কাঞ্চাসোনা পর্ব ৩

কাঞ্চাসোনা পর্ব ৩
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

নতুন বউ নিয়ে তো আর বাসে করে যাওয়া যায় না।আসাদ মির্জা একটা প্রাইভেট কার ভাড়া করেন।রাত নয়টা’য় সবাই রওনা হয়।সকাল খুব কেঁদেছে।এতো প্রিয়জন,প্রিয় পরিবেশ এসব ছেড়ে কিভাবে থাকবে?কিন্তু গলা ছেড়ে কেঁদেও কোন লাভ নেই তাকে যেতেই হবে,এটাই নিয়ম।মেয়েরা চিরকাল বাবার বাড়ি থাকতে পারে না।মনোয়ারা খুব ভালো মনের মানুষ।আজকাল শাশুড়ী ভালো না হলে সংসার টিকানো খুবই মুশকিল সেই দিক দিয়ে ফারজানা নিশ্চিন্তে আছেন,মনোয়ারা ভাবিকে চিনেন অনেক বছর,আর ধ্রুব খুব ভালো ছেলে মাশায়াল্লাহ।মেয়েকে ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে পেরে মুখে সুখের ঝিলিক ছুটে।

গাড়ি চলছে সমানতালে।ধ্রুব ড্রাইভারের সাথে বসেছে,মিতু অবশ্য বারবার বলছিল সকালের সাথে বসার জন্য কিন্তু ধ্রুব ঘাড় বাকিয়ে না করেছে,এই মেয়ের কথা ভাবলেই ধ্রুবর কান্না করতে ইচ্ছে করে নেহাৎ ছেলে বলেই কাঁদতে পারছে না,ভবিষ্যতে কি হবে এটা ভেবেই ধ্রুবর মাথা টনটন করে উঠে।ধ্রুব ফেসবুকিং করে সময় কাটায়,সে যে বিয়ে করেছে তার কোন ফিলিংস হচ্ছে না,হবে কিভাবে ছোট বোন টাইপ কাউকে কি বউ মনে করা যায়?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রায় দুই আড়াইঘন্টা পরে সকাল মিতুকে কিছু বলে।মিতু সাথে সাথেই ড্রাইভারকে বলে,
“ভাই তাড়াতাড়ি গাড়ি থামান।”
ধ্রুব বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে বলল,
“মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামাবে কেন?”

মিতু তার ভাইয়ের কর্মকান্ডে খুবই বিরক্ত।চোখ পাকিয়ে জবাব দিল,
“তোর বউয়ের জন্য বলেছি।তুই তো খেয়াল রাখবি না আমি না রাখলে বেচারির কি হবে?”
ধ্রুব কিছু না বলে,আবার মোবাইলে সমস্ত মনোযোগ ঢেলে দেয়।এই মেয়ের খেয়াল সে রাখবে!বাচ্চা পোলাপান বিয়ে করার শাস্তি এটাই।যত্তসব।

সকালের মাথা ঘুরে বমি আসে।সেই দুপুরে মায়ের হাতে কয়েক লোকমা ভাত খেয়েছিল,আর কিছুই খাওয়া হয়নি।তার জার্নি করে অভ্যাস নেই,তাই হঠাৎ করে জার্নি করাতে শরীর ঘুলিয়ে বমি আসছে।গাড়ি থামার সাথে সাথেই সকাল গাড়ি থেকে নেমে হুড়মুড় করে বমি করে দেয়।মিতু আর মনোয়ারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে।সকালের হিজাব খুলে মাথায় পানি দিতে চাইলে সকাল হিজাব খুলতে চায় না।পানি খেয়ে আবার সিটে মাথা হেলিয়ে দেয়,পরিবার ছেড়ে আসায় মন বিধস্ত এখন বমি করে শরীর বিধস্ত হলো।শাহেদ তেতুলের আচার এনে সকালকে দেয়,সকাল মুখে দেয়ার পরে মনে হলো আচারটা খুব তিতকুটে।

