কাঞ্চাসোনা পর্ব ৫

কাঞ্চাসোনা পর্ব ৫
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

ধ্রুব সারাদিন ছটফট করে কাটায়।বাড়িতে কখন আসবে বারবার ঘড়ি দেখছে,সকালকে যে ফোন দিবে সেই রাস্তাও নেই,সকালের ফোন নেই।কিভাবে কথা বলা যায়,ধ্রুব অসস্থিতে ডুবে গিয়ে মায়ের নাম্বারে ডায়াল করে,মনোয়ারা ফোন ধরে,বলে, “হ্যালো..”

ধ্রুব থমথম খেয়ে যায় কি বলবে?তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“আম্মা দুপুরে ভাত খেয়েছো?”
মনোয়ারা ধ্রুবর কথা শুনে মুচকি হাসে,যে ছেলে কখনো ফোন দেয় না সে আজকে ফোন দিল!তিনি সাহিত্য পড়ুয়া মানুষ এসব ঘুরানি-ফিরানি কথা ভালোই বুঝে,গলা খাকারি দিয়ে বলল,
“আব্বা আমি ভাত খেয়েছি আর সকাল’ও ভাত খেয়েছে,সকাল ভালো আছে,আমার সাথে বসে গল্প করছে।তুই টেনশন করিস না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ধ্রুব চোখ খিচে বন্ধ করে সাথে সাথেই ফট করে মোবাইল কেটে দেয়,তার আম্মাটা এই রকম কেন?কিভাবে বুঝে গেল ধ্রুব সকালের খোঁজ নিতেই ফোন দিয়েছে?অবশেষে অফিস টাইম শেষ হলো,ধ্রুব বাসায় ফিরার আগে এক কাজ করে বসলো,সকালের সুবিধার জন্য একটা হেয়ার ড্রায়ার কিনে নিলো,প্রতিদিন তো আর টেবিল ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না,গ্রামে না হয় খোলা বাতাসে চুল শুকিয়েছে,শহরে এমন বাতাস পাবে কই?

ধ্রুব সিড়ি বেয়ে উঠছিল আর বুকটা অজানা খুশীতে নাচানাচি করছিল,এই আটাশ বছরের জীবনে তার মনে এমন খুশী আর কখনো লাগে নি।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একটু পরিপাটি করে নিল।কলিংবেল দিলে মনোয়ারা দরজা খুলে,ধ্রুব সালাম দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।মনোয়ারা হাতের প্যাকেট দেখিয়ে বলে,

“এটা কিসের প্যাকেট?”
ধ্রুবর বলতে লজ্জা লাগছে,সে তার বউয়ের জন্য হেয়ার ড্রায়ার এনেছে।আমতা আমতা করে বলল,
“ওই আরকি আম্মা সকালের জন্য ‘ই’ আনছিলাম।”
মনোয়ারা তো আর মূর্খ না প্যাকেটের লেখা দেখেই বুঝতে পেরেছে।তারপরেও ধ্রুব বিয়ে করবেনা করবেনা করে অনেক জ্বালিয়েছে,এখন বউয়ের এতো খাতির একটু লজ্জা দিতে বলল,

“‘ই’ কি?নাম নেই নাকি?”
ধ্রুব মায়ের হাবভাব বুঝতে পেরে হেসে দেয়।
“আম্মা হেয়ার ড্রায়ার।যেই বউমা আনছো!হেয়ার ড্রায়ার ছাড়া হবে!”
মনোয়ারা ভ্রুকুচকে বলল,
“কেন বউ তোর পছন্দ হয় নাই?”

ধ্রুব কিছু বলল না,শুধু মুচকি হেসে দরজা ঢেলে রুমে চলে গেল।
মনোয়ারা পিছন থেকে হাসে,ছেলে মাশাল্লাহ টোপ গিলে ফেলেছে এখন শুধু টেনে উপরে তোলা বাকি।
সকাল ডাইনিং টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে সবই শুনছিল।লজ্জায় মন চাইছিলো টেবিলের নিচে ঢুকে যেতে।লোকটা কি তার বোন জেরিনের মতই লাগামছাড়া?অবশ্য এই ফ্যামিলির সবাই খুব ফ্রি মাইন্ডের।মনোয়ারা এসে বললেন,

