কোন কাননের ফুল গো তুমি পর্ব ৩

কোন কাননের ফুল গো তুমি পর্ব ৩
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

নওশাদ বিষণ্ণ চিত্তে চৈতির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সত্যিটা শোনার পরও চৈতির বিশ্বাস হবে কিনা কে জানে! সে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
“আমি সত্যিই দুঃখিত। কাজের চাপে ভুলে গেছিলাম।”

“আমি আপনার জন্য এক ঘণ্টা যাবৎ অপেক্ষা করেছিলাম। যত্ন করে শাড়ি পরে সেজেছিলাম শুধু আপনার জন্য।” কেঁদে কেঁদে বলল চৈতি।
নওশাদ ইতস্তত হয়ে মায়ের দিকে তাকায়। শামসুন নাহারও বাকহারা। তিনি ছেলের বর্তমান অবস্থা ঠাওর করতে পেরে চৈতির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“শান্ত হও মা। ও যা করেছে ভুল করেছে। ক্ষমা করে দাও।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

চৈতি ফোঁপাচ্ছে। শামসুন নাহার ইশারায় নওশাদকে কথা বলতে বলে নাস্তা আনতে গেলেন। নওশাদ বসল চৈতির মুখোমুখি একটা সোফায়। সে পূণরায় নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইল। ধীরে ধীরে চৈতিরও কান্নার গতি কমে আসছে। শামসুন নাহার নাস্তা নিয়ে এলেন। চৈতি খাবে না। সে মাথা নত করে বসে আছে। শামসুন নাহারের জোড়াজুড়িতে শুধুমাত্র এক চুমুক শরবত খেল। কান্না থামার পর সে বুঝতে পারে যে, সে কী করে ফেলেছে।

আবেগের বশে, অভিমানের সূত্র ধরে এভাবে সরাসরি নওশাদের বাড়িতে আসা উচিত হয়নি। এছাড়া সে আবেগের বশীভূত হয়ে আরও একটি ভুল কাজ করে ফেলেছে নওশাদকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু সে-ই বা কী করবে? নওশাদ এত অল্প সময়ে তার মনে জায়গা করে নিয়েছে যে সে নওশাদের এই অবহেলা মানতে পারেনি। তাই তো সবকিছু ভুলে গিয়ে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু এখন সে সত্যিই ভীষণ লজ্জিত। সাইড ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলল,

“আমি সরি আন্টি। এভাবে বাড়িতে আসাটা আমার ঠিক হয়নি। প্লিজ মেয়ে ভেবে ক্ষমা করে দেবেন।”
“কী যে বলো! এসেছ বেশ করেছ। আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। খাওয়া-দাওয়া করে তারপর তুমি যাবে।”
“না, আন্টি। ভাগ্যে থাকলে আর আল্লাহ্ চাইলে নিশ্চয়ই একদিন আসব। এখন আমাকে যেতে হবে।”

তিনি আর জোর করলেন না। নওশাদকে বললেন চৈতিকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য। যদিও চৈতি বারংবার বলছিল, নওশাদের আসার প্রয়োজন নেই; তথাপি মনে মনে ঠিকই চাইছিল নওশাদ আসুক। নওশাদও অবশ্য চৈতির বারণ শুনল না। সে চৈতির সঙ্গেই বাড়ি থেকে বের হলো। একটা রিকশা নিয়ে বসল পাশাপাশি। নওশাদের তেমন কোনো অনুভূতি নেই। পাশে সুন্দরী, রূপবতী একটা মেয়ে বসা এসব বোধবুদ্ধি কিংবা চিন্তা তাকে টানছে না।

এখনো সে মিতুলের মাঝেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। মাকেও সময়ের বিলম্বে মিতুলের কথা বলা হয়ে উঠল না। অন্যদিকে চৈতির মনে রঙ বেরঙের প্রজাপতি উড়ছে। খুব ইচ্ছে করছে নওশাদের হাতটা জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। এতটাও হ্যাংলামি একটা মেয়েকে অন্তত মানায় না। সে মন ভরে নওশাদকে দেখে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে।

