কাঞ্চাসোনা পর্ব ২

কাঞ্চাসোনা পর্ব ২
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

কাল রাত থেকে সকালের প্রচন্ড মাথা ব্যাথা।এই মাথা ব্যাথা নিয়ে বেশি রাত জেগে থাকা সম্ভব হলো না,রাত আটটা নাগাদ বিছানায় গা ছেড়েছিল।রাতে ঢাকার জেঠুরা আসার কথা ছিল,কিন্তু সকাল কিছুতেই বসে থাকতে পারছিল না।হঠাৎ করে সপরিবারে আসার কারনটা সকাল জানে,তাকে দেখতে আসছে।অজানা ভয়ে মন শরীর বিষিয়ে যাচ্ছে।

এই অল্প বয়সেই বিয়ের তোড়জোড় করার একমাত্র কারন হচ্ছে পাড়ার বখাটের দল সকালকে খুব জালায়,এক নেতা তো বিয়ে করতেই পাগল হয়ে গেছে,আর প্রেমের প্রস্তাব তো আছেই।সকাল অবশ্য এসব প্রেম পিরিতির ধারে কাছেও নেই,তার জগত জুড়ে পরিবার আর উপন্যাসের বই ছাড়া কিছুই নেই।ভোরে নামায পড়েই সকাল বেরিয়ে পড়েছে অবশ্যই মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে,মায়ের কঠিন আদেশ ছিল আজকে যেন ভালো মেয়ে হয়ে থাকা হয়,সকালে হাটতে মানাও করেছে কিন্তু ভোরের নির্মূল বাতাসে শ্বাস না নিলে আর আদুরে সাদা কুয়াশা গায়ে না মাখলে সকালের ভালই লাগে না।তার কাছে শীতকাল মানেই কুয়াশার চাদর গায়ে মেখে হাঁটা।তার সাথে আছে তার প্রিয় বিড়াল টুকি।টুকি যেন ভালো হয়ে হাটতেই পারে না তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়ে হাটবে,সকাল অবশ্য বেশ উপভোগ করে টুকির কাজকর্ম।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আলতো পায়ে হেটে সকালের প্রিয় গান গেয়ে উঠে,এই গানটা শুনলে বা নিজে গাইলে মন ভালো হয়ে যায়।ঠিক তখনি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কারনে নাকি কে জানে সকালের মনে হলো পেছনে কেউ আছে,পিছনে ফিরে তার চোখের মনি কিছুটা বড় হয়ে যায়।একটা জোয়ান ছেলে দাঁড়িয়ে আছে,না লোকটাকে মোটেই ছেলে ছেলে লাগছেনা বরং পুরুষ বলা যায়।একদৃষ্টিতে সকালের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।সকাল অপ্রস্তুত হয়,লোকটা একদম তার সামনে দাঁড়িয়ে,কিছু না বললে খারাপ দেখায়,অচেনা পুরুষকে কি বলা যায় সকাল ভেবে পায় না,সে খেয়াল করলো তার জিভ ভারী হয়ে গেছে,তারপরেও অনেক কসরত করে বলল,

“আপনি কে?”
ধ্রুব সেই আগের মতোই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে।মেয়েটাকে বিব্রত অবস্থায় দেখতেও তার ভালো লাগছে,টানা টানা চোখে ঘন পাপড়ি মাঝে মাঝেই ঝাপটায়,ধ্রুব অবাক হয়ে চোখগুলো দেখলো মনে হচ্ছে শিল্পীর হাতে আঁকা,মেয়েটা দেখতে ভারী মিষ্টি কিন্তু একটু খাটো,ধ্রুবর কাধে পড়বে,লম্বা চুলগুলো বেশ নজরকাড়া।ধ্রুবর প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কোন তাগিদ নেই।কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,

“আপনার চুলগুলোকে কি খাওয়ান?”
সকাল ভ্যাবাচেকা খেয়ে অচেনা আগুন্তুকের দিকে তাকিয়ে থাকল।তাদের দুজনের আজকেই প্রথম দেখা,প্রথম দেখায় কেউ কাউকে এমন প্রশ্ন করে বলে তার ধারনা ছিল না।ভালো করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখল,ছেলেটার মাঝে শহুরে একটা ভাব বিরাজমান।কোন ছেলের সাথে কথাবার্তা বলার অভ্যাস সকালের নেই।এমন অচেনা ছেলের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে কেউ দেখে নিলেই সর্বনাশ।গ্রামের মানুষজন তিলকে তাল বানাতে এক দন্ড দেরী করে না।তাই কিছু না বলেই সেখান থেকে দ্রুত পায়ে পালিয়ে গেল।

