কারনে অকারনে ভালোবাসি শেষ পর্ব

কারনে অকারনে ভালোবাসি শেষ পর্ব
Suraiya Aayat

নিরবে একা বসে আছে আরু দরজার সাথে মাথা রেখে, পুরো বাড়ি জুড়ে এক শোকের ছায়া, চারিদিকে কান্নাকাটি র শব্দ , আরু নিজেও কাঁদতে কাঁদতে হাপিয়ে উঠেছে, আফসানা বেগম জ্ঞান হারিয়েছেন অনেকখন আগেই, তাকে ঘরে শুইয়ে রেখেছেন, দূর থেকে মধুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে, এক এক জন এক এক রকম কথা বলছে আর কাঁদছে। যারা দূর সম্পর্কের আর অপরিচিত তারাও কাঁদছে আর এতো সব কিছু মধ্যে আরুর নিজের নিষ্প্রাণ বলে মনে হচ্ছে।

আরিশ ঠিকই বলেছিলো কালকে যে জন্ম মৃত্যু আর বিয়ে এই তিনটে জিনসের ওপর আমাদের কোন হাত থাকে না। ওর নানাভাইয়ের ঘরটাতেই বসে রয়েছে দরজায় হেলান দিয়ে মাথা ঠেকিয়ে, চোখ থেকে আপনা আপনিনিই নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়ছে যার ওপর আরুর আজ কোন নিয়ন্ত্রন নেই।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

হঠাৎ অনুভব করলো ওর পাশে কেও বসলো। আরুর আর বুঝতে বাকি রইলো না যে আরিশ। আরিশ মলিন কন্ঠে আরুপাখি নামটা ধরে ডাকতেই আরু আরিশের বুকে কান্নায় লুটিয়ে পড়লো। আরিশের গলা ধরে আসছে আরু কে এই অবস্থায় দেখে, প্রিয় মানুষদের এক এক ফোঁটা চোখের জল সমুদ্রের জলের মতো সমান হয়। আরিশ আরু কে জড়িয়ে নিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ধরা গলায় বলল

” কষ্ট হচ্ছে খুব তাইনা? ”
আরু আরিশের শার্ট খামচি মেরে ধরলো
” এমনটা হওয়ার কি খুব দরকার ছিলো? প্রিয় মানুষরায় কেন এভাবে পর করে দূরে চলে যায়? কেন এতো কষ্ট পেতে হয় বলতে পারেন? ”
আরিশ আরুর কপালে চুমু দিয়ে বলল
” নানাভাই য়ের দাফন কাজ শেষ চলো একবার দেখে আসবে শেষ বারের মতো। ”
আরু আরিশের দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো, দুই চোখ থেকে অনবরত জল গড়াচ্ছে। আরিশ চোখটা মুছে দিয়ে কপালে ভালোবাসার পরশ একে বলল

” সমস্ত পৃথিবীটায় একটা মায়া। মায়া ছাড়া এই পৃথিবী অচল। আমাদের সবাইকেই একদিন এই মায়া কাটিয়ে যেতে হবে। চলো। ”
আরুর প্রায় দূর্বল হয়ে যাওয়া পা গুলো আর চলতে চাইছে না থেমে থেমে যাচ্ছে বারবার। আরিশের সাদা পাঞ্জাবীর বুক পকেটের জায়গার অংশ ভিজেছে আরুর চোখের জলে তবুও কষ্ট হলেও যে চলতে হবে!

দেড় মাস পর।
“ভাইয়া কই রে? আমার তো ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে আরু। কি হবে? যদি মেডিক্যাল এ চান্স না পাই। ”
নারভাসনেস নিয়ে ভয়ে থতমত খেয়ে গেল সানা। আরু ভ্রু কুঁচকে সানার দিকে তাকাতেই সানা বলল
” না না চান্স কেনো পাবো না? চান্স তো পেতেই হবে আর তা ঢাকা চত্বর এর মধ্যেই না হলে ভাইয়া মেরে আলু ভাজি করে দেবে একদম। ”
আরু সানার কথাটা শুনে ফিক করে হেসে ফেলল, চিন্তা ওর যে হচ্ছে না তেমনটা নয় চিন্তা হচ্ছে তবে এই মুহূর্তে সানার কাজ কর্ম আর কথাবার্তা শুনে আর দেখে হাসি পাচ্ছে। আরুর হাসির শব্দ শুনে সানা ধমকে বলল
” তুই হাসছিস আর এদিকে আমি চিন্তায় চিন্তায় শেষ। ”

