কোন কাননের ফুল গো তুমি পর্ব ৪

কোন কাননের ফুল গো তুমি পর্ব ৪
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

মিতুল অনেকক্ষণ যাবৎ বাইকওয়ালা ছেলেটির শার্ট খুঁজে যাচ্ছে। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সন্ধান পাচ্ছে না। অথচ সে ভার্সিটি থেকে ফিরে নিজে ধুয়ে দিয়েছিল। এরপর ছাদ থেকে এনে ইস্ত্রি করে ভুলবশত ড্রয়িংরুমের সোফায় রেখে দিয়েছে। ক্লাসের পড়া শেষ করে বই গুছাতে গিয়ে হঠাৎ করেই শার্টের কথা মনে পড়ে যায়। সেই থেকে সে হন্যে হয়ে শার্ট খুঁজছে। মমতা বেগম সেটা লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলেন,

“কী খুঁজছিস?”
“এখানে একটা শার্ট ছিল। দেখেছ মা?”
“কালো কালার?”
“হ্যাঁ। কোথায় রেখেছ?”
“ঐটা তো টুটুল পরে গেছে। ঐ শার্ট কার?”
মিতুল হতবিহ্বল হয়ে বলে,
“ভাইয়া কেন ঐ শার্ট পরেছে? আশ্চর্য!”
“ঐটা টুটুলের শার্ট না?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“না। ঐদিন যে কাদা ভরালাম জামায়। তখন আসার পথে ভার্সিটিরই একজন আমাকে শার্টটা দিয়েছিল কোমরে বেঁধে নিতে। যাতে করে জামার কাদাগুলো দেখা না যায়। আমি শার্ট ফেরত দেবো বলে কষ্ট করে ধুয়ে ইস্ত্রি করে রেখেছি। আর তোমার গুণধর ছেলে সেটা পরে গেল?”
“এত সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছিস। ও তাই নিজের ভেবে পরে গেছে।”
“নিজের ভেবে পরবে কেন? ঐটা কি ভাইয়ার শার্ট নাকি? নিজের শার্ট নিজে চেনে না গ’র্দ’ভ!”
“হয়েছে। এখন আর রাগারাগি করিস না। টুটুল আসলে আমি শার্ট ধুয়ে ইস্ত্রি করে দেবো নে।”
“ধুর! ভালো লাগে না আর আমার।”

মিতুল রাগ করে নিজের ঘরে চলে যায়। ঠিক সেই সময়েই টুম্পা আসে বাসায়। ওর সাথে রাজকুমার টিয়াপাখিও আছে। টিয়াপাখি দেখে তো মিতুলের মেজাজ আরও খারাপ হয় যায়। টুম্পা জিজ্ঞেস করে,
“কী করো আপু?”
মিতুল রাগ করে বসে ছিল বিছানায়। সে উত্তর করল,
“কিছু না। বসো।”
“মন খারাপ নাকি তোমার?” মিতুলের পাশে বসে জিজ্ঞেস করল টুম্পা।
মিতুল হাসার চেষ্টা করে বলল,

“না তো! কেন?”
“দেখে মনে হচ্ছে।”
“আরে না। তেমন কিছুই না। মেজাজ একটু খারাপ আরকি!”
“কী হয়েছে?”
“তেমন কিছু না। ছাড়ো ওসব। আমি চা নিয়ে আসি।”
“না, চা খাব না। এসেছি একটা কথা বলতে।”
“কী?”

