খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৩

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৩
আভা ইসলাম রাত্রি

সমস্ত রাতের অজস্র ক্লেশ- চিন্তাকে এক মুহূর্তে মুছে ফেলে একটি শিশু কণ্ঠের দুর্বিষহ কান্না। সে কি ভয়ানক কান্নার শব্দ। সম্পূর্ণ হাসপাতাল যেন মাথায় তুলে রেখেছে। শেহজাদ কান্নার আওয়াজ শুনে দ্রুতকদমে ওটির সামনে এসে দাঁড়ায়। বাকিরা শেহজাদের পাশে দাড়িয়ে আছেন। রেখা বেগম ছেলের কাঁধে হাত রেখে চোখে জল নিয়ে বলেন,

‘আমাদের সাত রাজার ধন এসেই কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছে। তুমিও জন্ম হবার পর এমন করেই কেঁদেছিলে। সে কি কান্না। তোমার আব্বাজান তোমাকে কোলে নিয়ে কান্না থামিয়েছিলেন। অথচ তোমার আম্মাজান সেটা পারেন নি।’
শেহজাদ হালকা হাসে, পরপরই সে হাসি মিলিয়ে যায় চিন্তায়। চিত্রার অবস্থা কেমন সেটা এখনো জানা হয়নি। একটু পর ডাক্তার বেরিয়ে এলেন, শেহজাদ ডাক্তারের কাছে এগিয়ে গেলে তিনি বলেন,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘আমরা চেষ্টা করেছি, নরমাল ডেলিভারি করার। আপনার স্ত্রীর সাহস ছিল বিধায় অনেক ক্রিটিকাল সিচুয়েশনের মধ্যেই উনি কো-পারেট করেছেন। বাচ্চা সুস্থ এবং স্বাভাবিক, মা ভালো আছেন, উনার জ্ঞান ফিরবে কিছুক্ষণের মধ্যেই।’
এতক্ষণে শেহজাদের অন্তরে পানি এলো বোধকরি। শেহজাদ জিজ্ঞেস করে,
‘ভেতরে যাওয়া যাবে এখন?’
ডাক্তার উত্তর দেন,

‘শিউর, কিন্তু খেয়াল রাখবেন বেশি হইচই যেন না হয়। বাচ্চার মায়ের প্রপার রেস্ট প্রয়োজন।’
কথা বলে ডাক্তার চলে গেলেন। শেহজাদ আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করে না। কেবিনে প্রবেশ করে, শেহজাদের পেছনে পেছনে সবাই একে একে কেবিনে ঢুকে।

চিত্রার জ্ঞান নেই। ক্লান্ত–ঘর্মাক্ত চেহারায় সে কি তৃপ্তি ফুটে উঠেছে। মা হওয়াটাই বোধহয় নারীদের জীবনের সবচেয়ে বড় তৃপ্তি। শেহজাদ চিত্রার পাশে বসে। অপলক চেয়ে থাকে স্বীয় স্ত্রী পানে। পরপরই সবার কথার হইচই শুনে চোখ সরিয়ে নেয়। রেখা এবং শেফালি এগিয়ে এসে চিত্রার ঘেমে যাওয়া চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন। শেহজাদের ইচ্ছে করছে চিত্রার সারা মুখে চুমু খেয়ে অস্থির হয়ে যেতে। অথচ বড়রা সামনে বিধায় চিত্রার পাশে বসতেও লজ্জা লাগছে।

শেহজাদ চিত্রার পাশে থেকে উঠে খানিক দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। নার্স খানিক পর বাচ্চাকে গোসল করিয়ে এনে কেবিনে ঢুকে। নার্সের কোলে শুভ্র রঙের টাওয়াল জড়িয়ে দূর থেকে এক আশ্চর্য সুন্দর শিশুকে দেখে শেহজাদ। ঠোঁটে হাসি, চোখখানা নিভুনিভু, বুড়ো আঙুল মুখে পুড়ে রেখেছে। শেহজাদ বাচ্চাকে দেখে দু কদম আপনা আপনি সামনে এগিয়ে যায়।
রেখা সবার আগে এগিয়ে নার্সের কোল থেকে শিশুকে নিজের কোলে নেন। শিশুটি চেঁচিয়ে কান্না করছে শুধু। জন্মের পর থেকে তার কান্না থামানোই যাচ্ছে না। নার্স রেখার কোলে বাচ্চাকে আলগোছে রেখে বলল,

