কাঞ্চাসোনা গল্পের লিংক || জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

কাঞ্চাসোনা পর্ব ১
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

“আম্মা এতো ছোট মেয়েকে বিয়ে করা কি ঠিক হবে?”
মনোয়ারা বেগম উনার ছেলে ধ্রুবকে ভরসা দিয়ে বলেন,
“আব্বু মেয়ে মাশাল্লাহ দশজনের একজন,একবারে হুরপরীর মতো দেখতে।”
ধ্রুব বুঝানোর ভঙ্গিতে দুদিকে মাথা নেড়ে বলল,

“আম্মা সুন্দরী হলে কি হবে যদি ম্যাচিউর না হয়।আজকাল সুন্দরের থেকে বুজধার মানুষের গুরুত্ব বেশি,ম্যাচিউর না হলে সংসার টিকে না আম্মা।”
মনোয়ারা পান চিবুতে চিবুতে বলেন,
“তোমারে এতো বড়ো ভার্সিটিতে পড়িয়ে কি লাভ হলো বলোতো ,একটা বাচ্চা মেয়েকেই যদি ম্যাচিউরিটি শিখাতে না পারলা!”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ধ্রুব থমথম খেয়ে বলল,
“আমি কিভাবে শিখাব আম্মা?এসব নিজেই বয়সের সাথে শিখে নিতে হয়,কাউকে শিখানো যায় না।”
মনোয়ারা হাল ছাড়ে না।এই মেয়েকে তিনি ছেলের বউ করবেই।ধ্রুবর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“কাঁচা ভিজা মাটি এনে দিতেছি আব্বা,নিজের মতো আকৃতি দিয়া গড়ে নিবা তোমার জন্যই ভালো হবে।”

ধ্রুবর মন মানে না।ঢাকা শহরে আজকাল এমন ছোট মেয়েকে কেউই বিয়ে করেনা,মেয়ে ছোট তার উপর গ্রামের,কি যানি কেমন হয়।সে এতো বড় ব্যাংকে চাকরি করে,তার কলিগরা আর বন্ধুরা এটা শুনলে খুব হাসবে কিন্তু মা বাবার ইচ্ছেটাকেও গুরুত্ব দেয়া তার দায়িত্ব।কি করবে মাথায় আসছে না।ধ্রুব মনোয়ারাকে আর কিছু না বলে তার রুমে চলে যায়।সে ভেবেছিল তার থেকে বেশি হলে দুই তিন বছরের ছোট মেয়েকে বিয়ে করবে তা না একটা বাবু বিয়ে করা লাগবে!ধ্রুব রাগে চুপচাপ ফ্লোরে বসে থাকে।

এভাবেই চুপচাপ কয়েকটা দিন কেটে যায়।মনোয়ারা অবশ্য হাল ছাড়লেন না,তার স্বামী আসাদ মির্জার ও মেয়ে পছন্দ হয়েছে মূলত মেয়েটাকে তারা তাদের গ্রামের বাড়িতে দেখেছে,আসাদ মির্জার চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে।এদিকে কাজের চাপে কয়েকবছর গ্রামে যাওয়া হয়নি,এই কিছুদিন আগে গিয়েছিলেন তখনি মেয়েটাকে দেখেই ধ্রুবর জন্য ঠিক করেছেন।

এবার মোটে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে,বয়স কিছুটা কম তারপরেও মেয়ে নিজেরাই গড়ে নেয়া ভালো,এই কথাটাই ধ্রুবকে তারা বুঝাতে পারছেন না।ধ্রুব এই মেয়ের কথা শুনতে শুনতে কান ব্যাথা হয়ে গেছে,এতদিন চুপ থাকলেও আজকে ইনিয়ে বিনিয়ে না বলাতে মনোয়ারা কেঁদেকেটে প্রেসার বাড়িয়ে ফেলেছেন,ধ্রুব তাকে মানাতে চেষ্টা করাতে পরিস্থিতি আরো খারাপের পর্যায়ে চলে গেলে,আসাদ মির্জা ধ্রুবকে ডেকে বললেন,