“মাঠে সবাই ব্যাডমিন্টন খেলছে। চলো আমরাও যাই।”
মিতুল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাতটা বাজে। সে বলে,
“এখন?”
“হ্যাঁ। ফ্ল্যাটের আরও আপুরা আছে তো। চলো যাই প্লিজ! তুমি গেলে আমাকে বাড়ির কেউ কিছু বলবে না।”
মিতুল ভাবল রাগ করে বসে থাকার চেয়ে ব্যাডমিন্টন খেললে হয়তো মনটা ভালো হবে। তাই সে রাজি হয়ে যায়। রাজকুমার খুশিতে উল্লাসিত হয়ে বলে,

“মুতু, খেলা। চলো। মুতু খেলা, চলো।”
মিতুল দাঁত-মুখ খিঁচে বলে,
“ওকে আমার সাথে কথা বলতে নিষেধ করে দেবে টুম্পা। নয়তো ওর মুখে আমি স্কচটেপ লাগিয়ে দেবো।”
টুম্পা শব্দ করে হাসে। মিতুল বলে,
“হেসো না। আমার নামের কী অবস্থা করেছে দেখেছ?”
“আহা! বাদ দাও। চলো আন্টির কাছে যাই। পারমিশন নেওয়া লাগবে না?”

মাঠ যেহেতু ফ্ল্যাটের মধ্যেই, আবার সঙ্গে টুম্পাও আছে তাই মমতা বেগম আর বারণ করলেন না। শুধু বললেন এক ঘণ্টার মাঝেই ফিরে আসতে। মিতুল রাজি হয়ে টুম্পার সঙ্গে নিচে গেল। মাঠে গিয়ে রূপকের সাথে দেখা হয়ে যায়। সেও ব্যাডমিন্টন খেলছে। তবে ছেলেরা এক সাইডে এবং মেয়েরা আরেক সাইডে। মিতুলকে দেখে রূপকও বার দুয়েক তাকাল। মিতুল অবশ্য সেদিকে দৃষ্টিপাত করল না আর। রাজকুমার উড়ে উড়ে খেলা দেখছিল। হঠাৎ সে বলে ওঠে,

“মুতু, রূপ খেলো। মুতু, রূপ খেলো।”
অর্থাৎ সে মিতুলের সঙ্গে রূপককে খেলতে বলছে। সঙ্গীরা সেটা শুনে বলে,
“কী ব্যাপার রাজকুমার? রূপক ভাইয়া মিতুলের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলুক চাও?”
রাজকুমার ফের পাখা ঝাঁকিয়ে বলে,
“মুতু, রূপ খেলো।”
মিতুল ঘেমেনেয়ে একাকার। সে সাইডের বেঞ্চে বসে পড়েছে। রাজকুমার এলো তখন। মিতুলের বিনুনি খাঁমচে ধরে বলল,
“মুতু, খেলো।”
মিতুল বেজায় বিক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
“যা এখান থেকে।”

রাজকুমার নাছোড়বান্দা। সে মিতুলের পিছু ছাড়ছে না। স্বভাবতই আমাদের যারা অপছন্দ করে থাকে আমরা তার পেছনেই পড়ে থাকি। রাজকুমার পাখি হলেও সেও এর ব্যতিক্রম নয়। রাজকুমারের নাছোড়বান্দা স্বভাব দেখে রূপক এগিয়ে এলো পানির বোতল নিয়ে। ঢকঢক করে পানি পান করে বলল,
“রাজকুমার যখন এতবার করে বলছে…”
পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই মিতুল বলল,
“এই অ’স’ভ্য টিয়াপাখির কথা আমি রাখব না।”
“নিরীহ একটা পাখির ওপর এত রাগ কেন তোমার?”
“কে নিরীহ? এই টিয়া? আস্ত ফা’জি’লের হাড্ডি!”
রাজকুমার চুপ রইল না। সে ঘোর প্রতিবাদের স্বরে বলল,
“মুতু বকে, মুতু বকে।”

রূপক হাসল। রাজকুমার যতবারই মিতুলকে মুতু বলে ডাকে ততবারই রূপকের দম ফাটিয়ে হাসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সময়-সুযোগ তো আর সর্বদা অনুকূলে থাকে না। রূপককে হাসতে দেখে মিতুল চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলে,
“হাসছেন কেন আপনি?”
“না, এমনিই।”
মিতুল রোষানল দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। আর এক মুহূর্তও সে এখানে থাকবে না। টুম্পাকে বলে তৎক্ষণাৎ সে বাড়িতে চলে আসে। রাজকুমার বলল,
“মুতু গেল, মুতু গেল।”
রূপক এবার শব্দ করেই হাসল। রাজকুমারের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“যা একটা নাম দিয়েছিস না! দারুণ।”