অনিকা খান চটপটির ট্রে টা টেবিলে রেখে বলল
” এতো ভাবা ভাবির কি আছে, পেয়ে যাবি ইনশাআল্লাহ। ”
আরুর ও তাল মিলিয়ে বলল
” আরে সানা বেকার এতো প্রেশার নিচ্ছিস কিছু হবে না।”
“কিন্তু ভাইয়া? ভাইয়া তোকে হয়তো কিছু বলবে না কারন তোর নানাভাই। ”
কথাটা বলার পরপর ই জিভ কাটলো সানা এই মুহূর্তে হয়তো কথাটা ওর বলা উচিত হয়নি। নিমেষেই আরুর মুখটা মলিন হয়ে গেল আর হাসিটাও উবে গেল।
সানা আরুর পাশে বসে বলল
” সরি সরি আমি বলতে চাইনি। ”
অনিকা খান ধমকে বললেন

” কখন কি বলতে হয় শিখিস নি? এখনও শিখিস নি আর কবে শিখবি। ”
আরু অনিকা খানকে ধীমে কন্ঠে বলল
” ফুপি আমি কিছু মনে করিনি তুমি শুধু শুধু ওকে বকছো। ”
সানা মাথা নীচু করে নিলো। অনিকা খান রেগে উঠে গেলেন। হঠাৎ আরিশ সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো, ওদের দুজনের সামনে দাঁড়ালো, মুখের হাবভাব দেখে বোঝার উপায় নেই যে কি বলতে চাচ্ছে, বেশ থমথমে পরিবেশ। আরু না পেরে প্রশ্ন করে উঠলো
“রেজাল্ট? ”

আরিশ সানার দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
” সেহরাওয়া্দী। ”
সানা খুশিতে একাকার। আরুকে জড়িয়ে ধরলো আনন্দে। আরু সানা কে জড়িয়ে ধরে বলল
“কংগ্রেস জানু।”
সানা কৌতুহল নিয়ে বলল
” ভাইয়া আরু? ”
আরিশ চুপ করে রইলো দেখেও আরুর মাঝে তার কোন এফেক্ট পড়লো না। আরু নির্লিপ্ত ভাবে বলল

” চান্স কি আদতেও হয়েছে? ”
আরিশ ভাবলেশহীন হয়ে বলল
” স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল। ”
আরুর মুখে একটা মলিন হাসি ফুটে উঠলো। সবাই খুব খুশি। আরিশ বেশ গম্ভীর আর শান্ত স্বর নিয়ে বলল
“আরু পাখি রুমে এসো। ”
আরু মাথা নাড়িয়ে বলল
“হমম।”

আরিশ রুমে চলে গেল, আরু অনিকা খানের সাথে দেখা করে রুমে এসে দেখলো আরিশ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। আরু আরিশ এর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। দুজনের মাঝেই পিনপতন নিরবতা, আরিশ বেশ কিছুটা পর হালকা নরম সুরে বলল
” মন খারাপ? “আরু মুচকি হেসে বলল “কই না তো? ”
আরিশ আরুর দিকে তাকিয়ে বলল
” খুশি হওনি রেজাল্ট এ? ”
আরু পাল্টা প্রশ্ন করলো
“আপনি খুশি হননি? ”
আরিশ আরুর মাথায় হাত রেখে বলল
” কে বলল খুশি হয়নি? ”
আরু আরিশ এর কাছে খানিকটা সরে এসে বলল
” আপনি ঢাকা মেডিকেল আর আমি। ”
আরু কে থামিয়ে আরিশ বলল

” ছিলাম এখন আর নেই, পাস আউট করেছি কলেজ থেকে। কখনো কারোর সাথে কারোর তুলনা করবে না সেটা হয়তো আমি শেখাতে ভুলে গেছি তবে আজ বলছি শিখে নাও। ”
আরু হেসে ফেলল।
আরিশ এর বুকে মাথা রেখে বলল

