খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৪

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৪
আভা ইসলাম রাত্রি

আয়ুষ্মান পরিবারের বড় ছেলের ছেলে সন্তান হয়েছে, খবরটি সম্পূর্ণ গ্রামে ছড়িয়ে গেল। সবাই যারপরনাই সন্তুষ্ট, নেতাসাহেবের পরে গ্রামের হাল ধরতে তার নিজের পুত্র জন্ম নিয়েছে। আজ স্ত্রী সন্তান নিয়ে শেহজাদ হাসপাতাল থেকে ফিরবে। রেখা বাড়ি পরিষ্কার করছেন, শিশু এসে ধুলোবালি জমা বাড়িতে অসুস্থ বোধ করবে বিধায় এ কাজ অতি গুরুত্ত সহকারে করানো হচ্ছে। শেফালি রান্না করছেন।

শেহজাদ আসবে ভেবে উঠোনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, নওশাদ এবং সৌরভ আয়ুষ্মান। বেলা ফুরিয়ে যখন সন্ধ্যা হবার পথে, তখন উঠোনের সামনে এক সাদা রঙের গাড়ি এসে থামে। গাড়িটির দিকে চোখ পরে দুই আয়ুষ্মান পুরুষের। এ গাড়ি আয়ুষ্মানদের নয়, তাহলে কার গাড়ি?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নওশাদ অপরিচিত গাড়ি দেখে পাঞ্জাবি টেনেটুনে ঠিকঠাক করে এগিয়ে যান। পেছনে পেছনে সৌরভ প্রশ্নবোধক চাওনি নিয়ে এগুন। গাড়ির ইঞ্জিন আয়ুষ্মান বাড়ির সামনে এসে বন্ধ হলে, নওশাদ বিরক্ত হয়ে পাশে থাকা ভৃত্য বলেন,
‘দেখো তো গাড়িটা কার? আমাদের বাড়ির সামনে কেন থামল?’

ভৃত্য সঙ্গেসঙ্গে গাড়ির পানে ছুটে গেল। ভৃত্য নিজে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলবে, তার আগেই গাড়ির দরজা খুলে গেল। ভেতরে থেকে নেমে এলো একজন ইংরেজ সুট বুট পড়া পুরুষ। চোখে রোদচশমা পরে থাকা সত্ত্বেও নওশাদ এবং সৌরভ কারোরই চিনতে বাকি থাকল না এ সুদর্শন পুরুষ কে? অল্পসময়ের জন্যে সৌরভের চোখ দুখানা চকচক করে উঠল যেমন। পরপরই পুরনো রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই উজ্জ্বল মুখে আঁধার নেমে আসে। রাগান্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন তার একমাত্র ছেলে পলাশ আয়ুষ্মানের দিকে।

পলাশ বাপ-চাচাকে দেখে চোখের থেকে রোদচশমা নামায়। ছলছল চোখে চেয়ে থাকে তাদের দিকে। নওশাদ সৌরভের দিকে তাকান, সৌরভ নিজের স্থানে ঠাই দাড়িয়ে আছেন। ছেলেকে এতবছর পরে দেখেও তার মধ্যে খুশির ঝলক দেখা যাচ্ছে না। নওশাদ আজ আগবাড়িয়ে কিছু বলেন না, অপেক্ষা করেন সৌরভের প্রতিক্রিয়ার।

পলাশের পিছুপিছু গাড়ি থেকে নেমে আসে শাড়ি পরা এক বিদেশিনী মেয়ে। তার ঘাড়ে মাথা রেখে এক তিন বছরের বাচ্চা ঘুমিয়ে আছে। সৌরভ বুঝতে পারেন, বাচ্চা পলাশের এবং সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এ অসহ্য খ্রিস্টান মেয়ের। সৌরভ আর সহ্য করতে পারেন না। এগিয়ে যান ছেলের দিকে। পলাশ পূর্ন দৃষ্টিতে বাবার দিকে চায়। ঝুঁকে গিয়ে পা ধরে সালাম করতে গেলে সৌরভ দু কদম পিছিয়ে যান। চিৎকার করে প্রশ্ন করেন,