‘বাচ্চাটা যেমন সুন্দর, তেমন চিৎকারও করে। নেতাসাহেবের সন্তান উনার মতোই হয়েছে একদম।’
রেখা কিছুক্ষণ শিশুটিকে দেখে তারপরই উজ্জ্বল মুখে বলে উঠেন রেখা,
‘রাজপুত্র এসেছে আমাদের ঘরে। ছেলে হয়েছে, ছেলে।’

শেহজাদ এ কথা শুনে অদূরে দাঁড়িয়েই বিড়বিড় করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। শেহজাদের কাছে ছেলে না মেয়ে ব্যবধান ছিল না। তার প্রয়োজন ছিল, একটি সুস্থ বাচ্চার। আল্লাহ তায়ালা তার ঘরে দুহাত ভরে রহমত নাযিল করেছেন।
রেখা বাচ্চাকে কোলে নিলে মেহজাদ দ্রুত পায়ে রেখার পাশে এসে দাঁড়ায়। বাচ্চার মুখ থেকে টাওয়াল হালকা সরিয়ে হাত নাড়িয়ে জানায়,

‘হ্যালো চ্যাম্প, আমি তোমার চাচাজান হই। তুমি আমাকে চাচ্চু বলেই ডাকবে। ঠিকাছে?’
বাচ্চাটা কি বুঝল কে জানে? দাঁত-বিহীন ঠোঁট নাড়িয়ে হেসে উঠেই খানিক পর আবার গলা চেঁচিয়ে কাঁদতে লাগে। মেহজাদ অল্প হাসিতেই খুশিতে আত্নহারা। শেহজাদের দিকে চেয়ে বলে,

‘ভাইয়া, তোমার ছেলে একদম তোমার বিপরীত,শুধু হাসে।’
রেখা নার্সকে জিজ্ঞেস করেন,
‘বাচ্চার ওজন কত? কোনো রোগ বালাই আছে?’
নার্স উত্তর দেয়,
‘একদম না। বাচ্চা সম্পূর্ণ সুস্থ এবং শক্তিশালী। ওজনও ভালো, সাড়ে তিন কেজি।এটুকু মায়ের পেটে এমন বাচ্চা সাধারণত হয়না।’

রেখা এবার অহংকার অনুভব করেন। বরাবরের মত এবারেও নিজের সুনাম গাইতে কার্পণ্য করেন না এটুকু। গদগদ কণ্ঠে শেফালির দিকে চেয়ে বলেন,
‘শশুরবাড়ি কেমন পেয়েছে সেটাও তো দেখতে হবে।’
শেফালি হাসলেন রেখার কথায়। নার্স বেরিয়ে যায়।
রেখা বাচ্চার কান্না থামানোর চেষ্টা করেন অনেকক্ষণ ধরে, অথচ লাভ হয়না। শিশুর মুখের দিকে চেয়ে শেহজাদের উদ্দেশ্যে বলেন তিনি,

‘পুরো আমার ছেলের মত হয়েছে। জন্মের পর দুজনেই কেঁদে হাসপাতাল মাথায় করে ফেলছে।’
সবাই রেখার আশেপাশে ভিড় জমিয়েছে শিশুকে দেখায় জন্যে। শেহজাদের পা কাঁপছে। এগুতে পারছে না যেমন। এতমাস যাবৎ যে শিশুকে পেটের মধ্যে আদর করে এসেছে, যার সঙ্গে এতমাস একা একাই কত কথা বলেছে, সুখ-দুঃখের কথা আলোচনা করেছে, এ শিশু এখন সবার হাতে। তাকে চোখে দেখা যাচ্ছে, আদর করা যাচ্ছে, চুমু খাওয়া যাচ্ছে। শেহজাদের বুকের ভেতরে কেমন অদ্ভুত খুশি অনুভব হচ্ছে। রেখা শেহজাদকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডাকেন,

‘শেহজাদ, দূরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এদিকে আসো, নিজের ছেলে কোলে নাও একবার। শিশুর কানে প্রথম আযান তুমি দিবে।’
মায়ের কথা শুনে শেহজাদ এগিয়ে আসে ধীর কদমে। আস্তে আস্তে কদম ফেলে রেখার পাশে এসে দাঁড়ায়। রেখা শেহজাদের কোলে আস্তে করে শিশুকে রাখেন। শেহজাদ নিজের কোলে শিশুকে রেখে কান্না থামানোর চেষ্টা করে। কয়েকবার ঝাঁকানোতেই শিশু আশ্চর্যের ন্যায় কান্না থামিয়ে দেয়।

