খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩২

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩২
আভা ইসলাম রাত্রি

রাত বেড়েছে, চারপাশ কেমন গুমোট অন্ধকার রঙ ধারণ করছে। শেহজাদ বারান্দার গ্রিলে এক হাত রেখে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। চোখের কোণায় হঠাৎ হঠাৎ জলের চিহ্ন দেখা গেলেও, পরমুহুর্তে জল ম্যাজিকের ন্যায় মিলিয়ে যাচ্ছে। শেহজাদের বুকের ভেতরটা তছনছ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। পরিবারের সুখের বাইরে যে কিছু ভাবে না, তার ভাবনা আজকাল পরিবারের মানুষের কাছে বি/ষ সমতুল্য। শেহজাদের কণ্ঠমনী ক্রমশ উঠানামা করছে।

কষ্টগুলো গিলে ফেলার কি তীব্র চেষ্টা! মেহজাদ খানিকটা উগ্র, চঞ্চল, আগাগোড়া অবুঝ। শেহজাদ তো ভাইয়ের খারাপ চাইল না, বরং ভাইকে চেয়েছে বোঝাতে, পূর্ণ বুঝদার পুরুষে রূপান্তরিত করতে। অথচ আজ — আজ সবকিছু কেমন উলটপালট হয়ে গেল। হঠাৎ করে এমনটা কেন হয়ে যাচ্ছে সব? শেহজাদ আন্দাজ করতে পারছে না কিছুই।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হাজারখানেক চিন্তায় যখন শেহজাদ ডুবে, ঠিক সেসময় এক টুকরো আশা নিয়ে কেউ শেহজাদের বাহু জড়িয়ে কাধে মাথা রাখে। শেহজাদ ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে চায়, চিত্রার চোখে জলে মাখামাখি। শেহজাদের ঘাড়ে থুতনি রেখে চেয়ে আছে সরাসরি শেহজাদের অবসন্ন চেহারার দিকে। চিত্রার সবসময় উজ্জ্বল, সুদর্শন স্বামী যেন আজ হাজার বছরের ক্লান্তি অনুভব করছে। চিত্রা হাত উঁচু করে শেহজাদের কপালের উপর থেকে চুল সরায়, চোখের কোণে অজান্তে জমে যাওয়া জলটুকু মুছে মিহি গলায় শুধায়,

‘কষ্ট পাবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
শেহজাদ নিজের কখনো চোখের জল দেখায় না। অথচ আজ সকল নিয়ম ভেঙে চিত্রার সামনে তার দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েই গেল। শেহজাদ আলগোছে চিত্রার পিঠে হাত রেখে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে। চিত্রা অনুভব করে,
তার ঘাড় ভিজে যাচ্ছে। বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যায় চিত্রার। কাপা হাত শেহজাদের সুডৌল পিঠে রাখে,
‘দয়া করে কাঁদবেন না, আপনার কান্না আমার বুকে বিঁধে।’

শেহজাদ বুঝতে পারে, সে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গেসঙ্গে চিত্রাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। চিত্রা দুহাতে শেহজাদের ভেজা চোখ মুছে দেয়, শেহজাদ মুখ অন্যদিকে সরিয়ে নেয়। চিত্রা বলে,
‘শক্ত হোন। আপনার ভাই অবুঝ, বুঝে না। তাকে বোঝান আপনার মত করে, ওর সঙ্গে আলাদা কথা বলুন, জানতে চান, কি চায় সে। দু ভাইয়ের মধ্যে বড়সর সংঘর্ষ হওয়ার আগেই সব নিজেদের মধ্যেই মিটমাট করে ফেলুন। বাইরেরটা সামলাতে গিয়ে না জানি আপনার ঘর বরবাদ হয়ে যায়।’

শেহজাদ গ্রিলে এক হাত রাখে, অপর হাতে কোমর ধরে। চিত্রা শেহজাদের কাঁধে হাত রেখে ভরসা দেয়। হঠাৎ শেহজাদ হাঁটু গেঁড়ে চিত্রার পেটের কাছে বসে। চিত্রার পেটের উপর থেকে শাড়ি সরিয়ে আলগোছে চুমু খায় সেথায়। শিহরণে কেঁপে উঠে চিত্রা। শেহজাদ চিত্রার পেটে চুমু খেয়ে আওড়ায় কটা কথা,
‘আব্বাজানকে মাফ করো। তুমি জন্ম নেবার আগেই ঝগড়ার সৃষ্টি হচ্ছে, ফাটলের সূচনা হচ্ছে। অথচ এ পরিবারের মানুষ তোমাকে শেখাবে, সকল প্রকার বন্ধনের গুরুত্ব। তোমার আব্বাজান সব ঠিক করে দেবেন, তুমি আসার আগে সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার আব্বাজান তোমাকে কথা দিচ্ছে।’