ধ্রুব কিছু বুঝল না,কি এমন বলল যে এভাবে পালিয়ে গেল,শহরের হলে মেয়েরা ধ্রুবর গায়ে পড়ে ভাব জমাতে আসে,আর এই মেয়ে কিনা পালিয়ে গেল?ধ্রুবর চোখে এখনো মেয়েটার রেশ লেগে আছে।কালো থ্রিপিস জরানো ফর্সা শরীর জ্বলজ্বল করছিল।কালো জরজেট ওরনা গলায় পেচিয়ে সামনে এনে রেখেছে,দীঘল কালো চুল বেনী করে পিঠে ঝুলিয়ে দিয়েছে।

বাবা মা কি এই বেনীকন্যাকে দেখেনি?এই মেয়েকেই পছন্দ করতো,তা না পছন্দ করেছে এক দেড় ব্যাটারি পিচ্ছিকে।ওই পিচ্ছি মেয়েটার হাসি মনে হলেই ধ্রুবর মন তেতু হয়ে যায়।ওই পিচ্ছির বদলে বেনিওয়ালীকে বউ করতে না পারার দুঃখে ধ্রুব মন খারাপ হয়।অবশ্য এই বেনীওয়ালীও ছোট কিন্তু ওই বোন টাইপ ফিলিংস আসে না এই আরকি।বেনীওয়ালী চলে যাবার পরে ধ্রুবর ভোরের কুয়াশা আর উপভোগ করা হলো না,মন খারাপ করে মাথায় কালো হুডি চাপিয়ে বাসায় ফিরল।সারারাত না ঘুমানোর জন্য হয়তো তার খুব ঘুম পেলে বিছানায় সুয়ে এক লম্বা ঘুম দিল।

সকাল বাড়িতে এসেই তার ছোটবোন জেরিনের সাথে দেখা হয়।জেরিন তাকে দেখে মুচকি হাসে।কিছু না বলে গর্দভের মতো হাসলে সকালের খুব রাগ হয়।জেরিনের মাথায় থাপ্পড় দিয়ে বলল,
“ছাগলের মতো হাসতেছিস কেন?”
আজকে সকালের বিয়ে এটা জেরিনের অজানা নয়,কিন্তু বেচারী সকাল জানে আজকে দেখতে এসেছে।সে আগের মতোই দাঁত কেলিয়ে বলল,

“আপা ছেলেটা পুরাই আগুন।কাল রাতে আমি দেখে তো চোখ জলসাই গেছে।”
সকাল জানে তার বোনটা একটু লাগামছাড়া মুখে যা আসে তাই বলে।মুচকি হেসে বলল,
“এক কাজ করি আব্বাকে বলি তোরে বিয়ে দিতে,যেহেতু চোখ জলসাই গেছে,মন জলসাতে কতক্ষণ!”
জেরিন সকালের কোলে শুয়ে বলল,
“সত্যি বলছি আপা তোমার পছন্দ হবে,তোমার উপন্যাসের নায়কের মতোই।”
সকাল জেরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“আচ্ছা।”
জেরিন মুচকি হেসে বলল,
“আপা শুধু মানুষটা দেখতেই উপন্যাসের নায়কের মতো না নামটাও এমন টাইপ।”
সকাল নামটা জানে অনেকের মুখেই ধ্রুব ধ্রুব বলতে শুনেছে।সকালের এখন ভিষন লজ্জা লাগছে।ধ্রুব ধ্রুব বলে কয়েকবার মিনমিন করল।ধ্রুব নামের মানুষটা তাদের বাড়িতে!এইতো আর দুই রুম পরেই অথচ লোকটাকে তার এখনো দেখাই হয়নি!

