কুসুম কাঁটা পর্ব ২২

কুসুম কাঁটা পর্ব ২২
সাবিকুন নাহার নিপা

তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর রঙ্গনা রাফাতের মা’কে ফোন করলো। ভদ্র মহিলা দূর্বল নাটক করার চেষ্টা করলেন। রাফাতের জন্য চিন্তিত। ফোন করেও পাচ্ছেন না। রঙ্গনার সঙ্গে আকাশী আর শ্রাবণ্য। ওরা নিজেদের মতো বোঝানোর চেষ্টা করেও লাভ হলো না। রঙ্গনা বলল,

“আমি বাড়ি যাব। আমার কিছু ভালো লাগতেছে না। অস্থির লাগতেছে। ”
সাজগোজ কমপ্লিট হতে আরও কিছু সময় বাকী। শ্রাবণ্য জোর করে সেটুকু সময় রঙ্গনা কে বসিয়ে রাখলো। রঙ্গনা বলল,
“শ্রাবণ্য, মা’কে একবার ফোন করে দেখ তো। ”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শ্রাবণ্য বাড়িতে ফোন করে শিলাকে ব্যাপার টা জানালো। শিলা মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করলেন। তুলিকে ছাড়া আর কাউকে জানান নি। রাফাতের মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলেন যে রাফাতের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। শিলা চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করে,

“খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না মানে কী? হারিয়ে গেছে?”
রাফাতের মা দু:খী গলায় বলে, জানিনা আপা। এই ছেলে কী আমার কথা শোনে! ওর যা মন চায় করে। আগেও দুইবার বিয়ের কথা ঠিক হবার পর এমন করছে।
“মানে? এসব তো আপনারা বলেন নি আগে?”
“কী বলব আপা?”

শিলা মিলাতে পারছে না হিসাব। রাফাত কে অবিবেচক মনে হয় নি কখনো। গায়ে হলুদের দিন রাফাতের মা, খালাদের সন্দেহজনক আচরণ থেকেই কী এই নাটকের সূচনা হলো।
বিকেলের মধ্যে বাড়ির অন্যান্য রা সবাই জেনে গেছেন যে রাফাত কে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন বেজে গেলেও ফোন টা তুলছে না।

আফতাব সাহেব কোনো কিছুতে বিচলিত হন না। প্রত্যেক টা বিষয়েই সে দুটো দিক ভাবেন। একটা কাজ না করলে অন্যটা। তার জন্য এই ঝামেলা টা অপ্রত্যাশিত। রাফাত ছেলেটা চমৎকার। রঙ্গনাও কী সুন্দর সবকিছু মেনে নিয়েছিল। রাগারাগি, বাড়াবাড়ি কিছু দেখা যায় নি। কত আনন্দ করেছে সবাইকে নিয়ে। তার এখন খারাপ লাগছে। তার নাতনীটা কতো কষ্ট পাবে। কত আত্মীয় স্বজন কে দাওয়াত করা হলো। সবাই এসে মেয়েটার ছোট হওয়া দেখে যাবে।

আফতাব সাহেব শিলার কাছে গেলেন। তিনি কখনো কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য শিলার কাছে আসেন না। আজ এলেন। শিলার ঘরে দাদী খাটে বসে সুর করে কাঁদছেন। এই মহিলা অন্যান্য সময় কাঁদলে শুধু গলা দিয়ে সুর ই বেরোয়। চোখ দিয়ে পানি পড়ে না। তবে আজ সত্যি ই কাঁদছেন।
আফতাব সাহেব শিলাকে প্রশ্ন করলেন,
“বউমা, এবার কী হবে? ”
শিলা স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন। সে তো নিজেও জানেনা যে কী হবে।

রঙ্গনার ভীষণ লজ্জা লাগছে। অনেক দিন পর ওর আবারও ভীষণ কান্না পাচ্ছে। শেষবার এমন হয়েছিল এইচ এস সির রেজাল্টের সময়। এতো ভালো পরীক্ষা দিলো অথচ বাংলায় ফেল এসেছে। পরে জানা গেল রেজিষ্ট্রেশন নাম্বার লিখতে ভুল করেছিল।