বুড়ো আঙুল মুখে ঢুকিয়ে চুষতে থাকে, চেয়ে থাকে শেহজাদের দিকে। শেহজাদ মুখ থেকে আঙ্গুল সরানোর চেষ্টা করে একবার, সফল হয়না। আঙুল সরালেই কেঁদে উঠে। শেহজাদ তাই আর চেষ্টা করেও না। নিজের অংশ, এ সুন্দর শিশুকে দেখে শেহজাদ যারপরনাই বিস্মিত। বারবার তাকাচ্ছে ছেলের দিকে। বোধ হচ্ছে, শেহজাদের নিজের নজর লেগে না যায় বাচ্চার বেলায়।

শেহজাদ নিজের আবেগ সহ্য করতে পারে না। আলগোছে মাথা নামিয়ে চুমু খায় শিশুর কপালে, বিড়বিড় করে প্রশ্ন করে,
‘তোমার আব্বাজান তোমার সঙ্গে এতদিন অনেক গল্প করেছে, তুমি কি তার কথাগুলো শুনেছ, আব্বা?’
শিশুটি কি বুঝল কে জানে? শেহজাদের পাঞ্জাবি দু আঙ্গুলে খামচে ধরে হালকা হেসে উঠে। শিশুর হাসি দেখে শেহজাদের বুকের ভেতরটা নড়ে উঠে যেন। ছেলেকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে। চোখের জল এবার আর আটকে রাখতে পারে না। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুঁজে দু ফোঁটা জল বিসর্জন দেয় শেহজাদ।

রেখা শেহজাদের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন,
‘তোমার ছেলে একদম তোমার সবকিছু পেয়েছে। তুমি যেমন হাসো, তেমনি হাসি। নাক-মুখ তোমার, চোখটা আবার পেয়েছে মায়ের।’

শেহজাদ রেখার দিকে তৃপ্তি নিয়ে চায়। পরপরই ছেলের মুখের দিকে চেয়ে থাকে আবার। এত দেখছে কোলের এ শিশুকে। অথচ তৃপ্তি যেন মেটেই না। মায়ের মত জন্ম নিয়েই জাদু করেছে যেমন তাকে।
মেহজাদ রেখার কথায় বাঁধ সাধে। বলে,
‘আম্মাজান, ভাইয়ার হাসি আপনি দেখলেন কখন? সবসময়ই ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থাকে ভাইয়া। হাসলেও সেকেন্ডের মধ্যে হাসি মিলিয়ে যায়। শুনো ভাইয়া, তোমার ছেলেকে কিন্তু হাসতে শেখাবে। তোমার মত গম্ভীর হলে আমি ওকে শাসন করে হাসি শিখিয়ে দেব একদম।’

শেহজাদ হালকা মাথা নাড়ে। কোলে থাকা ছোট্ট শিশুর দিকে অপলক চেয়ে শান্ত স্বরে বলে,
‘ও হাসুক, যতদিন বেঁচে থাকে ততদিন কোনো দুঃখ যেন তাকে না ছুঁয়।’
সবার এত কথায় মাঝখানে নওশাদ বললেন,
‘শিশুর কানে আযান দেওয়া হয়নি। শেহজাদ, আযান দিয়ে দাও।’

নওশাদের কথায় শেহজাদ ছেলেকে উঁচু করে এবার। কানের কাছে ঠোঁট এনে ‘আল্লাহু আকবার’ বলার সঙ্গেসঙ্গে শিশু হেসে উঠে শেহজাদের পাঞ্জাবি খামচে ধরে চোখ বুজে ফেলে। ছেলে যতবার হাসে, শেহজাদের বুকে যেন প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়। আনন্দে আত্নহারা হয়ে যায় সে। রাজপুত্রের মত এ শিশু তাদের, ভাবলে বুকের মধ্যে প্রশান্তি উপচে পরে। সুভাষিণীর জ্ঞান ফেরার পর ছেলেকে দেখলে কেমন পাগলামি করবে? আনন্দে আত্নহারা হবে নিশ্চয়ই যেমনটা অনুভব করছে স্বয়ং শেহজাদ।