ধ্রুব বিরক্তিতে কপাল কুচকে ফেলে,বমি টমি ধ্রুবর চিরশত্রু।আর এমন অপছন্দের কাজ কিনা তার নিজের বউ’ই করছে ধ্রুবর ইচ্ছা করছে পিচ্ছি মেয়েকে গাড়ি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে।ভেবেছিল বিয়ের পরে বন্ধুদের মতো বউ নিয়ে লম্বা লম্বা ট্যুর দেবে,কিন্তু এই পিচ্ছি সব পরিকল্পনা পানি দিয়ে ধুয়ে দিলো।বন্ধুরা শুনলে হেসে গড়াগড়ি খাবে,এই দুঃখে তার বনবাসে চলে যেতে মন চাইছে।

আধা’ঘণ্টা পরে সকাল তার স্বরে আবার চেঁচিয়ে উঠে,
“আপু গাড়ি থামান।”
গাড়ি থামালে সকাল আবার বমি করে।এইবার একেবারে কাহিল অবস্থা,পেটে কিছু না থাকায় আরো বেশি কষ্ট হচ্ছে।মিতু এবার জোড় করে সকালের হিজাবটা খুলে দিলো।হিজাব ওরনার মতো গলায় পেঁচিয়ে দিল,মনোয়ারা সকালের মাথায় পানি দিয়ে বলল,”আম্মু কিছু খাবে?বল এনে দেই।”
সকাল মাথা নেড়ে না বলে।

ধ্রুব বিরক্তি চোখে পিছনে তাকায় তখনি একটা বড় ট্রাক যায় রাস্তা দিয়ে সেই ট্রাকের আলোয় ধ্রুব যা দেখলো তার মনে হলো এটা সপ্ন।কালো বোরকা পরিহিত মেয়েটা।সকালের মতোই ওরনা গলায় পেচানো,ধ্রুবর বুকের চলন বুঝি বন্ধ হবার যোগার।এই বেনীকন্যা তার বউ!ধ্রুব চোখ বড়ো করে ভালো করে তাকায়।তার বুক ধরফর করে,অজানা শিহরণ সারা শরীরে বিদুৎের মতো ঝলকে যায়,তার এখনো মনে হচ্ছে এটা মনের ভুল।সারা রাস্তা এই মেয়েটাই মাথায় ঘুরছিল তাই কি এমন হচ্ছে?আস্তে করে গাড়ি থেকে নেমে মিতুর কাছে গিয়ে হাত টেনে দূরে নিয়ে যায় ফিসফিস করে বলে,

“এটাই কি আমার বউ মিতু?”
এমনিতেই মেয়েটার শরীরের খুব খারাপ অবস্থা তার উপর বলদ এসে এমন প্রশ্ন করায় মিতুর রাগ চরচরিয়ে মাথায় উঠে যায়,দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“তুই আসলেই একটা ছাগল।বিয়ে করে বউ নিয়ে বাসায় যাইতেছে রাস্তায় প্রশ্ন করে এটা তার বউ কিনা!”
ধ্রুব কিছুটা দমে যায়।মিনমিন করে বলে,

“চেতোস কেন?”
মিতু মুখ ঝামটা মেরে বলল,
“তো কি করবো,সকাল বমি করতে করতে অবস্থা খারাপ,জামাই হিসাবে একবার এসে জিজ্ঞেস করতি কিছু লাগবে কিনা!!”
ধ্রুব মিতুর কথায় বুঝল এই ডাগর চোখের মালকিন’ই তার বউ,পিঠ বেয়ে ঠান্ডা অনুভূতি ঝনঝনিয়ে নেমে যায়।স্বাভাবিকভাবে মুখ টিপে বলল,

“আচ্ছা এখন জিজ্ঞেস করি?”
মিতু ধমকে বলল,
“যা সর।এতোক্ষণ যেমন মোবাইল দেখছিস এখনো গিয়ে দেখ যা।”
মিতু আবার সকালের কাছে এসে দাঁড়ায়।ধ্রুবও আসে কিন্তু আগের মতো গাড়িতে গিয়ে বসে না,সকালের একপাশে গিয়ে দাঁড়ায়।কি বলবে ভেবে পায় না,ধ্রুব কিছু বলার সিন্ধান্ত নেয়ার আগেই মনোয়ারা গাড়িতে উঠে তাড়া দেয় সবাই গাড়িতে উঠার জন্য মিতু সকালকে বসিয়ে নিজে বসতে গেলে ধ্রুব অসস্থিতে কাঁটাকাঁটা গলায় আস্তে করে বলে,