এতো সেজেগুজে যার জন্য এসেছে সে গায়েব। ও এতো শক্ত, তবুও আজ এতো লজ্জা লাগছে! গেট দিয়ে ঢোকার সময় স্বপ্নীল এসে জড়িয়ে ধরলো। ও’কে কাঁদানোর জন্য স্বপ্নীলের হাউমাউ করে কাঁদাটাই যথেষ্ট ছিলো।
ঘন্টাখানেক চলল এমন ই। রাফাতের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে ওই বাড়ির কাউকে দেখেই মনে হচ্ছে না যে তারা এই ব্যাপারে ব্যথিত। সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। রাফাতের বাবার সঙ্গে শিলা কথা বললেন,
ভদ্রলোক আমতা আমতা করে বলল,

“কী করতে পারি আপা বলেন? কপাল চাপড়েও তো লাভ নাই। অপেক্ষা করি ছেলে যদি ফিরে আসে…!
শিলা কঠিন গলায় বলেন,
“ফিরে আসে কথাটার মানে কী?”
“মানে অপেক্ষা করি আর কী! আজ না ফিরলে, পরে আর কী….
ভদ্রলোক কথা শেষ করার আগেই শিলা ফোন টা কেটে দিলো। ইচ্ছে করলো বয়স্ক ভদ্রলোক কে ঠাস ঠাস দুটো থাপ্পড় দিতে।

কিছুক্ষন পর রাফাতের মামী ফোন করলো রঙ্গনাকে। ফোন টা তুলল শ্রাবণ্য। মামী জিজ্ঞেস করলেন,
“রঙ্গনা কী করে? কান্নাকাটি করে?”
শ্রাবণ্য বলল,

“কান্নাকাটি কেন করবে? কান্নাকাটি করার মতো কিছু ঘটেছে? রাফাত ভাইয়া তো মারা যায় নি। ”
মামী থতমত খেল। ভেবেছিল কাঁদতে কাঁদতে এরা হয়তো বেহুশ হয়ে পড়বে। কিন্তু মায়ের গলাও স্বাভাবিক, মেয়েও নাকি কাঁদছে না! শ্রাবণ্য আবারও জিজ্ঞেস করলো,

“আপনি কী এটা জানার জন্য ফোন করছিলেন?”
“না আমাদের তো অবস্থা খারাপ। গলা দিয়া দানাপানি কিছু নামতেছে না। ”
শ্রাবণ্যর জবাবও বেশ শক্ত। বলল,
“আপনার গলা শুনে তা মনে হচ্ছে না মামী। বেশ আনন্দিত গলা শোনাচ্ছে আপনার। ”
মামী থতমত খেলেন। হাসার চেষ্টা করে বলল,

“তুমি ছোট মানুষ তো তাই মাথা গরম হয়ে গেছে। এখন রাখি, রাফাত আসলে তোমাদের সাথে দেখা হবে। ”
রঙ্গনা পাশেই ছিলো। ওকে ধরে বসে আছে আকাশী। শ্রাবণ্য ফোন রেখে বলল,
“পাজি মহিলা ফোন করছিল আপু। আপু আমার ধারণা রাফাত ভাইয়া কোনো ট্রাপে পড়েছে। সবাই মিলে গুটিবাজি করছে কিছু একটা। ”
রঙ্গনা হতাশ গলায় বলল,

“রাফাত স্বপ্নীলের মতো না শ্রাবণ্য। ও’কে আমার তেমন মনে হয় নি। ”
“আপু আমার মনে হয় উনি আসলেই কোনো ঝামেলায় ফেঁসে গেছেন। ”
রঙ্গনা এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিলো না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

আশ্চর্য হলেও সত্যি যে রেহানা এই পুরো ঘটনায় মনে মনে ভালোই খুশি। কিন্তু তাকে দু:খী দু:খী অভিনয় চালিয়ে যেতে হচ্ছে। ব্যাপার টা এমন নয় যে রঙ্গনা তার শত্রু। এই বাড়ির লোকজন কেও অপছন্দ নয়। তবুও তার খুশির কারণ হলো ঝামেলা হওয়া নিয়ে। বড় মেয়েকে নিয়ে সে যে ঝামেলা টা সহ্য করেছেন সেটা অনেক কষ্টের। লোকজনের নানান কটু কথা, অনেক আফসোস,অনেক কিছু। সেই একই কষ্ট এখন অন্যদের পেতে দেখলে ভালো লাগে।