সকাল সাতটা বাজে মিতুলের ঘুম ভাঙে। ফ্রেশ হয়ে রেডি হয় কলেজে যাওয়ার জন্য। বর্তমানে মিতুল ক্যামিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে। যদিও ভার্সিটি লাইফে প্রতিদিন নিয়মমাফিক ক্লাস করার প্রয়োজন নেই, তথাপি বাবার ভয়ে মিতুলকে ক্লাস করতে হয়। নতুবা কে যায় সকালের আরামের ঘুম হারাম করে ক্লাস করতে?

মিতুল রেডি হয়ে ডাইনিং-এ আসে। সবার খাওয়া-দাওয়া শেষ। মা বোধ হয় শুয়েছে আবার। তাই সে মমতা বেগমকে অযথাই আর ডাকল না। টেবিলে নাস্তা সাজানোই ছিল। নাস্তা করে রুমে যায় ব্যাগ আনতে। তখন টেবিলের ওপর অচেনা যুবকটির শার্ট দেখতে পায়। শার্টটি কে সে কলেজে নিয়ে যাবে? যদি ছেলেটির সঙ্গে দেখা না হয়? ভাবল শার্ট আজ নেবে না। আজ কলেজ থেকে এসে শার্ট ধুয়ে ইস্ত্রি করে রাখবে।

আগামীকাল সাথে করে নিয়ে যাবে। যদি দেখা হয় তাহলে ফেরত দেবে। ছেলেটাকে যে খুঁজে বের করবে তারও তো কোনো উপায় নেই। ছেলেটা যখন আইডি কার্ড শো করল তখন মিতুল তো কার্ডে নাম, ডিপার্টমেন্ট কিছুই খেয়াল করেনি। জাস্ট কার্ডের ফিতা দেখেই বিশ্বাস করেছে ছেলেটি আর সে একই ভার্সিটির স্টুডেন্ট। শার্ট এবং চিন্তাভাবনা উভয়ই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে সে ব্যাগ নিয়ে মায়ের কাছে যায়। মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে সরাসরি চলে যায় ক্যাম্পাসে। পৌঁছে আগে সে রায়া এবং আর্শিকে কল করে। এ দুজন মিতুলের নতুন ফ্রেন্ড। ভর্তি হওয়ার পর ওদের সঙ্গেই প্রথম আলাপ হয়েছিল। আর্শি ক্লাসে আছে। কিন্তু রায়া এখনো আসেনি। সে গাড়িতে। মিতুলও তাই ক্লাসে চলে গেল। ওকে দেখেই রিয়াদ এগিয়ে আসে। হেসে জিজ্ঞেস করে,

“কেমন আছিস?”
মিতুল মুখ গোমড়া করে উত্তর দেয়,
“ভালো।”
“কী হয়েছে? মন খারাপ নাকি?”
“না।”
“তাহলে মুড অফ কেন?”
মিতুল প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে বলে,
“সত্যি করে বলো তো, আমার জামায় কাদা লাগল কীভাবে?”
“আমি জানব কী করে?”

“আমি বাড়ি থেকে ভালো জামা পরে এসেছিলাম। গতকাল বৃষ্টিও হয়নি যে রাস্তা থেকে কাদা ভরবে। তার মানে কেউ ইচ্ছে করেই লুকিয়ে সুযোগ বুঝে জামাতে কাদা লাগিয়ে দিয়েছে।”
রিয়াদ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
“হতেও পারে। কিন্তু কলেজে আবার তোমার শত্রু কে?”
“তুমি নও তো?”
“ধুর যা! আমি কেন এমনটা করতে যাব? আমি তো উলটো তোমাকে হেল্প করেছিলাম।”

