কাঞ্চাসোনা পর্ব ৯

কাঞ্চাসোনা পর্ব ৯
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

সকালের জন্ম হয়েছিলো কুয়াশা পড়া সকালে।চারদিকে কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে ছিলো।পাখির কিচিরমিচির,কুয়াশায় ডাকা সকাল সব মিলিয়ে খুব স্নিগ্ধ লাগছিলো।তখনি বাচ্চাটা তার স্বরে কেঁদে জানান দেয় সে এসে গেছে এই মায়ার পৃথিবীতে।তারেক আশ্চর্য হয়ে বাচ্চাটাকে দেখলো,কি সুন্দর স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে আছে সারা মুখে।এই মিষ্টি শীতের সকালে মিষ্টি বাচ্চাটার আগমনে তার মন পুলকিত হয়।শীতের সকালের সাথে মিলিয়ে বাচ্চাটার নাম রেখে দিলো সকাল।সকালের মুখেও সব সময় এক আকাশ স্নিগ্ধতা বিরাজ করে,কিন্তু আজকে তার মন একটুও ভালো নেই।আকাশে আজ স্নিগ্ধতার বদলে মেঘ জমেছে।দুঃখী মুখে দাঁড়িয়ে আছে ধ্রুবর কিছুটা দূরে।

সকালের দিকে ধ্রুবর জ্বর কিছুটা কমে আসে কিন্তু সারা শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা।অফিসে ফোন করে ছুটির কথা বললে,স্যার জানায় কোন ছুটি পাওয়া যাবে না তাই ধ্রুব চুপচাপ রেডি হয়ে নেয়।পরের চাকরি করে,কিছুই করার নেই।সকাল পাশেই মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে।ধ্রুব হাত ধরে কাছে টেনে নেয়।একহাতে গালে ধরে বলে,
“তুমি এভাবে মন খারাপ করে আছো কেন?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ধ্রুবর শরীরটা আসলেই খুব খারাপ।সমসময় হাসিখুশি থাকা মুখটা আজকে ফ্যাকাসে লাগছে।তারপরেও অফিস যেতে হবে ভেবেই সকালের কান্না পাচ্ছে।এই কয়দিনেই ধ্রুব সকালের ছোট মনে বাড়ি বানানোর আয়োজন শুরু করে দিয়েছে,অলরেডি ইট সিমেন্ট আনা হয়ে গেছে এখন শুধু ফাউন্ডেশন গড়ার অপেক্ষা।জ্বর আছে কিনা দেখার জন্য সকাল উঁচু লম্বা ধ্রুবর কপালে হাত ছোঁয়ায়।এখনো হালকা জ্বর বিদ্যমান।সকাল আদেশের সুরে বললো,

“আজকে অফিসে যেতে হবে না।”
ধ্রুব সকালের লম্বা বেনী হাতে পেঁচিয়ে নেয়।
“ম্যাডাম অফিসে না গেলে চাকরি যে চলে যাবে।”
সকাল ধ্রুবর গভীর চোখে তাকায়।কেমন লাল হয়ে আছে।শরীরের থেকে চাকরি বেশী বড়ো!সকালের অভিমান হয়,

“চলে যাক।”
ধ্রুব হাসে,
“চাকরি চলে গেলে বউকে খাওয়াবো কি?”
সকাল ছোট বাচ্চার মতো বললো,
“খেতে হবে না।”

ধ্রুব চুপচাপ তার বউয়ের ছেলেমানুষী দেখে।তারপর গাল টেনে বলে,
“তাড়াতাড়ি চলে আসবো সোনা।তুমি মায়ের সাথে গল্প করো,বই পড়ো সময় কেটে যাবে।”
তারপর খুব নরমভাবে কপালে একটা চুমু দিয়ে বেড়িয়ে যায়।সকাল কপালে হাত দিয়ে চোখে হাসে।লোকটা এতো ভালো কেন?সকালকে যেন সবকিছু হাত ধরে শিখিয়ে যাচ্ছে।
অফিস থেকে এসে ধ্রুব বিছানায় বসে আছে।সকাল আসলে কাছে ডাকে।তারপর একটা শপিং ব্যাগ সকালের হাতে দিয়ে বলে,

