কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ১৯

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ১৯
লেখায় নামিরা নূর নিদ্রা

“কী এটা?”
“ডিভোর্স পেপার!”
কুয়াশার কথায় তুরাব দুই পা পিছিয়ে যায়। একটু আগেই তার হাতে কুয়াশা এই ডিভোর্স পেপার ধরিয়ে দিয়েছে।
“কী হলো তুরাব? খুশি হননি আপনি?”
“কুয়াশা তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছ? এসবের মানে কী?”

“আপনি নিজেই তো আমার থেকে ডিভোর্স চেয়েছিলেন। তাহলে আজ কেন এত অবাক হচ্ছেন?”
“দেখ কুয়াশা আমি এখন ডিভোর্স চাই না। আমি তোমার সাথে থাকতে চাই।”
“কিন্তু আমি যে এমন জঘন্য চরিত্রের কারোর সাথে আর এক মুহূর্ত থাকতে চাই না।”
কুয়াশার এহেন কথায় তুরাব অসহায় চাহুনি নিয়ে তাকায় তার দিকে। এমন চাহুনি দিয়েও সে কুয়াশার মন গলাতে পারে না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আমি যখন ডিভোর্স চেয়েছিলাম তখন তো ডিভোর্স দাওনি। তাহলে আজ কেন?”
“আজ আপনি চান না বলেই তো আমি চাচ্ছি।”
“মানে?”
কুয়াশা আনমনে হেসে উত্তর দেয়,

“অনুভূতিগুলো চোখের সামনে শেষ হয়ে যাওয়ার কষ্ট বোঝেন? আজ আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন একদিন এই জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেদিন চলে আসার পর ভেবেছিলাম আপনি আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু না, আপনি তো আমাকে ছেড়ে দিতে চাইলেন! নিজের কাজ শেষে ছুঁড়ে ফেললেন আমাকে। আমার যন্ত্রণা সেদিন আপনি বুঝতে পারেননি। বুঝতে পারেননি আপনাকে নিয়ে আমার মনের কোণে জমে থাকা সুপ্ত অনুভূতিগুলোকে। আর আজ আপনিও ঠিক একই রকম কষ্ট পাচ্ছেন। নিরব প্রতিশোধ নিতে কখনো কাউকে দেখেছেন? আমিই সে যে আপনার উপর নিরব প্রতিশোধ নিলো আজ!”

“তার মানে এজন্যই তুমি আমাকে এতদিন ডিভোর্স দাওনি?”
“হ্যা। আমি তো আপনাকে ছেড়ে আসার দিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যেদিন আপনার মনে আমাকে নিয়ে অনুভূতি জন্মাবে ঠিক সেই মুহূর্তে আমি আপনাকে ছেড়ে দিব। সবাই ভেবেছে সমাজের কথা ভেবে আমি আপনাকে ডিভোর্স দিচ্ছি না। আসলে কিন্তু তা নয়। সমাজের কথা আমি কেনই বা ভাবতে যাব? যে সমাজের মানুষজন অসহায় মেয়েদের বলে, স্বামী যেমনই হোক সংসার করতেই হবে।

স্বামী যদি পরনারীতে আসক্ত হয় তবুও সংসার করতে হবে। স্বামী যদি প্রাক্তন প্রেমিকার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য স্ত্রীকে ব্যবহার করে তবুও সেই স্বামীর সংসার করতে হবে। স্বামী যদি ভালো না বাসে তবুও তার সংসার করতেই হবে। স্বামী হাজারো অপরাধ করবে। তবুও চুপ করে সংসার করতে হবে। স্বামী যদি একবার ক্ষমা চায় তাহলে সাথে সাথে ক্ষমা করে দিতে হবে। কোনো অবস্থাতেই সংসার ছাড়া যাবে না। কারণ মেয়েদের আসল ঘর হলো স্বামীর ঘর। এইসব ভাবা সমাজের মানুষজনকে আমি ঘৃণা করি। কেন জানেন? কারণ তারা আমাদের মত মেয়েদের এসব বুঝিয়ে আমাদের আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে শেখায়। এমন সমাজ আমাকে নিয়ে কি বলল তাতে আমার কিচ্ছু যায় কিংবা আসে না!”