মিতুল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার কেন জানি মনে হচ্ছে এই কাজটা রিয়াদ-ই করেছে। অন্তত ওর চোখ-মুখ, হাসি ও কথার ধরণে এটাই মনে হচ্ছে। নবীনবরণ অনুষ্ঠান হয়েছে ক্লাস শুরু হওয়ার দু’দিন পর। এর মাঝে মিতুল শুধু একদিন ক্লাস করেছিল। আর তখনই সে লক্ষ্য করেছে রিয়াদ ছেলেটি অত্যন্ত গায়ে পড়া স্বভাবের। তার মতো যেসব মেয়ে গায়ে পড়া স্বভাবের তাদের সঙ্গেই রিয়াদের সখ্যতা গড়ে ওঠেছে। অন্যদিকে যারা মিতুলের মতো তাকে পাত্তা দেয়নি, মূলত তাদের পেছনেই রিয়াদ লেগে আছে। হতে পারে ওদের মধ্যে রিয়াদের প্রথম টার্গেট মিতুল। কিন্তু রিয়াদ তো আর জানে না যে, মিতুলকে কব্জা করা অত সহজ ব্যাপার নয়।

মিতুল রিয়াদের সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে আর্শির পাশে গিয়ে বসল। আর্শি এতক্ষণ দূর থেকে ওদের কথা বলতে দেখলেও কথোপকথন শুনতে পায়নি। তাই সে মিতুলের কাছে জানতে চায়,
“কী হয়েছে?”
“কিছু না। রায়া আসেনি এখনো?”
“না। কাল তুমি কখন চলে গেলে? বললেও তো না।”
“ভালো লাগছিল না। তাই কিছু না বলেই চলে গেছিলাম। সরি।”
“আরে ধুর! এরজন্য আবার সরি বলতে হয় নাকি?”
দুজনে কথা বলতে বলতে রায়াও চলে আসে। তিনজনের কথোপকথন, গল্প-গুজব মিনিট পাঁচেক চলে। এরপর ক্লাসে স্যার চলে আসায় যে যার সিটে গিয়ে বসে পড়ে।

রিনভী দু’হাত বগলদাবা করে দাঁড়িয়ে আছে। তার চক্ষুযুগল র’ক্তা’ভ। দৃষ্টিতে আ’গু’নে’র স্ফুলিঙ্গ। পারছে না শুধু সম্মুখে এটিটিউড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা টুটুলকে চোখের দৃষ্টি দিয়েই ভস্ম করে দিতে। টুটুল বাম হাতের ঘড়িতে সময় দেখে কিছু বলতেই যাবে রিনভী চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“সময়ের দোহাই আমাকে দিতে যাবেন না। আপনার সময়ের ধার আমি ধারি না। রিনভীরও সময়ের দাম রয়েছে।”
টুটুল প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে বলল,

“আমি জানি, প্রতিটা মানুষেরই সময়ের দাম রয়েছে। আপনারও। ঠিক সেজন্যই আমি বলতে চাচ্ছি, এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে না থেকে যে কথা বলার জন্য আমরা দেখা করেছি সেই বিষয়ে কথা বলা উচিত।”
“কথা তো অবশ্যই বলব। বলার জন্যই তো দেখা করেছি।”
“তার আগে আমরা কোথাও বসি? কোনো রেস্টুরেন্টে?”
“নেভার এভার। আপনার সঙ্গে কোথাও কোনো রেস্টুরেন্টে কেন; জাহান্নামেও বসব না। প্রয়োজনে গঙ্গায় প্রাণ বিসর্জন দেবো। তবুও আপনার সঙ্গে বসব না।”

“বেশ। কিন্তু এত রেগে কেন আছেন আমার ওপর?”
“রাগ করার কি যথেষ্ট হেতু নেই?”
“সেই কারণটাই আমি জানতে চাচ্ছি।”
“আপনি কি আমাকে রিজেক্ট করেছেন? রিয়েলি! আমি জাস্ট অবাক। মানে মিস্টার টুটুল, আই মিন আপনি আমাকে রিজেক্ট করেছেন? এই দিনটাও আমাকে দেখতে হচ্ছে!”