মিতু প্রথমে মেয়ে ছোট বলে কিছুটা অ-খুশি ছিল কিন্তু সকালকে দেখে তার দুইচোখ চিকচিক করে উঠে,কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে সকালের মিষ্টি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে,মেয়েটা এতো সুন্দর!বয়স মাত্র সতেরো তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না।মেয়ে যে একবার দেখবে তারই পছন্দ হয়ে যাবে,মেয়ে যেহেতু তার পছন্দ হয়েছে তাহলে তার ভাইয়ের অপছন্দ হবার কোন কারনই তিনি দেখেননা।মিতু তার মা মনোয়ারা কে বলেন,

“আম্মা ছেলে মেয়ের আলাদা কথা বলানোর ব্যাবস্থা করে দাও।”
মনোয়ারা বলেন,
“তোর ভাইকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর কি বলে।”
মিতু ধ্রুবকে জিজ্ঞেস করতে যায়,গিয়ে দেখে শাহেদের সাথে কথা বলছে মিতু যাওয়ার পরে বলে,
“ধ্রুব মেয়ে দেখবি না?চল চল”

ধ্রুব মুখ বেকিয়ে মিতুকে বিকৃতি করে মিতুর কথাই রিপিট করল।
মিতু আর শাহেদ ধ্রুবর কথা বলার ধরন দেখে হেসে কুটিকুটি।ধ্রুব এবার রেগে গেল,
“মিতু হাসবি না।”
মিতু দু’হাত কোমড়ে রেখে বলল,
“ধ্রুব আমাকে আপু বলবি আমি তোর পাঁচ মিনিটের বড়ো।চল ভাই মা তোর জন্য চাঁদের মতো মেয়ে ঠিক করেছে।দেখে বল পছন্দ হয় কিনা।”

ধ্রুব বিরস মুখে বলল,
“এখন দেখে অপছন্দ হলে নিশ্চয়ই বিয়ে ভেঙ্গে যাবে না?”
মিতু যেন খুব অবাক হলো এই ছেলে এখনো বিয়ে ভাঙ্গা নিয়েই পড়ে আছে,
“ওমা একি কথা বিয়ে ভাঙ্গবে কেন?”
ধ্রুব চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

“সেটাই তো!আমি দেখলেও যেই বিয়ে হবে না দেখলেও সেটাই হবে।”
মিতু ভাইয়ের অভিমান বুঝল।শান্ত স্বরে বল,
“তাও কাকে বিয়ে করছিস একনজর দেখে নে।”
ধ্রুব বালিশে শুয়ে মোবাইল হাতে নিল,ছোট করে উত্তর দিল,
“দেখেছি।বাকিটা বাসায় গিয়েই দেখব।”

মিতু অপ্রসন্ন মুখে মনোয়ারাকে জানায় ধ্রুব মেয়ে দেখতে চায় না।মনোয়ারা অবশ্য এই নিয়ে বেশি মাথা ঘামালেন না।সবার সাথে মিলে বিয়ের আয়োজনে হাত দিলেন।
বিয়ের ব্যাপারটা সকালকে জানালেন তার মা ফারজানা।ফারজানা শিক্ষিত মানুষ,মেয়েকে কায়দা করে বুঝিয়ে দিলেন কিসে মঙ্গল কিসে অমঙ্গল।

সকাল চুপচাপ মায়ের কথা মেনে নিল,গ্রামে প্রায় মেয়েদেরই ছোট বয়সেই বিয়ে হয় কিন্তু সকালের বাবা মা দুজনেই শিক্ষিত,সকালকে লেখাপড়া করাতে চেয়েছিল কিন্তু বখাটে নেতার দিক থেকে বিয়ের চাপ আসাতেই সকালকেও অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে।সকালকে বুঝিয়ে ফারজানা চলে যায় কিন্তু সকাল একটা ব্যাপার মাকে বলতে চাইছিল যে ছেলে দেখেনি এখনো,কিন্তু লজ্জায় সকাল মুখ খুলতে পারেনি।কিন্তু বিধাতা বোধহয় সকালের প্রতি সদয় ছিলেন,দুপুরের দিকে যখন সবাই খাবার খেয়ে যার যার মতো আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত তার কিছুক্ষণ পরেই জেরিন দৌড়ে সকালের কাছে আসে,জেরিন তার হাত ধরে টেনে জানালার কাছে নিয়ে যায়,উঠোনের দিকে হাত উচিয়ে বলল,

“আপা তোর উপন্যাসের ধ্রুব!”
সকাল বড়ো বড়ো চোখ মেলে দেখল।তারপর চুপচাপ বিছানায় গিয়ে বসে পড়ল।জেরিন যেভাবে ছুটে এসেছিল সেভাবেই চলে গেল।সকাল আবার গিয়ে জানালার পাশ দিয়ে দেখল,হ্যাঁ আজকে সকালের লোকটাই,যে কিনা আজব প্রশ্ন করেছিল।সকাল জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজায় অজানা আতংকে তার গলা শুকিয়ে যায়,বুক ধরফর করে জানান দেয় সকাল খুব লজ্জা পাচ্ছে,তাইতো এতো এতো লোকের মাঝেই সকাল লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে পরে এমন লজ্জা সকাল তার সতেরো বছরের জীবনে আর কখনো পায় নি হয়তো ধ্রুব নামের কাউকে দেখেনি তাই!