রিনভী একটা হলুদের রঙের থ্রি-পিস পরে রেস্টুরেন্টে বসে আছে। তার সামনে রাখা কোল্ড কফি। খাওয়ার রুচি নেই। এভাবে তো আর একা বসে থাকা যায় না। তাই বাধ্য হয়েই একটা কোল্ড কফি অর্ডার করেছে। কিছুক্ষণ বাদে বাদে সে হাত-ঘড়ি এবং ফোনে সময় দেখছে। এখনো টুটুলের আসার কোনো নামগন্ধ নেই। ছেলেটার সময়, জ্ঞান বলতে তো কিছুই নেই। এরকম একটা ছেলেকে কীভাবে যে মেয়ের যোগ্য মনে করেছেন বাবা আজিজুল হক। বসে থাকতে থাকতে রিনভীর বিরক্তি এসে গেছে।

রিনভীরা দু’ভাই এক বোন। সে-ই সবার বড়ো। ভাই দু’জন ছোটো। বর্তমানে সে মাস্টার্স করার পাশাপাশি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করছে। সে তার লাইফ নিয়ে পুরোদস্তুর হ্যাপি ছিল। হুট করে বাবা-মায়ের মাথায় বিয়ের ভূত ঢুকেছে। অনেক সময় দিয়েছেন তারা রিনভীকে। এবার বিয়ের পিঁড়িতে তাকে বসতেই হবে। রিনভীর কোথাও কোনো সম্পর্ক নেই। তাই সে বাবা-মায়ের পছন্দ করা ছেলেকেই বিয়ে করবে বলে জানিয়েছিল। কিন্তু বাবা যে এমন একটা ছেলেকে তার জন্য পছন্দ করে বসে থাকবে এটা সে ভাবেনি।

অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে টুটুল এলো। প্রায় পঁচিশ মিনিট লেইট। চুলগুলো অবিন্যস্তভাবে কপালের ওপর পরে আছে। সে রিনভীর মুখোমুখি বসল। চমকপ্রদ হাসি দিয়ে বলল,
“সরি। একটু দেরি হয়ে গেল।”
“একটু নয়। অনেকটা।”
“এগেইন সরি। রাস্তায় এত জ্যাম ছিল আর কী বলব! একি শুধু কফি কেন? আর কিছু অর্ডার করেননি?”
এরপর আর সে রিনভীর জবাবের অপেক্ষা না করে ওয়েটারকে ডেকে নিজের জন্য নিজের পছন্দ অনুযায়ী খাবার অর্ডার দিল। মেন্যু কার্ড রিনভীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“কী খাবেন অর্ডার দিন।”
রিনভী মেন্যু কার্ড নিল না। ওয়েটারকে বলল,
“একটা চিকেন বার্গার আর লেমন জুস।”
ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে যাওয়ার পর টুটুল নড়েচড়ে বসে বলল,
“তারপর বলুন। আবার দেখা করতে এলেন। নিশ্চয়ই বাবা-মায়ের চাপে?”
রিনভী এক পলক তাকিয়ে থেকে বলল,
“হু।”

টুটুল হাসছে। রিনভী এতক্ষণ পর টুটুলের গায়ের শার্ট লক্ষ্য করল। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। এই শার্টটা সে নিজে বান্ধবীকে দিয়ে কাস্টমাইজড করিয়েছিল ছোটো ভাইয়ের জন্য। এই শার্ট টুটুলের কাছে এলো কী করে?
রিনভীকে এভাবে শার্টের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে টুটুল নিজেও শার্টের দিকে তাকাল। ময়লা লেগেছে ভেবে হাত দিয়ে ঝেড়ে বলল,