“আপনার একটু ভুল হচ্ছে। আমি যে ডিরেক্টলি আপনাকে রিজেক্ট করেছি বিষয়টা কিন্তু তেমনও নয়। আসলে বাবা-মা প্রায়ই বিয়ের কথা বলে। এই মেয়ে, ঐ মেয়ের ছবি দেখায়। ঠিক সেভাবে একদিন বলল যে তার খুব কাছের বন্ধু আছে অফিসে। তো তার মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ের আলাপ করতে চায়। আমি বরাবরের মতো এবারও না করে দিয়েছি। আমি এখনই বিয়ে করতে চাই না। এই জিনিসটা যে কেন আপনার ইগোতে লাগল আমি বুঝতে পারছি না।”

“একুয়াল তো সেইম আন্সার। যেভাবেই রিজেক্ট করেন না কেন, রিজেক্ট তো আপনি আমাকেই করেছেন। আপনি এখন বিয়ে করবেন না বললেন না? আর আমি তো আপনাকেই বিয়ে করব না। এখন না, পরে না। যখন-তখনো না। আমি তো এই ব্যাপারে জানতামই না। হঠাৎ করে ছোটো ভাইয়ের কাছে শুনি এই কাহিনি। আমার বিয়ের কথা চলছে আমিই জানিনা। অথচ ছেলে আমাকে রিজেক্ট করে বসে আছে। এতকিছুর পরও বুঝতে পারছেন না কেন ইগোতে লেগেছে আমার? রিনভীর সম্পর্কে না আপনার কোনো আইডিয়াও নেই।”

“আমার শুধু রিনভী কেন, ইনভী, চিনভী কোনো ভী সম্পর্কেই আসলে ধারণা নেই। মা-বোন এবং নিকট আত্মীয় মেয়ে বাদে নারীসমাজ থেকে একটু দূরে দূরেই থাকি সর্বদা। এর সর্বদাই বিপদসংকুল।”
“বাহ্, বাহ্। নিজের মা-বোন, আত্মীয় মেয়েরা তুলসীপাতা আর বাকি নারীরা বিপদসংকুল? কী সুন্দর আপনার চিন্তা-ভাবনা!”

“আমি তো বলিনি ওরা তুলসীপাতা। তবে বিপদসংকুলও নয়। ওরা বিপদসংকুলের বস। আমার মা রণচণ্ডী, বোন নিমপাতা। মেয়ে কাজিনরা করলা পাতা আর আন্টি সমাজ ঘষেটি। তাহলে বুঝুন কেন এত ভীতি আমার।”
রিনভী প্রত্যুত্তরে বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পেল না। ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“ইউ আর এ রিয়েলি বোরিং পার্সন। আই কান্ট টোলারেট ইউ মোর।”
এরপর আর সে এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াল না। হনহন করে চলে গেল রাস্তার ঐ পাশে। ভেবেছিল দেখা করে ছেলেটাকে একটা উচিত শিক্তা দেবে। এখন নিজেই উচিত শিক্ষা পেয়ে বসে আছে। এর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্তটি আজকের দিনের সবচেয়ে বড়ো এবং জঘন্যতম ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। ড্যাম ইট!