“মিতু আমাকে আমার বউয়ের সাথে বসতে দে।”
মিতু অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
“কার বউ?”
বাবা মা যেন শুনতে না পায় ধ্রুব এমন আস্তে করে বলল,
“আমার।”
মিতু প্রথম কতো সাধাসাধি করলো দুজনে একসাথে বসার জন্য তখন বসলো না এখন বসতে আসছে।মিতু কিছু না বলে বসে পড়ল।

ধ্রুব মিতুর হাত চেপে ধরে বলল,
“কথা বুঝিস না কেন?আমার বউ অসুস্থ।”
মিতু তার স্বরে কড়কড় কন্ঠে বলল,
“এহ্ আসছে জামাইগিরি দেখাতে।এতোক্ষণ কই ছিলি?যা ভাগ।”

মিতু কথাটা এতো জোড়ে বলেছে যে ধ্রুবর মা বাবাও শুনতে পেয়েছে।ধ্রুব অসস্থিতে মাথা চুলকে আগের সিটে গিয়ে বসে পড়ল।মিতুটা সবসময় তার সাথে এমন করে,আচ্ছা সব সময়ের কথা বাদ আজকে আপাতত তার বেনী-বউয়ের কাছে বসতে দিতো!তারপরও বেনীকন্যা পাওয়ার খুশীতে ধ্রুবর বুকে সাদা শাপলা চিরচিরিয়ে ফুটে,পানিতে নাড়া পড়লে যেমন শাপলা হেলেদুলে উঠে,তার হৃদপিণ্ডর অবস্থাও এক,বার বার হেলেদুলে,ফুলেফেঁপে,কেঁপে-কেঁপে উঠছে।

বারবার মাথা বাকিয়ে সকালকে দেখল,সকাল হিজাব মাথায় ওরনার মতো দিয়েছে,ধ্রুব বারবার তাকানো কারনে একবার দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়।সকাল অবশ্য মাথা নিচু করে ফেলেছে ধ্রুব মিটিমিটি হেসে ভাবল,এমন আদুরে বউকে কিনা সে কিছুক্ষণ আগে গাড়ি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিল! ধ্রুবর মনে হলো এটা স্বপ্ন তাইতো সারা রাস্তা আর অন্যদিকে মনোযোগ দিল না,একটু পরপর সকালকে দেখলো।খুশীতে তার হাত পা শিরশির করছে,চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে,❝আম্মা আমি জিতছি❞

সকাল ধ্রুবর কাজে খুবই লজ্জা পাচ্ছে।তখন কেমন মিতুর সাথে বউ বউ করছিল,একসাথে বসার জন্য বাচ্চাদের মতো জেদ করছিল,অথচ এর আগে ফিরেও তাকায়নি,হঠাৎ এই পরিবর্তন সকালের চোখে লাগছে।বারবার পেছন ফিরে তাকানো,ওই জ্বলজ্বলে দৃষ্টি সকালের সারা শরীরে বিষ কাটার মতো বিধে যাচ্ছে।লোকটা এতোবার তাকাচ্ছে কেন?গাড়িতে সবাই কি মনে করবে এটা ভেবে সকাল নিজেই লজ্জায় কাবু হয়ে বসে রইল।
তখনি ধ্রুব তার গমগমে গলা বেশ মোলায়েম করে সরাসরি সকালকে উদেশ্য করে বলল,

“আপনার কিছু লাগবে?কিছু খাবেন?”
সকাল লজ্জায় কুঁকড়ে গেল।মাথা নাড়িয়ে জানাল তার কিছু চাই না।ধ্রুব অবশ্য সকালের সাথে একটু কথা বলতে চেয়েছিল তারপর পিচঢালা রাস্তার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,আল্লাহ এই বেনীওয়ালীকে আমার করে দেয়ার জন্য শুকরিয়া।আরো ভাবল বাসায় গিয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়বে।

কাঞ্চাসোনা পর্ব ২

সকালের লজ্জা মাখা মুখ দেখার লোভে ধ্রুব আবার ঘাড় কাত করে পিছনের দিকে তাকায়,মনোয়ারা আর আসাদ মির্জা দুজনেই ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আছে,ধ্রুব সাথে সাথেই সোজা হয়ে বসে।ধ্রুব খুব লজ্জা পেল,লজ্জা আর শান্তি মিশ্রিত করে আবেশে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুঝল,বিরবির করে বলল,”বেনীওয়ালী……আমার বউ!”

কাঞ্চাসোনা পর্ব ৪