“ময়লা নাকি?”
“এই শার্ট কোথায় পেলেন আপনি?”
“কেন? ঘরেই ছিল।”
“কোনো পেইজ থেকে নিয়েছেন?”
“ধুর না! আমি কখনো অনলাইন থেকে শপিং করি না। তবে আমার ছোটো বোন করলে করতে পারে। সম্ভবত ও-ই কিনেছে।”

রিনভী একটু দমে গেল। হতে পারে টুটুলের বোনই পেইজ থেকে একই রকম শার্ট নিয়েছে। তাও সে মনের সন্দেহ দূর করতে বাসায় গিয়ে ভাইকে জিজ্ঞেস করবে বলে ঠিক করল। আপাতত এই টপিক বাদ দিয়ে দুজনে নর্মাল আলোচনা তুলল।

মিতুলের আজ ভার্সিটিতে যাওয়া হবে না। বাবা-মায়ের সঙ্গে ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাবে। পাত্রী বাবার অফিসের কলিগের মেয়ে। মেয়ের ছবি দেখেছে মিতুল। দারুণ মিষ্টি দেখতে। তবুও যে ভাইয়া কেন বিয়েতে রাজি হতে চাচ্ছে না কে জানে! টুটুল রেডি হয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য বের হয়। মিতুল তখন ড্রয়িংরুমে বসে ছিল। তার হাতে চায়ের কাপ। টুটুল কাপটা নিয়ে চুমুক দিল। মিতুল চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,

“এটা আবার কেমন স্বভাব? আমার খাওয়া চা খাচ্ছ!”
“তো? তোর মুখে কি পাখির পটি লেগে আছে যে তোর খাওয়া চা খেতে পারব না?”
“বাজে কথা শুধু! মাকে বললেই তো চা দিত।”
“ছাই দিত! পারলে আজ আমাকে ঝা’ড়ু দিয়ে পে’টা’বে।”
“কেন?”
“কারণ আমি রিনভীদের বাসায় যাচ্ছি না।”
“গেলে কী হবে?”

“কিছুই হবে না। আবার না গেলেও কিছুই হবে না। তাই আমি ঠিক করেছি, যাব না।”
“মেয়েকে কি তোমার পছন্দ হয়নি?”
“পছন্দও করিনি, অপছন্দও করিনি।”
“তুমি একটা পাগল। সকাল সকাল আমার মাথা খেও না। যাও অফিসে।”
“যাচ্ছি। আমি যাওয়ার পর মাকে বলিস যে অফিসে চলে গেছি। এই নে তোর চায়ের কাপ।”

মিতুলের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে টুটুল অফিসে চলে গেল। এ খবর শুনে বাবা-মা দুজনেই ভীষণ রেগে গেলেন। ফোন দিয়ে টুটুলকে ইচ্ছে মতোন ঝাড়লও দুজন। দুজনের ক্ষোভের মুখে পড়ে টুটুল জানিয়েছে দুপুরে সে রিনভীদের বাসায় যাবে। এতে অল্প হলেও বাবা-মা শান্ত হয়। মিতুল চলে যায় রেডি হতে। আজ আর বিকেলের আগে ওই বাড়ি থেকে আসা যাবে বলে মনে হয় না।

সে আকাশি রঙের একটা থ্রি-পিস পরেছে। হাতে পরেছে সাদা-আকাশি মিলিয়ে খাঁজকাটা কাচের চুড়ি। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। পিঠ পর্যন্ত চুলগুলো সে খু্লেই রেখেছে। গোলগাল মুখের মিষ্টি মেয়ে বলা যায় মিতুলকে। সে রেডি হতে হতে বাবা-মা-ও রেডি হয়ে গেছেন। তিনজনে একসাথে বাড়ি থেকে বের হলেন। সিঁড়িতে রূপকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। বলাই বাহুল্য রূপক প্রথমে চোখ সরাতে পারেনি। পরক্ষণে মিতুল যখন ভ্রুঁ কুঁচকে তাকাল তখন নিজেকে দমিয়ে নিয়েছে রূপক। মনের মাঝে প্রশ্ন জাগে, ‘এত সেজেগুজে যাচ্ছে কোথায়?’