‘আল্লাহর নিকৃষ্ট জীব, আমাদের বাড়িতে তোমার পা ফেলার সাহস কিভাবে করলে তুমি? তাও কি না এই বিধর্মী মেয়ে নিয়ে এসেছ আমার বাড়িতে?’
পলাশ সৌরভের রাগ দেখেও এটুকু বিচলিত হল না। আলগোছে নিজের বলিষ্ট দু হাতে সৌরভকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘আমাকে মাফ করুন, আব্বাজান। আমি ভুল করে ফেলেছি,আমাকে কয়েকটা রাত এ বাড়িতে থাকতে দিন। আমার ছেলে তার দাদাবাড়ি দেখতে চায়। আমার আপনাদের কথা খুব মনে পরেছে, আব্বাজান। কয়েকটা রাত থেকে এ বাড়ির স্মৃতি নিয়ে সারাজীবন আমি পাড় করে দেব আব্বাজান। ব্যাস, কয়েকটা রাত শুধু।’

সৌরভের রাগে অন্ধ হয়ে যাওয়া বুক ক্রমশ শান্ত হয়ে যাচ্ছে। ছেলের কান্না ছোটবেলা থেকে তার দূর্বলতা, তাই আজ আর তিনি নিজেকে আটকে রাখতে পারলেন না। ছেলের পিঠে হাত রেখে নওশাদের দিকে চাইলেন। কি আর করবেন, নওশাদ চোখ দ্বারা সম্মতি দিলেন। ভাইয়ের সম্মতি পেয়ে সৌরভ ছেলেকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলেন। কাঠকাঠ গলায় বললেন,

‘ঠিকাছে, ব্যাস কটা রাত থাকতে দিচ্ছি। তোমার জন্যে নয়, এই মাসুম শিশুর জন্যে। এক সপ্তাহ পর তুমি চলে যাবে এ বাড়ি ছেড়ে। এক সপ্তাহ পর আমি তোমার মুখদর্শন অব্দি করতে চাই না।’

পলাশ সৌরভের কথা শুনে খুশিতে যেমন আত্নহারা হয়ে গেল। শরীর ঝুঁকে সৌরভের পা ধরে সালাম করল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্ত্রীকেও ইশারা করল সালাম করার জন্যে। বিদেশিনী সালাম করতে গেলে সৌরভ পা সরিয়ে অন্যদিকে ফিরে যান। বিদেশিনীর রক্তিম-শুভ্র মুখে যেন স্পষ্ট অপমান ফুটে উঠে। অপমানের রেশ ধরে নওশাদকে সালাম করতে আর এগিয়ে যায় না। পলাশ বারবার ইশারা করেও লাভটি কিছু হয়না। নওশাদ সেসব লক্ষ করেন, অথচ ভাইয়ের খাতিরে কিছুই বললেন না।

সৌরভ ভৃত্যকে ডেকে ব্যাগপত্র নিয়ে তাদের ঘরে ঢুকতে বলে নিজে আগে আগেই ভেতরে চলে গেলেন। পলাশ সবাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকতে যায়। সবাই ভেতরে চলে গেলেও নওশাদ এখনো উঠোনে দাঁড়িয়ে আছেন। সেটা দেখে পলাশ আশেপাশে দেখে, কেউ বোধহয় আসছে বাড়িতে। পলাশ এগিয়ে যায়,

‘চাচাজান, ভেতরে যাবেন না? মাগরিবের আজান পরবে।’
পলাশের মুখে আজানের কথা শুনে নওশাদ বিরক্ত হলেন। অন্যদিকে চেয়ে বললেন,
‘তুমি আবার আজান–নামাজ এসবের হিসেবও রাখো? শুনে খুশি হলাম।’
পলাশের মুখখানা অপরাধবোধে ঢেকে গেল। নত হয়ে এলো চিবুক। কণ্ঠে ক্লান্তি নিয়ে বলল,