চিত্রা শেহজাদের কথাগুলো শুনে, ঝরঝর করে জল নামে তার চোখে। শেহজাদ পুনরায় পেটে চুমু খেতে উদ্যত হলে হঠাৎ চিত্রা সজোরে চিৎকার দিয়ে উঠে। আচমকা চিত্রার চিৎকারে অভ্যস্ত ছিল না শেহজাদ। শেহজাদের চোখ এখনো চিত্রার পেটের দিকে, সে স্পষ্ট লক্ষ্য করে চিত্রার পেটে দুটো পায়ের ছাপ। শেহজাদ রীতিমত আঁতকে উঠে পেটে হাত রাখে। চিত্রা পেট খামচে ধরে আবারও চেঁচিয়ে উঠে শব্দ করে। শেহজাদ সঙ্গেসঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। চিত্রার দু কাঁধ আলগোছে নিজের বাহুতে টেনে নিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করে,

‘সুভাষিণী, চেঁচাচ্ছ কেন? কি হয়েছে? এদিকে তাকাও। আমার চোখে তাকাও। কি হয়েছে?’
চিত্রা শেহজাদের বাহুতে মাথা রেখে পেট খামচে ঢলে পরে রীতিমত। পেটে হাত রেখে চিৎকার করে কান্না শুরু করে। শেহজাদ চিত্রার পেটে হাত রাখে, বোঝার চেষ্টা করে কিছু। পরপরই চিত্রা হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
‘শুনুন, সময়– বো–ধহয় হ–য়ে এসেছে। আমাকে — নিয়ে –’
চিত্রাকে আর কিছুই বলতে হয়না। শেহজাদ চিত্রাকে দ্রুত পাজকোলে তুলে নেয়। পরপরই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে উঠোনের দিকে যেতে যেতে সবাইকে ডাকে।

রেখা বেগম, নওশাদ আয়ুষ্মান যে যার ঘরে ছিল চিত্রার কান্না এবং শেহজাদের ডাক শুনে দৌড়ে একে একে বেরিয়ে আসেন। আসে না শুধু মেহজাদ। রেখা বেগম উঠোনে এসে চিত্রার এই অবস্থা দেখে আঁতকে উঠে বলেন,
‘পানি ভাঙছে ওর। জলদি গাড়ি করে হাসপাতালে নিতে হবে।’
শেফালি বলেন,

‘বাড়িতে চেষ্টা করি একবার?’
শেহজাদ রেখা বেগমের উত্তর শোনার ধৈর্য্য রাখে না। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলে,
‘না, এসবের সময় এখন হাতে নেই। হাসপাতালে যাওয়া ভালো হবে। ড্রাইভার, গাড়ি বের করো।’
সৌরভ পাশে থেকে ব্যস্ত কণ্ঠে বলেন,
‘ড্রাইভার নেই,ওর মেয়ের বিয়ে। বাড়িতে গিয়েছে, তোমাকে বলেই গেল।’

শেহজাদ অসহায় চোখে চিত্রার দিকে চায়। চিত্রা শেহজাদের বুকের পাঞ্জাবি খামচে ধরে শুধু ছটফট করছে। রেখা বলেন,
‘মেহজাদকে ডেকে আনো। ও গাড়ি চালাবে, বউকে এভাবে রেখে শেহজাদ গাড়ি চালাতে পারবে না।’
শেহজাদ চারপাশে দেখে। রেখা বেগম লোক পাঠান মেহজাদের ঘরে। বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে যায় মেহজাদ আসে না। শেহজাদ এবার হাল ছেড়েই দেয়। আল্লাহর নাম করে রেখাকে বলে,
‘আম্মাজান, আপনি ওর পাশে পেছনে বসুন। আমি গাড়ি চালাব। চাচীজান আপনি সঙ্গে আসুন। আব্বাজান, চাচাজান পরে আসবেন।’

রেখা এ কথা শুনে আর কাল বিলম্ব করেন না। দ্রুত গাড়ির পেছনে বসেন। শেহজাদ চিত্রাকে আলগোছে রেখার পাশে বসায়। শেহজাদ সরে যেতে চাইলে চিত্রা বাঁধ সাধে। শেহজাদের পাঞ্জাবি খামচে ধরে কেঁদে কেঁদে বলে,
‘আ-পনি আমার সা-থে থাকুন, আ-মি বোধহয় আর বাঁচব না। আমার খুব য-ন্ত্রণা হচ্ছে, নে-তাশাহ।’
রেখা চিত্রার মাথার হিজাব হালকা সরিয়ে সেখানে পানির ছিটে দিতে দিতে বলেন,
‘বউমা, আমি আছি। শান্ত হও তুমি। বেশি না, আর অল্পসময়।’

চিত্রা তবুও শেহজাদের পাঞ্জাবি ছাড়ছে না। হাঁপাতে হাঁপাতে বারবার শেহজাদের বুকের মধ্যে ঢুকে পরার চেষ্টা করছে। শেহজাদ অসহায়ের ন্যায় চিত্রার কপালে সবার সম্মুখে চুমু বসায়। চোখে জল নিয়ে বোঝায়,
‘আমি আছি, যতক্ষণ রুহ আছে ততক্ষণ। শান্ত হও তুমি।’
শেহজাদ কোনরকম চিত্রাকে রেখার পাশে বসিয়ে গাড়ির দরজা খুলবে, সে সময় মেহজাদ কোথা থেকে এসে ড্রাইভিং সিটে বসে যায়। আচমকা মেহজাদকে দেখে শেহজাদসহ সবাই অবাক হয়ে যায়। মেহজাদ সবার বিস্মিত চাওনি পরোয়া না করে শেহজাদের দিকে না চেয়ে সামনে তাকিয়ে বলে,