“আম্মু সাহেব তো এসেছে,ফ্রিজে লেবুর শরবত করে রেখেছি,যাও দিয়ে আসো।”
সকাল মাথা নেড়ে শরবত নিয়ে রুমে যায়।রুমে ধ্রুব নেই ওয়াশরুম থেকে পানি পরার শব্দ হচ্ছে।সকাল আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে,ধ্রুব মিনিট দুয়েক পরে বের হয়।কালো ট্রাউজার পরে খালি গায়ে তোয়ালে দেয়া।সকাল মাথা নিচু করে বলে,

“মা লেবুর শরবত দিয়েছে।”
ধ্রুব তোয়ালে দিয়ে মাথা ঝাকিয়ে মুছে।সকালের দিকে তাকায়,সমস্যা কি মেয়েটার সবসময় এভাবে মাথা নামিয়ে রাখে কেন?আশ্চর্য এতো লজ্জা কেন পেতে হবে!ধ্রুব আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বডি স্প্রে করে আর ভাবে লজ্জার কিছু করলাম’ই না আর এখনি লজ্জায় খানখান!
সকাল আবার বললো,

“শরবত’টা।”
ধ্রুব ওয়্যারড্রোব থেকে গেঞ্জি বের করে পড়ে বললো,
“মিষ্টি ঠিকঠাক হয়েছে?আমি আবার মিষ্টি ছাড়া খাই না।”
সকাল ধ্রুবর সব কথাই বিব্রত হয়।উনার সব কথায়ই যেন লজ্জামাখা।দু’দিকে মাথা নেড়ে বললো,
“আমি জানি না।”

ধ্রুব সামনে এগিয়ে এসে বললো,
“না জানলে জেনে জানান।”
সকাল চকিত নয়নে ধ্রুব কে দেখে।ধ্রুব তাড়া দিয়ে বলে,
“খেয়ে দেখুন।”
সকাল কাচুমাচু করে একটু খায়,তারপর মাথা নেড়ে বলে,
“মিষ্টি ঠিক আছে।”

ধ্রুব সকালের হাত থেকে গ্লাস নিয়ে ভাবে,এখন এমনিতেই অতিরিক্ত মিষ্টি লাগবে।শরবত খাওয়ার পরে সকাল গ্লাস নিয়ে চলে যায়।ধ্রুব আবেশ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে,তার মনে খুশীতে গোলাপ,জবা ফুটে।মিতু চলে গেছে আজকে পাখি যাবে কোথায়?ধ্রুবর কাছে আসতেই হবে।ইশ বাচ্চা বউটা কি আদর আদর লাগে,অথচ আদর করার ভাগ্য এখনো হলো না।

রাত সাড়ে এগারোটায় ধ্রুব খাবার খেয়ে রুমে যায়,অপেক্ষা করে বেনীওয়ালীর।এতোক্ষণ লাগে পাশের রুম থেকে আসতে,মন চাইছে লম্বা বেনী ধরে টেনে নিয়ে আসতে।এদিকে সকাল আস্তে করে দরজা ঠেলে রুমে আসে,তার শাশুড়ি তাকে যত্ন করে একটা লাল জামদানি শাড়ী পড়িয়ে দিয়েছে,উনি যখন একটু সাজুগুজু করতে বলছিলেন সকালের খুব লজ্জা লাগছিল।

আজকে তাদের বাসর রাত।সকালের হাত পা কাঁপে।ধ্রুব সকালের দিকে তাকিয়ে ভাবে,তার জন্য বউ সাজুগুজু করে এসেছে এজন্য দেরী হয়েছে আর সে কিনা বেনি টেনী টানার সিধান্ত নিয়ে ফেলেছিলো।ধ্রুব পূর্ণদৃষ্টি দিয়ে সকালকে দেখে,খুব সুন্দর লাগছে।আর খেয়াল করলো সকাল কাঁপছে।ধ্রব মুচকি হেসে মাথার চুলে হাত বুলায়।আর এই প্রথম সকালকে সুন্দর করে জিজ্ঞেস করে,