প্রশ্ন করতে না পারলেও মিতুলকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় ফিসফিস করে বলে,
“কানে একটা ফুল গুঁজলে সাজ পূর্ণতা পেত।”
মিতুল হা করে তাকায় রূপকের দিকে। রূপক মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে ওপরে চলে যায়। রূপককে নিয়ে আর ভাবনার জাল বুনল না সে।

বাবা-মায়ের সঙ্গে রিনভীদের বাড়িতে পৌঁছানোর পর আজিজুল হক এবং বিউটি বেগম সাদরে ওদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলেন। ড্রয়িংরুমে বসে মিতুল ঘাড় ফিরিয়ে সাজসজ্জা দেখছে। বিশাল বড়ো ড্রয়িংরুম। ড্রয়িংরুমের একদম শেষদিকে একটা বারান্দা। দমকা বাতাসে সাদা রঙের পর্দাগুলো এলোমেলোভাবে উড়ছে। মিতুলের দারুণ পছন্দ হয়েছে বাড়িটা। রিনভীর বাবা-মা এবং মিতুলের বাবা-মা খোশগল্পে মেতে উঠেছেন। বিউটি বেগম তার ছোটো ছেলে আয়ানকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আয়ান এবার ক্লাস ফাইভে পড়ছে। বিউটি বেগম ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,

“আয়ান, তোমার মিতুল আপুকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাও তো। আর রিনভীকে বলো তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে এখানে আসতে।”
আয়ান বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়াল। মিতুলও এভাবে বসে থাকতে বোর হচ্ছিল। তাছাড়া তার ভীষণ ইচ্ছেও করছিল বাড়িটা ঘুরে দেখার জন্য। বাড়ি ঘুরে দেখতে দেখতে আয়ানের সাথে তার ভাব জমে যায়। প্রথম দেখায় আয়ানকে শান্ত-শিষ্ট মনে হলেও ক্রমে ক্রমে তার চঞ্চলতা প্রকাশ পাচ্ছে। সে মিতুলকে বলে,

“এই জানো, তোমার নামটা কিন্তু অনেক সুন্দর।”
মিতুল তাকিয়ে মুচকি হাসল। আয়ান ফের বলল,
“ঠিক তোমার মতো। তোমাকে দেখে আকাশ মনে হচ্ছে।”
“তুমি তো দারুণ কথা বলতে জানো।”
“জানি। সবাই বলে।”
“কী বলে?”

“এইযে তুমি যা বললে। এই শোনো, তুমি এখানে একটু অপেক্ষা করবে? আমি আপুকে যাওয়ার কথা বলতে ভুলে গেছি। বলে আসি?”
মিতুল মিষ্টি করে হেসে বলল,
“আচ্ছা যাও।”
“আমি এই যাব, এই আসব।”

বলেই আয়ান দৌঁড়ে চলে গেল। মিতুল করিডোর ধরে একা একা হাঁটছে। রুমগুলো যেদিকে সেদিকেও করিডোরের শেষ মাথায় একটা বারান্দা। বাড়িটা যার পছন্দে বানানো হয়েছে সেই মানুষটার রুচির তারিফ না করে পারছে না মিতুল। এভাবে রুম ছাড়াও যে খোলা বারান্দা দেওয়া যায় এরকম একটা সুন্দর আইডিয়া একটা সুন্দর মনের মানুষের মাথাতেই আসবে। সে খোলা বারান্দার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে তার নাকে প্রবেশ করল বেলীফুলের ঘ্রাণ।