“ধ্রুব মা বাবার কথা গুরুত্ব দেয়া তোমার দায়িত্ব ছিল কিন্ত তুমি অতি বিদ্বান হয়ে গেছ,এখন বাবা মায়ের কথার গুরুত্ব তোমার চোখেই পড়ে না।”
ধ্রুব বুঝতে পারল পরিস্থিতি তার বিপক্ষে তাই অতি নারাজ কন্ঠে বলল,
“আচ্ছা তোমরা বিয়ের ব্যবস্থা করো,আমি এই মেয়েকেই বিয়ে করবো।”
এটা বলেই বাবা মায়ের রুম প্রস্তান করেন।মনোয়ারা শব্দ করে বলেন, “শুকর আলহামদুলিল্লাহ,এই মিতুর আব্বা আজকেই তারেক ভাইকে ফোন করে বলে দাও বিয়ের আয়োজন করতে আমরা আসছি।”
আসাদ মির্জা বললেন,

“এতো তাড়াহুড়ো করতে হবে কেন?একবার রাজি হয়েছে যেহেতু বিয়ে অবশ্যই করবে।”
মনোয়ারা অস্থির হয়ে বললেন,
“আহা তুমি বুঝতে পারছ না,রাজি যেমন হয়েছে তেমনি বেঁকে বসতেও সময় লাগবে না।মিতুকে ফোন দাও শাহীনকে নিয়ে যেন দ্রুত চলে আসে।”

আসাদ মনোয়ারার কথামতো সবজায়গায় ফোন দেয়।তারেক খুব খুশি হয়,বলা বাহুল্য যে সবাই আগে কথাবার্তা বলেই রেখেছিল।মিতু জানায় সে আজকে সন্ধ্যায় আসছে তার স্বামীর অফিস ছুটি হলেই চলে আসবে একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা।অবশ্য মেয়ে ছোট এটা নিয়ে মিতুও একটু ধোনামোনা করেছিল পরে মনোয়ারার যুক্তির কাছে হেরে গিয়ে হাসিমুখেই রাজি হয়েছে।

ধ্রুবর আর কোন কথা বলার জায়গাই রইল না,আজকেই গ্রামে যেতে হবে,তার কথা বুঝার বা শোনার একটা মানুষও নেই,রাগে,দুঃখে ধ্রুব বাথরুমে গিয়ে কেঁদে দিল,জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিধান্ত তাকে নিজের মতামত ছাড়াই নিতে হচ্ছে।তারপরও চুপচাপ রেডি হয়ে গেল।পরিকল্পনা অনুযায়ী সবাই রাত দশটার বাসে উঠল,পৌছাতে পৌছাতে রাত দুইটা বেজে যায়।

সবাই খুব অমায়িক ব্যবহার করছিলেন তারপরেও ধ্রুবর মুখটা চিপে নেয়া লেবুর মতোই তেতু লাগছিল।কিছুই শান্তি লাগছিল না সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলতে হচ্ছে।ধ্রুবর সন্ধানী চোখ পিচ্ছি মেয়েটাকে খুঁজে,তখনি চোখে পড়ে গোল ফ্রক পড়ে টেবিলে খাবার পরিবেশন করছে,এতো ছোট্ট!ধ্রুবর বুকের খাঁচার হৃদপিণ্ড বন্দী কয়েদিদের মতো কেঁপে ওঠে,বাবা মা এই মেয়েটাকে কিভাবে তার জন্য ঠিক করল,উঁচু লম্বা বলিষ্ঠ দেহের ধ্রুবর সাথে এই মেয়েকে তো দেখাই যাবে না।

ধ্রুব ভালো করে খেয়াল করে দেখল তার মা যতো হুরপরী বলে চিল্লাপাল্লা করছিল তার চোখে এই মেয়েকে মোটেই হুরটুর লাগছে না বরং ছোটবোনের মতো লাগছে।ধ্রুব আশ্চর্য হয়ে দেখল,মেয়েটা নিলজ্জের মতো তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে,সে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নিজেকে নিজে একটা থার্ডক্লাশ গালি দিল,জীবনে কেন প্রেম করলনা এই রাগে মরে যেতে ইচ্ছে করেছে প্রেম করলেও আপাতত বলতে পারতো প্রেমিকার কথা।

সে অবশ্য মা বাবার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করার ইচ্ছা পোষণ করেছিল কিন্তু মা বাবা যে এমন ছোট বোন টাইপ মেয়ে পছন্দ করে ফেলবে সেটা অবশ্য ভাবেনি।অতি রাগে ধ্রুবর রাতে ঘুম হলো না,গ্রামে অবশ্য শহরের তুলনায় খুব বেশী শীত পড়ে,লেপ দেয়ার পরেও ধ্রুবর ঘুম হলো না।খুব ভোরে পাখির কিচিরমিচির শব্দে বিছানা থেকে উঠে বসল,গায়ে কালো সোয়েটার চাপিয়ে টিনশেড বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে পড়ল।উঠোনে নেমে দেখল একপাশের ছোট্ট রান্নাঘরে অতি আমেজের সহীত রান্নাবান্নার আয়োজন হচ্ছে,তাকে দেখে রান্নাঘর থেকে ফারজানা ছুটে এলেন অমায়িক গলায় বললেন,