তুরাব নিজেকে সামলাতে না পেরে কুয়াশার দুই হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বলে,
“একটা বার কী আমাকে ক্ষমা করা যায় না?”
“কাকে ক্ষমা করব? যে আমাকে খেলার গুটি বানিয়েছে? যে আমাকে ভালোবেসে কখনো স্পর্শ করেনি তাকে ক্ষমা করব? যে আমার জীবন নিয়ে খেলেছে তাকে ক্ষমা করতে বলছেন আপনি? যে মানুষটা আমার অনুভূতির মূল্য দেয়নি তাকে কী করে ক্ষমা করব আমি? যে আমাকে এক কথায় ডিভোর্স দিতে চেয়েছে তাকে ক্ষমা করব আমি? তাহলে আমাকে মাফ করবেন। আমি এত দয়ালু নই। আমার জীবনের দাম আছে। আমি ফেলনা নই তুরাব। আমার আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে আমি আপনার কাছে ফিরতে পারব না। আমি আপনার ছায়াও আর কখনো দেখতে চাই না।”

“আমি তোমাকে ডিভোর্স দিব না কুয়াশা। তুমি যা ইচ্ছা করতে পারো।”
“আপনি ডিভোর্স দিতে না চাইলেও তিন মাস পর, উর্ধ্বে ছয় মাস পর এমনিতেই আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। আর কী জানেন তো? জোর করে কখনো সম্পর্ক টেকানো যায় না।”
“তুমি এভাবে কষ্ট দিতে পারো না আমাকে।”

“ওহ্ তাই? আপনি মনে হয় আমাকে খুব সুখ দিয়েছেন? আপনি এমন এক পুরুষ যে কিনা শতশত মেয়েকে ছুঁয়েছে। আচ্ছা এত মেয়েকে স্পর্শ করলেন। আপুকে কেন ছেড়ে দিলেন?”
“তার প্রতি আমার ওই টান কখনো কাজই করেনি। তাকে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা করেনি।”
“সম্পর্কে ছিলেন কেন তাহলে?”
“জানি না। সত্যি বলতে এর উত্তর আমার কাছে নেই।”

“যাইহোক, একটা শেষ অনুরোধ করি? যদি আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিতে চান তাহলে এই পেপারে সই করে দিবেন। আর কোনোদিন আমার সামনে আসবেন না। ভালো থাকবেন!”
কথাটা বলে কুয়াশা নিজ মনে হাঁটতে শুরু করে। তার চোখের কোণে পানি জমেছে। এই পানি সে কাউকে দেখাতে চায় না। তাই যথাসম্ভব চোখের পানি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। সাফওয়ান তার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করে,
“কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলে? যে সিদ্ধান্ত তোমার চোখে পানি নিয়ে আসে।”

“আমি তুরাবকে হারানোর জন্য কাঁদছি না। আমি আজ থেকে আমার নামের পাশে ডিভোর্সি তকমা বসবে তার জন্যও কাঁদছি না। আমি কাঁদছি নিজের জন্য। সত্যিকারের ভালোবাসা না পাওয়া এক অভাগী আমি। আমার কপালে এক মুঠো ভালোবাসা নেই। আমি কি ভালোবাসার যোগ্য নই? এই বিশ্বে কেউ কেন ভালোবেসে কাছে টেনে নিলো না আমায়? আমি কি এতটাই খারাপ? ভালোবাসা পাওয়ার কোনো অধিকার কি আমার নেই? আমি তো শুধু এক মুঠো ভালোবাসার আশায় বেঁচেছি এতদিন। কিন্তু আমার ভাগ্যে ভালোবাসার সেই সুখ নেই!”