“এটা তোমার।”
সকাল ব্যাগ থেকে মোবাইল সেট বের করে।মোবাইল দেখে সে খুবই খুশী হয়।ধ্রুব সকালের হাত টেনে কাছে বসায়।চোখে চোখ রেখে বলে,
“এখন থেকে যখন মন চাইবে,এটা দিয়ে আমাকে ফোন দিবে।”
সকাল খুশী মনে বললো,
“আচ্ছা।”

“কি করলে সারাদিন।”
সকাল মাথা নেড়ে বললো,
“মায়ের সাথে একটু কাজ করেছি আর উপন্যাসের বই পড়েছি।”
ধ্রুব হাতে হাত রেখে বললো,

“সকাল আমি আমার মা-বাবার একমাত্র ছেলে,তো উনারা তোমার থেকে একটু আদর যত্ন আশা করবেই।মুখে না বললেও তুমি করবে।আম্মা তো তোমাকে রান্না বা কঠিন কোন কাজ করতে দিতে চাইবে না,আর ধুয়া-মুছা সব তো ছুটা বুয়াই করে।তুমি কি করবে,তুমি এই কাজগুলো করতে পারো সকালে আব্বা-আম্মাকে চা বানিয়ে দিলে,খাবার বেড়ে দিলে।আম্মা যখন রান্না করে তখন আম্মার কাছে থাকবে,

মাঝে মাঝে নিজেই জোড় করে রান্না করতে চাইবে,বলবে মা আপনি বসে বসে আমাকে দেখিয়ে দিন আমি করে দেই।আব্বা আম্মার রুম গুছিয়ে দিলে,আম্মার প্রেসার বাড়ে কিনা খেয়াল করে তেতুলের শরবত বানিয়ে খেতে দিলে।এখন শীতকাল একটু গরম পানি করে উনাদের অজু করতে দিতে পারো।আব্বা প্রতিদিন রাতে আধা চা খায় উনার চা বানিয়ে দিলে উনি খুব খুশী হবে।আব্বা আম্মার সাথে গল্প করবে মানুষের বয়স হলে একটা গল্প করার মানুষ খুঁজে।বুঝেছো।”

সকাল মাথা নাড়ে।ধ্রুব আবার বলে,
“সকাল আমার খেয়াল যত্ন কর আর না করো আম্মা আব্বার দিকে খেয়াল রাখবে।তুমি তো জানই উনারা কেমন।তোমাকে কতো শখ করে এনেছে,তুমি প্লিজ তাদের একটু ভালোবেসো।”

ধ্রুব খুব সুন্দর করে সকালকে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছে।সকাল এগুলো মনোযোগের সহিত মাথায় গেথে নেয়।
ধ্রুব সকালের গালে লেপ্টে থাকা চুল কানের পিছনে গুছিয়ে দেয়।আদর করে বলে,
“আমি চাই আমার বউটা সবচেয়ে ভালো আর লক্ষি বউ হোক।”
সকাল সাথে সাথেই বললো,
“হবো।”

“আচ্ছা কালকের রিক্সার হুডের ব্যাপারে জানতে চাইবে না?”
সকাল বলে,
“আপনিই তো বললেন না।”
“তুমি আসলেই বুঝোনি?”
“না।এতো দাম কেন?”
“ওই খাওয়া-দাওয়া করে আরকি।এইজন্য।”
সকাল অবাক হয়ে বললো,
“রিক্সায় খাওয়া-দাওয়া!”

সকালের সোজা সোজা কথায় ধ্রুব খুব মজা পায়।
“এই খাওয়া সেই খাওয়া না পাখি।কিস মিস খায় বুঝেছো?”
সকাল অবিশ্বাস চোখে তাকিয়ে থাকে মানে রিক্সায় এসব?কিভাবে? ছিহ।ধ্রুব সকালের মুখ দেখে হেসে দেয়,
“সকাল এখন অনেক কাপল আছে রিক্সাই এসব করে।”

ছিহ,ছিহ করে সকাল মাথা নাড়ায়।
ধ্রুব হেসে কাতর গলায় ডাকে,
“সকাল..”
সকাল প্রশ্ন চোখে তাকালে ধ্রুব বলে,
“মাথাটা খুব ধরেছে একটু হাত ভুলিয়ে দাও”