“বাবা এতো সকালে উঠে পড়েছো,কিছু লাগবে?”
ধ্রুবর মহিলাটার চেহারার দিকে তাকালেন চেহারায় স্মার্ট একটা ভাব আছে,উনাকে কাল রাতে কাকি হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে,কিছুক্ষণ পরে অবশ্য শাশুড়ী হবে।ধ্রুবর কাছে তাদের ব্যবহার খুব ভালো লাগছে শুধু বিয়েটা ছাড়া।সে মাথা নাড়িয়ে বলল,

“না কাকি কিছু লাগবে না।আপাতত সামনে একটু হেটে আসতে চাই।”
তিনি নিজেও হাসলেন পাত্র হিসাবে ধ্রুবকে তার ভালো লেগেছে।
“আচ্ছা যাও,চারদিকে ঘন কুয়াশা সাবধানে হেটো গ্রামের পথঘাট বুঝই।”
ধ্রুব মাথা নেড়ে রাস্তায় এসে নামল।

সেই ছোটবেলায় একবার গ্রামে এসেছিল সেবার খুব গরম ছিল কিন্তু জীবনে এই প্রথম গ্রামের শীতকাল দেখা সকালের মৃদু বাতাসে,কুয়াশা শিশির বিন্দু হয়ে ঘাসে পড়ছে,পাখিরা এই গা কাঁপানো শীত উপেক্ষা করেও উড়ে যাচ্ছে।সবচেয়ে মিষ্টি ব্যাপার হলো এমন শীতেও ধ্রুবর খারাপ লাগছে না বরং খুব উপভোগ করছে,সারারাত না ঘুমানোর ক্লান্তি মুহূর্তেই চলে গেল।

চারদিকে ঘন কুয়াশার জন্য দূরের জিনিস স্পষ্ট দেখা যায় না আবছাভাবে আস্তেধীরে সব ফুটে উঠছে,তেমনি এক মেয়ের আবছা প্রতিবিম্ব দেখা গেল,ধ্রুব একটু সামনে এগুতেই প্রথমে যে জিনিসটা দেখল,তা হলো গ্রামে আঁকাবাঁকা পথের মতো মেয়েটার লম্বা চুলের বিনুনি দুলছে।চুলগুলো খুব বেশিই লম্বা চোখে পড়ার মতো,কোমর ছেড়েও নিচে নেমেছে।মেয়েটা আলতো পায়ে ধীরে ধীরে হাটছে,আর পাশের সাদা বিড়ালটা তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে মেয়েটাকে সঙ্গ দিচ্ছে।ধ্রুব কেন যানি লম্বাচুলের মেয়েটার মুখ দেখতে ইচ্ছে জাগে,অঙ্গাত তরুনী বুঝতেই পারল না তার পিছনে শহুরে লোক হাটছে তাইতো নিজের মতো করে গান গায়,

“”যে মানুষ চেয়ে চেয়ে,ফিরিতেছি পাগল হয়ে,
যে মানুষ চেয়ে চেয়ে,ফিরিতেছি পাগল হয়ে।
মরমে জ্বলছে আগুন আর নিভেনা,

আমায় বলে বলুক লোকে মন্দ,বিরহে তার প্রান বাঁচেনা,দেখেছি! দেখেছি রুপ সাগরে মনের মানুষ কাঞ্চাসোনা।। “”
ধ্রুব মুগ্ধ হয়ে গানের গলা শুনল,এতো মিষ্টিও গান হয়!নিজেই মনে মনে কয়েকবার আওরাল ❝কাঞ্চাসোনা❞তখনি গান থেমে গেল,সাথে থেমে গেল ধীরগতিতে চলা বালিকার পা-যুগল।শান্ত চোখের ঘন পাপড়ি কেঁপে উঠে মেয়েটা ধ্রুবর দিকে ফিরে তাকাল। বেনীকন্যার শান্ত চোখ মূহুর্তের মাঝে অশান্ত হয়ে গেল,ধ্রুব আবারো মুগ্ধ হলো,বাড়িতে বউ দেখে মুগ্ধ হওয়ার কথা আর সে কিনা রাস্তায় বেনীকন্যা দেখে মুগ্ধ হচ্ছে!!আজব!

কাঞ্চাসোনা পর্ব ২