সে চোখ বন্ধ করে প্রাণ ভরে শ্বাস নিল। শ্বাসে শ্বাসে ভেতরে প্রবেশ করল বেলী ফুলের সুঘ্রাণ। বেলীফুল মিতুলের সবচেয়ে পছন্দের ফুল। সে একটা ফুল ছিঁড়ে নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ শুকছে। আচানক তার পায়ের কাছে নরম কিছুর স্পর্শ পাওয়ায় সে চোখ মেলে পায়ের দিকে তাকায়। নাদুসনুদুস ছোটো দুটো কুকুরের বাচ্চা তাকে ঘিরে ধরেছে। ভয় পেয়ে সে দু’পা পিছাতে গিয়ে পেছনে থাকা রুমের দরজাটি খুলে যায় এবং সে না চাইতেই রুমের ভেতর চলে যায়। পেছন ফিরে তাকিয়ে যা দেখে তার জন্যও সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না।

একটা ছেলে সাউন্ড বক্সে গান বাজিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে উরাধুরা নাচছে। তার পরনে থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট। শার্ট বা টি-শার্ট কিছুই পরেনি। খালি গা। আয়নার সামনে নাচতে নাচতে হঠাৎ করে মিতুলকে দেখে ছেলেটি চমকে যায়। দু’হাত জড়োসড়ো করে বুকের ওপর রেখে বলে,
“ওহ গড! কে আপনি?”
মিতুল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমন ঘটনার সম্মুখীন হবে এটা কল্পনাতীত ছিল। সে কুকুর দুটোর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,

“আল্লাহর দুনিয়ায় সব পশু-পাখি যে কেন আমার পেছনেই পড়ে থাকে!”
ছেলেটি ততক্ষণে চটজলদি টি-শার্ট পরে নিয়েছে। দু’কদম এগিয়ে এসে মিতুলকে ভালো করে লক্ষ্য করে সে চুপ হয়ে যায়। মেয়েটাকে তার চেনা চেনা লাগছে। পরক্ষণে মনেও পড়ে যায়। এটা তো সেই মেয়ে যাকে সে দু’বার সাহায্য করেছিল। মিতুল অপরাধীর ন্যায় মাথা নত করে বলে,
“আ’ম সরি। আমি আসলে ইচ্ছে করে আসতে চাইনি। কুকুর দুটো হঠাৎ পিছু নিল তাই ভয় পেয়ে…”
“কুট্টি, কিট্টি এরকমই। অপরিচিত মানুষ দেখলে চোখে চোখে রাখে।”

“সরি?”
অনিক কুকুর দুটোর দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওদের নাম কুট্টি আর কিট্টি।”
“ওহ।”
“আপনি এখানে?”
“ইয়ে মানে আমি বাবা-মায়ের সঙ্গে এসেছি রিনভী আপুকে দেখার জন্য।”
“আই সী! আপনি টুটুল ভাইয়ার বোন?” বেশ অবাক হয়েই জানতে চাইল সে।
“জি।”
“আমি অনিক। রিনভী আপুর ছোটো ভাই।”
“আমি মিতুল।”

দুজনের কথোপকথনের মধ্যে আয়ান চলে আসে। মিতুলকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“কোথায় হারিয়ে গেছিলে? তোমাকে খুঁজে খু্ঁজে আমি হয়রান!”
অনিক হেসে বলে,
“কিট্টি আর কুট্টি দৌঁড়ানি দিয়েছে।”
আয়ান নায়কের মতো ভাব নিয়ে বলল,
“ভয় পেও না। আমি তোমার সাথে আছি। ওরা তোমার কিচ্ছু করতে পারবে না।”
অনিক আয়ানের মাথায় চাটি মেরে বলে,