নওশাদ টিচার্স রুমের সামনে পায়চারি করছে। সে মাত্রই মিতুলদের ক্লাস নিয়ে এলো। তার ক্লাসটাই শেষ ক্লাস ছিল। মিতুল নিশ্চয়ই এখন বের হবে। তাই সে অপেক্ষা করছে এখানে। মিতুল এলো মিনিট পাঁচেক পরে। সঙ্গে রায়া এবং আর্শিও আছে। একবার ভাবল ওদের সামনেই কথা বলবে কিনা। যদি অন্যকিছু ভাবে? অন্যকিছু ভাবার-ই বা কী আছে? মিতুল তার পূর্বপরিচিত। সূতরাং সে কথা বলতেই পারে।

টিচার্স রুমের সামনে এসে মিতুলের নওশাদের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। বলা বাহুল্য সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফিরিয়েও নিল সে। নওশাদ দমে গেল না। দু’পা এগিয়ে গিয়ে অনেকটা পথরোধ করে দাঁড়াল। রায়া এবং আর্শি সালাম দিলেও মিতুল নিশ্চুপ রইল। নওশাদ সালামের উত্তর নিয়ে মিতুলকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“বাড়ি যাচ্ছ?”
মিতুলের ভীষণ ইচ্ছে করছে কিছু কঠিন কঠিন কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু বান্ধবীদের জন্য সেটা সম্ভব হচ্ছে না। তাই যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বলল,
“হ্যাঁ।”
“তোমার বাসার সবাই ভালো আছে?”
“হ্যাঁ।”
“কোথায় থাকো এখন?”

মিতুল এতক্ষণ অন্যদিকে মুখ করে তাকিয়ে ছিল। এবার সে নওশাদের দিকে তাকাল। তার দৃষ্টিতে রাগ। নওশাদ থমকে যায়। রায়া আর আর্শিকে মিতুল বলে,
“তোমরা চলে যাও। আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলে আসছি। লেট হবে।”
স্যারকে মিতুল কী করে চেনে এবং ওদের মাঝে সম্পর্কটাই বা কী এমন অনেক প্রশ্নই রায়া এবং আর্শির মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। এখন তো কোনোভাবে জানা সম্ভব নয়। কাল না হয় জিজ্ঞেস করবে। তাই ওরা মিতুলের কথামতো চলে গেল। ওরা যাওয়ার পর মিতুল বলে,

“আমি কোথায় থাকি সেটা জেনে আপনি কী করবেন?”
“জানতে পারি না?”
“না।”
“তুমি কি এখনো পুরনো জেদ নিয়ে বসে আছো?”
“নতুন করে আর ভাবার তো কিছু নেই। আমি না সত্যিই জানতাম না যে, আপনি এই কলেজের শিক্ষক। যদি জানতাম তাহলে ম’রে গেলেও ভর্তি হতাম না। কেন যে আব্বু সব জেনে-বুঝে আমাকে এখানে দিল আমি তো সেটাই বুঝতে পারছি না। বিশ্বাস করুন, আমি জাস্ট আপনাকে সহ্য করতে পারি না।”

“আমার ওপর তোমার এত রাগ?”
মিতুল জবাব দিল না। সে প্রচন্ড রেগে আছে এখন। ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। নওশাদ নিজেই বলে,
“তুমি একটুও বদলাওনি মিতুল। আগের মতোই আছো।”
“এটা আপনার ভুল ধারণা। আমি যদি আগের মতোই থাকতাম তাহলে আপনার মুখের ওপর এতগুলো কথা বলার সাহস কখনোই করে উঠতে পারতাম না। এরপরও বলছেন আমি আগের মতো আছি?”

“হ্যাঁ। এখনো রাগলে তোমাকে আগের মতোই লাগে। কোনো পরিবর্তন তো দেখছি না।”
মিতুল রাগে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
“এত সহজ-স্বাভাবিক ব্যবহার কেন করছেন আপনি?”
“শান্ত হও।”