“কেমন আছেন সকাল?”
সকালের ভয়ে কান্না করতে মন চাইছে।তারপরেও মিনমিন করে বলল,”ভালো।”
ধ্রুব বিছানায় বসে সকাল কে বসার জন্য ইশারা করলে সকাল আড়ষ্ট হয়ে বসে।
ধ্রুব স্বাভাবিক গলায় বলে,

“আপনার বয়স কতো?”
“জ্বী,সতেরো।”
ধ্রুব ঠোঁট কামড়ে হেসে বললো, “আমার বয়স কতো জানেন?”
সকাল মাথা নেড়ে না জানায়।
ধ্রুব নিজেই বলে,

“আটাশ বছর।আপনার থেকে এগারো বছরের বড়ো।”
সকাল মাথা কাত করে বললো, “আচ্ছা।”
ধ্রুব গালে হাত ঠেকিয়ে হাতের কনুই পায়ের উপর রেখে বলল,
“তাহলে আপনাকে আমি তুমি করে বলতেই পারি।তাই না?”
সকাল মাথা ঝাকায়।ধ্রুব বলে,

“চাইলে তুমিও আমাকে তুমি করেই বলতে পারো।আপনি থেকে এটাই বেশী সুইটেবল।”
সকাল আৎকে উঠে বলল,
“না না আমি আপনিই বলব।”
“আচ্ছা।”

তারপর দুজনেই চুপচাপ কেউ কোন কথা বলছেনা।ধ্রুবই আবার বললো, “কালকে এভাবে চলে গেলে কেন?”
সকাল মাথা নেড়ে বলল,
“এমনিই।”
ধ্রুব ফিসফিস করে বলল,
“আজকে যাবে না?”

সকাল বুঝল লোকটা তাকে লজ্জা দেয়ার জন্যই এসব বলছে।সে চুপ করে রইলো,ধ্রুব সকালের একটা হাত টেনে তার বলিষ্ঠ হাতের মুঠোয় পুড়ে নিলো।সকালের কাঁপা-কাঁপি বেড়ে দ্বিগুন হলো,বুকের খাচার দুষ্টু পাখি এমন ভাবে লাফাচ্ছে যেন বেরিয়েই যাবে।সকালের ঠোঁট ভয়ে শুকিয়ে যায়,মনে পড়ে যায় তার বান্ধবি সুইটির কথা এইতো কয়েকমাস আগেই বিয়ে হয়েছিল,বাসর রাতে কি জানি হয়েছিল এর পরে সুইটিকে সাত দিন হসপিটালে ভর্তি হয়ে থাকতে হয়েছিলো।আচ্ছা ধ্রুবও কি এমনি করবে?ভয়ে সকালের শরীর অস্বাভাবিকভাবে কাঁপে,ধ্রুব অবাক হয়ে বলে,”কি হয়েছে সকাল?”

সকাল কিছু বলায় আগেই ধুপ করে বিছানায় পড়ে যায়।ধ্রুব অবাক হয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে রইলো,তারপর সকালের মাথার নিচে বালিশ দিয়ে গালে হালকা থাপ্পড় দিয়ে বলল,”সকাল কি হলো?এই কথা বলো।”
কিন্তু সকাল কোন কথাই বললোনা।ধ্রুব বুঝলো সকাল জ্ঞান হারিয়েছে।কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো,মানে জ্ঞান হারানোর মতো কিছুই হয়নি।কি করবে এখন?

কাঞ্চাসোনা পর্ব ৪

আম্মাকেও ডাকা যাবে না এতো রাতে অজ্ঞান হবার ব্যাপারটা কিভাবে বলবে?ধ্রুব বাথরুম থেকে পানি এনে সকালের মুখে ছিটিয়ে দেয়।সকালের চোখ হালকা পিটপিট করে।ধ্রুব গালে হাত দিয়ে ভাবে,এই খবরটা যদি কোন সাংবাদিক পেতো তাহলে পেপারের এভাবে ছাপাতো যে,”আটাশ বছরের পুরুষের সাথে সতেরো বছরের বালিকার বিয়ে অতঃপর বাসর ঘরে বালিকা অজ্ঞান।”ধ্রুব নিজেও বালিশে শুয়ে বিরবির করে বললো “এই ছিল তার বাসরঘর এটা বাসর ঘর না হয়ে অজ্ঞানঘর হতো।”

কাঞ্চাসোনা পর্ব ৬