“আসছে বড়ো নায়ক!”
“হুহ্! মিতুল আপু, চলো আমরা ছাদে যাই।”
মিতুল রাজি হলো। অনিকের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে আয়ানের সঙ্গে ছাদে চলে যায়। অনিক মিতুলকে চিনলেও মিতুল যে অনিককে চেনেনি এটা অনিক ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। ওরা চলে যাওয়ার পর অনিক ড্রয়িংরুমে গেল। মিতুলের বাবা-মাকে সালাম দিয়ে পাশে বসে কথা বলল কিছুক্ষণ। বিউটি বেগম কিছু খাবার অনিকের হাতে দিয়ে বললেন,

“বাবা, এগুলো নিয়ে ছাদে যা তো। মিতুলকে দিয়ে আয়।”
অনিক বিনাবাক্য ব্যয়ে খাবারগুলো নিয়ে ছাদে গেল। মিতুল আর আয়ান ছাদে দৌঁড়াদৌঁড়ি করছিল। ওদের সঙ্গে কিট্টি আর কুট্টিও দৌঁড়াচ্ছিল। মিতুল এখন আর ওদের ভয় পাচ্ছে না। বরং ওদের সঙ্গ উপভোগ করছে। অনিককে দেখে মিতুল থেমে যায়। খাবারগুলো রেলিঙের ওপর রেখে অনিক বলল,

“মা পাঠিয়েছে।”
“আপনি আবার কষ্ট করে আনতে গেলেন কেন?”
“মা বলল তাই। তাছাড়া আপনি তো কিছু খাননি।”
“বাড়ি থেকে খেয়েই এসেছি। পেট ভরা আছে।”
“টুটুল ভাইয়া আসল না কেন?”
“আসবে। দুপুরে।”
“আচ্ছা খান।”

বলে অনিক ফোন চাপায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মিতুল লজ্জা ও সংকোচের দরুণ খেতে পারছে না। অন্যদিকে অনিক যেচে খাবার নিয়ে এসেছে। না খেলেও তো মন্দ দেখায় বিষয়টা। তাই সে একটা বিস্কুট আয়ানকে দিয়ে নিজে একটা বিস্কুট নিল। পরেই আবার মনে হলো অনিককে তো সাধেনি। তাই সে হাতের বিস্কুটটাই এগিয়ে দিয়ে বলল,
“নিন।”

অনিক একবার মিতুলের মুখের দিকে তাকাল এবং আরেকবার হাতের দিকে তাকাল। মিতুল অবশ্য তার মুখের দিকে তাকায়নি। তার দৃষ্টি নত। মুখে সলজ্জিত আভা। অনিক অনেকক্ষণ মিতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বিস্কুটটি নিল। হাতে করে দেওয়ার পর না নিলে এতে সামনের মানুষটি অপমানিত হবে। বিস্কুটটা মুখে পুরে ছাদে থাকা জবা গাছ থেকে একটা সাদা জবা ফুল ছিঁড়ে আনল অনিক। অনধিকার চর্চায় হোক অথবা মিতুলের সাজসজ্জার পূর্ণতা দান করার উদ্দেশ্যেই হোক না কেন সে নিজ হস্তে জবা ফুলটি মিতুলের কানের পিঠে গুঁজে দিল। আকস্মিকতায় চমকে তাকাল মিতুল। এবার আর অন্যদিকে নয়। সরাসরি অনিকের মুখপানে তাকিয়েছে। সম্পূর্ণ মুখ রেখে মিতুলের চোখ আটকে গেল অনিকের স্বচ্ছ ঐ চোখ দুটিতে। অনিক হেসে বলল,

কোন কাননের ফুল গো তুমি পর্ব ৩

“একটা ফুলের ভীষণ অভাববোধ হচ্ছিল আপনার মাঝে। এখন একদম ঠিকঠাক লাগছে।”
মিতুল কোনো জবাব দিতে পারল না। তখনো সে অনিকের স্বচ্ছ চোখের মাঝে আটকে আছে। এ দুটো চোখ কোথায় যেন এর আগেও দেখেছে সে!

কোন কাননের ফুল গো তুমি পর্ব ৫