” আপনার সংস্পর্শে না আসলে বোধহয় কখনো বুঝতেই পারতাম না যে প্রতিটি মানুষকে পারফেক্ট হওয়া খুব জরুরি নয়, একটু ইমপারফেক্ট হলেও মন্দ হয় না, এই যেমন আমি, জানিনা কতোটুকু পারফেক্ট তবে আমার বেবি হবে না তার কারনে নিজেকে ইমপারফেক্ট মনে করি। আপনি চাইলেই আবার বিয়ে করতে পারতেন কিন্তু করেননি কারন আপনি আমার অপূর্ণতা তেই নিজের সুখ খুঁজে নিতে চেয়েছেন সবসময়। আপনি আমার জীবনে না এলে হয়তো বাকিটা জীবন এই অপূর্ণতা নিয়ে বেঁচে থাকার ও শক্তি পেতাম না। নিজেকে ভীষন লাকি মনে করি আমি কারন আপনি আমার জীবনে এসেছেন কোন রকম কোন স্বার্থ ছাড়াই, কতোজন ই বা পারে এমন হু? জানেন আপনাকে মিঃ অভদ্র কেন বলি? ”

আরিশ মুচকি হেসে বলল
“কেন? ”
আরু আরিশ কে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল
” কারন আমার দৃষ্টিতে আপনিই হলেন আমার জীবনের সেই অভদ্র প্রেমিক যাকে ছাড়া আমার জীবনের একটা বৃহৎ অংশ অসমাপ্ত। ভালোবাসি আপনাকে তাই তো কাছে পেতে চাই আরও ভালোবাসতে চায়। ”
আরিশ ও আরু কে জড়িয়ে ধরে বলল
” জানো তো আরু পাখী একটা কথা যা আমি তামাকে আজ ও বলিনি। ”
আরু অবাক হয়ে বলল
” কি? ”

” নানাভাই যেদিন মারা যান সেদিন মধ্যে রাত অবধি উনি আমার সাথে কথা বলেছিলেন। তখন একটা কথা শুনে বড্ড আবেগপ্রবন হয়ে গিয়েছিলাম
” কাঁকনরে হারাই ছিলাম খুব তাড়াতাড়িই তাই ডর করে সবাইরে হারানোর। আরু দিদি ভাই তোমার সাথে অনেক সুখী থাকবে আমি জানি আর তোমারেও যে আমি অপছন্দ করি তেমনডা নহে, খালী মনে হয় তুমি মোর আরু দিদিভাইরে আমার থেকে কাইড়া লইবার তাই তো মোর ডর করে। শোনো নাতনির জামাই আমি হয়তো আর বেশি দিন থাকবো না তাই তোমারেই আমার আরুর দায়িত্ব দিয়ে যাইতে চাই, ভালো রাইখো ওরে, ও তোমারে অনেক ভালবাসে যেমনটা তুমি তারে বাসো তবে মাঝে মাঝে তাকে আমার কথা বলে মনে করাইয়া দিও যে আমিও তারে অনেক ভালবাসতাম। ”

কারনে অকারনে ভালোবাসি পর্ব ৩০

আরুর চোখ ভিজে এলো, কয়েক ফোঁটা নোনা জল ও গড়ালো। আরিশ আরুর চোখটা মুছে আরুর হাতটা মুঠিবদ্ধ করে বলল
“সেদিন লাইব্রেরির তাকে ধুঁলোয় মোড়ানোর বইয়ের পাতলা ভুল কিছু বলেনি জানো তো আরু পাখি। ”
আরু মুচকি হেসে বলল
” আপনার মনে আছে লাইনটা। ”
আরিশ আরুর কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিলো তারপর আরিশ আর আরু দুজন দুজনের কপাল ঠেকালো আর বলতে শুরু করলো

” এই পৃথিবীতে ভালোবাসার কোন নির্দিষ্ট সূত্র নেই, কারনে অকারণেও ভালবাসা যাই। তাই তো কারনে অকারনে ভালৈবাসি। ”
দুজনের মুখে তৃপ্তির হাসি আর ভালোবাসার অভিযোজনা।
কতোজন পারে আরিশ আরু হতে যারা কারন ছাড়াই ভালোবাসতে জানে!

(লেখাঃ সুরাইয়া আয়াত) এই লেখিকার আরও লেখা গল্প পড়তে চাইলে এখানে ক্লিক করুন

1 COMMENT

  1. Sotti valobaste kono karon er proyojon hoy na na lage na valobasa toh okaronei basa jay j karon a valobase seta valobasa na golpo ta khub khub khub sundor hoyeche khub khub valo legeche

Comments are closed.