ধ্রুব যারপরনাই বিরক্ত।দলে দলে বাচ্চা,যুবতী,মহিলা,পুরুষ সবাই ধ্রুবকে দেখতে আসছে।ধ্রুবর নিজেকে আজব চিড়িয়া মনে হচ্ছে তাই সবার থেকে আলাদা উঠোনের দক্ষিন পাশে খেজুর গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়।তখনি পিচ্ছি মেয়েটা মুচকি হেসে কাছে এসে দাঁড়ায়।ধ্রুবর মেজাজ যতোটুকু ভাল ছিল তার পুরোটাই খারাপ হয়ে গেল এই মেয়েকে দেখে।মেয়েটাই প্রথমে বলল,

“আমাদের গ্রাম ভালো লেগেছে।”
ধ্রুব বিরক্তিতে চোখ খিচে বন্ধ করে আবার খুলল।উত্তর না দিলে অভদ্রতা হবে।মনোয়ারা শুনলে আবার কেঁদেকেটে দুনিয়া এক করে ফেলবেন,তাই অনিচ্ছা সত্বেও ছোট করে বলল,
“ভালো লেগেছে।”
মেয়েটা দুলে দুলে বলল,
“আপনাকেও আমার খুব ভালো লেগেছে।”

ধ্রুব কারেন্টে শক খাওয়ার মতো মেয়েটার দিকে তাকায় মেয়েটা ততক্ষণে উধাও।ধ্রুব বাম হাতে চুল টেনে ভাবল,বাবা মা কি এক বাউন্ডুলে মেয়ে কপালে জুটিয়ে দিল,কই গ্রামের মেয়ে লজ্জায় পড়িমরি করে লুকিয়ে থাকবে তা না এসে সরাসরি বলে যাচ্ছে ভালো লাগার কথা।ধ্রুব পরের সারাটা সময় রুমে থাকল।সন্ধ্যায় বিয়ে পড়াবে বলে ঠিক হলো,যেহেতু কাল সবার অফিস খোলা তাই রাতের মধ্যেই ঢাকা ফিরতে হবে।

ধ্রুব অবশ্য এসবে মন নেই,মুখ অন্ধকার করে কাজীর সামনে বসল,তার এখন মনে হচ্ছে আসামীকে ফাসি দেয়ার আগে যে তওবা পড়ানো হয় তাকেও এমন কিছু করা হচ্ছে।ভাবা যায় ধ্রুবর মতো ছেলেকে এমন মেয়ে বিয়ে করানো হচ্ছে,ধ্রুব পাশে বসা তরুনীর দিকে তাকায় এমন লম্বা গোমটা দিয়ে বসে আছে যে চেহারা দেখার উপায় নেই।আশ্চর্য মেয়েটাকে দেখে তার বিতৃষ্ণা জাগছে তাহলে সারাজীবন কাটাবে কি করে!

কাজী বিয়ে পড়িয়ে মোনাজাত ধরেন।সবশেষে মিতু বলেন ধ্রুব বিয়ে হলো চল ছবি তুলি,ধ্রুবর মনে বিষাদে ভরা,এসব ছবি টবি তুলতে মন চাইছে না।কাটাকাটা গলায় না বলতে গিয়েও বলল না পাশেই সবাই বসে আছে তাই মুখ অন্ধকার রেখেই এক ফ্রেমে বন্দি হলো।

কাঞ্চাসোনা পর্ব ১

ধ্রুব একবারও মেয়েটাকে বধূ সাজে দেখল না দেখার ইচ্ছাও জাগল না।ধ্রুবর মনে তখন ঘুরছে আচ্ছা বেনিওয়ালী পাশে থাকলে কেমন হতো!টানা চোখে কাজল পড়লে কি মিষ্টি বউ লাগতো না?ঘন পাপড়ি ঝাপটে তাকালে কি ভিষণ আদুরে লাগতো না!!

কাঞ্চাসোনা পর্ব ৩