‘এভাবে বলছেন কেন? আমি বিদেশে কখনো নামাজ–রোজা ছাড়ি নি চাচাজান। রোজ যেভাবে ওর ধর্ম পালন করে, আমিও সেভাবে ইসলাম ধর্ম চর্চা করি। আমরা যার যার ধর্ম নিয়ে সচেতন সবসময়। আপনাদের শিক্ষা আমি বিদেশেও ভুলি নি, এবং বিদেশিনীকে বিয়ে করেও নয়।’

নওশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসেন। পলাশের নিজেকে নিয়ে সাফাই গাওয়া ঠিক সহ্য হল না নওশাদের। তিনি ব্যঙ্গ করার ভঙ্গিতে মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
‘এক বিধর্মী মেয়ে বিয়ে করে ইসলামের অপমান করে, আবার ইসলাম ধর্মের সম্মান রক্ষার কথা বলছ? আমাকে এসব জানিয়ে লাভ নেই। আল্লাহর কাছে জানাও, হয়ত আল্লাহ তোমার এত বড় অপরাধ ক্ষমা করেও দিতে পারেন।’

পলাশের বলার আর কিছু বাকি থাকল না আর। পলাশ তবুও চেষ্টা করে নওশাদের মন রাখার জন্যে আরো কয়েকটা কথা বলার, তবে নওশাদের এসব মিছামিছি কথা শোনার ধৈর্য্য থাকল না। মুখখানা ঘুরিয়ে বললেন,

‘অনেকটা পথ এসেছ, ভেতরে যাও, বিশ্রাম নাও, যদি মন চায় আজান হলে নামাজ পরো। আমার এখানে আরো কিছুসময় থাকতে হবে। কারো আসার অপেক্ষা করছি।’
পলাশ জানতে চাইল, ‘কে আসছে আজ? বিশেষ কেউ?’
নওশাদের শান্ত স্বরের উত্তর,
‘আমার ছেলে, শেহজাদ আসছে, আমার নাতি-বউকে নিয়ে।’

শেহজাদের গাড়ি উঠোনে এসে থামলে, নওশাদ খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠেন। দ্রুতপদে গাড়ির দিকে এগিয়ে যান। শেহজাদ একহাতে শিশুকে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। নওশাদ এগিয়ে এসে গদগদ হয়ে শেহজাদের কোল থেকে নাতিকে কোলে নিয়ে নেন। শেহজাদ এবার ওপর হাতে চিত্রাকে গাড়ি থেকে সাবধানে নামায়। চিত্রা নিকাব তুলে এতক্ষণে। নওশাদ শেহজাদকে বলেন,

‘ভেতরে যাও বউকে নিয়ে, বিশ্রাম দরকার ওর। বাচ্চা আমার কোলে থাকুক।’
শেহজাদ চিত্রাকে আলগোছে ধরে রেখে নওশাদকে জানাল,
‘কান্না করলে এনে দিবেন, আমরা ঘরেই আছি।’
নওশাদ মাথা নাড়লেন, ‘ঠিকাছে, যাও।’
শেহজাদ ঘরে ঢুকার আগে পেছন থেকে আবার নওশাদ ডেকে উঠেন,
‘শেহজাদ!’

শেহজাদ পেছনে ফিরে। নওশাদ বললেন,
‘ঘরে বিদেশি নাফরমান ঢুকেছে, সাবধানে থেকো।’
শেহজাদ প্রথমে বুঝতে পারল না নওশাদের কথা। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে ভাবার পর পরমুহুর্তে শেহজাদের ভ্রু সোজা হয়ে গেল। তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে কাঠকাঠ গলায় প্রশ্ন করল,
‘পলাশ এসেছে?’