সকাল তার মোলায়েম হাতে ধ্রুবর মাথায় হাত ভুলিয়ে দেয়।ধ্রুব আবেশে চোখ বন্ধ করে আছে।সকাল মাথায় হাত ভুলিয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানায় এতো ভালো,বুঝদার স্বামী তার কপালে লিখার জন্য।ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে ভাবে এই ধ্রুবটা তার,সবটাই তার,এসব ভাবতে ভাবতে এক অভাবনীয় কাজ করে বসে,টুপ করে নরম কোমল ঠোঁট দিয়ে ধ্রুবর কপালের মধ্যিখানে চুমু দিয়ে দেয়।ধ্রুব সাথে সাথেই চোখ খুলে তাকায়।সে বিষ্ময়কর চোখে তাকিয়ে।সকাল আর ধ্রুবর কাছেই থাকে না তার করা কাজে সে নিজেই লজ্জায় রাঙ্গা।একছুটে বারান্দায় চলে যায়।

ধ্রুব কিছু বলে না চোখ খুলে সকালের চলে যাওয়া দেখে।বাচ্চাটা নিজেই তাকে চুমু দিয়েছে!এটাইতো ধ্রুব চাইছিলো পাখি ডানা ঝাপটে নিজেই ছটফটিয়ে সইচ্ছায় ডাকুক,মন থেকে বুকে টানুক।খুশীতে ধ্রুবর মনে আতশবাজি ফুটে।ধ্রুব কিছুক্ষণ শুয়েই থাকে তারপর আস্তে করে বারান্দায় ঢুকে যায়।সকাল গ্রীলে হাত রেখে রাতের উজ্জ্বল চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে।আজকের চাঁদটার উচিত ছিলো লজ্জায় মেঘের আড়ালে মুখ ঢাকা তা না করে কেমন বেহায়ার মতো সকালকে দেখে হাসছে।ধ্রুব নিঃশ্বব্দে সকালের পাশে এসে গ্রীলে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।আস্তে বলে,

“আজকের চাঁদটা একটু বেশীই সুন্দর তাই না বউ।”
আচমকা ধ্রুবর কথা শুনে সকালের মনের ছোট পিঞ্জিরা কেঁপে ওঠে, লজ্জায় মাথা নুয়ে পড়ে।চাঁদের উপর ভিষণ অভিমান হয়,একটু মেঘের আড়াল হয়ে গেলে কি হতো!ধ্রুব স্পষ্ট দেখে তার বউ লজ্জার বহর খুলে সারা গায়ে লেপ্টে নিচ্ছে।ধ্রুব এই প্রথম সকালের পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।কানের লতির কাছে মুখ ছুঁইছুঁই করে ঘোর লাগানো গলায় ফিসফিসিয়ে বললো

“আমি কি এতোই খারাপ সোনা?”
ধ্রুবর সম্মোহনী ডাকে সকালের সুপ্ত অনুভূতিরা কাঁপে।তার পিছনে ধ্রুব লেপ্টে আছে,সারা শরীরে অজানা শিহরণ।সকাল হাফসাফ করে বললো,
“সরে দাঁড়ান না!”
ধ্রুব সরে না,সকালের ভেতরটা আরো নাড়িয়ে দিতে,ভেতরের সুপ্ত ইচ্ছাটাকে টেনে বের করতেই বললো,
“আগে উত্তর দাও।তারপর ছাড়ছি।”

সকালের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে।ধরা গলায় বলে,
“ভালো।”
ধ্রুব সকালের কানে তার ঠোঁট আলতো ঘষে বলে,
“ভালোবাসার মতো ভালো তো?”
সকাল ধ্রুব সংস্পর্শে এসে কথা বলতে পারছেনা।সে ধ্রুবকে কি করে বলবে সকাল তাকে একটু একটু ভালোও বেসে ফেলছে।লজ্জায় বেশী কিছু না বলে ছোট করে উত্তর দেয়,
“জানিনা তো।”