“এভাবে কেঁদো না। তোমার জীবনেও সত্যিকারের ভালোবাসা আসবে। অপেক্ষা করতে ক্ষতি কোথায়? অপেক্ষার ফল মধুর হয়। তোমার অপেক্ষাও একদিন স্বার্থক হবে। মিলিয়ে নিয়ো আমার কথা।”
কুয়াশা আর কোনো কথা বলে না। সাফওয়ান কুয়াশাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে চলে যায়। তার আগে আদ্রিতাকে বলে দেয়,
“ওর খেয়াল রেখো। পারলে সব সময় ওর পাশে থেকো। আজকের রাতটা ওকে একদম একা রাখবে না।”

সাথে কুয়াশার যত্ন নেওয়ার কথা বলতেও ভোলে না সে। মেয়েটার চোখের পানি একদম ভালো লাগে না তার।
কুয়াশা নিশ্চুপ হয়ে জানালার পাশে বসে আছে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু ফোঁটা এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তাকে। চোখের পানি আর বৃষ্টির পানিতে একাকার হয়ে গিয়েছে তার মুখখানা। আদ্রিতা তার পাশে বসে। সেদিকে মেয়েটার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

“তোর খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?”
আদ্রিতার এমন কথায় কুয়াশার মধ্যে কোনোরকম পরিবর্তন খেয়াল করে না সে।
“উত্তর দিবি না?”
“আমার না অবাক লাগে।”
“কেন?”

“তুরাবের মত ছেলের সাথে যারা আমাকে সংসার টিকিয়ে রাখতে বলেছে সেই সকল মেয়েদের দেখে অবাক লাগে। তাদের মধ্যে কী আত্মসম্মান বলতে কিছু নেই? ডিভোর্সি মেয়েদের কেন আলাদা চোখে দেখা হয়? মানছি সব মেয়ে ভালো হয় না। কিন্তু কিছু খারাপ মেয়ের জন্য সবাই কেন শাস্তি পায়? কেউ কি নিজ ইচ্ছায় এমন জীবন বেছে নেয়? আমাদের মত মেয়েদের অবস্থা কেন বুঝতে পারে না ওরা?”

“মানুষের কথায় কান দিবি না। তুই যা করেছিস একদম ঠিক করেছিস। চরিত্র যার ঠিক নেই তার সাথে থাকার থেকে ছেড়ে দেওয়া অনেক ভালো।”
হঠাৎ কুয়াশার ফোন বেজে ওঠে। আদ্রিতা ফোন হাতে নিয়ে বলে,
“আন্টি কল দিয়েছে। কথা বল।”
কুয়াশা কানের কাছে ফোন নিয়ে মলিন কণ্ঠে বলে,

“মা!”
“মন খারাপ?”
“ভীষণ!”
“কেন?”
“আমায় কেউ কেন ভালোবাসে না মা?”
“কে বলেছে ভালোবাসে না? তোমাকে সবাই ভালোবাসে।”
“তবে যে আমি স্বামীর ভালোবাসা পেলাম না। পেলাম না নিজের হাতে তৈরি করা সুন্দর সাজানো একটা সংসার। পেলাম না সন্তান সুখ!”

মেয়ের প্রশ্নের জবাবে কোনো উত্তর খুঁজে পান না মিসেস নাহার। এমন প্রশ্নের উত্তরে কী বলা যায়? আদৌও কী এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর আছে? না, এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না। হয় শুধু নিরবতা!

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ১৮

বিঃদ্রঃ যারা তুরাবের সাথে কুয়াশার মিল চেয়েছেন তাদেরকে কুয়াশার মাধ্যমেই আমার উত্তর দিয়ে দিলাম আজ। এবং আজকের পর্ব পড়ার পরেও যারা তুরাবের সাথে কুয়াশার মিল চান তাদেরকে এই গল্প না পড়ার অনুরোধ করব।

কুয়াশা মিলিয়ে যায় রোদ্দুরে পর্ব ২০