মুনসুর অবশ্য সেই দলে না। সে শিলাকে বললেন,
“ভাবী কী করবেন? অন্য ব্যবস্থা বোধহয় করা উচিত। ”
শিলা বললেন, যাই করি মেয়েকে জোর করে অন্য কোথাও বিয়ে দেব না ভাই। ছেলের ক্ষেত্রে যে ভুল করেছি সেটার পুনরাবৃত্তি করতে চাচ্ছি না।
মুনসুর খানিকটা দমে গেলেন।

সন্ধ্যে অবধি রাফাতের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। অন্যান্য আত্মীয় স্বজন রা এলো। রাফাত দের বাড়ির লোকজন অপেক্ষা করছে। রাফাত ফিরলে তারা রওনা হবে। নাহলে না। এছাড়া আর হেলদোল নেই।
শিলা আফতাব সাহেব কে বললেন, বাবা আজকের রাত টা দেখি। কাল ব্যবস্থা নেয়া যাবে।
আফতাব সাহেব জিজ্ঞেস করেন, কী ব্যবস্থা নিবা? আমার নাতনী এই অপমানের পর আর কখনো বিয়েতে রাজী হবে? সংসার করার স্বপ্ন দেখবে?”

শিলা জবাব দেয় নি। রঙ্গনার সঙ্গে তার একটাও কথা হয় নি। সামনাসামনি হবার সাহস হয় নি।
রঙ্গনা হঠাৎ বাইরে এলো। সবার সামনেই বলল,
“মা সবাইকে বলে দাও আসল ঘটনা। আর রাফাত দের বাড়িতে ফোন করে বলো, রাফাত যখনই আসুক বিয়ে হবে না। সবকিছুর ই নিয়ম আছে। পরীক্ষায় যেমন নির্ধারিত সময়ে না গেলে পরীক্ষায় বসতে দেয় না, বিয়েটাও তেমন। বিয়েও তো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা পরীক্ষা।”
রঙ্গনাকে দাদু বোঝাতে এলেন। শিলা গম্ভীর গলায় বললেন,
“বাবা তাই ই হোক। আমি রঙ্গনার সঙ্গে একমত। ”

ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিলো কিছুক্ষনের মধ্যে। মিশুকের বাবা মা এসেছিলেন রঙ্গনার বিয়েতে। ওরা অবশ্য আসতে বলেনি। এরকম বিধ্বস্ত পরিবার কে বিয়েতে অংশগ্রহণ করতে বলাটা আসলে অমানবিক ই লাগে। কিন্তু তাদের মনে হয়েছে যাওয়া উচিত। যে মেয়েটার বিয়ে সে রক্ত দেবার সময় ভাবতে একটুও সময় নেয় নি। পরিবারের অন্যান্য মানুষজনও তাদের শিক্ষা, ব্যক্তিত্বের, মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়েছে।

বিয়ে বাড়িতে এসে মিশুকের বাবা, মা ঘটনা শুনলেন স্বপ্নীলের কাছে। মিশুকের বাবা, মা দুজনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে সময় নিলেন মিনিট পাঁচেকের মতো। তারপর তারা শিলা আর আফতাব সাহেব কে জানালেন।
মিশুকের বাবার নাম মোস্তাফিজ হোসেন। মোস্তাফিজ সাহেব দাদুকে বললেন,
“হালিশহরে তাদের নিজেদের বাড়ি আছে। বাজারে দুটো ফার্মেসী আছে যা অন্যদের দিয়ে চালানো হয়। এছাড়া বাদবাকি সবকিছু সে চাইলে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে। তাদের আপত্তি না থাকলে এই সুন্দর পরিবার টির সঙ্গে তারা আত্মীয়তা করতে চায়। ”

আফতাব সাহেব নিমরাজি। মিশুক কে তার আগে থেকেই পছন্দ। শিলা রাজী হলেন না। মিশুক কে নিয়ে এমনিতেই এর আগে ঝামেলা হয়েছে। শিলা চাইলেনও না রঙ্গনাকে এই বিষয়ে কোনো কিছু জানাতে। তুলি গিয়ে জানালো। রঙ্গনা এসে বলল, এই বিয়ে করবে। ওর কোনো আপত্তি নেই।
মিশুকের বাবা, মা খুব খুশি হলেন। মিশুকের মা রঙ্গনাকে বলল,

