খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৫

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৫
আভা ইসলাম রাত্রি

রাতে আয়ুষ্মান পরিবারের সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছেন।
বহুদিন—বহুদিন পর আয়ুষ্মান পরিবারের সকল পুরুষ এক টেবিলে! দৃশ্যটি চোখে পরার ন্যায়। খাবার বেড়ে দেবার ফাঁকে বারবার সবার দিকে চোখ চলে যাচ্ছে রেখা বেগমের। শেফালির একই দশা বলতে গেলে। ছেলে এতদিন পর এসেছে, ছেলের পাশে নাতি নিজের হাতে খাচ্ছে।

পলাশ ছেলেকে খাবার খেতে সাহায্য করছে। শেফালি বারবার ঘুরেফিরে নাতি ছেলের কাছে ঘুরঘুর করছেন। এই খাবার বেড়ে দিচ্ছেন, এই পানি এগিয়ে দিচ্ছেন, তরকারির বাটি সবটাই পলাশের দিকে। শেফালির এত দরদ হয়ত সৌরভের পছন্দ হল না। তিনি খাওয়ার ফাঁকে হাত থামিয়ে ফেললেন। সবাই সৌরভের দিকে চাইলে, সৌরভ শেফালির দিকে তীক্ষ্ম চোখে চেয়ে স্পষ্ট কণ্ঠে জানালেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘শেফালি, ছেলের প্রতি এত দরদ ভালো না। ওরা দুদিনের মেহমান, ব্যাস। দূরে থাকো তাদের থেকে।’
কথাটা শুনে ছলছল করে উঠস শেফালির চোখ দুখানা। স্বামীর আদেশ শিরোধার্য। পলাশ বাবার কথা শুনে আড়চোখে মায়ের দিকে চাইল। শেফালি ছেলের দিকে কোনা চোখে চেয়েই আঁচলে মুখ চেপে রান্নাঘরে চলে গেলেন। এতদিন পর ছেলে আসল, তাকে ভালোমন্দ খাওয়াতেও হাত কাপে শেফালির। আদর করে দুখানা কথা বলতে পারেন না, ভয়ে বুক ফেটে যায়। আল্লাহ তায়ালা এমন জটিল কেন করে তুললেন তাদের সম্পর্ক?

শেফালিকে কষ্ট পেতে দেখে রেখা আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন না, খাবারের দায়িত্ব মহিলা ভৃত্য এর হাতে ধরিয়ে দিয়ে তিনি নিজেও পিছু পিছু ছুটেন। আজ খাবারের দায়িত্ব নিতে চিত্রা আসেনি। শেহজাদ সরাসরি মানা করে দিয়েছে পলাশের সামনে না যাবার জন্যে। হয়ত চিত্রা জানে না, কিন্তু শেহজাদ তো জানে। ছোটবেলা থেকে পলাশের নজর খুব একটা ভালো না। হয়ত মা সমতুল্য ভাবির মধ্যেই তার কু দৃষ্টি পরতে পারে। শেহজাদ এ ব্যাপারে একদম সতর্ক বলা চলে।
নওশাদ খাবার টেবিলে এমন অশান্তি দেখে বিরক্ত হলেন। খাবার থামিয়ে সরাসরি সৌরভের দিকে চাইলেন, সৌরভ খেতে মশগুল। নওশাদ গম্ভীর কণ্ঠে জানান,

‘খাবার টেবিলে এত কথা না বললেও চলত তোমার। খেতে বসে এত কথা বলা ভালো?’
সঙ্গেসঙ্গে সৌরভের মুখের আদল বদলে যায়। তিনি খাবার খাওয়া থামিয়ে নত মুখে বসে থাকেন ঠাই। খাবার খাওয়ার ইচ্ছে কেমন মাটি হয়ে যাচ্ছে তার। এতকাল পর ছেলে এসেছে, অথচ ছেলের একটা জঘন্য কাজের জন্যে নিজের ছেলেকেই বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে পারছেন না। এর চেয়ে যন্ত্রণার কিছু হতে পারে আদৌ? বোধহয় নয়। সৌরভকে নিশ্চুপ দেখে নওশাদ কিছুটা আন্দাজ করেন সৌরভের বুকের ভেতর বয়ে চলা ঝড়। হাত রাখেন ভাইয়ের প্রশস্থ কাধে। সৌরভের চোখ থেকে এক ফোঁটা জল টুপ করে গড়িয়ে পরে। পলাশ এসব দেখে অপরাধবোধে জ্বলে উঠে যেমন। পাশে থাকা ছেলের দিকে চেয়ে বলে,