ঘরে ঢুকে ক্লান্তিতে গা অবশ হয়ে এল যেন চিত্রার। বিশ্রাম করার জন্যে বিছানায় গা এলিয়ে দিল সে। শেহজাদ বালিশ ঠিক করে ঘুমাতে সাহায্য করল স্ত্রীকে। তারপর এগিয়ে আলমারি থেকে ফতুয়া, লুঙ্গি বের করে বাইরের কাপড় ছাড়ল। এতক্ষণ গায়ে যেন হাসপাতালের গন্ধ লেগে ছিল। এবার একটা গোসল নিতে হবে, নাহলে গা গুলিয়ে আসছে বারবার। শেহজাদ কাঁধে গামছা নিয়ে টয়লেটে যাবার জন্যে উদ্যত হল। চিত্রা বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায় নিভুনিভু স্বরে ডাকল শেহজাদকে,

‘শুনছেন?’
শেহজাদ পেছনে তাকাল। ভ্রু উঁচু করে জানতে চাইল ডাকার কারণ। চিত্রা কষ্ট করে উঠে বসার চেষ্টা করল। বালিশে হেলান দিয়ে বসে তারপর আস্তে করে বলল,
‘আমি গোসল করব, শরীর থেকে গন্ধ বেরুচ্ছে। একটু কষ্ট করে কা-উকে ডেকে দিবেন?’

শেহজাদ শুনে, সত্যি বলতে তার নিজেরও গোসল করা এই মুহূর্তে প্রয়োজন। চিত্রার তাহলে আরো বেশি দরকার এটা। শেহজাদ তাই আর সাতপাঁচ ভাবে না। এগিয়ে এসে চিত্রাকে পাজকোলে তুলে নেয়। চিত্রা আচমকা এমন আচরণে হম্বিতম্বি করে উঠে। ছটফট করে উঠে বলে,

‘কি করছেন আপনি, নামান নামান। পরে যাব তো। নামান না?’
শেহজাদ হাঁটা থামায়, সরাসরি চিত্রার চোখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে,
‘এত ছটফট কেন করছ? গোসল করবে না?’
চিত্রা ভয়ে ভয়ে শেহজাদের দিকে চেয়ে উত্তর দেয়,
‘করব, কিন্তু —-‘
‘আমি করিয়ে দেব।’
শেহজাদের স্পষ্ট উত্তর। চিত্রা এবার লজ্জায় যেন মরেই যায়। বিস্মিত হয়ে মুখ লুকিয়ে বলে,

‘আপনি এভাবে আমাকে ছিঃ—না, লজ্জা লাগবে আমার।’
চিত্রার এমন করে বরাবরই লজ্জা পায়, শেহজাদ এমন করেই এসব সহ্য করে এসেছে এক বছর যাবৎ। মাঝেমধ্যে শেহজাদ ভাবে, একজন নারীকে আর ঠিক কতটা ছুঁয়ে দিলে তার লজ্জা কমবে? ভেবে পায় না শেহজাদ। বিয়ের পর কম চেষ্টা করেনি চিত্রার লজ্জা কমানোর। অথচ এ নারীকে এখনো সামান্য ছুঁইয়ে দিলেই হইচই করে উঠে লজ্জায়।
শেহজাদ এবার অতিষ্ট গলায় বলে,

‘আর কিছু দেখা বাকি আছে তোমার শরীরের? আমার সন্তানের মা তুমি। এটুকু করার অধিকার আমার আছে। কথা না বলে চুপ থাকবে এখন।’
চিত্রা হইহই করে উঠে লজ্জায়। শেহজাদের বুকের ফতুয়া খামচে ধরে মৃদু কণ্ঠে বলে,
‘আপনি আগে এভাবে ছিলেন না নেতাশাহ। বিয়ের পর আপনার এত পরিবর্তন আমাকে বারবার লজ্জায় ফেলে দেয়।’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৩

শেহজাদ উত্তর করে না আর। চিত্রার চোখের দিকে চোখ রাখে। সঙ্গেসঙ্গে ঘোলাটে ওই চোখে চিত্রা নিজের সর্বনাশ দেখতে পায়। সম্মোহনের ন্যায় ডুবে যায় আকন্ঠ। শেহজাদ বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। শব্দের তীব্রতায় সম্বিত ফিরে চিত্রার। একজোট পানি চিত্রার থরথর করা গা ছুঁইয়ে যেতেই চিত্রা এবার লজ্জার অথৈ সাগরে আকন্ঠ ডুবেই মরে।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৫