“আম্মু শোনো, ইউনিভার্সিটি তে পড়ার সময় এক মেয়ের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করতো। সেই মেয়ে বিয়ে করে ইউরোপ গেছে। এছাড়া আর কোনো মেয়ের পিছনে ও ঘুরে নাই। আমাকে সব সত্যি বলে। বাদবাকি সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তো তুমি জানোই। তোমার পাশের রুমেই তো থাকতো। ”
এই কঠিন সময়েও শ্রাবণ্য হেসে ফেলল মিশুকের মায়ের কথা শুনে।

মিশুক হসপিটালে বসেই জানতে পারলো ওর আজ বিয়ে। রঙ্গনার সাথে। বাবা জানালেন যে তিনি কথা দিয়ে ফেলেছেন। এই পরিবারের সঙ্গে তার রক্তের ঋন আছে। কোনোভাবেই মিশুক যেন না বলে।
মিশুক আমতা আমতা করে বলল,
“তোমরা যখন কথাই দিয়েই ফেলেছ এখন না বলে কী হবে। কী আর করা… করলাম বিয়ে। ”
ফোনের এপাশে থাকা মিশুকের উজ্জ্বল মুখ টা কেউ দেখতে পেল না।

পঞ্চান্ন হাজারের লেহেঙ্গা আর দুই লাখের জুয়েলারি পরে রঙ্গনার বিয়ে হলো না। ওর বিয়ে হলো আকাশীর ডিজাইন করা হালকা গোলাপি শাড়ি আর ঘরে থাকা গোল্ডের জুয়েলারি পরে। পার্লারের সাজও উঠিয়ে ফেলেছিল। আবার নতুন করে সাজতে হলো। বিয়ের সময়ে মিশুক বারবার রঙ্গনাকে দেখছিল। রঙ্গনা অদ্ভুত রকমের স্বাভাবিক। চোখে পানি নেই, রাগ নেই। কী সুন্দর স্নিগ্ধ! একবার দুজনের শুধু চোখাচোখি হলো। যখন দাদু রঙ্গনার হাত টা মিশুকের হাতে দিলো।

মিশুক হাত টা উল্টে তালুতে লেখা ‘আর’ শব্দটা দেখলো। শ্রাবণ্য পাশে ছিলো। ও বলল,
“রঙ্গনা তো আর দিয়েই শুরু হয়। ”
মিশুক হাসলো। শ্রাবণ্য বলল,
“ডোন্ট ওরি। মেহেদী আছে আমার কাছে। আপনার হাতেও লিখে দেব। ”

রাফাতের ঘুম ভাঙলো রাত দুইটায়। তাও কোনোভাবে চোখ খুলে তাকাতে পারছে না। ও কোথায় আছে সেটা আবিষ্কার করতেও সময় লাগলো মিনিট খানেক। মামী ও’কে নিয়ে এসেছিল। এই বাসায় একটা গয়না আছে ওর নানুর। সেটা রঙ্গনাকে দেবার কথা। সেটা নিয়ে ও যাবে রঙ্গনার কাছে, ও যখন পার্লারে যাবে। রঙ্গনাকে অতো সকালে ফোনও করেনি। বাসায় আসার পর মামী চা খেতে দিয়েছিল। আদা, দারুচিনি, এলাচি দিয়ে বানানো দুধ চা। রাফাতের পছন্দের চা। এরপর কিছু মনে নেই।

রাফাত দেখলো ওর ফোনে ৪৯১ টা মিসড কল! স্বাভাবিক ব্যাপার! রাত হয়ে গেছে এতো! বাসার সবাই চিন্তা করছে। আর রঙ্গনা! ইশ!
রাফাত ড্রইং রুম পর্যন্ত হেটে এসে মেঝেতে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষনের মধ্যে ঘুমিয়ে গেল আবারও।

কুসুম কাঁটা পর্ব ২১

রাফাতের মা শিলাকে ফোন করেছে ভোরের দিকে। শিলা ফোন টা তুললেন। রাফাতের মা বললেন,
“আপা রাফাতের খোঁজ পাওয়া গেছে আলহামদুলিল্লাহ। আপা আর চিন্তা করবেন না। আমরা সকালের দিকে আসব। ”
“সকালে আসতে হবে না। আমরা যাব কাল তেঁজগাও থানায়। সেখানে আপনাদের সাথে দেখা হবে ইনশাআল্লাহ। ”

কুসুম কাঁটা পর্ব ২৩