‘বাবা, গো টু ইউর মাম্মা। পাপা ইজ কামিং, হু?’
এটুকু ছেলে বাবার কি বাধ্য। পলাশ বলার সঙ্গেসঙ্গে দৌঁড়ে খাবারের প্লেট নিয়ে মায়ের কাছে চলে গেল। ছেলে চলে গেলে, পলাশ সবার দিকে একপল চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মাথা নিচু করে সবার উদ্দেশ্যে বলে,

‘আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি খাবার টেবিলে বসলে হয়ত সবার খাওয়াই মাটি হয়ে যাবে। আগামীকাল থেকে আমি রুমেই খাব। আমাকে থাকতে দিয়েছেন আপনারা এ বাড়িতে, আমার ছেলে তার দাদাবাড়ি চিনতে পারছে। এই অনেক। আমার অপমান আমি গায়ে মাখব না, আব্বাজান। আমার ছেলেই আমার কাছে সব, যেমনটা আমি আপনাদের কাছে ছিলাম—অথচ এখন নেই।’

শেষের কথাটা বলার সময় পলাশের কণ্ঠ যেমন কেপে উঠে। শেহজাদ চেয়ে থাকে পলাশের দিকে। পলাশ কি বদলে গেছে? এমন নম্র কণ্ঠ তো পলাশের কখনোই ছিল না। সত্যি কি সে অপরাধবোধে দগ্ন? পলাশ খাবার প্লেট নিয়ে উঠে চলে যাবে, তার পূর্বেই শেহজাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে

‘পলাশ, চেয়ারে বসো। মাঝপথে খাবার ছেড়ে উঠা ঠিক না।”
পলাশ সৌরভের দিকে চায়। সৌরভ কথা বলেন না। নওশাদ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
‘বসে যাও চেয়ারে, কালকের ব্যাপার কালকে ভাবা যাবে।’
পলাশ বড়দের কথা আর ফেলে না। নিজেকে পুনরায় অপমানিত করতে চেয়ারে বসে প্লেট নিয়ে।

চিত্রা বারবার চোখ ঘুরিয়ে পলাশের বিদেশিনী স্ত্রী রোজকে দেখে যাচ্ছে। সাধারণ ত্রিপিস পরিহিত অবস্থায় বিদেশিনীকে কেমন বেমানান লাগছে। বাঙালিদের বোধহয় বাঙালি জামায় বেশি মানায়। ত্রিপিসটা খুব বেশি ফিট হয়ে আছে গায়ে, গরমে হাসফাস করছে শুধু সে। হয়ত এখন ফাঁকা বাড়ি থাকলে জামা কাপড় খুলে হেঁটে বেড়াত বোধহয়। ওদেশে কি এসব খুব সাধারণ? চিত্রা আঁতকে উঠে। খালি বাড়ি কেন, বাথরুমেই চিত্রা খালি গায়ে গোসল করে না। ভয় হয়।

রোজ ছেলেকে খাইয়ে দিচ্ছে মুখে তুলে। চিত্রা মা ছেলের কাজ দেখছে। চিত্রার কোলে তার দু দিনের বাচ্চা। সুন্দর মুখে আঙুল ঢুকিয়ে ঘুমিয়ে কুপোকাত। দুদিনের বাচ্চা ছেলে, অথচ কান্নাকাটি খুব একটা করে না। ঘুমায়, হাসে, কাউকে না পেলে একা একাই খেলে। অবশ্য একা থাকে না কখনো। নেতাসাহেবের বাচ্চা তো, কাউকে না কাউকে সঙ্গ দেবার জন্যে ঠিক পেয়ে যায়।

চিত্রা একটু অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘হুয়াট–নেম –দ্যা –’
পুরো কথাটা শেষ করতে পারেনি চিত্রা। রোজ শেষ করার আগেই বলে,
‘আমি বাংলা বুঝি।’

চিত্রা থতমত খেয়ে যায়। একপল নিজের কোলে শুয়ে থাকা ছেলের দিকে তাকায়। পরপরই রোজের দিকে চায়। রোজ আর কিছু বলে না। চিত্রা শ্বাস টেনে পুনরায় বাংলায় জিজ্ঞেস করে,
‘তোমাদের ছেলের নাম কি?’
রোজ ছেলেকে খাওয়াতে খাওয়াতে উত্তর দেয়,
‘জিহাদ আয়ুষ্মান।’