‘ভাবিজানের তোমাকে প্রয়োজন। উনার পাশে বসা উচিত তোমার।’
শেহজাদ এ কথা শুনে আর সাতপাঁচ ভাবে না। দ্রুত চিত্রার পাশে বসে চিত্রার মাথা নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে। যতটুকু দোয়া দরুদ পারে, সব বিড়বিড় করে পড়তে শুরু করে। মেহজাদ গাড়ি চালানো শুরু করে।

সময় পেরুচ্ছে, ততই শেহজাদের বুকের উঠানামার গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাসপাতালের মধ্যে থাকা গ্রামের কয়েকজন শেহজাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করেছে। শেহজাদের এমন অসহায় অবস্থা তারা আদৌ কখনো দেখেছে কি না সন্দেহ। গ্রামের মুরুব্বী কজন শেহজাদকে আশ্বস্ত করছেন। শেহজাদ চেয়ারের মধ্যে বসে আছে নিশ্চুপ। চিত্রা ওটিতে প্রবেশ করার পর এখন অব্দি শেহজাদ রা অব্দি কাটে নি। সেই যে বসেছে, বসেই আছে।

মেহজাদ দূরে পিলারের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অভিমান এতটাই তীব্র যে ভাইয়ের এমন কঠিন মুহূর্তে সবাই শান্তনা দিলেও, মেহজাদ কিছুই বলেনি। রেখা বেগম দু ভাইয়ের মধ্যে এমন দ্বন্ধ চোখে দেখতে পারেন না। উঠে আসেন মেহজাদের নিকট।

মেহজাদ রেখাকে তার দিকে আসতে দেখে নড়েচড়ে দাড়ায়। রেখা মেহজাদের কাঁধে হাত রাখেন। মা সুলভ বোঝান,
‘মেহজাদ, ভাইয়ের সঙ্গে কেউ এমন কথা না বলে থাকে? তোমার ভাই তোমাকে সবসময়ই আদর করেছে, আশকারা দিয়েছে। এতটাই ভালোবেসেছে যে, বাড়ির সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তোমাকে তোমার স্বপ্ন পূরণে বিলেতে পাঠিয়েছে। বড় ভাইকে সম্মান দিয়েছ সবসময়ই, তাহলে আজ কেন পিছিয়ে যাচ্ছ? যাও, শেহজাদের সঙ্গে কথা বলো। ক্ষমা চাও। ছোট হয়ে আজকে অনেক বড়বড় কথা বলেছ তুমি। শেহজাদ কষ্ট পেয়েছে। তোমরা দু ভাই সবসময় মিলেমিশে থাকবে, মনে থাকবে?’

মেহজাদ মায়ের কথা শুনে। বিবেক হঠাৎ করেই তার জাগ্রত হয়। রাগের মাথায় যা নয় তাই বলেছে শেহজাদকে। অথচ শেহজাদ নিজের জীবনের পরোয়া না করে বারবার মেহজাদকে সকল বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে। কি হয়েছিল তার? আজ কিভাবে গলা উঁচু করে এতগুলো কথা বলে ফেলল? যেসব বলেছে, সেসব তো শান্ত ভাষায় ভালোভাবে বসেও বলা যেত। মেহজাদ চিন্তায় ডুবে যায় কিছুক্ষণের জন্যে। খানিক পর অন্যমনস্ক গলায় প্রশ্ন করে বসে,

‘আম্মাজান, আমি কি সত্যি খুব বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি ভাইয়াকে?’
রেখা বেগম ছেলের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রায়শ্চিত্ত করতে দেখে যারপরনাই আপ্লুত হোন। মেহজাদের কপালে চুমু খেয়ে বলেন,

‘যা করেছ, করেছ। এখন যাও, ভাইয়ের কাছে বসো। তোমার ভাই এখন সবচেয়ে জটিল মুহুর্ত পাড় করছে।’
মেহজাদের মুখখানা কালো হয়ে যায় অপরাধবোধে। রেখা বেগমকে পাশ কাটিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে যায় শেহজাদের দিকে।
আচমকা কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করে শেহজাদ মাথা তুলে চায়।

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩১

মেহজাদ শেহজাদের দিকে হাসিমুখে চেয়ে আছে। শেহজাদ চেয়েই থাকে অপলক। চোখের কোণে যে এখনো জল জমে। মেহজাদ হালকা স্বরে বলে,
‘চিন্তা করো না, ভাবিজান, আমাদের চ্যাম্প সুস্থ থাকবে। তুমি আল্লাহকে অনেক মানো, আল্লাহ তোমার ঘরের আলো ছিনিয়ে নেবেন না। ভরসা রাখো।’

খাঁচার ভেতর অচিন পাখি পর্ব ৩৩