ধ্রুবর বিষাক্ত ইচ্ছেরা আবারো জেগে উঠে।দেহ নাড়িয়ে মন কাঁপিয়ে অনুভূতিরা উল্টাপাল্টা ছুটে চলে।সে বউটাকে কিভাবে বুঝাবে ধ্রুব যে তাগড়া যুবক।বিষাক্ত ইচ্ছেরা তাকে বেশী জ্বালায়।সকাল আগে থেকে একটু ফ্রী হয়েছে কিন্তু তারপরেও সকালের মাঝে স্পষ্ট সংকোচের দাগ দেখা যাচ্ছে।ধ্রুব সরে এসে গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে সকালের দিকে তাকায়।ধ্রুবর চোখের ভাষাটা সত্যিই সকালের বুকটা পুড়িয়ে দিচ্ছে,তলপেটে প্রজাপতির ঝাঁক উড়ে উড়ে সুরসুরি দিচ্ছে।কেমন মাতাল করা আশায় মন মেতে উঠে,সকালও সমানতালে ধ্রুবকে দেখে।ধ্রুব যেন চোখ দিয়েই তার পিচ্ছি ছাত্রীকে শিখাচ্ছে,চিনাচ্ছে,জাগিয়ে তুলছে।

সকালের ছটফটানি ধ্রুবর চোখে পড়ে।গভীর গলায় বললো,
“এতো ভয় পাও কেন?”
সকাল হেসে বললো,
“ভয় পাই না।”
ধ্রুব হাতমুড়ে দাঁড়ায়।ফিচলে হেসে বললো,
“তাই?”
সকাল নিজেও হাসে।মাথা নাড়িয়ে বলে,
“হ্যাঁ।”

ধ্রুব সকালকে ভয় দেখাতে পিছনের দেয়ালে দিকে ঠেলে দেয়।তারপর সকালের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“এখন ভয় পাচ্ছো।”
সকাল মাথা নাড়িয়ে বলে,
“মোটেই না।”
ধ্রুব সকালের নরম শরীরের সাথে একটু চেপে দাঁড়ায়।বিরবির করে বলে,
“এখন?”

সকাল ধ্রুবর চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়।
ধ্রুব সকালের নরম কোমল ঠোঁটের কাছে নিজের পুরু ঠোঁট এগিয়ে নেয়।দুজনে দুজনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,ধ্রুব চোখ দিয়েই পাগলকরা ইচ্ছা সপে দেয়,সকাল দ্রুত মাথা নেড়ে না করে।দুজনের নিশ্বাসের মধুর আলিঙ্গন হয়,হয়না শুধু তাদের।ধ্রুব এখন মোটেও মজা করছে না,তিরতির করে কাঁপা ঠোঁট তাকে চুম্বকের মতো টানছে।ধ্রুব ফিসফিস করে বললো,

“জান একবার প্লিজ।শুধু একবার।”
সকাল অস্পষ্ট স্বরে কিছু একটা বলে।সে কথা ধ্রুবর কাছে বোধগম্য হয় না।সে ঘন শ্বাস ফেলে ঠোঁট ছোঁয়িয়ে দেয়,সকাল চোখ বন্ধ করে থাকে অস্বাভাবিক গতিতে হৃদপিণ্ড ছুটে চলছে।ধ্রুবর একবার ছুঁয়ে মন ভরে না,আরেকবার ছোঁয়,আরেকবার ছোঁয়।

তখনি মিসাইলের মতো মনোয়ারা সকালকে ডেকে উঠে রাতের খাবার খেতে।ধ্রুব আরো শক্ত করে সকালকে ধরে বলে,”পরে যেও। প্লিজ।”
সকাল ধ্রুব কথা শুনে না।সে যেতে পারলেই বাঁচে,মোচড়ামুচড়ি করে ধ্রুবর থেকে ছুটে চলে যায়।দূরে গিয়ে বুকে থু থু ছিটিয়ে পড়ে ‘লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিউল আজিম।’

কাঞ্চাসোনা পর্ব ৮

ধ্রুব অসহায় মুখে তাকিয়ে থাকে।তার মায়ের উপর খুব রাগ হচ্ছে এমন মূহুর্তে কেউ ডাকে?বাচ্চা বিয়ে করিয়েছে এখন বাচ্চাকে বুঝি ছোঁয়াও যাবে না।কি মুশকিল!কি যন্ত্রনা!

কাঞ্চাসোনা পর্ব ১০