‘জিহাদ’ বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে চিত্রা। এটুকু ছেলের নাম জিহাদ রাখা হল কেন? ভালো নাম ত রাখাই যেত। হঠাৎ মনে হল চিত্রার, তাদের ছেলের আকীকা কবে করা হবে? শেহজাদ এ ব্যাপারে এখনো কোনো কথা বলে নি। চিত্রা আরো কিছু গল্প করতে চায়। কিন্তু রোজের শক্ত মুখ দেখে আর কিছু বলার সাহস পায় না। দমে যায়। তাদের সামনে একা একা বসে থাকার চেয়ে বাচ্চাকে নিয়ে নিজের ঘরেই চলে এলো।

বাচ্চাটা অনেক আগে ঘুমিয়েছে, বিছানায় শুইয়ে দেয়া ভালো এবার।
অথচ বিধিবাম। বিছানায় ওড়না পেঁচিয়ে বালিশের মত করে শুইয়ে দিতে চেয়েছিল চিত্রা। অথচ মখমলের বিছানা বাচ্চার গায়ে স্পর্শ করার সঙ্গেসঙ্গে ঘুম ভেংগে যায় বাচ্চার। তারপরই কান্না। সে কি কান্না। চিত্রার মাথা ধরে যাচ্ছে। চিত্রা শুয়ে ছেলেকে খাওয়ানোর চেষ্টা করে। অথচ খাবে না। শুধু মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে কেদেই যাচ্ছে। চিত্রা কাপড় ঠিক করে ছেলেকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ঘরের এপাশ ওপাশ পায়চারি করে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে ক্রমশ। ঘুমায় না ছেলে। রাগ উঠে যায় চিত্রার। ঝাকানো শুরু করে জোরেজোরে।

খাবার শেষ করে নিজের ঘরের সামনে আসতেই চিত্রার ধমক, ছেলের কান্নার আওয়াজ কানে আসে শেহজাদের। শেহজাদ এদের হইচই শুনে দ্রুত ঘরে প্রবেশ করে। শেহজাদকে দেখে চিত্রা অসহায় চোখে তার দিকে চায়। চিত্রা এটুকু সময়েই ছেলেকে সামলাতে উস্কসুষ্ক হয়ে গেছে। চুল এলোমেলো হয়ে আছে। কোলের বাচ্চা গলা চেচিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। শেহজাদকে দেখে চিত্রা মাথায় আঁচল তুলে। শেহজাদ বিরক্ত হয়ে এগিয়ে যায়,

‘ও এভাবে কাদছে কেন? ঘুমাচ্ছিল দেখে গেলাম।”
শেহজাদ এগিয়ে গিয়ে বাচ্চাকে নিজের কোলে নেয়। কোলে নিয়ে দুবার ঝাকাতেই বাচ্চাটা কান্না থামিয়ে চুপ করে থাকে। মুখে আঙুল ঢুকিয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে শেহজাদের দিকে চেয়ে আছে। শেহজাদ এবার চিত্রার দিকে চায়, বলে,
‘বাচ্চার মায়েদের বাচ্চা সামলানো শেখা লাগে, সুভাষিণী। এটুকু বাচ্চাকে কেউ ধমক দেয়? ও কি বুঝে ধমকের? ওর ভেতরে ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছ তুমি।’

কথাগুলো চিত্রার কানে প্রবেশ করার সঙ্গেসঙ্গে চিত্রার চোখ টলমল করে উঠল। ফ্যালফ্যাল চোখে তাদের বাবা ছেলের দিকে চেয়ে থাকল নির্নিমেষ। ভেজা কণ্ঠে বলল,
‘আপনি বোঝাতে চাইছেন, আমি আমার ছেলের মা হওয়ার যোগ্য না? আমি বাচ্চা পালতে জানিনা?’

শেহজাদ তীক্ষ্ম চোখে চিত্রার দিকে চায়। তার কথাগুলোর এহেন অর্থ চিত্রা কিভাবে ধরে, অবাক হয় শেহজাদ। চিত্রা এগিয়ে আসে দু কদম। শেহজাদের চোখে চোখ রাখতে চায়, পারে না। রাগ ভুলে নিশ্চয়ই এবারেও শেহজাদের নেশালো চোখে ডুবেই যাবে চিত্রা। চিত্রা অন্যদিকে চেয়ে কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করে বলে,

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৪

‘আপনার ছেলে আপনি সামলান, ভালো বাবা হন আপনি, আমি তো খারাপ মা-ই।আপনাদের হয়ত আমাকে আর দরকার নেই। ছেলে কাদলে আর ডাকবেন না আমাকে। ছেলের কান্না সামলানো তো জানেন, সামলান তাহলে।’
কথাগুলো বলে চিত্রা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। শেহজাদ ছেলেকে কোলে নিয়ে হতবম্ব হয়ে চিত্রার যাবার দিকে চেয়ে রইল।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৬