হাসপাতালে যারা ছিল তারা কিছু সময় আগে বাড়ি গিয়েছেন। যোহরের নামাজ পরে আবার আসবেন। শেহজাদ ছেলেকে কোলে নিয়ে চিত্রার পাশে শুয়ে আছে। চিত্রার জ্ঞান আর অল্পসময়ের মধ্যেই ফিরবে। বাচ্চা কান্না করছে শুধু। ক্ষুধা লেগেছে তার। শেহজাদ কান্না থামানোর যারপরনাই চেষ্টা করছে। কিন্তু কান্না থামাতে সক্ষম নয় সে। অগ্যতা অপেক্ষা করছে চিত্রার জ্ঞান ফেরার।

ঘণ্টা-খানেক পর ধীরে ধীরে চোখ খুলে চায় চিত্রা। ক্লান্তি এবং ব্যথায় চোখের কোণে জল জমে যায়। শরীর এখনো অবশ হয়ে আছে যেন। জ্ঞান ফিরেই সর্বপ্রথম কানে আসে বাচ্চার কান্না। বুকটা তাৎক্ষণিক শান্ত হয়ে যায় চিত্রার। ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে চায়। শেহজাদ এক বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ঝাঁকাচ্ছে শুধু। অপটু হাতে শেহজাদকে বাচ্চা সামলাতে দেখে দারুণ মজা পায় চিত্রা। ক্লান্তিতেও হেসে উঠে। চিত্রার হাসির আওয়াজে শেহজাদ চিত্রার দিকে চোখ রাখে। চিত্রা আস্তে করে শুধায়,
‘এ-তবড় নে-তা হয়ে এখনো বাচ্চা সা-মলানো শিখলেন না, নেতা-শাহ! এভাবে ঝাকালে ব-মি করে দে-বে।’

চিত্রার নিভু নিভু কণ্ঠস্বর শুনে শেহজাদ ঝাঁকানি থামিয়ে চিত্রার দিকে চায়। বলে,
‘ক্ষুধা লেগেছে বোধহয় ওর। ওকে কষ্ট করে খাওয়াতে পারবে?’
চিত্রা বিছানায় শুয়ে দুহাত বাড়িয়ে দেয় শেহজাদের দিকে। শেহজাদ ঠোঁট নাড়িয়ে চিত্রার হাতে এক হাত রাখে, ওপর হাতে বাচ্চাকে চিত্রার বুকের মধ্যে শুইয়ে দেয়। এতক্ষণ খা খা করা চিত্রার বুকটা যেন এবার ভরে যায় আনন্দে। চিত্রা শেহজাদের হাত খামচে ধরে বাচ্চার মুখের দিকে চায়। তারপরই শেহজাদের দিকে চেয়ে উচ্ছল কণ্ঠে প্রশ্ন করে,

‘ছেলে?’
শেহজাদ মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়। চিত্রার শেহজাদের হাত ছেড়ে দিয়ে দুহাতে ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। চোখ বেয়ে অবিরাম জল গড়ায়। শেহজাদ চিত্রার পাশে বসে চিত্রার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। চিত্রা শেহজাদের দিকে চোখ তুলে চায়, আদ্র কণ্ঠে প্রশ্ন করে,
‘আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন, আপনার সন্তান আপনার মতোই সুদর্শন।”

শেহজাদ শুনে, ভেজা চোখে চেয়ে থাকে স্বীয় স্ত্রী সন্তানের পানে। অতঃপর হালকা হেসে মাথা নামিয়ে চিত্রার কপালে গাঢ় চুমু বসায়। আবেগে চোখ বুঁজে আসে চিত্রার। শেহজাদ চিত্রার কপালে ঠোঁট রেখে স্থির হয়ে থাকে অনেকক্ষণ। বলতে চায় অনেক কথা। অথচ আজ যেন কথারা হারিয়ে গেছে। চিত্রা শেহজাদের সরু নাকে চুমু বসায়। সারা রাত পর এতক্ষণে চিত্রার সংস্পর্শে থেকে শেহজাদের বুকের উত্তাল-পাত্তাল ঝড় এবার শান্ত হয়। শেহজাদ এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে খানিক পর সম্মোহন করা কণ্ঠে শুধায়,

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩২

‘দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠো! আমরা দুজন আমাদের সন্তানের জন্যে শ্রেষ্ট বাবা-মা হব, মনে রেখো।’
চিত্রা ভেজা চোখে চেয়ে থাকে শেহজাদের চোখের দিকে। পরপর তৃপ্তি নিয়ে হেসে উত্তর দেয়,
‘মনে থাকবে।’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৪