“পারছি না। আপনাকে দেখলে শান্ত থাকতে পারি না আমি। আপনার ক্লাস ৫০টা মিনিট যে কীভাবে করি সেটা শুধু আমিই জানি। ফর গড সেইক, আমাকে আমার মতো থাকতে দিন প্লিজ! আর পাঁচটা ছাত্রীর সাথে আপনার সম্পর্ক যেমন আমার সাথেও আপনার সম্পর্কটাও ঠিক সেরকমই। এর বাইরে আমি আপনাকে চিনি না। আপনিও আমাকে চেনেন না। অতীতে আমাদের মধ্যে কী ছিল, আমরা পরিচিত ছিলাম কিনা এই সমস্ত কিছু আমার মতো করে ভুলে যান প্লিজ! আর এরকম হুটহাট এসে কথা বলবেন না। একজন টিচার হিসেবে এরকম বিহেভিয়ার আপনার সঙ্গে যায় না। নিজের সম্মানটা নিজের কাছে বজায় রাখুন আর আমাকেও সম্মানের সাথে বাঁচতে দিন।”

মিতুলের এত কঠিন কঠিন কথার পিঠে নওশাদ আর বলার মতো কিছুই খুঁজে পেল না। কেবলমাত্র অপলক দৃষ্টিতে মিতুলের রাগী মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে। মিতুল ঠিকই বলেছে, সে পরিবর্তন হয়েছে। অল্প নয়; অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে।
উত্তরের জন্য মিতুল কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও যখন কোনো উত্তর পেল না তখন সেও আর অপেক্ষা করল না। নিজের গন্তব্যে পা বাড়াল। প্রতিটা স্নায়ুকোষে যেন তার রাগের বিচরণ।

মিতুল রাগের চোটে রাস্তা পার হতে গিয়ে তার পার্স আর হাতে থাকা দুটো বই রাস্তায় পড়ে যায়। মেইন রোড হওয়াতে বিরতিহীনভাবে গাড়ি চলছে। মিতুল কোনোদিকে না তাকিয়েই নিচে বসে পড়ে বই আর পার্স তোলার জন্য। ক্রমান্বয়ে ব্যস্ত গাড়িগুলোও এগিয়ে এসেছে। মিতু্ল হঠাৎ করে সেদিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যায়। সেই মুহূর্তে একটা ছেলে বাইক নিয়ে এসে গাড়িগুলোর সামনে পথরোধ করে দাঁড়ায়। গাড়িওয়ালারা সমানে হর্ণ দেওয়ার পরও ছেলেটা বাইক নিয়ে সরে না। মিতুলকে ধমক দিয়ে বলে,

“চুপচাপ বসে না থেকে এগুলো নিয়ে জলদি সরুন।”
এটা তো গতকাল হেল্প করা সে-ই ছেলেটা মনে হচ্ছে। হেলমেট পরে থাকার জন্য মিতুল আজও ছেলেটির মুখ দেখতে পারেনি। ধমক খেয়ে তাড়াতাড়ি বই আর পার্স তুলে সরে দাঁড়ায় একপাশে। সে ভেবেছিল ছেলেটা তার কাছে আসবে। তখন সে তাকে ধন্যবাদ দেবে এবং নামও জিজ্ঞেস করবে। এরপর আগামীকাল দেখা করে তার শার্ট ফেরত দিয়ে দেবে। কিন্তু ছেলেটা তার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে বাইক নিয়ে উলটোপথে চলে গেল। মিতুল থ বনে চলে যায়। ছেলেটা এমন অদ্ভুত স্বভাবের কেন?

কোন কাননের ফুল গো তুমি পর্ব ২

বিঃদ্রঃ আগের পর্বে আমি ছোটো একটা ভুল করেছিলাম। সীমান্ত রূপক ও টুম্পার ভাতিজা হয় সম্পর্কে। টুম্পা যেহেতু মিতুলকে আপু ডাকে সেহেতু মিতুল সম্পর্কে আন্টি হয় সীমান্তর। কিন্তু আমি ভুলে আপু সম্বোধন লিখে ফেলেছিলাম। আমার পেইজে অবশ্য কারেকশন করে নিয়েছি।]

কোন কাননের ফুল গো তুমি পর্ব ৪