতে কতক্ষণ দুষ্টুমি করেছেন হিসেব আছে আপনার? ঘুম হয়নি ভালোভাবে, তাই যাইনি?”

“কী করছেন কী? ছাড়ুন মোম। কীসব বলছেন?” ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললেন তিনি। হাত দিয়ে পোশাক ঝেড়ে পুনরায় বললেন, “আপনার মাথা ঠিক হলে অফিসে আসবেন।”
“মানে?”

“আপনি দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। তার কথা বলছি।”
“কালরাতে আপনি আমার সাথে ছিলেন। আজব তো! আপনার কিছু মনে নেই? আমাদের বিয়েটা আপনি মন থেকে মেনে নিয়েছেন। আপনি আমাকে উদিতা ঊষার মা করতে চেয়েছেন।”

“আমি আমার মেয়েদের ছেড়ে রাতে আপনার কাছে ছিলাম? স্যরি এটা অসম্ভব মোম।” বলেই তাচ্ছিল্যর হাসি হাসলেন। আরেকদফা চমকে উঠে তার দিকে চেয়ে রইলাম। গতরাতের মতো টোল পড়ল না। অতি সাধারণ। হাত দিয়ে দুগাল নাড়িয়ে দেখে বললেন, “আপনার গালে টোল কেন পড়ছে না?”

“আমার গালে টোল পড়ে না মোম, টোল পড়ে অগ্নির গালে।”
গতরাতে আমার সাজানো সংসার মুহুর্তেই খণ্ড বিখণ্ড হয়ে গেল। মাটিতে বসে পড়লাম। চুলগুলো দু-হাতে মুঠোবন্দী করে বললাম, “তাহলে? গতরাতে অগ্নি আমার সাথে..?”
অভ্র হয়তো বুঝতে পারলেন সবটা। অতিদ্রুত ভেতরে প্রবেশ করে দরজায় খিল তুলে দিলেন। কাঁধে হাত রেখে বললেন, “মোমবাতি, কাঁদবেন না। ওটা আপনার দুঃস্বপ্ন ছিল। শান্ত হোন।”

হাত এক ঝটকায় সরিয়ে কক্ষে চলে এলাম। মেঝেতে পড়ে থাকা একটা মোজা দেখিয়ে বললাম, “এটা কার স্যার, আপনার না-কি অগ্নির?”
অভ্র হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দেয়ালে আঘাত করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “গতকাল এতকিছু বলার পরেও এখানে এসেছিল ও।”

নিঃশব্দে অশ্রু ঝরল। ঝাপসা দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এক হাঁটু ভাঁজ করে তাতে ভর দিয়ে বললেন, “মোমবাতি..
“আপনি এখান থেকে চলে যান স্যার। আমি একটু একা থাকতে চাই। প্লীজ।” বাক্য শেষ করতে না দিয়ে বললাম।

“কিন্তু মোমবাতি..
“বললাম তো, যান।”
বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। অভ্র স্যার অধীরচিত্তের তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন। পুনরায় অশ্রুপাত শুরু হলো দুচোখের।

আকাশে কালো মেঘ স্তর স্তরে সজ্জিত। ঝিরিঝিরি ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। সময় রাত দশটা। কালো রঙের ছাতাটা মাথার উপরে ধরে দাঁড়িয়ে আছি স্টেশনে। বুকের উপর ছোট ব্যাগটার ভেতরে আমার ছোটো কিট্টি ঘুমিয়ে আছে।

জামা কাপড় সহ নিজের ব্যবহৃত সবকিছু ব্যাগে ভর্তি করে নিয়েছি। এই ব্যস্ত শহরে আমার মতো সাধারণ মেয়ে থাকতে পারবে না। রিংটোন বাজল ফোনের। ‘মামা’ নামটা জ্বলজ্বল করতে দেখে রিসিভ করলাম। উৎকণ্ঠার সাথে মামা বললেন, “মোম, এই মোম। তুই না-কি গ্ৰামে ফিরে আসছিস মা? সত্যি!”

“জি মামা। আমি স্টেশনে।”
“তোর মামি আবার অভিকে ফোন করে ডেকেছে। তুই গ্ৰামে ফিরলেই তোকে বিয়ে দিবে।”

এ মন মেলুক পাখনা পর্ব ১৯

“গ্ৰামের মানুষ আর যাই হোক, সম্পর্কের কদর করতে জানে।” আলগোছে কল বিচ্ছিন্ন করে ট্রেনের দিকে তাকালাম। ইতোমধ্যে হর্ন বাজছে। ট্রেন স্টেশনে এসেছেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সে নতুন গন্তব্যের উদ্দেশ্য রওনা হবে। ট্রাভেলিং ব্যাগ নিয়ে ট্রেনের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম।

এই গল্পের পরবর্তী অংশ আসবে অনেক পরে। ঢাকায় ফেরার পর বা তারও পরে।

(সমাপ্ত)